গল্প ।। আকাশের দিকে ।। অনিন্দ্য পাল
অফিস থেকে বেরিয়ে নিজেকে বড় একা লাগে সুজনের। প্রায় সতেরো বছরের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। কত স্মৃতি কত সুখ দুঃখের ঘটনা জড়িয়ে আছে এই অফিস কলিগদের সঙ্গে। জয়নিং এর প্রথম দিনটার কথা আজ খুব মনে পড়ে সুজনের। তাদের গ্রাম থেকে তখন কলকাতায় চাকরি করতে আসা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তার উপর এরকম ঠাটবাট এর ইন্দো-বৃটিশ অফিসে চাকরি- সে তো আকাশ কুসুম। মা-বাবা এসেছিল ট্রেনে তুলে দিতে, সঙ্গে এসেছিল রমেশ, বিশু, অরুণ- মাঠে খেলার বন্ধুরা।
আজ সকালেও যখন আসছিল, প্লাটফর্মে নুরুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেই সখ্যতা এখনও আছে। কিন্তু এরপর হয়তো আর কখনো প্লাটফর্মে বন্ধুদের সঙ্গে এইভাবে দেখা হবে না।
স্বেচ্ছায় অবসর নিল সুজন। এখনো প্রায় দশ বছর চাকরি ছিল কিন্তু পরিস্থিতি তাকে দিয়ে এই স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ালো। চাকরি সে করবে, কিন্তু কার জন্য করবে? গত কয়েক বছর ধরে এটাই বুঝতে পারছিল না সুজন। বউ, মেয়ে, ছোট ছেলে, বড় ছেলের জন্য? মুখগুলো মনে পড়তেই মাথার দুপাশের শিরা দুটো ভয়ংকর ভাবে দপদপ করতে লাগল সুজনের। তার নিজের মনে হল আশপাশের মানুষ গুলোও যেন তার এই দপদপ শব্দ শুনতে পাবে।
মেয়েটার জন্য তার খুব কষ্ট হয়। আর কারো প্রতি তেমন কোন টান এখন আর অনুভব করেনা সুজন। টাকাগুলো হাতে পাওয়ার পর প্রথমেই তার নিতুর কথা মনে হয়েছিল। প্রায় মাস দেড়েক আগে যখন সে বাড়ি গিয়েছিল, মেয়েটা সেদিন একটা ভালো সিডি প্লেয়ারের আবদার করেছিল। সে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু সেই রাজি হওয়াটাই হয়েছিল তার কাল! সেই রাতই তার কাছে হয়ে উঠেছিল চরমতম দুঃখের রাত। সেসব কথা আর ভাবতে চায় না সুজন কিন্তু মস্তিষ্কের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রায়ই ভেসে ভেসে ওঠে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সেই রাতের দৃশ্য গুলো।
উর্মির সঙ্গে ঝগড়া তার কাছে নতুন কিছু নয়। বিয়ে হয়েছে প্রায় ঊনিশ বছর। বিয়েটা পালিয়ে হয়েছিল, উর্মির মা বাবা মেনে নিলেও সুজনের বাবা একেবারেই মেনে নিতে চাননি, তাই পালিয়ে যাওয়া। প্রায় বছর দেড়েক এর প্রেম। মন থেকে শরীরে নেমে এসেছিল প্রেম। উর্মি যখন তিন মাসের পোয়াতি তখন বাধ্য হয়েই পালাতে হয় তাদের। উর্মিরা ব্রাহ্মণ হলেও উর্মির বাবা-মা কোন একটা অজ্ঞাত কারণে তাকে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু সুজনের বাড়ির আপত্তি ছিল। ব্রাহ্মণের মেয়ে, বউ হিসেবে এলে হয়তো নিজেদের ছোট হয়ে যেতে হবে তার কাছে সেই ভেবেই এই আপত্তি হতে পারে।
