গল্প ।। নাটক ।। চন্দন মিত্র
প্রতি বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফেরার সময় শোভন পাড়ার মোড়টা খুব সঙ্গোপনে পার হয়। আসলে সে ভয় পায় যদি রমেশ তাকে দেখে ফেলে। বৃহস্পতিবার বাজার বন্ধ থাকায় রমেশ সকাল থেকেই মোড়ের চা-দোকানে ঠেক মারতে শুরু করে, সন্ধ্যায় সেখানেই সে মদের আসর বসায়। সচেষ্ট হয়েও সব বৃহস্পতিবার শোভন রমেশকে এড়াতে পারে না। যেদিন রমেশ তাকে ধরে ফেলে সেদিন আর শোভনের অস্বস্তির শেষ থাকে না। প্রথমে রমেশ তার দু-হাত ধরে মিনিট খানেক কাঁদবে, তারপর বলবে, বন্ধু বেশি না এক পেগ নে, তুই তো জানিস আমি পিওর ভদকা ছাড়া অন্য কিছুই ছুঁই না। তোর প্রিয় ব্র্যান্ডই আছে। শোভন একটু খেঁকিয়ে উঠে বলবে, রমেশ একেবারে বাড়াবাড়ি করবি না। তুই ভালো করে জানিস আমি ওসব অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এবার রমেশ অনুনয় করবে, তাহলে বন্ধু এই সিগারেটটা একটু প্রসাদ করে দে। শোভন এবারও যথারীতি একটু ধমক মারবে। রমেশ এবার মোক্ষম ও বহু ব্যবহৃত অস্ত্রটি ছাড়বে, ' ঠিক আছে বন্ধু, তুই বেশিদিন বাঁচতে চাস তাই তো, আমি তোর মতো বাঁচার কাঙাল নই ; এই পৃথিবী থেকে মানে মানে কেটে যেতে পারলে বাঁচি।' শোভন বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে খিস্তি দেবে, শালা নাটকবাজ, দোকানে বসলে নিজের বাপকেও চেনে না ! লাখ লাখ টাকার লেনদেন...
রমেশের দোষ নেই শোভন আসলে নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছে। পাড়ার ছেলে ও সহপাঠী হওয়ার সুবাদে একসময় রমেশের সঙ্গে তার নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। সঙ্গদোষ হোক বা নিজের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য হোক কৈশোরে শোভন রমেশের সঙ্গে বিড়ি-সিগারেট, মদ-গাঁজা ইত্যাদি বেশ উপভোগ করেছে। তারপর একদা সম্বিৎ ফিরতে সে বুঝেছে রমেশের পাল্লায় পড়ে ভেসে গেলে চলবে না। রমেশের বাবার ব্যবসা আছে, টাকার অভাব নেই। কিন্তু তার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিলে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হবে। শোভন নিজেকে শুধরে নেয়। কলেজে ঢোকার পর আক্ষরিক অর্থেই সে শোভন হয়ে ওঠে। তার সহপাঠীরাও অবাক হয়ে যায় তার পরিবর্তন দেখে। রমেশ অবশ্য কলেজে পৌঁছাতে পারেনি। বেশ কয়েকটি বিষয়ে ফেল করে সে পৈতৃক মুদিখানার গদিতে বেশ আয়েশ করে বসে যায়। বছর দুয়েক পরে সশব্দে ও সসৌরভে তার বিয়ের ফুলটি প্রস্ফুটিত হয়।
শোভন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পড়তে চাকরির পরীক্ষায় বসার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে। শিকে সহজে ছেঁড়ে না। সেও হাল ছাড়বার পাত্রটি নয়। অবশেষে বাবার রিটায়ারমেন্টের বছরেই সে সরকারি চাকুরের মহার্ঘ্য তকমাটি ছিনিয়ে নেয়। এতদিন যারা তাকে কোনো ব্যাপারেই গুরুত্ব দিত না, সেই তারাই এখন তাকে সমীহ করে চলে। অবশ্য পিছনে ঠিক তার উলটো আচরণই করে, ঈর্ষায়-মাৎসর্যে। চাকরি পাওয়ার