গল্প ।। এক হতভাগ্য পিতার গল্প ।। গোবিন্দ মোদক
মনোরঞ্জন। বাপ-মায়ের আদরের মনু। কিন্তু বাপ-মা কবেই গত হয়েছেন। মনু একা। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে সে লেখাপড়া শিখেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। তথাপি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সে কোনও চাকরি জোটাতে পারেনি। কাজেই নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে হয়।
এভাবেই মনুর দিন চলে। এসে যায় শিক্ষক দিবস। সেদিন ছাত্র-ছাত্রীরা সেজেগুজে মনুর জন্য ফুল, মিষ্টি এবং উপহার স্বরূপ একসেট পাজামা-পাঞ্জাবি নিয়ে এসে প্রণাম করে। কিন্তু সুতপা, ওর খুব প্রিয় ছাত্রী, প্রণাম করতে গেলে খুব কষ্ট হয়; কারণ সুতপা প্রতিবন্ধী, নিচু হয়ে প্রণাম করতে পারে না। মনু তাকে আশ্বস্ত করে, তার চোখে জল এসে যায়, বলে -- আজও আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীরা কতো অসহায়! মনুর একজন ছাত্র ঈষৎ প্রতিবাদ করে -- না স্যার, প্রতিবন্ধীরাও আজ সমান কদমে এগিয়ে চলেছে, তারা আজ কিন্তু পুরোপুরি অসহায় নয়। আরেক ছাত্রী বলে ওঠে -- হ্যাঁ স্যার, আজকাল প্রতিবন্ধীরা মনের জোরে এভারেস্টে ওঠার সাহস করছে। কোনও প্রতিবন্ধী আবার সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে গিনেস বুকে নাম তুলছে। এভাবে কোনও প্রতিবন্ধী আবার গাড়ি চালাচ্ছে। এইরকম উদাহরণ কিন্তু আমাদের চারপাশে অনেক।
প্রতিবন্ধী বিষয়ক আলোচনা এগোতে থাকে। একসময় মনু বলে -- আমি মেনে নিচ্ছি যে প্রতিবন্ধীরা এগোচ্ছে। তারা স্বনির্ভর হতে জানে, স্বনির্ভর হওয়ার সাহস তারা নিজে যেমন করছে, অন্য প্রতিবন্ধীকেও সেই সাহস যোগাচ্ছে। তবুও প্রতিবন্ধীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে কতো অসহায় তার একটি গল্প আমি সংক্ষেপে তোমাদেরকে বলি।
এক হতদরিদ্র পিতা ছিল। তার একমাত্র কন্যাসন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে তার স্ত্রী মারা যায়। এই কন্যাসন্তানটি পিতার নয়নের মণি। কিন্তু হলে কী হবে, মেয়েটি প্রতিবন্ধী। তার বয়স বাড়ে কিন্তু তার পা'দুটি বাড়েনা। পা'দুটি ছোট্ট এবং কাঠির মতো সরু। তারপর প্রকৃতির নিয়মে মেয়েটির জীবনে যৌবন আসে, তার সারা শরীরে যৌবন টলমল করে। কিন্তু পা'দুটি সরু লিকলিকেই থেকে যায়। মেয়েটি একপ্রকার বাবার কাছে বোঝা হয়ে যায়। মেয়েটিকে দেখভাল করতে গিয়ে তার বাবা সময়মতো কাজকর্ম করতে পারে না। আশেপাশের ছেলেছোকরারা মেয়েটির প্রতি প্রলুব্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকাতো। কাজেই এদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আগলে রাখতে হতো মেয়েটিকে, এভাবে তার জীবিকানির্বাহ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। বাজারে ধারদেনাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। একসময় মহাজন আর তাকে কোনও ধার দেয় না। এমনই একদিন ঘরে একদানা চাল নেই যে মেয়েটিকে দু'টো খেতে দেবে। সে মহাজনের কাছে এসে পায়ে পড়ে -- আজকের মতো কিছু টাকা দিন, আমি ঠিক শোধ করে দেবো। তখন মহাজন তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এসে একটা কুৎসিত ইঙ্গিত করে বলে -- কেন তোর ডাগর মেয়েটি তো আছে, ওকে দিয়ে দে আমায়।
--- কি বলছেন কর্তা! ও যে আমার একমাত্র মেয়ে, মা-মরা প্রতিবন্ধী !
--- হ্যাঁ সেই জন্যই তো বলছি। ও তো তোর বোঝা! তুই তোর বোঝা আমাকে দিয়ে দে ! আমি তোর আগের সব দেনা মুকুব করে দেবো, আর তোকে পাঁচ হাজার টাকাও দেবো।
--- না না কর্তা, তা হয় না! হয় না !
--- হয়, খুব হয় ! তুই ভালো করে ভেবে দেখ, নইলে আজই কিন্তু আমার সব দেনা শোধ করে দিতে হবে, এই বলে রাখলাম!
হতভাগ্য পিতা ফিরে যায় তার বাড়িতে। সারারাত চোখে ঘুম আসে না তার। পরদিন সকালে সে তার মেয়েটির হাত ধরে বলে -- মা চল, আজ তোর মামা বাড়ি যাব।
মেয়ে তো অবাক ! এত বড় হলাম কোনওদিন তো মামাবাড়ীর কথা শুনিনি ! তাই মামা বাড়ি যাবে বলে মেয়েটা খুব আনন্দ করে সাজগোজ করে। মেয়েটিকে নিয়ে হতভাগ্য পিতা সেই মহাজনের কাছে রেখে আসে। মহাজন তার দিকে ছুঁড়ে দেয় পাঁচ হাজার টাকার নোটের বান্ডিল। সেই টাকা নিয়ে সে চোরের মতন ফিরে আসে। ঠিক সেই মুহুর্তে মহাজন লালসার দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকায়। তারপর খপাত্ করে খামচে ধরে তার কিশোরী বুকদু'টো। মেয়ের চিৎকার করে -- বাবা ! আমাকে বাঁচাও ! আমাকে তুমি কোন মামার কাছে রেখে গেলে বাবা !
হতভাগ্য পিতার কানে মেয়ের আর্তস্বর পৌঁছায়, একবার ভাবে ফিরে যায়, মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনে। কিন্তু তারপরই ভাবে -- তাকে কি খাওয়াবে, কি পরাবে, কেমন করে তাকে চারপাশের লোভ-লালসার হাত থেকে বাঁচাবে ! দুই কানে হাত চাপা দিয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে হতভাগ্য পিতা, পেছনে ভেসে আসতে থাকে মেয়ের করুণ কণ্ঠস্বর।
মনোরঞ্জনের কাহিনী এখানেই শেষ হয়ে যায়, তাকিয়ে দেখে সবার চোখে জল। এখনই বুঝি বৃষ্টি নামবে।
=============================
স্বরচিত মৌলিক অপ্রকাশিত গল্প।
প্রেরক: গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ডাকসূচক - 741103