সুজন তার মার কাছে শুনেছিল কুমোরের চাকা যত ঘোরে তার মনের ভিতরে প্যাঁচও তত জটিল হয়। বিয়ের পর প্রথম চার-পাঁচ বছর বেশ ভালোই কেটেছিল সুজনের। বিয়ের ঠিক বছর দুয়েকের মাথায় চাকরিটা পায় সুজন। চাকরি পাওয়ার ঠিক বছর দুয়েকের মাথায় ছোট ছেলের অন্নপ্রাশনে শ্বশুর-শাশুড়িকে নিমন্ত্রণ করতে গেছিল সুজন এবং অত্যন্ত আশ্চর্যের সঙ্গে দেখেছিল উর্মির বাবা-মা সেদিন উর্মিকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। সেদিন বোঝেনি, আজ বোঝে খাল কেটে কুমির এনেছিল , নাহলে তার জীবনটা এত তাড়াতাড়ি এমন বিষাক্ত হয়ে যেত না। উর্মির সমস্ত কাজ, চিন্তা নিয়ন্ত্রন হয় বাপের বাড়ি থেকে।
সেদিন রাতে উর্মি যখন একনাগাড়ে তাকে অজস্রবার বাপ-মা তুলে খিস্তি দিচ্ছিল আরো কত কি বলছিল তখন সুজনের উর্মির মুখটাকে কেমন যেন অচেনা আর ছোট্ট মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন উর্মি কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। তার মুখটা যেন ধীরে ধীরে অনেক দূরে অনেক দূরে ছোট হতে হতে সরে যাচ্ছে, মাঝে ব্যবধানটা যেন বেড়েই চলেছে । মনে হচ্ছিল বহুদূর থেকে উর্মি যেন প্রচন্ড আক্রোশে শুধু ঠোঁটদুটো নেড়ে যাচ্ছে। সুজনের মাথায় তখন কিছুই ঢুকছিল না সে ভাবছিলো ওই মুখটাকে কি সে ছুঁয়েছে কখনো? ওই ঠোঁট দুটোতে কি সে কখনো ঠোঁট রেখেছে? ওই শরীরটাতে সে বহুবার প্রবেশ করেছে, তবুও সেদিন উর্মিকে কেমন অন্য একটা মানুষ বলে মনে হচ্ছিল তার, যাকে সে একেবারেই চেনে না।
খুব তেষ্টা পাচ্ছিল সুজনের। সে বুঝেছিল উর্মির তিরস্কারের পর শুধু জলে আর তার তেষ্টা মেটার নয়। নতুন একটা বিষ জীবনে যুক্ত হয়েছিল- তাড়ি। কখনো-সখনো চোলাই। সেদিনও গেছিল তাড়ি খেতে গড়াই-এর বাড়ি। ভরপেট তাড়ি খেয়ে নেশা তেমন হয়নি, শরীর টলছিল, কথা এলিয়ে যাচ্ছিল। পড়েছিল কয়লা গুলের পাইকের মদনের দোকানের রকে। রাত প্রায় এগারোটার সময় রুপম আর উর্মি পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা হাতে নিয়ে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিল। ওদের দেখতে পেয়ে সুজনই সাড়া দিয়েছিল ঘড় ঘড়ে গলায়। তারপর আর মনে নেই তার। শুধু কয়েকটা চড় ঘুষির অনুভূতিহীন স্মৃতি আর বারবার জলের মধ্যে মাথাটা জোর করে ডুবিয়ে দেওয়ার আবছা ছবিটা মাথায় রয়ে গেছে। পরদিন তার মুখ, নাক, হাত ফুলে উঠেছিল । সারা শরীর অসহ্য ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। অনেক পরে বুঝতে পেরেছিল সুজন ওই ফোলা আর ব্যথা গুলো তার স্ত্রী আর ছেলের দেওয়া।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সুজন। নিজের বাড়ি যার প্রতিটা ইটে তার অধিকার আছে সুজন সেখানেই ঢুকতে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল। টাকাগুলো পাবার পর বারবার মেয়েটার কথাই মনে হয়েছে। একটা ভালো সিডি প্লেয়ার নিয়ে এসেছে, নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি। কিন্তু বাড়ির দরজা থেকে মাত্র তিন চার গজ দূরে দাঁড়িয়ে নিজেকেই কেমন অপরিচিতের মতো মনে হচ্ছিল তার। হঠাৎ চোখে পড়ল ছোট্ট বাগান টার দিকে নিজে হাতে কয়েকটা গাঁদা, বেলফুল আর একটা গোলাপের চারা সেখানে লাগিয়েছিল সুজন। এখন আগাছায় ভরে গেছে জায়গাটা। এখানে সেখানে কিছু জঞ্জাল জড়ো করা রয়েছে।
--"মাত্র দেড় মাসেই বাগান টা নষ্ট হয়ে গেল!"