পর থেকে শোভন যেন রমেশের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। তাকে অপদস্থ করার জন্য রমেশের এই তৎপরতা শোভনকে ব্যথিত করে। অথচ রমেশই একসময় ছিল তার প্রাণের বন্ধু। তবে কী রমেশ তাকে দেখে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে ? তা কেন হবে ! রমেশের তো টাকার অভাব নেই ! নাকি রমেশের মনে হয় যথেষ্ট টাকাপয়সা থাকা সত্ত্বেও তার বাবার মতো সেও যথেষ্ট সামাজিক সম্মান পায় না ! শোভন অতটা তলিয়ে ভাবতে চায় না। তার ভাবার মতো বিষয়ের অভাব নেই। বাড়িতে ফেরার পরেও অফিসের বেশ কিছু হিসাবপত্তর নিয়ে তাকে বসতে হয়।
বৃহস্পতিবারগুলোর জন্য রমেশ যেন মুখিয়ে থাকে। সন্ধ্যাবেলা মোড়ের মাথায় অফিস-ফেরতা শোভনকে ধরে সে এমন ধানাইপানাই করে যে, তামাশা দেখার জন্য লোক জমে যায়। নিতান্ত নিরীহ ও ভদ্র শোভনকে অপদস্থ হতে দেখে লোকজন মজা পায়, কেমন যেন অশ্লীল কৌতুক অনুভব করে মনে মনে। রমেশ উপসংহার টেনে যখন বলে ' ঠিক আছে বন্ধু, যা তুই বেশিদিন বাঁচতে চাস তাই তো, আমি তোর মতো বাঁচার কাঙাল নই ; এই পৃথিবী থেকে মানে মানে কেটে যেতে পারলে বাঁচি।' শোভন বুঝে যায় এবার সে অব্যাহতি পাবে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রমেশের এই ভাঁড়ামি সে একদিন ঘোচাবেই, তাতে যদি তাকে দু-চারদিন অফিস কামাই করতে হয় তাও আচ্ছা।
রমেশ অবাক হয়ে গেল, সূর্য কী আজ পশ্চিমে উঠল নাকি ! সকাল সকাল শোভন এসেছে চায়ের ঠেকে। সে সহাস্যে জানায়, কীরে বন্ধু আমার না-হয় বৃহস্পতিবারের জন্য দোকান বন্ধ, তোর আবার কী হল।
—আজ একটু ছুটি করলাম বুঝলি। তারপর রমেশের কানে কানে বলে, শোন না, আজ বাড়িতে কেউ নেই। সন্ধ্যায় এদিকের প্রোগ্রামটা বাতিল করে দে। আমিই সব আয়োজন করব, হ্যাঁ আমাদের প্রিয় ব্র্যান্ডের ভদকাই থাকবে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে শোভন শোনে, রমেশ উচ্চকিত কণ্ঠে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জানিয়ে দিচ্ছে— শোন আজ সন্ধ্যাবেলায় আমার একটু কাজ পড়ে গেছে, আজকের প্রোগ্রাম বাতিল।
রমেশ সন্ধ্যার একটু আগেই শোভনের বাড়িতে পৌঁছায়। সত্যিই শোভনের বাড়িতে কেউ নেই। শোভন কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল, রমেশকে দেখে ফোন রেখে দেয়। বাইরের গেট এতক্ষণ খোলাই ছিল, রমেশ ভিতরে ঢোকার পরে শোভন গ্রিলে তালা মেরে চাবিটা নিজের পকেটে ঢোকায়। রমেশ দেখে ডাইনিং টেবিলে শোভন সমস্ত সরঞ্জাম সাজিয়ে রেখেছে। প্রিয় ব্র্যান্ডের ভদকার বোতল, সোডা ওয়াটার, সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, ফলের ট্রে। শোভন একটা সিগারেট ধরায়, রমেশও। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শোভন বলে, দ্যাখ বন্ধু এতদিন তুই বলতিস আমি বাঁচার কাঙাল ; আমি প্রতিবাদ করতাম না। কারণ সত্যিই আমি বেশিদিন বাঁচতে চাইতাম। কিন্তু কালকে আমার সঙ্গে যা হয়েছে তাতে আমার বাঁচার ইচ্ছাটাই শেষ হয়ে গেছে। আজ আমিও তোর মতো পৃথিবীর মায়া কাটাতে চাই !
রমেশ অবাক হয়ে জানতে চায়, কেন কী এমন হল বন্ধু ?
—কী আবার হবে। বাবা-মার সঙ্গে তিতলির মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছে। দুপক্ষই আমাকে দোষারোপ করছে। আমি কার পক্ষ নিই বলত ! কাল দুপুরে মেয়েকে নিয়ে তিতলি বাপের বাড়ি চলে গেছে। বলে গেছে সে আর কোনোদিনই আমার মুখ দেখবে না। অশান্তির জেরে মা-বাবা গিয়ে উঠেছে মামার বাড়িতে। কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি, কিছু খাওয়াও হয়নি। কাল রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। সে জন্যই তোকে ডাকা।
রমেশ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না শোভন আসলে কী বলতে চাচ্ছে। সে আরও একটা সিগারেট ধরায়।
শোভন দুটো সুদৃশ্য কাচের গেলাসে ভদকা ঢালে। তারপর টেবিলের তলা থেকে একটি ঈষৎ হলুদ রঙের তরলভরা বোতল বের করে খুব সাবধানে দুই গেলাসে ঢেলে নেয়। গেলাস দুটি কানায়কানায় ভরে ওঠে। গ্লাস থেকে ধোঁয়া ওঠে।
রমেশ বলে, সোডা না-দিয়ে গেলাসে কী মেশালি শোভন ?
শোভনের মুখে মৃদু হাসি। সে বলে, অমৃত বন্ধু অমৃত ! এইচ-এন-ও-থ্রি; মানে পিওর নাইট্রিক অ্যাসিড। দুবন্ধু এই দু গেলাস মেরে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে একেবারে পরলোকে, যেখানে আর মৃত্যুর ভয় নেই, সাংসারিক ঝুট-ঝামেলা নেই।
রমেশ ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে বলে, তার মানে তুই আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি এঁটেছিস ? তুই না আমার বন্ধু !
শোভন ভিজে গলায় বলে, আমাকে তুই এমন কথা বলতে পারলি ! আমি না তোর বন্ধু ! তোকে আমি দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চাইছি। তোর তো বাঁচার ইচ্ছা নেই। এখন আমারও নেই। আমরা দুজনেই তো মরতে চাই। আর আমি সেই ব্যবস্থাটাই করেছি নিখুঁতভাবে। দুজনে সুন্দরভাবে মরে যাব। প্রতিদিন তিলে তিলে মরার চেয়ে এই ব্যবস্থা ভালো নয় বন্ধু ! এইজন্য গ্রিলে চাবি দিয়েছি। আমরা চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে দিলেও কেউ ভিতরে ঢুকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। মিনিট দশেক একটু যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে এই যা।
—না, আমি মরতে চাই না। আর্তনাদ করে ওঠে রমেশ। আমার বউ-ছেলে আছে, ব্যবসা আছে। তুই আমাকে মুক্তি দে শোভন, আমি বাঁচতে চাই। রমেশ শোভনের দুই হাত ধরে কেঁদে ফেলে।
—তবে তুই যে কথায় কথায় বিজ্ঞাপন দিস তুই নাকি বাঁচার কাঙাল নোস। আর আমার মতো যারা নেশা করে না তাদের তুই বেশিদিন বাঁচতে চায় বলে খিল্লি করিস !
—শোভন, আমি মদ ছাড়তে পারব না। তুই ছাড়তে পেরেছিস দেখে আমার হিংসা হয়। আমি চেয়েছি তুইও আমার মতো মাতাল হ, যাতে কেউ আমার একার দিকে আঙুল তুলতে না-পারে।
শোভন নির্বিকারভাবে একটি গেলাস হাতে নিয়ে রমেশের দিকে এগিয়ে দেয়। রমেশের হাত কাঁপতে থাকে। চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
================চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা)
ডায়মন্ড হারবার
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা