আমি যখনকার কথা বলছি তখন মোবাইল চালুই হয়নি। মোবাইল তো দুরের কথা টেলিফোনি ছিল একেকটা এলাকায় হাতে গোনা বাড়ীতে। কম্পিউটার কোথাও থাকলেও ল্যপটপ তখনো বাজারে আসেনি। ইচ্ছে থাকলেও ক্যমেরা কেনার সাধ্য ছিলনা অনেকেরেই। এখানে এমন একজন লোকের কথা বলবো যার প্রতি বছর বেড়াতে যাবার সখ থাকলেও তার দামী ক্যমেরাটা চুরি হয়ে যাবার ফলে সে একটা অদ্ভুত উপায় বের করে তার ছবি তোলার নেশা মেটাতেন এবং তা পরিচিত ও অল্প পরিচিতদের দেখিয়ে নিতান্তই আনন্দ পেতেন।
তাহলে ঘটনাটা বলি।
আমরা তিন বন্ধু রাঁচী বাস স্ট্যান্ড থেকে সকালে বাসে চেপে নেতারহাট বাস স্ট্যান্ড-এ পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যায়। বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন একটা ট্যু্রিসট অফিস বেশ ছোটখাট। ওখানে খোঁজ খবর নিয়ে উঠলাম গিয়ে এক হোটেলে। আমরা যে দিন ঐ হোটেলে উঠেছিলাম সেদিন ছিল দুরগা-অস্টমী, আর হোটেলের উদ্ভোবন হয়েছিল মহালয়ার দিন। মিস্ত্রীদের কাজ চলছে। দু-তিনটে ঘর পুরো সম্পূর্ণ। এর সাথে নিচে বিশাল ক্যানটিন। আগে খালি ক্যনটিনি ছিল। স্থানীয় লোকেরা তার সঙ্গে ট্যুরিসটরা এসে ব্রেকফাস্ট করতো লাঞ্চ করতো কেউ কেউ ডিনারো খেতে আসতো। হোটেলের আইডিয়াটা এসেছে পরে। এখনতো দোতলার কাজ চলছে খুব ঢিমে তালে। দূর্গা পূজার কারণে মনে হয়।
পরের দিন সা্রাদিন ঘুরেটু্রে পাহাড়ের নৈস্বর্গিক দৃশ্য অবলোকন করে কোয়েল ভিউ পয়েন্ট দেখে সব শেষে সানসেট পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখে হোটেলে ফিরলাম। অবশ্য মাঝে এক সময় হোটেলে এসে স্নান খাওয়া করে গিয়েছিলাম। ক্যনটিনের একটা টেবিল দখল করে সিঙ্গাড়া আর চায়ের অর্ডার দিলাম। বাইরে তখন বেশ শীত। ক্যনটিনো বেশ জমজমাট। চাপা কোলাহল আর কাপ ডিসের টুং টাঙ শব্দ।
কিছুক্ষণ পরে একজন ছোটখাট টাকমাথা ফর্সা চশমা পরিহিত ভদ্রলোক টেবিলের এক মাত্র খালি চেয়ারটায় এসে বসেই বললেন, ' আলাপ করতে এলাম আপনাদের সাথে। আপনার এই কোটহাতা সোয়েটারটা কিন্তু ভারি চমৎকার।' উনি অত্যনত যত্নে আমার পিঠের একটা কোনে হাত বুলিয়ে নিলেন। যেন আমি ওনার কতদিনের চেনা। আমি চমৎকৃত হলাম। বন্ধুরাও আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, 'ঐ দেখুন আমার নামটাই বলা হয়নি, আমার নাম শিবেস চ্যটারজী।' পেছন দিকে তাকিয়ে ঠিক ওনার মত দেখতে আর একজন নি্রিহ ভদ্রলোককে উনি ডাকলেন, 'এই নির্মল, আয় এখানে একটা চেয়ার টেনে এনে বস।' সেই ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ
ওখান থেকে উঠে এসে একটা চেয়ার টেনে এনে বসেই আমাদের দিকে হাত জোর করে বললো,' নমস্কার, আমার নাম নির্মলেন্দু সরকার। এবার তুই বল শিবু কি বলছিলি?' শিবেসবাবু বললেন, 'তোকে এই সোয়েটারের কথা বলছিলাম না, এবার আরও কাছ থেকে দেখ।' আমার মনে পড়লো এদের দলটাকে আমরা সানসেট পয়েন্টে দেখেছিলাম। বেশ বড় দলটা।
আলাপটা বেশ ভালভাবেই জমে গেল। আমরাও আমাদের পরিচয় দিলাম। আমাদের কোন ক্যমেরা নেই শুনে নির্মলবাবু বললেন, 'জানেন আমার একটা খুব দামী ক্যামেরা ছিল। যেখানেই বেড়াতে যেতাম সেখানেই ওটা নিয়ে যেতাম। একবার হয়েছে কি কাশ্মীর ভ্রমণ করে ফিরে আসার সময় টেরেণে সেটা খোয়া যায়। কাশ্মীর ভ্রমণের দুর্দান্ত সব ছবিগুলো ক্যমেরার সাথে চির জীবনের জন্য হারিয়ে যায়। এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে কি বলবো। সে দুঃখ কোনোদিনই ভুলতে পারবো না।' শিবেসবাবু বললেন, ' টালিগঞ্জে আমাদের একটা দল