সুজন নিজের মনেই কথাটা বলে ওঠে। নিজের অবচেতনেই ইতিমধ্যে কয়েক পা এগিয়ে এসেছে সুজন বাড়ির দিকে। হঠাৎ কানে এলো, বাড়ির ভিতর থেকে হাসির রোল বাতাসে ভেসে আসছে। সুজনের মনে হলো তার থাকা না থাকায় তার পরিবারের তেমন কোনো লাভ লোকসান নেই। এই দেড় মাস সে উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটা অখ্যাত রেল স্টেশনে পড়েছিল, তার খোঁজ ও কেউ নেয়নি। সুজন বুঝতে পারে না, সে সত্যিই এদের কেউ কি না?
ধীর পায়ে বন্ধ দরজার দিকে এগিয়ে গেল সুজন। কলিংবেলটা টিপতে গিয়ে টের পেল তার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে, কপালের দু'পাশের অবাধ্য শিরা দুটো আবার লাফালাফি শুরু করেছে। কলিংবেলের সুরেলা আওয়াজে কোথাও দুঃখ বা আপনজন না থাকার বেদনা অনুভব করল না সুজন। ভিতরে কেউ কেউ কি অনুভব করল? কে জানে!
দরজাটা খুলল নিতু। বাবাকে দেখে কেমন যেন থমকে গেল। আগে বাড়ি ফিরলে মেয়ের মুখে যে উচ্ছ্বাস আনন্দ দেখতে পেত আজ সেটা কেমন যেন বিবর্ণ আর ধোঁয়াটে মনে হল সুজনের।
অস্ফুট স্বরে নিতু বলল,
-- বাবা!
কথাটা সুজনের কানে যেন বুলেটের মতো বিঁধল। শেষ কবে এই ডাকটা শুনেছে মনে করতে পারে না। কিছুটা বিহ্বলতা তাকে গ্রাস করল, ঘুমিয়ে থাকা স্নেহ তাকে দুর্বল করে দিল। রাগ আর কষ্ট ভুলে একটু ভেজা গলায় সুজন বলল,
--হ্যাঁরে নিতু। ঘরে ঢুকতে দিবি না?
দ্রুত দরজাটা ছেড়ে সরে দাঁড়ায় মেয়ে। ভিতর থেকে তখনও হাসির ফোয়ারা ফুলঝুরির মত ছুটছে। সুজন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে,
-- নিতু , ভিতরে কারা এসেছে রে মা ?
--মার পিসির মেয়ে আর জামাই। দাদার চাকরি করে দেবে নাকি ওরা! একটু ব্যাঙ্গের হাসি হাসলো নিতু। এভাবে হাসলে ওর ঠোঁটটা কেমন বেঁকে যায় একদিকে।
মেয়ের জবাবে একটু অবাক হলো সুজন। রুপমের চাকরি? সে তো এখনো গ্রাজুয়েটই হয়নি। আর অপর্ণার বর আশীষ, সে কেমন করে চাকরি দেবে তাকে? আশীষ সুজনদের অফিসেই গ্রুপ-ডি চাকরি করে ! জুতো খুলতে খুলতে সুজন নিতুকে আবার জিজ্ঞাসা করে,
-- কি চাকরি?
