সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও জেলা মালদহ..
( 'আনন্দমঠ' ও 'বন্দেমাতরম' সৃষ্টির স্থান কাল অন্বেষণ )
রীতা রায়
সাহিত্য সম্রাট 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' হলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও উপন্যাসের জনক। সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তথা বাঙালি হৃদয়ে আজও সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে রয়েছেন। এছাড়াও, গীতার ব্যাখ্যা দাতা ও সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তিনি বিশেষরূপে খ্যাত। ছদ্মনাম 'কমলাকান্ত'। তিনি জীবিকাসূত্রে ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা হয়েও স্বদেশের প্রতি তাঁর অনুগত্য, ভালোবাসা ও ভাবনা স্বমর্যাদায় বিরাজমান যা তাঁর লেখার অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত। তিনি বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
জন্ম- ২৬ জুন ১৮৩৮ সন, বাংলা ১৩ আষাঢ় ১২৪৫ কাঁঠালপাড়া গ্রাম, নৈহাটি, কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত।
তাঁর জীবনকাল মাত্র পঞ্চান্ন বছরের (মৃত্যু ৮ এপ্রিল ১৮৯৪ )। স্বল্প পরিসরের এই জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে যে অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। বাঙালি তাকে কোনোদিনও ভোলেনি, ভুলবেও না। শুধু বাংলা সাহিত্য নয় স্বদেশি ভাবনায় উদ্বুদ্ধ তাঁর লেখনী দেশীয় মননে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'আনন্দ মঠ' তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনকারীদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর রচিত আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাসের কবিতা 'বন্দেমাতরম' ১৯৩৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
শুধু তাই নয় স্বাধীন ভারতে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি 'বন্দেমাতরম' সংগীতও সমমর্যাদায় গীত হয়ে আসছে।
আমরা মালদহবাসী রূপে গর্বিত যে এই মহান সাহিত্যিকের পদধূলি আমাদের এই ক্ষুদ্র শহরে পড়েছিল এবং অজস্র সাহিত্য সৃষ্টি তিনি এই শহরে বসে করেছেন যা আজ ইতিহাস। শুধু তাই নয়, মনে করা হয় যে 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের পটভূমি তিনি মালদহে বসেই এঁকে ফেলেছিলেন। একটি উপন্যাস রচনা একদিনের উৎপাদিত ফসল নয়। তার প্রেক্ষাপট মনের ভেতর ভিত্তি স্থাপন করে একটু একটু করে গেঁথে চলে বহু পূর্ব থেকেই। পরে তা কাগজে কলমে আক্ষরিক ভাবে প্রতীয়মান হয়।
ইতিহাস বলে, ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহি, বগুড়ায় সংঘটিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও ফকির বিদ্রোহর পটভূমিতেই বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন 'আনন্দমঠ' উপন্যাস। কর্মজীবনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৪-এর অক্টোবর থেকে ১৮৭৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত মালদা জেলায় ডেপুটি কালেক্টর নিযুক্ত ছিলেন তৎকালীন রাজশাহি ডিভিশনের দায়িত্বে । ১৮৮০তে তিনি 'আনন্দমঠ' রচনা আরম্ভ করেন এবং ১৮৮২তে তা প্রকাশিত হয়। বঙ্কিম ভ্রাতা পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মবিবরণী খ্যাতনামা সমালোচক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তর প্রবন্ধগ্রন্থ 'বঙ্কিমচন্দ্র' থেকে জানা যায় যে আনন্দমঠ উপন্যাস রচনার অনেক আগেই তিনি 'বন্দেমাতরম' গানটি রচনা করেছিলেন। সময়ের হিসাবে তখন তাঁর 'মালদহে' কালেক্টর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 'মালদহ' জেলারূপে গঠিত হয় ১৮১৩ সালে। শুরুতে ১৮১৩ - ১৮৭৬ পর্যন্ত মালদহ 'রাজশাহী বিভাগ'এর অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরে ১৮৭৬ - ১৯০৫ পর্যন্ত 'ভাগলপুর বিভাগ'এর অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই কারণে দেশ বিভাগের সময় মালদহ জেলাকে নিয়ে বাংলা ও বিহারের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং শেষপর্যন্ত্য বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
সুতরাং বঙ্কিমচন্দ্র যখন মালদহের ডেপুটি কালেক্টর হয়ে আসেন তখন মালদহ 'রাজশাহী বিভাগ'এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সূত্রে তিনি মালদহ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়িসহ সারা উত্তরবঙ্গের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পান।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলতে মূলত আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতবর্ষের বাংলাতে ফকির ও সন্ন্যাসী বা মুসলিম ও হিন্দু তাপসদের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনকে বোঝানো হয়ে থাকে। 'যামিনী মোহন ঘোষ' ছাড়া সকল দেশীয় ইতিহাসবিদ একে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার বলে মনে করেন কারণ ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর খাজনা তোলার কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে আসে। ফলস্বরূপ সাধারণ জনগণের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য স্থানীয় জমিদারগণ চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য হন। জনসাধারণের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং জনগণের স্বার্থে ডাকাতির ছলনায় জমিদার ও ব্রিটিশ কোষাগার লুঠ করে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করেন। যদিও ইংরেজ লেখকরা শুরু থেকেই এই বিদ্রোহকে দস্যুদের লুটতরাজ বলে চালাতে চেয়েছেন। সেরকমই ইংরেজের অনুগত রেকর্ডবিভাগের কর্মচারী যামিনী মোহন ঘোষ উপনিবেশী প্রশাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে একদল উচ্ছৃঙ্খল ফকির ও সন্ন্যাসীর চুরিচামারি ও লুটতরাজ বলে আখ্যায়িত করেন। এ জন্য ভারতের গবেষক গৌতম ভদ্র তাঁকে ব্যঙ্গ করে 'দাঙ্গা হাঙ্গামা' ও 'লুটতরাজে'র ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
( তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া )
বঙ্কিমচন্দ্র যে সময় মালদহে আসেন সেই সময়কার মালদহের ঘন আমবাগান ও চারপাশের শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলার ছবি তাঁর লেখার প্রেক্ষাপট হিসেবে গ্রহণ করা এবং সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্যশ্যামলাং বাংলাকে ভীষণ কাছ থেকে অনুভব করা স্বাভাবিক ছিল। সেই সময় ও পরবর্তীতে মালদহে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে নীলচাষের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন কৃষকদের দ্বারা ডাকাতির প্রভাব অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়, এরকম অজস্র ঘটনা বিভিন্ন পুস্তকে গল্পের আকারে লিখিত আছে বা লোকমুখে জনশ্রুত থেকে গেছে। আজও বিভিন্ন জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে মোহর বা স্বর্ণধাতুর প্রতিমা পাওয়া গেলে তা রাতের আঁধারে পাচার হয়ে যাবার খবর গ্রামাঞ্চলের লোকের মুখে শোনা যায়। সেগুলো যে ব্রিটিশ আমলে ডাকাতদের দ্বারা লুন্ঠিত দ্রব্য এবং ধরা পড়ার ভয়ে ও সুরক্ষার জন্য সেগুলো মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে রেখে দেওয়া হত তা বোঝা সহজ। সুতরাং এধরণের ঘটনার খবর বঙ্কিমচন্দ্রের অজানা ছিলনা। যাই হোক এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক, চৰ্চা ও অনুসন্ধান চলছে কারণ তিনি কোনো নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে যাননি। মালদহ কলেজের অধ্যাপিকা ডঃ দীপাঞ্জনা শর্মা এ বিষয়ে তাঁর খোঁজ ও পর্যালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মতে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ঘটনা । বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একজন অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ লেখক । 'বঙ্গীয় নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন' প্রবন্ধে তিনি নিজেই নিজের লিখনপদ্ধতির বিষয়ে লিখেছেন যে একটি লেখা প্রয়োজনে তিনি চার-পাঁচবার সংশোধন করেছেন বা নতুনভাবে লিখেছেন। নৈহাটির বঙ্কিম ভবনে 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটির মূল পাণ্ডুলিপি রাখা আছে। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকাতে প্রকাশিত যে 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটি তিনবার পুনর্লিখিত হয়। সেই পত্রিকাগুলোও সেখানে গচ্ছিত রয়েছে ।
(তথ্য সংগ্রাহক : কল্লোল মজুমদার )
বঙ্কিমচন্দ্র খুব অল্প সময় এই জেলায় ছিলেন ( ২৫শে অক্টোবর ১৮৭৪ -- ১৬ই জুন ১৮৭৫ )। তা সত্বেও বেশ কিছু সমৃদ্ধশালী লেখা তিনি এখানে বসেই লিখেছিলেন। মালদহে অবস্থানকালে তিনি যে সমস্ত রচনা প্রকাশ করেন, তার মধ্যে উল্লেখনীয় 'রজনী' উপন্যাসটি। এছাড়া, বিদ্রুপাত্মক ব্যঙ্গ কবিতা অধঃপতন, সঙ্গীত ও ভাই ভাই। প্রবন্ধের মধ্যে ভালোবাসার অত্যাচার, অনুকরন, কল্পতরু, জ্ঞান সম্বন্ধে দার্শনিক মত, কৃষ্ণচরিত, চন্দ্রলোক, ঋতুবর্নন, মিলভ্যার্বিন এবং হিন্দুধর্ম, শকুন্তলা মিরন্দা এবং দেসদিমনা, দ্রৌপদী, বাংলার ইতিহাস, গঙ্গে দেবপূজা, ও বৃত্রসংহার।
এগুলোর মধ্যে 'চন্দ্রলোক' ও 'গঙ্গে দেব পূজা' প্রকাশিত হয় 'ভ্রমর পত্রিকা'য়। উপন্যাস সহ বাকি রচনাগুলি প্রকাশিত হয় 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায়।
(তথ্যসূত্র : জানা অজানার মালদহ -- ওঙ্কার বন্দ্যোপাধ্যায়)
মালদহে অবস্থানকালে বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রচনাসকল :
'জানা অজানার মালদহ' বইটিতে উল্লেখিত বঙ্কিম রচনা বিষয়ে যা তথ্য দেওয়া আছে সেটা অনুসরণ করেই তথ্যগুলো এখানে তুলে ধরা হল :
১. 'রজনী' ( উপন্যাস ) প্রকাশিত হয় 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আশ্বিন থেকে চৈত্র ১২৮১ এবং বৈশাখ ১২৮২
( পুনরায় ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ন ১২৮২ বঙ্গাব্দ, মালদহ ছেড়ে চলে যাবার পর প্রকাশিত হয় । যদিও 'রজনী' পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রূপে প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে )।
২. 'অধঃপতন সংগীত' ( ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক কবিতা ) বঙ্গদর্শন, অগ্রহায়ন ১২৮১
৩. ভালোবাসার অত্যাচার ( সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধ ), বঙ্গদর্শন, অগ্রহায়ন ১২৮১
৪. গঙ্গে দেবপূজা ( ভ্রমর পত্রিকায় ১২৮১ সনের কার্তিক সংখ্যায় শ্রী স্বাক্ষরিত 'গঙ্গে দেবপূজা' নামে প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রতিবাদে লেখা ) ভ্রমর, অগ্রহায়ন, ১২৮১
৫. অনুকরণ ( রাজনারায়ণ বসু প্রনীত 'সেকাল ও একাল' গ্রন্থের সমালোচনা )
বঙ্গদর্শন, পৌষ ১২৮১
৬. কল্পতরু ( ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রনীত কল্পতরু গ্রন্থের সমালোচনা ) বঙ্গদর্শন, পৌষ ১২৮১
৭. বাঙ্গালার ইতিহাস ( রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় রচিত ( প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার গ্রন্থের সমালোচনা ) বঙ্গদর্শন, মাঘ ১২৮১
৮. বৃত্র সংহার ( কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ 'বৃত্র সংহার' এর সমালোচনা ) বঙ্গদর্শন, মাঘ-ফাল্গুন ১২৮১
৯. জ্ঞান সম্বন্ধে দার্শনিক মত ( যথার্থ জ্ঞানের উৎস নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ) বঙ্গদর্শন, ফাল্গুন ১২৮১
১০. ভাই ভাই ( ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক কবিতা ) বঙ্গদর্শন, চৈত্র ১২৮১
১১. কৃষ্ণচরিত ( অক্ষয় চন্দ্র সরকার ও সারদা চরণ সম্পাদিত প্রাচীন গ্রন্থের সমালোচনা ) বঙ্গদর্শন, চৈত্র ১২৮১
১২. চন্দ্রলোক ( বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ) ভ্রমর পত্রিকা, চৈত্র ১২৮১
১৩. ঋতুবর্ণন ( গঙ্গাচরণ সরকার প্রনীত 'ঋতুবর্ণন' কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা ) বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১২৮২
১৪. মিলভ্যার্বিন এবং হিন্দুধর্ম ( ত্রিদেব সম্পর্কে হিন্দুশাস্ত্র কী বলে সে বিষয়ে আলোচনা ) বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১২৮২
১৫. শকুন্তলা, মিরান্দা এবং দেসদিমোনা (
( শকুন্তলা, মিরান্দা এবং দেসদিমোনার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ) বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১২৮২
১৬. দ্রৌপদী ( দ্রৌপদীর চরিত্র নিয়ে আলোচনা ) বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১২৮২
এছাড়াও, দুটো চিঠি তিনি মালদহ থেকে লিখেছিলেন। একটি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে লেখা ( ইংরেজি তারিখ ১৫.১১.১৮৭৪ ) ও দ্বিতীয়টি চাঁচলের রাজা শরৎ রায় এস্টেটের ম্যানেজারকে রোড সংক্রান্ত বিষয়ে লেখা ( ইংরেজি তারিখ ২১.১১.১৮৭৪) পাওয়া যায়।
মালদহ শহরের কেন্দ্রবিন্দু পোস্ট অফিস মোড় বা ফোয়ারা মোড় থেকে তিনদিকে তিনটি রাস্তা ঘিরে রয়েছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামাঙ্কিত রাস্তা বা বাজারের নাম। পাশেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পৌরবাজার। উত্তর দিকের রাস্তা চলে গেছে নেতাজি মূর্তির পাশ দিয়ে নেতাজি সুভাষ রোড। পশ্চিমদিকের রাস্তাটির নাম রবীন্দ্র এভিনিউ, একধারে অর্থাৎ ওড়াল পুলের শুরুতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দন্ডায়মান এবং ওড়াল পুলের ওপর প্রান্তে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আবক্ষ মূর্তি । রাস্তাটি মিশেছে রথবাড়ি মোড় হয়ে রাজমহল রোডে। যার পাশেই নেতাজি কমার্শিয়াল মার্কেট।
দক্ষিণদিকের রাস্তাটি মকদমপুর রোড নামে পরিচিত যেটা গৌড়রোডে মিশেছে। পোস্ট অফিস মোড়েই রয়েছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর আবক্ষ মূর্তি। সেটাকে বাঁ হাতে রেখে কিছুটা এগোলে ডানদিকে অতুল কুমার স্মরণে 'অতুল মার্কেট'। জেলা শাসকের অফিস পেরিয়ে রাস্তার বাঁদিকে বৃন্দাবনী মাঠ, সেখানে বিরাজমান শ্রীচৈতন্যদেবের মূর্তি। পাশেই টাউন হলের সামনে গান্ধীমূর্তি। মকদমপুর রাস্তা ধরে সোজা দক্ষিনে এগিয়ে জলকল মোড়ের বাঁ হাতে শিব্রাম ভবন, তার সামনেই বিনয় সরকার অতিথি আবাস। সেই রাস্তাটি মিশেছে বাঁধরোডে। মোড়ে বিবেকানন্দ স্ট্যাচু। পাশেই সংগ্রহশালা ও জাতীয় গ্রন্থাগার। সামনেই রামকৃষ্ণ মিশন। ওদিকে যাবো না। আমরা মকদমপুর রোড ধরে চলেছি। ইতিমধ্যে আমরা পেরিয়ে এসেছি ডানদিকে নজরুল সরনী। আর একটু এগোবো। পর পর ডাক্তারের চেম্বার, নার্সিং হোম.. লোক গিজগজ করছে, বাজারও বসেছে। রোজকার শাক সবজি ফলমূলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। আর তারই মাঝে বাঁ হাতে রাস্তার ধারে 'সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের আবক্ষ মূর্তি'। এই জায়গাটি এখন 'বঙ্কিমচন্দ্র পৌর বাজার' নামেই পরিচিত। কেননা তাঁর মূর্তির সামনের বাড়িটাই ছিল তাঁর বাসস্থল যে বাড়িটা তখন ভাড়াবাড়ি হিসেবেই পরিচিত হত। অর্থাৎ যাঁরা সরকারী চাকরি নিয়ে মালদহে আসতেন তাঁদের অনেকে এখানে ভাড়া থাকতেন। বাড়িটার মালিকানা তখন যে কার ছিল ঠিক জানি না তবে এখন এই বাড়িটি চিকিৎসক নীলরতন সাহার। তাঁরা এই বাড়িটি ১৯৫৮ সালে কিনেছেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী বাড়িটি গৌড়ীয় ইট মানে ছোট ছোট ইট দিয়ে তৈরী ছিল। এখনও অনেক পুরোনো বাড়ি এরকম ইট দিয়ে তৈরী। এখন যেখানে বাজার বসে সেখানে একটি পুকুর ছিল আর এই বাড়িটির একটি ঘরে সাহিত্য সম্রাট থাকতেন। বাড়িটিতে দীর্ঘদিন বঙ্কিমচন্দ্রের একটি ছবি টাঙানো ছিল, এখন আর নেই।
উল্লেখ্য যে সেই সময় মালদহ জেলার শহরাঞ্চল এই এলাকা ঘিরেই ছিল। বর্তমানের ইংরেজ বাজার তখন রংরেজ বাজার নামে পরিচিত ছিল। যারা কাপড় রাঙাতো তাদের 'রংরেজ' বলা হত। তারও আগে মুসলিম আমলে এই জায়গার নাম ছিল ইঙ্গলেজাবাদ। মালদহ তখন রেশম শিল্প, মসলিন শিল্পের বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীতে নীল চাষের কারণে ইংরেজরা নীলকুঠি স্থাপন করেন। আর এই স্থলেই কিছুটা সময় কর্মসূত্রে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র কাটিয়ে গেছেন
(তথ্যসূত্র: মালদহ জেলার ইতিহাস চৰ্চা -- সুস্মিতা সোম )।
এইদিকেই ছিল সার্কিট হাউস, জাহাজবাড়ী.. যেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সহ বহু নামী অনামী ব্যক্তিবর্গ এসে সময় কাটিয়েছেন কাজের আছিলায়।
বহু স্মৃতি বিজড়িত জেলা মালদহ। বহু গুণীজনের পদধূলিতে সমৃদ্ধ। তাঁদেরই আশীর্বাদধন্য হয়ে কলমের আঁচড়ে তাঁদের স্মরণ করলাম।
-----------------------------------------------------------------
ঋণ স্বীকার :
•ওঙ্কার বন্দ্যোপাধ্যায়
•অধ্যাপিকা সুস্মিতা সোম
•অধ্যাপিকা দীপাঞ্জনা শর্মা
•কল্লোল মজুমদার
•চিকিৎসক নীলরতন সাহা
•উইকিপিডিয়া