আছে। আমরা নিজেরাই চালাই। প্রতি বছরই জনা তিরিশেক নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি ঘুড়তে। এবার এসেছি রাঁচী-নেতারহাট। আমার এই বন্ধুটির খুব সখ ছবি তোলার। সে সাধারণ ক্যমে্রা কিনবে না আবার দামী ক্যমেরা কিনবে সে ক্ষমতা এখন আর নেই। তাই ও ভাল ছবি আঁকতে পারা্র সুবাদে ছোট্ট ছোট্ট খুব মোটা খাতা বানিয়ে তাতে খালি স্কেচ করে। কৈ দেখা নারে একটু নির্মল।'
নির্মলবাবু পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেটা বার করলো সেটার সাইজ বড় জোর লম্বা চওড়ায় ৪" বাই ৩" কিন্তু বেশ মোটা আর হাতে বানানো। তার পাতায় পাতায় সরু পেন্সিল দিয়ে আঁকা এক একটা স্কেচ। মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর হাত-পা গুলো এক একেকটা পেন্সিলের আঁচড় আর মাথাগুলো এক একেকটা একটু মোটা ডটের মত। নির্মলবাবু বললেন, 'আমরা আজ সন্ধ্যেবেলা নেতারহাট এসে পৌঁছেছি। এসেছি রাঁচী থেকে বেতলা হয়ে এখানে। আমি মশাই চটপট বাস থেকে নেমে পড়ে একটা সাইডে সরে গিয়ে এই দেখুন এই স্কেচটা এঁকে ফেললাম। দেখুন বাস থেকে আমাদের লোকেরা নামছে, বাসের উপর থেকে মালপত্র নামান হচ্ছে, তার তদারকি করছে এই শিবু। সামনে ছোটখাট একতলা ট্যুরিসট অফিস। চেয়ার টেবিলে অফিসারটি কাজ করছে। সিঁড়িতে উঠতে ডান দিকে একটা কল। সন্ধ্যা হয়ে যাবার দরুন তাড়াতাড়িতে আর কিছুই আঁকতে পারিনি।'
আমরা নিজেরা আলোচনা করলাম কাল থেকেও এতবার ট্যুরিসট অফিস ঘেঁষে যাতায়াত করলাম একবারের জন্যও কলটা খেয়াল করিনি। কিন্তু সেটা আছে ওখানেই পরে দেখেছিলাম। নির্মলবাবু বলেই চলেছেন,' প্রতিটা ছবিরি একটা করে নাম দিই আমি। এখানে আসতে গিয়ে শেষ যে গ্রামের উপর দিয়ে আসলাম লাতেহার নাকি যেন নাম তার, সেখানে সপ্তাহে একদিন হাট বসে। সেই হাটে সত্যজিৎ রায় 'অরণ্যর দিন রাত্রির' স্যুটিঙ করেছিলেন সৌমিত্র-শরমিলাকে নিয়ে।এই দেখুন সৌমিত্র -শর্মিলা কাঁচের চুড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু মেলার ছবি তাই এর নাম দিয়েছি , 'আননদমেলা'। আর বেতলার এই ছবিটা দেখুন এটা কেচকির ফরেস্ট বাঙলো। আর এই পাতকূয়াতে ছবির চার নায়ক স্নান করেছিল তাই আমাদের মহিলা যাত্রীরা ঐ পাতকুয়াতে স্নান করার জন্যে এককাট্টা।' তাই এই ছবিটার নাম দিয়েছি 'নতুন তীর্থ'। এরি পাশে একটা মাদূর পেতে আমরা বসেছিলাম। শিবু ছিল এখানে বসে আর আমি ঠিক এখানে বসে স্কেচ করছিলাম।' শিবেসবাবু আপত্তি করে বলে, ' না না, আমি ঠিক এই জায়গায় বসেছিলাম রমা বৌদির পাশে।' নির্মল বাবু বলে, 'আরে, আমি ছবি এঁকেছি আমি জানিনা। তুই এখানেই বসেছিলি।' 'আরে আমি বসেছিলাম আমি জানিনা? আমি এখানেই বসেছিলাম রমা বৌদির পাশে।' অমনি তিনি, ' দুর রমাবৌদি এখানেই........
দুই বন্ধুর ঝগড়া চলতেই লাগলো। আমরা অত্যন্ত অভিভূত। ঐ স্কেচ দেখে যে কিছুই বোঝার উপায় নেই যে কোনটা কে।
_______ O ________
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block - 8, Flat - 1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.