-- অপর্ণা মাসির বর বলছিল তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিলে, না-না ভি-আর-এস না কি একটা নিলে দাদার চাকরিটা নাকি হয়ে যাবে।
স্তব্ধ হয়ে গেল সুজন। সমস্ত মনটা যেন তেতো হয়ে গেল এই কথাগুলো শুনে। নিজেকে বড় একা আর অসহায় মনে হল হল সুজনের। পরিবারের কাছে তার গুরুত্ব যে তলানীতে এই কথাটা বড় স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল এখন। তার মনে হয়েছিল উর্মি তাকে এতদিন পর বাড়ি ফিরতে দেখে কেঁদে বুক না ভাসাক অন্তত কিছুটা অভিমান করবে। কিছুটা অনুযোগ থাকবে তার কথায় কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সম্পর্কটা বাগানটার মতোই নষ্ট হয়ে গেছে। সুজন বুঝতে পারল না এর পরও তার এখানে থাকা উচিত কিনা। বোহেমিয়ান সে ছিল না, কিন্তু গত এক বছর সে তেমনটাই হয়েছে। দিনের পর দিন অফিস যায় নি, ফলে পুরো মাইনেও পায়নি। আর রোজকার সংসারে যেটা পেয়েছে, সেটাকে আর যাই হোক, ভালোবাসা বা সম্মান কোনটাই বলা যায় না।
#দুই.
শীতটা বেশ জাকিয়ে পড়েছে। শীতের তীব্রতা আছে, কিন্তু কোন কষ্ট নেই সুজনের। তার চোখে শুধু একটাই দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে গত একমাস ধরে। সেদিন দেড় মাস পরে সে বাড়ি ফিরে ছিল। সঙ্গে অনেক টাকা ছিল, তবু সেই রাতটাই তার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার রাত হয়ে উঠেছিল। বৌয়ের গালি, ছেলের মার তো ছিলোই, তার সঙ্গে সেদিন যোগ হয়েছিল আদরের মেয়ে নিতুর চড়। অথচ তার এবার বাড়ি আসার কারণটাও নিতু।
ইচ্ছা করেই কাউকে আর জানায়নি সুজন যে সে ভি আর এস নিয়েছে। উর্মি আর রুপম বারবার শুধু একটাই কথা তাকে বুঝিয়েছে, চাকরিটা রুপমকে পাইয়ে দিতেই হবে।
প্রত্যেকবারই সুজন তার তীব্র অসম্মতি প্রকাশ করেছে। বোঝানোটা প্রথমে ভালো মুখেই চলছিল কিন্তু তাকে রাজি করাতে না পেরে উর্মি নিজেকে নগ্ন করে অকথ্য গালি-গালাজ এবং শাপ-শাপান্ত করতে থাকে। সেদিন সুজনের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল উর্মি। সে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি, হাত চালিয়েছিল-- উর্মির ঠোঁট থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল। উর্মিও থেমে থাকেনি সেদিন। রান্নাঘর থেকে বড় দেখে চেলাকাঠ নিয়ে এসেছিল, তারপর সুজন পিঠে চেলাকাঠ আর মুখে পেটে ঘুষি খেতে খেতে সমস্ত দৃশ্যমান জগত থেকে হারিয়ে যেতে যেতেও ভাবছিল রুপমের হাতদুটো এত শক্ত হয়ে উঠল কবে? ছোটবেলায় ওর নরম তুলতুলে হাত দুটো কতবার তার গলা জড়িয়ে ধরেছে!
