"অম্লমধুর মক্সরা আর
মুক্ত হাস্যরস
তাতেও আছে
বাঙ্গালীদের বনেদি হাতযশ।"
---- কুমারেশ ঘোষ
হাসি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। হাসি মানসিক আনন্দময় অনুভূতির অভিব্যক্তি। মানুষ হাসতে পারে, হাসাতে পারে। আনন্দ অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য মানুষ হেসে থাকে। তবে প্রকৃত হাস্যরসিক যিনি, তিনি নিজে খুব কম হাসেন। ধারাপাত গম্ভীর মুখের মধ্যে থাকে অফুরন্ত হাসির ফল্গু ধারা। শরীর মন চাঙ্গা রাখার জন্য আজকাল অনেক জায়গায়"লাফিং ক্লাব" হয়েছে। সেখানে নিয়মিত প্রাণখোলা হাসির চর্চা হয়। সাধারণত প্রকৃত রসিক ব্যক্তি সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে থাকেন।
'হিউমার'কে বলা হয় করুণ হাস্যরস। এই হাসি মৃদু এবং অনুচ্চ। প্রকৃত হাস্যরস স্রষ্টা জীবনকে দূর থেকে দেখেন না, তিনি জীবনের মধ্যে প্রবেশ করে তার রস মর্ম দিয়ে গ্রহণ করেন। জীবনের প্রতি সংবেদনশীল দৃষ্টি, সকলের প্রতি উদার সমদর্শিতা চিন্তাশীলতার সঙ্গে আমোদ প্রিয়তার এক মিশ্রিত অনুভূতি হল হিউমারের বৈশিষ্ট্য। আর এক ধরনের হাস্যরস আছে, যারা আবেদন বুদ্ধিশীল মস্তিষ্কে।
ইংরেজিতে একেই বলে -- 'উইট'। যার বাংলা পরিভাষা হলো 'বৈদগ্ধ পূর্ণ হাস্যরস'। এই উইট জগত সঞ্জাত, সচেতন ও মননশীল।'হিউমার' অভিজ্ঞতার প্রকাশ, অন্যদিকে 'উইট' পাণ্ডিত্যের বিকাশ। রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের সাহিত্যে হিউমার এবং শেষ জীবনের সাহিত্যে উইটের নিদর্শন পাওয়া যায়। শেক্সপিয়রের নাটকে উইট এবং হিউমারের চমৎকার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান জগতে হৃদয়াবেগ অপেক্ষা বুদ্ধিবৃত্তির কদর বেশি। হাস্যরসের অন্য আর এক বিভাগ হলো --- 'ব্যঙ্গরস'। ইংরেজিতে কী বলা হয় 'স্যাটায়ার'। এই হাসি হাস্যরসের মধ্য দিয়ে আমাদের বিষণ্ন করে তোলে । ব্যঙ্গরসের মধ্যে উপহাসের জ্বালা নিদারুণ রূপে বিদ্যমান থাকে। ব্যঙ্গরস সমাজে যেখানে যত দোষ, যত ত্রুটি অসঙ্গতি, যত রোগ সঞ্চিত হয়ে আছে, সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে সেসব অনাবৃত করে।
বাংলা সাহিত্যে খাঁটি ব্যঙ্গ রচনা প্রবর্তক হলেন ভবানীচরণ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখা 'নববাবু বিলাস', 'নব বিবি বিলাস', নবদূতি বিলাস' বিশুদ্ধ ব্যঙ্গ সাহিত্যের নিদর্শন। আর এক প্রকারের হাস্যরস আছে, যাকে বলা হয় 'কৌতুক রস' বা ইংরেজিতে 'ফান'(Fun).
এটি হলো মানুষের স্বাভাবিক আমোদপ্রিয়তা। দীনবন্ধু মিত্রের 'জামাই বারিক' ও 'বিয়ে পাগল বুড়ো' কিংবা অমৃতলাল বসুর 'চাটুয্যে ও বাড়ুয্যে' ও 'তাজ্জব ব্যাপার'। পরশুরামের 'কজ্জলী' ও 'গড্ডালিকা' গল্পগুলি মনে পড়ে। সর্বপেক্ষা অধিক হাস্যরসের কবি হচ্ছেন ভারতচন্দ্র। তাঁর কবিতায় আদিরস ও হাস্যরসের গঙ্গা যমুনার সঙ্গম ঘটেছে। দেবতা ও মানুষ সকলের প্রতি তাঁর রঙ্গ ব্যঙ্গ বাক্য নিক্ষেপ করেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার মধ্যে হাস্যরসের স্নিগ্ধ ধারা প্রবাহিত হয়েছে। তাঁর রচনা বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায় উজ্জল। তাঁর শ্রেষ্ঠ হাস্যরসের রচনা হলো 'কমলাকান্তের দপ্তর'। হাসির গান লিখে যশস্বী হয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। রবীন্দ্র সাহিত্যেও হাস্যরসের মন্দাকিনী প্রবাহিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের হাস্যরসে প্রসন্ন আকাশের নির্মল সূর্য কিরণের মতো প্রদীপ্ত, শুভ্র ও নিষ্কলঙ্ক। বেদনার সঙ্গে হাস্যরসের মণিকাঞ্চন যোগ দেখা যায় শরৎসাহিত্যে। এছাড়াও, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশ চন্দ্র বসু, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, রাজ শেখর বসু, প্রমথনাথ বিশী, সৈয়দ মুজতবা আলী, দীনবন্ধু মিত্র, কুমারেশ ঘোষ এবং অতি অবশ্যই শিবরাম চক্রবর্তী, তারাপদ রায় ও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেকে বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট হাস্যরস পরিবেশন করেছেন।
বাংলা সাহিত্য হাস্যরসের উল্লেখযোগ্য আর একটি দিক হলো 'প্যারডি'। প্রাশ্চাত্য সাহিত্যের প্যারডি অতি প্রাচীন। কখনো রঙ্গ-কৌতুক, কখনো বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। কবিতার প্যারডির ক্ষেত্রে মূল কবিতাটি জানা না থাকলে মজাই মাটি। প্যারডি সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধের সন্ধান পেলাম, লিখেছিলেন -- সতীশ চন্দ্র ঘটক, শিবরাম চক্রবর্তী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, কবিশেখর কালিদাস রায়, পরিমল গোস্বামী, নলিনীকান্ত সরকার, চিত্তরঞ্জন লাহা ইত্যাদি আরো অনেকে। শ্রদ্ধেয় সতীশচন্দ্র ঘটকের লেখায় পড়লাম, তিনি লিখেছিলেন,"হাসির মর্যাদা হৃদয়াঙ্গম করিলে এ দেশের লোকে গাম্ভীর্যের সীলমোহর মরা মুখকে জ্ঞানের প্রতিমূর্তি মনে করিত না।" রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, "কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে, উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে।" প্যারডি আসলে পরাশ্রয়ী রচনা। অন্যের রচনা রূপটিকে অক্ষুন্ন রেখে ভাবটি হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া। শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন, 'হাসির হলেই তার খেলা হাসিল হয়।' এখানে একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক, প্রিয় পাঠকদের জন্য ------
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "বাংলার মাটি বাংলার জল" কবিতার অনুকরণে সতীশ চন্দ্র ঘটক লিখেছিলেন "বাংলার ঢেঁকি" -----
"বাংলার ঢেঁকি, বাংলার কুলো
বাংলার হাঁড়ি, বাংলার চুলো
পূজ্য হউক, পূজ্য হউক"বাংলার ঢেঁকি, বাংলার কুলো
বাংলার হাঁড়ি, বাংলার চুলো
পূজ্য হউক, পূজ্য হউক
পূজ্য হউক, হে ভগবান।
বাংলার টিকি, বাংলার কোঁচা
বাংলার কচু, বাংলার মোচা
দীর্ঘ হউক, দীর্ঘ হউক
দীর্ঘ হউক, হে ভগবান।"
পূজ্য হউক, হে ভগবান।
বাংলার টিকি, বাংলার কোঁচা
বাংলার কচু, বাংলার মোচা
দীর্ঘ হউক, দীর্ঘ হউক
দীর্ঘ হউক, হে ভগবান।"
অতুলপ্রসাদ সেনের "মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা"
গানটির অনুকরণে সুদর্শন চক্রবর্তী লিখেছিলেন ------
"মোদের গরব হায় বাংলা, ভাগ করে দেশ দুটি ফালা।
তোমার ছেলে তোমায় ভোলে, হয়েছে সব বোম্বেওলা।
কি জাদু হিন্দি গানে, নেই কোন তার মুন্ডু মানে।
গেয়ে গান ডিস্কো নাচে, গান শুনে কান কালাপালা।"
রবি ঠাকুরের একটি বিখ্যাত গান প্যারডি করেছিলেন সাহিত্যিক সরিৎ শেখর মজুমদার ----
"পরমায়ু ধায় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে
ওগো মেয়ে! নাওখানি বাইয়ো।
সংসারে ধরো হাল, বসে খাবে পিন্টু পাল,
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো।"
বঙ্কিমচন্দ্রের "বাবু" রচনা অনুকরণে কুমারেশ ঘোষ লিখেছিলেন "মস্তান"।
এছাড়াও কুমারেশ ঘোষ বিবেকানন্দের "হে ভারত ভুলিও না" ,
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত "শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা" রচনার
প্যারডি করেছিলেন।
একটা সময়, বাংলা গানেরও প্যারডি
জনপ্রিয় ছিল। সেইসব প্যারডি গুলো ছিল শ্লীল, শুদ্ধ এবং উজ্জল হাস্যরসে পরিপূর্ণ । অহেতুক ভাড়ামি ও নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ অশ্লীলতা তাতে থাকতো না।
ভূপেন হাজারিকার একটি বিখ্যাত গানের প্যারডি এখানে তুলে ধরলাম -----
"আমি এক নিশাচর।
প্রণয়িনী আমারে আদর করেছে
ভুলেও হয়নি বর।
তাই আমি নিশাচর।
আমি ভাঙ্গার থেকে মামীর ভারী হয়ে
সুরমার মুখ দেখেছি।
আমি আনিপুর থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে
মরিশাসের মূলো খেয়েছি।
আমি ইলোরা হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে
স্ট্রং হয়ে সিঙ্গাপুর শহরে গিয়েছি।
কপালের ফের, কুমিল্লায় বিয়ে
পুলিশের গল্লা খেয়েছি।
মাইকেলের সমাধিতে বসে
নজরুলের কথা ভেবেছি।
বারে বারে প্রেমের টানেই
পথকেই করেছি ঘ-অ-অ-র
তাই আমি নিশাচর।"
=========================
ঋণ স্বীকার :---
(১) 'যষ্টিমধু' ১৪০১ প্যারডি সংখ্যা।
(২) 'বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা'---
ড: অজিতকুমার ঘোষ।
(৩) ভূপেন হাজারিকার গানের প্যারডি --- কল্যান দেশমুখ্য।
(৪) বিশেষ কৃতজ্ঞতা--- কল্যান দেশমুখ্য।
_______________________________
লিখেছেন ---- সৌম্য ঘোষ। পোঃ চুঁচুড়া। জেলা: হুগলী।
__________________________________________
_______________________________