সুজন জ্ঞান ফেরার পর ক্ষত-বিক্ষত নিজেকে আবিষ্কার করেছিল জেঠতুতো দিদির বাড়ি। কাছেই বাড়ি দিদির। সম্পন্ন পরিবার, সেবায় কার্পণ্য করেনি। কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল সে। তাদের বাড়ির রোজকার ঝগড়া অশান্তি কারোর কৌতূহল সৃষ্টি করে না আর। তবুও দিদি অত চেঁচামেচি শুনে সেই রাত্রে এসে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন পড়শীকে সঙ্গে করে এসেছিল দিদি। হয়তো একা আসতে ভয় পেয়েছিল। সুজন অজ্ঞান অবস্খাতেই কখন দিদির বাড়ি এসছে সেটা তার জানার কথা নয়, সে জানেও না। মোটামুটি সুস্থ হবার পর সে আর বাড়ি ফেরেনি। কিছুদিন দিদির বাড়ি ছিল। সারাদিন নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করত সবার মধ্যে শারীরিক ও মানসিকভাবে। সন্ধ্যেবেলায় নেশা করত। কিছু টাকা মানিব্যাগেই ছিল। বাকি টাকা ব্যাংকে জমা আছে, উর্মিকে নমিনি করা আছে। মাতলামি সে কোনোকালেই তেমন করত না নেশা করে চুপচাপ পড়ে থাকত দিদির সিঁড়িঘরে, রাত্রে খাবার জন্য কেউ সাধাসাধি করত না, আর সেও চাইত না।
তারপর আর দিদির বাড়ি যায়নি সুজন। কখনো ফাঁকা মাঠে শুয়েছিল কখনো গড়াই এর বাড়ি --তাড়ি খেতে।
গত তিনদিন সুজন এই ফাঁকা টালিখোলায় এক কোণে পড়ে আছে। ভেবেছিল দিদির বাড়ি থেকে চলে আসবার আগে দিদিকে তার ভিআরএস নেবার কথাটা একবার জানিয়ে রাখবে। উর্মি পরে জেনে যেত। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি।
সুজন বেশ বুঝতে পারছে শরীরটা ছাড়া আর কোন অস্তিত্ব বা গুরুত্ব তার নেই। নিজেকে নিয়ে ঠিক কি করবে সেটাও বুঝতে পারছে না সে। শরীরটাকে বয়ে বেড়াবার আর কোনো কারণ সে খুঁজে পায়নি গত কয়েকদিনে। মানিব্যাগে এখনও বেশ কিছু টাকা রয়েছে, কিন্তু তার খাবার ইচ্ছাটাই যেন উবে গেছে কর্পূরের মত। তিনদিনের অনাহারক্লিষ্ট শরীরটাকে আজ কোনমতে টালি খোলার এই গড়ন ঘরের বারান্দায় নিয়ে এসেছে।
এই কদিনে বহু মানুষের বহু প্রশ্নের জবাব দিয়েছে সে। অনেকের কাছ থেকে উপদেশ পেয়েছে, অনেকে তিরস্কার করেছে কেউ কেউ এমনও বলেছে "মাতালকে আবার কি ধুপ ধুনো দিয়ে পুজো করবে?" কিন্তু তার কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করেনি এখনো করছে না। একটু বিশ্রাম দরকার সুজনের শরীরের মনের।
সুজনের ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ। বড্ড শীত লাগছে। একটা কম্বল হলে ভালো হতো। রাত এখন কত? সুজন বুঝতে পারে না!
শরীরটা খুব হালকা লাগছে তার। কেমন যেন মুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। যাক, বরফে ঢেকে যাক সব কিন্তু তাকে আর কোন কষ্ট ছুঁতে পারবে না। আজ এই মুহূর্তে সুজন যেন সমস্ত পারিপার্শ্বিক সমস্ত প্রকৃতি থেকে কেমন একটা অপরিচিত হয়ে গেছে। দিনের বেলা দেখেছিল বারান্দায় বাসের আড়ায় মজুরদের হাত পা মোছার জন্য বেশ বড় একটা গামছা রয়েছে। সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়েছিল।
কষ্ট হচ্ছে না আর সুজনের। কিন্তু দুর্বলতা বাধা দিচ্ছে। না, হেরে গেলে হবে না। আর হারবে না সুজন। জিতবেই নিজের কাছে, নিজের থেকেই নিজেকে জেতাতে হবে। উর্মির মুখটা মনে পড়ল সুজনের। নিজের মনেই কেমন হেসে ফেললো সে। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিল গামছাটার দিকে। আকাশটা আর খুব বেশি দূরে নয়।
===============================
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত