আজ একফোঁটাও বৃষ্টি নেই। আকাশের আদিম অন্ধকার কেটে গিয়ে পুব দিকে উষার আলো, সাতঘোড়ায় ছুটে আসেন রবিদেব। আকাশপারের দূর দিগন্তে চলে যান ক্রমে ক্রমে। এভাবেই কেটে যায় একটা দিন, একেকটা মাস, বছরগুলোও ছুটে চলে।
শাস্ত্রে সূর্যের কথা অনেক আছে। সূর্য প্রসব করেন একেকটা দিন। তাই তিনি সবিতা। তবে তিনি নক্ষত্রপতি একেশ্বর সম্রাটও বটে।
বিশ্বম্ভর লেখনী টেনে নেন। মস্যাধারের নবসঞ্চিত শ্যামমেঘের মতো সান্দ্র মসিতে প্রলিপ্ত করে লেখনী রাখেন মাতৃকায়। পাণ্ডুলিপির পাতা ক্রমশ পূর্ণ হয়ে ওঠে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে।
প্রাত্যহিক অভ্যাসের চর্বিতচর্বণে মন ভরে না তাঁর। ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেনে নেন একটি রক্তবস্ত্রাবৃত পাণ্ডুলিপি। কাঠের পাটার নিচে তাড়পত্রের নিপুণ বিন্যাস। নিটোল মুক্তাক্ষরে শিল্পিত ছন্দে পূর্ণ একেকটি পাতা। পূর্ণঘট। পুথিটি রঘুবংশের। রঘুবংশের রাজা দিলীপ সূর্যসম্ভূত এক বংশে পবিত্র চন্দ্রসুধার মতো আবির্ভূত হলেন।
অভ্যুদয়ে এঁরা উল্লাসহীন, দুঃখে নিরুত্তাপ, সুখে নিস্পৃহ, জ্ঞান তাঁদের টলায় না, পৃথিবীকে অটল রাখেন তাঁরা মেরুপর্বতের মতো।
আজ ন্যায়দর্শনের যুক্তিজালে বিরাগ জন্মেছে খানিক। উত্তরমীমাংসার তত্ত্ব, আন্বীক্ষিকী ও ত্রয়ীর আলোচনায় মন বসছে না। কী এক প্রহেলিকা, কী এক অমোঘ টান যুক্তিকে ছিন্ন করে বিশ্বাসকে আশ্রয় করতে চায়। উত্তুঙ্গ শাস্ত্রমহিমা, মুক্তির পথে
উচ্চকিত ধর্মঘোষ যুগে যুগে অধ্যাত্মমার্গে যে ভেরীবাদ্যের ধ্বনির মায়ায় সাধককে পীড়িত করে বৃহত্কে বরাবর সঙ্কুচিত করে কুক্ষিগত করতে চায়, সেখানে মহাজনতার প্লাবনস্রোতের সমুদ্রনাদ কোথায়?
ভক্তি যুগযুগান্তের মহাজাড্যের পাষাণতলে আনবে জলকল্লোলের ধারা, শুষ্কতার উপলবেলায় জাগবে নির্ঝরের মহাধ্বনি, আদিম বিশুষ্ক দুরতিক্রম্য দুর্গম ক্ষুরধার রুধিরপ্লাবিত পথকে নিমেষে করবে মহাসড়ক রাজপথ। সমবেত জনতা উদগ্র আবেগে ছুটে চলবে শরীররথে ভর করে। সাধারণের দুরধিগম্য তর্কজাল নয়, বন্ধন-মুক্তির অনিঃশেষ টানাপোড়েন নয়, ভক্তির টান-ই অসাধ্যসাধন করবে। শ্রীক্ষেত্র নীলাচল বড় টানছে আজ।
রঘুবংশের পাতা উল্টে চলেন নিমাই। শাস্ত্র যাঁদের শাসনের আশ্রয়, সূর্যের মতোই যাঁরা সন্তপ্ত করেন, নিঃশেষে দগ্ধ করেন নিজের প্রতাপে, রবি যেমন ধরার বুকের অমৃতবারি শোষণ করেন, আবার সহস্রগুণে ফিরিয়ে দেন মুষলধারে, ষষ্ঠাংশবৃত্তি রাজাও কর নেবেন, তারপর ফিরিয়ে দেবেন মানুষের মাঝে। কল্যাণকামী রাষ্ট্র শেষপর্যন্ত মানুষের কথা বলবে।
সেই মুণ্ডিতমস্তক দীপ্যমান নবীন তরুণ পাশে থাকা স্তূপীকৃত তাড়পত্রের মাতৃকাগুলির দিকে চেয়ে দেখেন। মনুস্মৃতি, অর্থশাস্ত্র, শুক্রনীতির নীচে থেকে একটি সদ্যকৃত শূন্য পুথি উঁকি দেয়। সদ্যপাতীঃ মেঘের মতো নির্ভার তার প্রথম পাতে সুছাঁদ অক্ষরে লেখা ইষ্টদেবের নাম। ইচ্ছা আছে, নীলাচলপতির মাহাত্ম্যে তাকে ভরিয়ে তুলবেন।
প্রভু জগন্নাথের নাম
গেয়ে চলি অবিরাম
মদনমোহন ঘনশ্যাম।
যে স্মরে তাহার ধাম
পুরায় মনস্কাম
প্রণমি তাহারে বারেবার
আজি বন্দি নাথ হে
তোমার চরণে শোভে
ভক্ত বৈষ্ণবের অহংকার।
চারপাশে বিবর্ণ বহুচর্চিত মাতৃকা, ইদানীং রাজনীতিশাস্ত্র আলোচনা করেছেন খানিক। তিনি দেখেছেন, ধর্মশাস্ত্রে ধর্মের আদর্শ অবিসংবাদী, তাই ধর্মশাস্ত্রের প্রেরণা ভাববাদী, অর্থশাস্ত্র সেদিক দিয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী বটে। রাজার উত্তুঙ্গ মহিমা ভূমি, কোশ আর বলের অধীন। দিলীপ-রঘু-দশরথ তো আর এই কলিকালের মানুষ নন, ত্রেতায় রাজা ঈশ্বরতুল্য, ধুলো-মাটির পৃথিবীতে থেকেও তিনি অনভিগম্য, অধৃষ্য। আর করুণাবর্ষী রবিদেবের মতো কখনও সন্তাপক, কখনও পরম আকাঙ্ক্ষিত।
আষাঢ়ের আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা। তবু দ্বিপ্রহরে রবির তেজ মর্মভেদী। কখনও তা ক্ষণকালের জন্য ম্রিয়মাণ হয়ে দ্বিগুণ দর্পে পরমুহূর্তেই ব্রহ্মতালু উত্তপ্ত করে। কিন্তু এখন বিশ্রাম নাস্তি। যে মহাসমুদ্রে তিনি ভেলা ভাসিয়েছেন, তার কোনও এক উপকূলে তাঁর সার্থক বাণীকে যতক্ষণ না তিনি পৌঁছে দিতে পারবেন, শান্তি নেই।
নীলাচল বড় টানছে যে।
একটি নৌকার পত্রাবরণের অন্তরাল থেকে সেই সুদর্শন সদ্যযুবা সন্ন্যাসী বেরিয়ে আসেন। যেন পর্বতশিখরে বালসূর্যের বিচ্ছুরণ, যেন অমিতদ্যুতি ভানুর আসন্ন মঙ্গলময় প্রকাশে বিধৌত হয় দিব্যলোক। এখন দ্বিপ্রহর। মাথার উপর সূর্য অগ্নিবর্ষণ করছে। ভাবালু আয়ত চোখে চেয়ে দেখেন চতুর্দিকে। আদিগঙ্গার পথে দিবারাত্র পণ্যবাহী নৌযান আর ভড়ের আনাগোনা। তীরে তীরে শ্যামল তৃণভূমি, কখনও সমৃদ্ধ জনপদ। বেতোড়ের পথ বেয়ে কালীক্ষেত্র হয়ে এখন যেখানে নৌকা থেমেছে, সেখানে চারপাশে আদিমদ্রুমের বিপুল সমাহার, উচ্চকায় উন্নত জবার ঝোপ, করবীর দুর্ভেদ্য বেড়াজাল। সর্বত্র আগাছার বাড়বাড়ন্ত। অকৃত্রিম আদিম এক সৌন্দর্য, জঙ্গলের পথে সূর্যের আলো অপ্রতুল। কিন্তু পাশেই বহতা গঙ্গার বুকে একপাশে ছায়াশীতল শান্তি, অন্যদিকে দ্বিপ্রাহরিক আলোকরাশি আর তাপ।
সেই সুদর্শন সন্ন্যাসীকে দেখে আশপাশের নৌকা থেকে কিছু কৌতূহলী মুখ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। এরা বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যবসায়ী। এই পথে নিত্য যাতায়াত এদের। এই স্থান বিশেষ সুবিধা নয়। কাছেই শ্মশানভূমি। তার উপর ডাকাতের আস্তানা। জলপথ ছেড়ে পথে নামাই দায়। এখানে এমন বিসদৃশ দৃশ্য অদূর অতীতে দেখেনি কেউ। সুদূর নদিয়া জেলা থেকে এক মুণ্ডিতকেশ সংসারবিবাগী তরুণ চলেছেন শ্রীক্ষেত্রে, এই পথে। ইনি মহাপণ্ডিত। অথচ দেহে অহংকারের লেশমাত্র নেই। উন্নতকায়, দীর্ঘবাহু, গৌরবর্ণ এই নবীনের পূর্বাশ্রমের নাম বিশ্বম্ভর। সকলে নিমাই পণ্ডিত বলে ডাকেন। যারা একদেশ থেকে অন্য দেশে কর্মসূত্রে যাতায়াত করে, তারা জানে শ্রীচৈতন্যদেব কলিযুগের অবতার। তিনি লোকপ্রিয়, মৃদুভাষী, মধুর বচনে আপ্যায়িত করতে করতে তাঁর ঐ আয়ত দুটি আঁখির মায়াময় অমোঘ টান নিঃশেষে ভুলিয়ে দেয় সকল শোক, শরীরে বুলিয়ে দেয় যেন চামরব্যজন, স্নাত করে পূতঃ বারিধারায়,সকল দুঃখের পরপারে থাকা অমৃত আনন্দ যেন স্বয়ং তিনি। সকল কণ্টক মোচন করে তিনি ফুল ফোটাবেন, এ বিশ্বাসে শ্রান্ত মন দুখের পরপারে অমৃতনিষ্যন্দী দিব্য কোন্ চেতনার মর্মরধ্বনি শুনতে পায়। কিন্তু এখানে জনপদবাসীর অধিকাংশই অজ্ঞানাচ্ছন্ন। ক্ষুত্কাতর। এতকথা তারা জানে না।
গৌরাঙ্গের আবির্ভাবে ব্যস্ত হয়ে পাশের নৌকা থেকে দুই নবীন শিষ্য উঠে আসে। গৌরাঙ্গ ইতঃস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বলেন, "গঙ্গার জল বড় ই উষ্ণ। কোথায় শরীরের শ্রান্তি লাঘব হয়? সুশীতল পবিত্রবারির জলাশয় আছে কোথাও"?
এক শিষ্য বলে, "গুরুদেব, গতকাল আমি সন্ধান করে কিঞ্চিৎ দূরে একটি পবিত্র জলাশয়ের কথা শুনলাম। স্থানটি বটচ্ছায়ায় সুশীতল, পুষ্করিণীর জল অহোরাত্র-ই হিমস্পর্শী ও সুভগ। কিন্তু পথটি দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ, উপরন্তু তস্করকবলিত"। গৌরাঙ্গের ঠোঁটে ঈষত্ হাস্য সঞ্চারিত হয়। তিনি বলেন, "দুর্দমকে শান্ত, দুর্গমকে সুগম, অধৃষ্যকে আপন করে নিতে না পারলে এ মনুষ্যজন্মের সার্থকতা কোথায়? আমাকে পথ দেখাও"।
ছায়ানিবিড় শ্যামঘন পুষ্পবাটিকার মধ্যে হিমশীতল দূরবিসারী জলরাশি, পদ্মদীঘী। এখন কমলদলের সমাহার নেই, শারদরজনীতে পূর্ণচন্দ্রের মায়াময় জ্যোত্স্নায় কোজাগরীর দিনে এ স্থানে স্বর্গ নেমে আসে। শ্রীচৈতন্য পদার্পণমাত্রেই মনে মনে শিহরিত হলেন। এই অপরাহ্নের দাবদাহে শীতল জলের মেদুর-মদির স্পর্শসুখ, এই মনোলোভা বৃক্ষবাটিকা, এই অঙ্গ অবশ করা মন্দানিল, এই শ্যামকান্তি নিবিড় ছায়ায় ঢাকা একচিলতে মরুদ্যান দেখে ভাবাবেশে আকুল হলেন যুগপুরুষ। তারপর নেমে গেলেন ধীর পদক্ষেপে, গভীর থেকে গভীরতর শ্যামঘন জলরাশির পানে। আহা! নীলাচল যে বড় আকুল করলো গো। ওগো শ্যাম, তোমার মধুর বংশীর ধ্বনি আমার কানে, প্রাণে-মনে যে কুহুতান তুলছে অহর্নিশ, তার বিপুল রব, তার চিত্তহারী আহ্বান দুর্নিবার খরস্রোতে বইছে আর সকল বন্ধন, সকল জাড্যকে মুহূর্তে নিঃশেষে বিখণ্ডিত করছে বারংবার। আহা!
গভীর জলে আজানুলম্বিত বাহুযুগল দ্রুতছন্দে সঞ্চালন করে সাঁতরে চলেন ইতঃস্ততঃ।
চারিদিকের সকল বন্ধদ্বার যেন একে একে খুলে যায়।
ডুবসাঁতারে দীঘী পারাপার করেন বারকয়েক।
যেন সকল সদ্যোন্মুক্ত দ্বারপথে অনন্তবায় বয়ে আসে।
পরিতৃপ্তচিত্তে ক্রমে উঠে আসেন সিক্তবসনে, পারের তৃণাচ্ছাদিত সান্দ্র মৃত্তিকার বুকে পদপাত করেন।
সকল ভববন্ধন, সকল দীনতা, কলুষের স্তরীভূত আঁধার যেন প্রবল আর্তরবে ভেঙে ভেঙে পড়ে অনৈসর্গিক দিব্য আলোক যেন ঘিরে ধরে চারপাশ।
হে হরি, হে বহুব্যাপক বিষ্ণু, হে অনন্ত, হে আনন্দ, হে সচ্চিদানন্দস্বরূপ! ভক্তির আনন্দপ্লাবন তোলো এই ভারতভূমে, হে পরমেশ! লঘুস্রাবী ক্ষীণতোয়া ঝর্ণাধারাকে, অন্তরের অচিন কূলে বয়ে চলা আনন্দের ফলল্গুধারাস্রোতকে বন্ধনমুক্ত করো, খরস্রোতে বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে নিঃশেষে বাহিত করো উষ্ণ শোণিতধারা, অঝোরবর্ষণ করো হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে, বিপুল ভক্তিস্রোতে, অনিঃশেষ কল্লোলে পূর্ণ হোক মুখরিত হোক মনের গোপন কোণ।
ধীরে ধীরে আকাশ ঢেকে আসে পুঞ্জীভূত গহন কালো আঁধারে, মন্দানিল দ্রুত হয়, শ্যাম মেঘের কোলে ঝিলিক দেয় হীরকদ্যুতি বজ্র, তালিবনের মর্মর রব দ্রুত হয়, আমের বনে, জামের বনে, পনসশাখায়, বেল-জুঁইএর ঝোপে ঝোপে দীর্ঘ দহনবেলার আর্তি, ক্ষোভবিহ্বল শ্রান্ত দিনের হাহাকার যেন মূর্তিমতী বারিধারা হয়ে ঝরে পড়ে বিন্দু-বিন্দুতে। বৃক্ষশাখার আন্দোলন তীব্রতর হয়, নারিকেলের বনে বনে দারুণ ক্ষোভে ধেয়ে চলে বাদল হাওয়া। ক্রমে ক্রমে অনন্ত বর্ষণে প্লাবিত হতে থাকে দিগ্বিদিক। সিক্ত কচুর পাতায় পাতায় ঝরে পড়ে বারিধারা অমৃতবিন্দুর মতো।
********************************
তখন বৃষ্টি ধরে গেছে। সিক্ত পত্ররাজি থেকে ঝরে পড়ছে শেষ জলবিন্দু। স্নাত হংসের মেদুর ডানার মতো বৃহত্ গজপিপুলের ঝাড় থেকে সুখস্বপ্নের মতো ঝরে পড়ে জলবিন্দু। কাজল মেঘের শ্যামল ছায়া ঢেকে রেখেছে ধরণীকে। বায়ুর শীতস্পর্শে শিহরণ জাগে। কদম্বের কেশর আসন্ন শুভ পরিপূর্ণতার প্রস্তুতি নেয়।
সন্ধ্যা আসন্নপ্রায়। দ্রুত পদসঞ্চারে সপার্ষদ গঙ্গার পানে ফিরে আসছেন চৈতন্যদেব। আজ তাঁর মনোলোক কোন্ এক অজানার আহ্বানে, কোন্ এক আকাঙ্ক্ষিতের পুলকে রোমাঞ্চিত, কোন্ এক নবীন অনুভূতি, যাকে এতদিন খুঁজে ফিরেছেন পাগলপ্রায়, সে কি আজ দিল ধরা?
নীলাচলের শ্যামঘন কোন্ এক দীর্ঘছায়ার চৌম্বকপ্রায় আকর্ষণ পথ ভোলাচ্ছে।
ঘন বনের কোণে কোণে শীতল হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে। ঘনায়মান আষাঢ়সন্ধ্যায় দীর্ঘ বিলীয়মান বৃক্ষের শ্রেণী ভেদ করে এক দীর্ঘকায় মনুষ্যছায়া আবির্ভূত হয়। মাথায় কেশদাম, কষ্টিপাথরে কোঁদা যমমূর্তির মতো বিভীষিকাবাহী
এক ভয়াল-করালছায়া পথরোধ করে দাঁড়ায়। হৃদ্বিদারী হুংকারে হাতের তৈলমর্দিত বংশদণ্ডটি এগিয়ে ধরে বলে ওঠে, "প্রাণে বাঁচতে চাস তো দিয়ে দে সব"।
মহাভয় শিষ্যদুটির কণ্ঠরোধ করে ধরে। পাথেয় যা কিছু সামান্য, তা নৌকায় সঞ্চিত আছে। এখন প্রাণসংশয়, এখানের মাটির অগভীরে রাশি রাশি পথিকের শব, করোটি, কঙ্কালের হাড় প্রথিত আছে। রাত্রির অন্তরালে অশরীরীর করুণ হৃদয়ভেদী ক্রন্দন দূরের শ্মশানবায়ুর উগ্রতায় মিশে ভস্মবাহী হয়ে আকস্মিক হাস্যরোলে ছুটে যায় অরণ্যের গভীরতর প্রদেশে। আকস্মিক বিপদপাতে হত হতভাগ্যের অতৃপ্ত আত্মার দুরপনেয় আকাঙ্ক্ষার স্রোত যেন কালচক্রের ঘূর্ণিপাকে জর্জরিত হতে হতে উদগ্র আবেগে সংসারপানে ছুটে যেতে চায়।
অনিন্দ্যকান্তি সেই যুবক সন্ন্যাসীকে দেখে দস্যুর ওষ্ঠে বক্র ক্রূর হাসি ফুটে ওঠে। শ্রীচৈতন্য মৃদু হাস্যে বলেন, "তোমায় যা দিতে পারি তা বহনের শক্তি কি তোমার আছে?"
দস্যুর চোখ রত্নরাজির লোভে চকচক করে ওঠে। কোন্ সম্পদ আছে এর কাছে?"
কর্কশস্বরে তর্জন করে ওঠে সে। "কী আছে তোর কাছে? কে তুই"?
শিষ্য রঘুনাথ আহত ব্যাঘ্রের মতো চিৎকার করে ওঠে, "দুবৃত্ত! বাক্-সম্বরণ করো। তোর ওই পাপমুখে শ্রীচৈতন্যদেবের নিন্দা করলে বাকরোধ হবে রে পাতক। যে নাম ভজলে জীব সংসার পারে যায়, তাকে অসম্মান করিস"!
দস্যুর কোনও ভাবান্তর দেখা যায় না। মহাপ্রভু বলে ওঠেন, "রঘুনাথ! যে মানুষ অজ্ঞানের আবরণে আচ্ছাদিত, যে নিদ্রিত, যে প্রকৃত-ই দীনাতিদীন, মৃত সে জন কেমন করে অনন্তের মহাসঙ্গীত শুনবে? সংসারের পঙ্কিল কল্মষে যে নিমজ্জিত একমাত্র হরিনামেই তার উদ্ধার। ওরে! তুই একবার বল হরি, জগতের নাথ, আমাকে জাগাও"।
মরণ যে জন করেছে বরণ, হে প্রভু তাকে বাঁচাও।
দস্যু বিরক্তমুখে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল। এবার তার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এই পথিক সন্ন্যাসীদের কাছে কানাকড়িও নেই তা সে বুঝেছে তা বলে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত তার কাছ থেকে বেঁচে কেউ ফেরেনি। ভীম খড়্গ উত্তোলন করে সে হেঁকে ওঠে।
মহাপ্রভু স্মিত হেসে বলেন, "অক্রূর, তোমার এ ক্রূরতা কেন"?
চমৎকৃত হয়ে তস্কর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে আগন্তুককে। তার পিতৃদত্ত এ নাম কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আজ সে শুধুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাধাই ডাকাত। মাধাই ডাকাতের নামে শিশু ভূমিষ্ঠ হতে ভয় পায়, সদ্যোজাত শিশুর ক্রন্দনরব মূক হয়ে যায় তার না শ্রবণে। আর এ কোন্ আশ্চর্য মানুষ তার সামনে অনায়াসে দাঁড়িয়ে বাক্যাঘাতে তাকে থামিয়ে দিল?
"তুমি জানলে কি করে এই নাম? এ তো তোমার জানার কথা নয়!!!"
স্খলিতস্বরে বলে ওঠে দস্যু সর্দার।
"তোমার এ বহুসঞ্চিত পাপভার লাঘব করবে কী করে মাধাই? অগণ্য নিরপরাধ মানুষের রক্তে রাঙা ঐ হাত, ঐ শাণিত কৃপাণ, ঐ লুণ্ঠিত ধনভার তোমাকে অহর্নিশ যে অনন্ত অতলে নিয়ে যাচ্ছে, তার থেকে মুক্তি পাবে"?
"মুক্তি?? হেঁকে ওঠে মাধাই, "কে চায় মুক্তি" বলে সে, "জগত্ আমার পায়ে লুটায়, জাগতিক কোনও চাহিদাই আমার অপূর্ণ নেই, কামিনী-কাঞ্চনের চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত আর কী হতে পারে?" সংশয়দীর্ণ কণ্ঠে বলে সে।
"তোমার পুত্র তো ভবিষ্যতে এই হীনবৃত্তি গ্রহণ করে পাপভারে আকীর্ণ হবে। পিতা হয়ে পুত্রকে মৃত্যু ব্যতীত আর কী দিতে পারবে তুমি?"
চমৎকৃত হয়ে দস্যু মাধাই তাকায় ঐ আয়ত দুই মর্মভেদী অতল আঁখি দুটির পানে। কী শান্তি ঐ চোখে। ক্রমে তার মুখে নেমে আসে শ্রাবণের কাজল মেঘের আঁধার। এই আগন্তুক কী করে জানছে তার সব কথা।
"পুত্র!!"
পথপ্রান্তের প্রস্তরবেদীমূলে বসে পড়ে সে। স্খলিত স্বরে বলে চলে মাধাই। তার বালক পুত্র গত চার বত্সর অশক্ত জীবন্মৃত হয়ে শয্যালীন। গোবিন্দপুর থেকে সুন্দরবনের বাঘা বাঘা হাকিম-কবিরাজরা রোগনির্ণয় করতে পারেনি। তবু সে কী যাদুবলে বেঁচে আছে, বলা কঠিন।
"অবশেষে হালিশহরের এক ধন্বন্তরির সন্ধান পেলাম। আমার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। সেই বৃদ্ধকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে নিয়ে আসতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করিনি। কিন্তু সেই খট্টারূঢ় ব্যাটাকে অন্তর্জলি করতে হয়েছে। আমার ছেলেটা বুঝি…"
"তোমার পাপেই তোমার সন্তান আজ মরতে বসেছে। তুমি সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ ত্যাগ করেছো। নিয়তি তোমাকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে"।
"মানি না নিয়তি" লাফিয়ে উঠে হাত চেপে ধরে আকর্ষণ করে মাধাই।
"চলো, নিজের চোখে দেখবে, তুমি যদি আমার সন্তানের জীবন দান করতে পারো, তোমাকে সসম্মানে মুক্তি দেব। আর যদি না পারো, তাহলে তোমার প্রতি বাক্যের মূল্য শোধ করতে হবে তোমায়। জীবন দিয়ে"।
"তোমার সন্তানকে জীবন দিতে পারেন একমাত্র জগত্পতি পরমেশ্বর। তাঁকে স্মরণ করো। তাঁর পায়ে শুভ-অশুভ সকল কর্মফল অর্পণ করো। তিনি তোমাকে পথ দেখাবেন"।
"এসব কথায় আমার কাজ নেই। তুমি আমার সঙ্গে চলো"।
একটি নিষ্প্রদীপ কক্ষে প্রবেশ করে দীপ জ্বেলে দেয় মাধাই। তার পরিজন, অনুচররা ভীড় করে থাকে দ্বারপ্রান্তে। এই দীর্ঘবাহু মুণ্ডিতকেশ স্বয়ংপ্রভ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে তাদের মনে সম্ভ্রম জেগে উঠেছে।
প্রজ্জ্বলিত দীপালোকে নিমাই দেখলেন, শয্যায় মৃতপ্রায় এক বালক, তার দেহ শোণিতহীন পাণ্ডু, তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ, ওষ্ঠ কালিমালিপ্ত, কোটরগত নেত্রযুগলের তলে দীর্ঘ রোগভোগের চিহ্ন। বালকটি নিদ্রিত অথবা নির্জীব।
নিমাই মহাপ্রভু ধীরে ধীরে বালকের কপাল স্পর্শ করে শিহরিত হলেন। প্রবল দাহজ্বর। ধীরে ধীরে মাথায় করসঞ্চালন করেন। মুখে ধীরস্বরে কিছু বলেন। শোনা যায় না। তারপর বালকটির বিশীর্ণ মুখপানে দৃকপাত করে ইষ্টনাম স্মরণ করে করে ধীরে ধীরে কক্ষ পরিত্যাগ করেন।
*********************************
আরেকটি উজ্জ্বল সকাল। আদিগঙ্গার বুকে মঝিমাল্লার হাঁকডাক, বণিকের ব্যস্ত আসা-যাওয়া। গঙ্গার তীরে বিপণিতে নিত্যদ্রব্যের সম্ভার। হাঁড়ি-কলসি নিয়ে ছোট ছোট ভড় ইতঃস্ততঃ আসে যায়। খড়-বিচালি গবাদি পশু নিয়ে অপেক্ষাকৃত বড় নৌকাগুলি কিছু ভিড়েছে ঘাটে, কিছু আবার স্থানাভাবে আদিগঙ্গার বুকে ভাসমান। সুদূর চক্রতীর্থ থেকে একদল পুণ্যার্থী কালিক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছিল। তারা যাবে আরও পশ্চিমে। ঘাটের সোপানশ্রেণীতে মগ্ন এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে কৌতূহল ও সম্ভ্রমে তারা তাকিয়ে ছিল আর অনুচ্চস্বরে আলাপ করছিল।
রঘুনাথ ও রামতনু এসব-ই দেখছিল ঘাটে বসে। প্রাতঃকালে দধি ও উৎকৃষ্ট চিপিটক সহযোগে ফলার সম্পন্ন করে তারা খানিক জিরোচ্ছে। এখান থেকে আগামিকাল পুনরায় যাত্রারম্ভ হবে। নৌকার মাঝিরা তাই মহাব্যস্ত। এরপর জল বাড়বে, নৌকায় বিন্দুমাত্র ছিদ্র থাকলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
মহাপ্রভুর এসব দিকে কোনও লক্ষ্য নেই। তাঁর মানসলোকে শ্যামঘন যে দূরলোকের বংশীধ্বনি অহরহ ধ্বনিত হচ্ছে, তার মধুর অনুরণন তাঁর মস্তিষ্ক ও হৃদয়কে আপ্লুত করছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নীলাচলের দিকে।
আকাশে মেদুর মেঘের আনাগোনা। প্রভাতবেলার খররৌদ্র শ্যামকান্তি মেঘের অন্তরালে বিলীন হয়। বায়ুর শৈত্য স্পর্শ করে যায় মর্মস্থল।
আদিগঙ্গার বুকে ব্যস্তজীবনযাত্রা মুহূর্তে শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
মঝিমাল্লা আর বণিকের দল আবরক পট নিয়ে বিপণি আর পণ্যের সম্ভার ঢাকা দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আকাশ আষাঢ়ের আকস্মিক বাদলমেঘে সমাচ্ছন্ন। প্রায়ান্ধকার এই প্রাতঃকালে নবীন মেঘের দল হস্তিযূথের মতো মত্ত তাণ্ডবে ঝাঁপিয়ে নামে আদিগঙ্গার বুকে। তাদের শ্যামকান্তি ধারাপ্রপাত হয়ে নামে তীরবর্তী ধুতুরার ঝোপে, বনচম্পার দল তীব্র আশ্লেষে দোলে, শ্যামের ঝুলনদোলার মতো। পক্ব কদমের রেণু বয়ে আনে সুগন্ধ, অদূরে দেবমন্দিরে বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি, নিত্যপূজার পুষ্পরাশির সুগন্ধ বাদলবায়ুতে মেশে। অনুপম সুগন্ধ ছড়ায় অগুরু-গুগগুলের ধূম্রজাল, বনটিয়ার ঝাঁক সোল্লাসে ডেকে ওঠে, নবীনা বর্ষা তার সকল গন্ধ ও রূপ নিয়ে আমোদিত করে, রসসিক্ত করে প্রান্তর-অরণ্যানী-হৃদকন্দর।
মহাপ্রভু পরমানন্দে দুই হাত উত্তোলিত করে শ্যামনামে বিভোর হন, রামতনু নৌকা থেকে মৃদঙ্গ এনে বাদ্যধ্বনিতে মুখর করে তোলে। অন্যান্য নৌকা থেকে সকল বৈষ্ণব হরিধ্বনি করে সেদিন মর্ত্যের বুকে নামিয়ে আনে স্বর্গীয় আনন্দধারা। তাদের দুই নয়নে অশ্রান্ত অশ্রুধারা দরদর বেগে নামে, গঙ্গার বুকে ভাসমান নৌবহর থেকে কৌতূহলী যাত্রীর দল সেই বৃন্দনৃত্যের মধ্যমণি উদ্বাহু বিভোর তরুণ যুবাকে দেখে বিস্ময়াঘাতে হতবাক হয়।
মধ্যাহ্নে পদ্মদিঘীর কপোতাক্ষ জলে অবগাহন করলেন মহাপ্রভু। আকাশ আজ মেদুর সঘন। দিঘীর পাড়ে পাড়ে মধ্যদিনের ম্রিয়মাণ আলোয় বনপুষ্পের বিচিত্র বর্ণ ভবনশিখি-র পেখমের মতো ভাস্বর, দীঘির জলে পানকৌড়ির ছায়া আন্দোলিত হয়, দূরে দিগন্তবিসারী শস্যক্ষেত্রে আলোর নাচন, আষাঢ়দিনের স্পর্শে জেগে ওঠা কোমল পত্রপল্লবে বাদলপোকার আলোড়ন, নাগচম্পায় ভ্রমরের কলরোল…. চারিদিকে এক মধুর প্রশান্তি। এ বিশ্ব মধুময়, এই বায়ু, এই তরঙ্গভঙ্গ, এই বৃক্ষরাজি সকলই মধুক্ষরা। এই নদী মধুমতী। জগত্-জীবনে অনন্ত মধু, যা কিছু প্রত্যক্ষগ্রাহ্য সকলই মধুময়, বিষ্ণুর পদক্ষেপে মধুর স্থান। সে বড়ই রহস্যঘন, গোপনীয়। তাকে জানা যায় নিজেকে জানার পথেই, আত্মানং বিদ্ধি।
নীলাচল টানছে যে বড়।
শীতল জলে অঙ্গমার্জনা করে দৈব আনন্দে উদ্বেল হলেন মহাপ্রভু। এ স্থানটি বড়ই মনোরম ও পবিত্র। নীলাচল থেকে প্রত্যাগমনকালে এই স্থানটিতে পুনরায় রাত্রিবাস করবেন, মনস্থ করেন মহাপ্রভু।
মুহূর্তে মনে হয়, ঘনশ্যাম পীতবাস বংশী মধুরতানে হাতছানি দেন, কখনও কুরুক্ষেত্রে, কখনও যমুনাতটে, কখনও দ্বারকা-মথুরায়, কখনও নীলাচলে শ্যাম গানে গানে প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবার্তা শোনান। "রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব"
আহা!! নীলাচল কী মায়াবী টানে ডাকে গো!
"ঈশাবাস্যং জগত্ সর্বম্"….
সর্বব্যাপক বিষ্ণুর মায়ার জালে এ জীবন পদ্মপাতায় জলের মতো টলটলায়, তা ক্ষণিক, জীর্ণবসনের মতো এই শরীর ছেড়ে যে আত্মা অপর দেহরথ খুঁজে নেবে, সে তো পরমাত্মার আংশিক প্রকাশমাত্র। অহং কেবল জীবকে স্বরূপোপলব্ধিতে বাধা দেয়, মায়ার বশবর্তী জীব ভেদবুদ্ধির শিকার হয়। হে হরি! হে দয়াময়! নিখিল আশ্রয় হে দীনবন্ধু! হে কমলাক্ষ! এ ধরাপানে চাও।
চিন্তাহরণের চরণকমলে সকল চিন্তা সঁপে দিলেও চিন্তামণি চিন্তা দেন। তাই বাধা পড়ে চিন্তাস্রোতে।
জবার ঝোপের অন্তরাল থেকে অকস্মাত্ আবির্ভূত হয় গতকালের সেই করাল মূর্তি। মাধাই ডাকাত ত্বরিতে মহাপ্রভুর চরণযুগল জড়িয়ে ধরে আছড়ে পড়ে। কিছু বোঝার আগেই অশ্রুধারায় ধুইয়ে দিতে থাকে প্রভুর পদযুগল।
"ওঠো, ওঠো মাধাই! পা ছাড়ো!!"
"না প্রভু!! আপনার চরণে শরণাগত আমি, আমি আপনার শিষ্য হওয়ার যোগ্য নই। আমি মন্ত্রহীন, অভাজন। আমার মুক্তি নেই। অনন্ত নরক আমার অপেক্ষায়। আমার কর্মফল আমি ভোগ করব ঠাকুর। আমার ছেলেটাকে আপনি রক্ষা করেছেন। ওর প্রাণ আপনারই দান। কাল যে ছেলের প্রাণসংশয় ছিল, আজ দীর্ঘ চারবছরের পর সে পথ্য পেয়েছে। আজ প্রথম দিন, যেদিন ওর জ্বর নেই… ঠাকুর তুমি আমার ছেলেকে নবজীবন দিয়েছো। আমি মরতে ভয় পাইনা ঠাকুর, জানি, আমার পাপের ক্ষমা নেই। তুমি আমায় শাস্তি দাও ঠাকুর"। ভেঙে পড়ে দস্যুসর্দার।
"ইষ্ট নাম জপ করো। যে নামে জগত্ উদ্ধার পায়, সেই জগত্তারণকে স্মরণ করো, তিনি তোমায় উদ্ধার করেছেন পাপের পঙ্কিল আবর্ত থেকে। তুমি আত্মোপলব্ধি করেছো। তোমার অনুতাপ তোমাকে দগ্ধ করে নিখাদ করেছে। আজ থেকে তুমি পরম বৈষ্ণব। জগত্স্বামীর দাস তুমি। তোমার হাতেই উদ্ধার পাবে পতিতের দল, তোমার মুখেই তাঁর নাম সহস্রধারে ছড়িয়ে পড়ুক"।
আদিগঙ্গার বহমান স্রোতধারায় জীবন-মরণের সীমাহীন আনন্দছন্দ জেগেছে। পূর্ণিমার জোয়ারের টান জেগেছে নদীখাতে। আকাশে নভশ্চর বিখণ্ডিত মেঘমালা। শ্যামসমান মরণ বুঝি আজ জীবনতরীর কর্ণধার, গঙ্গার জলে বেগ বাড়ে, তরঙ্গভঙ্গে দোদুল্যমান নৌবহর, ছোট ছোট ভড় আর ডিঙিনৌকাগুলি তিরতির করে কাঁপে শীতার্ত পক্ষিশাবকের মতো। কোনও কোনও ছিপ নৌকো জোয়ারের তাড়নায় মুমুক্ষু সাধকের মতো বাঁধন ছেঁড়ে। কোনওটা বা সংসারতরঙ্গে দুলতে থাকে খড়কুটোর মতো। ভেসে যাওয়ার অপেক্ষায়।
আজ বুঝি বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে।
মহাপ্রভু নৌকায় চড়ে বসেন সপার্ষদ। জোয়ারের টানে এখনই এ নাও দরিয়া বেয়ে গ্রন্থিচ্ছেদ করে ছুটবে জোয়ারের বেগে। তবুও কোথাও বন্ধনহীন গ্রন্থি থেকে যায় বুঝি? তা না হলে আজ ঘাটে অশ্রুসজল এরা কারা? মাধাই ডাকাতকে এমন শিশুর মতো আকুল সুরে কাঁদতে দেখেছে কেউ?
নেমে আসেন গৌরাঙ্গ।
মাধাই বলে "প্রভু! এরা তোমার দাস। এতদিন পরের দ্রব্য লুঠেছে। আজ এই মুহূর্তে সকল অস্ত্র আমরা এই গাঙের জলে দিলাম। আমরা মন্ত্রহীন। আমাদের কী হবে প্রভু?"
স্মিতসজলহাস্যে আপ্যায়িত করে নিমাই বলেন "তোমরা প্রকৃত বৈষ্ণব। অহংমুক্ত হয়েছো আজ থেকে। জানবে জীবের মাঝেই তাঁকে পাবে। তোমাতেই তাঁর অধিষ্ঠান। বাসনামুক্ত হলে জীব তাঁকে পায়। তাঁকে পেলে আর পাওয়ার কিছু থাকে না, শুভমস্তু"।
মাধাই বলে "প্রভু, একটি নিবেদন ছিল। আপনার পদধূলিধন্য এই ভূমি। আমার একান্ত মনোবাসনা এই যে, ফেরার পথে কিছুদিন এখানে আপনার অধিষ্ঠান হয়, আপনাকে ধরে রাখি সে সাধ্য কই? একটা কিছু দেন যদি তো বুকে আঁকড়ে রাখি"।
নিমাই পণ্ডিত হেসে বলেন, "নীলাচল ডাকছে বড়। ফেরার কালে এখানে কাটাই কিছুদিন, ঐ পদ্মদীঘির কোলে বসে শ্যামনাম গাই, এ বড় সাধ। প্রভু যদি চান, হবে"।
নিমাই পণ্ডিত নৌকায় উঠে একটি রক্তবর্ণ পুথি নিয়ে আসেন। মাধাই-এর হাতে দিয়ে বলেন, এ আমার একান্ত নিজের। নীলাচলপতির নাম গেয়ে রচতে শুরু করেছিলাম। পদকটি আমার স্মরণে আছে। তুমি এটা রাখো। পরম ভক্তিভরে তাঁকে ডেকো। তিনি জগদগুরু। তিনি কল্যাণ করবেন"।
জগন্নাথস্বামি! নয়নপথগামি! ভবতু মে।
আজ একফোঁটাও বৃষ্টি নেই।
আকাশের আদিম অন্ধকার কেটে গিয়ে পুব দিকে উষার আলো, সাতঘোড়ায় ছুটে আসেন
রবিদেব। আকাশপারের দূর দিগন্তে চলে যান ক্রমে ক্রমে। এভাবেই কেটে যায় একটা
দিন, একেকটা মাস, বছরগুলোও ছুটে চলে।
শাস্ত্রে সূর্যের কথা অনেক আছে। সূর্য প্রসব করেন একেকটা দিন। তাই তিনি সবিতা। তবে তিনি নক্ষত্রপতি একেশ্বর সম্রাটও বটে।
বিশ্বম্ভর
লেখনী টেনে নেন। মস্যাধারের নবসঞ্চিত শ্যামমেঘের মতো সান্দ্র মসিতে
প্রলিপ্ত করে লেখনী রাখেন মাতৃকায়। পাণ্ডুলিপির পাতা ক্রমশ পূর্ণ হয়ে ওঠে
তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে।
প্রাত্যহিক
অভ্যাসের চর্বিতচর্বণে মন ভরে না তাঁর। ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেনে
নেন একটি রক্তবস্ত্রাবৃত পাণ্ডুলিপি। কাঠের পাটার নিচে তাড়পত্রের নিপুণ
বিন্যাস। নিটোল মুক্তাক্ষরে শিল্পিত ছন্দে পূর্ণ একেকটি পাতা। পূর্ণঘট।
পুথিটি রঘুবংশের। রঘুবংশের রাজা দিলীপ সূর্যসম্ভূত এক বংশে পবিত্র
চন্দ্রসুধার মতো আবির্ভূত হলেন।
অভ্যুদয়ে এঁরা উল্লাসহীন, দুঃখে নিরুত্তাপ, সুখে নিস্পৃহ, জ্ঞান তাঁদের টলায় না, পৃথিবীকে অটল রাখেন তাঁরা মেরুপর্বতের মতো।
আজ
ন্যায়দর্শনের যুক্তিজালে বিরাগ জন্মেছে খানিক। উত্তরমীমাংসার তত্ত্ব,
আন্বীক্ষিকী ও ত্রয়ীর আলোচনায় মন বসছে না। কী এক প্রহেলিকা, কী এক অমোঘ
টান যুক্তিকে ছিন্ন করে বিশ্বাসকে আশ্রয় করতে চায়। উত্তুঙ্গ
শাস্ত্রমহিমা, মুক্তির পথে
উচ্চকিত
ধর্মঘোষ যুগে যুগে অধ্যাত্মমার্গে যে ভেরীবাদ্যের ধ্বনির মায়ায় সাধককে
পীড়িত করে বৃহত্কে বরাবর সঙ্কুচিত করে কুক্ষিগত করতে চায়, সেখানে
মহাজনতার প্লাবনস্রোতের সমুদ্রনাদ কোথায়?
ভক্তি
যুগযুগান্তের মহাজাড্যের পাষাণতলে আনবে জলকল্লোলের ধারা, শুষ্কতার
উপলবেলায় জাগবে নির্ঝরের মহাধ্বনি, আদিম বিশুষ্ক দুরতিক্রম্য দুর্গম
ক্ষুরধার রুধিরপ্লাবিত পথকে নিমেষে করবে মহাসড়ক রাজপথ। সমবেত জনতা উদগ্র
আবেগে ছুটে চলবে শরীররথে ভর করে। সাধারণের দুরধিগম্য তর্কজাল নয়,
বন্ধন-মুক্তির অনিঃশেষ টানাপোড়েন নয়, ভক্তির টান-ই অসাধ্যসাধন করবে।
শ্রীক্ষেত্র নীলাচল বড় টানছে আজ।
রঘুবংশের
পাতা উল্টে চলেন নিমাই। শাস্ত্র যাঁদের শাসনের আশ্রয়, সূর্যের মতোই যাঁরা
সন্তপ্ত করেন, নিঃশেষে দগ্ধ করেন নিজের প্রতাপে, রবি যেমন ধরার বুকের
অমৃতবারি শোষণ করেন, আবার সহস্রগুণে ফিরিয়ে দেন মুষলধারে, ষষ্ঠাংশবৃত্তি
রাজাও কর নেবেন, তারপর ফিরিয়ে দেবেন মানুষের মাঝে। কল্যাণকামী রাষ্ট্র
শেষপর্যন্ত মানুষের কথা বলবে।
সেই
মুণ্ডিতমস্তক দীপ্যমান নবীন তরুণ পাশে থাকা স্তূপীকৃত তাড়পত্রের
মাতৃকাগুলির দিকে চেয়ে দেখেন। মনুস্মৃতি, অর্থশাস্ত্র, শুক্রনীতির নীচে
থেকে একটি সদ্যকৃত শূন্য পুথি উঁকি দেয়। সদ্যপাতীঃ মেঘের মতো নির্ভার তার
প্রথম পাতে সুছাঁদ অক্ষরে লেখা ইষ্টদেবের নাম। ইচ্ছা আছে, নীলাচলপতির
মাহাত্ম্যে তাকে ভরিয়ে তুলবেন।
প্রভু জগন্নাথের নাম
গেয়ে চলি অবিরাম
মদনমোহন ঘনশ্যাম।
যে স্মরে তাহার ধাম
পুরায় মনস্কাম
প্রণমি তাহারে বারেবার
আজি বন্দি নাথ হে
তোমার চরণে শোভে
ভক্ত বৈষ্ণবের অহংকার।
চারপাশে
বিবর্ণ বহুচর্চিত মাতৃকা, ইদানীং রাজনীতিশাস্ত্র আলোচনা করেছেন খানিক।
তিনি দেখেছেন, ধর্মশাস্ত্রে ধর্মের আদর্শ অবিসংবাদী, তাই ধর্মশাস্ত্রের
প্রেরণা ভাববাদী, অর্থশাস্ত্র সেদিক দিয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী বটে। রাজার
উত্তুঙ্গ মহিমা ভূমি, কোশ আর বলের অধীন। দিলীপ-রঘু-দশরথ তো আর এই কলিকালের
মানুষ নন, ত্রেতায় রাজা ঈশ্বরতুল্য, ধুলো-মাটির পৃথিবীতে থেকেও তিনি
অনভিগম্য, অধৃষ্য। আর করুণাবর্ষী রবিদেবের মতো কখনও সন্তাপক, কখনও পরম
আকাঙ্ক্ষিত।
আষাঢ়ের
আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা। তবু দ্বিপ্রহরে রবির তেজ মর্মভেদী।
কখনও তা ক্ষণকালের জন্য ম্রিয়মাণ হয়ে দ্বিগুণ দর্পে পরমুহূর্তেই
ব্রহ্মতালু উত্তপ্ত করে। কিন্তু এখন বিশ্রাম নাস্তি। যে মহাসমুদ্রে তিনি
ভেলা ভাসিয়েছেন, তার কোনও এক উপকূলে তাঁর সার্থক বাণীকে যতক্ষণ না তিনি
পৌঁছে দিতে পারবেন, শান্তি নেই।
নীলাচল বড় টানছে যে।
একটি
নৌকার পত্রাবরণের অন্তরাল থেকে সেই সুদর্শন সদ্যযুবা সন্ন্যাসী বেরিয়ে
আসেন। যেন পর্বতশিখরে বালসূর্যের বিচ্ছুরণ, যেন অমিতদ্যুতি ভানুর আসন্ন
মঙ্গলময় প্রকাশে বিধৌত হয় দিব্যলোক। এখন দ্বিপ্রহর। মাথার উপর সূর্য
অগ্নিবর্ষণ করছে। ভাবালু আয়ত চোখে চেয়ে দেখেন চতুর্দিকে। আদিগঙ্গার পথে
দিবারাত্র পণ্যবাহী নৌযান আর ভড়ের আনাগোনা। তীরে তীরে শ্যামল তৃণভূমি,
কখনও সমৃদ্ধ জনপদ। বেতোড়ের পথ বেয়ে কালীক্ষেত্র হয়ে এখন যেখানে নৌকা
থেমেছে, সেখানে চারপাশে আদিমদ্রুমের বিপুল সমাহার, উচ্চকায় উন্নত জবার
ঝোপ, করবীর দুর্ভেদ্য বেড়াজাল। সর্বত্র আগাছার বাড়বাড়ন্ত। অকৃত্রিম আদিম
এক সৌন্দর্য, জঙ্গলের পথে সূর্যের আলো অপ্রতুল। কিন্তু পাশেই বহতা গঙ্গার
বুকে একপাশে ছায়াশীতল শান্তি, অন্যদিকে দ্বিপ্রাহরিক আলোকরাশি আর তাপ।
সেই
সুদর্শন সন্ন্যাসীকে দেখে আশপাশের নৌকা থেকে কিছু কৌতূহলী মুখ বিস্ময়ে
চেয়ে থাকে। এরা বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যবসায়ী। এই পথে নিত্য যাতায়াত এদের।
এই স্থান বিশেষ সুবিধা নয়। কাছেই শ্মশানভূমি। তার উপর ডাকাতের আস্তানা।
জলপথ ছেড়ে পথে নামাই দায়। এখানে এমন বিসদৃশ দৃশ্য অদূর অতীতে দেখেনি কেউ।
সুদূর নদিয়া জেলা থেকে এক মুণ্ডিতকেশ সংসারবিবাগী তরুণ চলেছেন
শ্রীক্ষেত্রে, এই পথে। ইনি মহাপণ্ডিত। অথচ দেহে অহংকারের লেশমাত্র নেই।
উন্নতকায়, দীর্ঘবাহু, গৌরবর্ণ এই নবীনের পূর্বাশ্রমের নাম বিশ্বম্ভর। সকলে
নিমাই পণ্ডিত বলে ডাকেন। যারা একদেশ থেকে অন্য দেশে কর্মসূত্রে যাতায়াত
করে, তারা জানে শ্রীচৈতন্যদেব কলিযুগের অবতার। তিনি লোকপ্রিয়, মৃদুভাষী,
মধুর বচনে আপ্যায়িত করতে করতে তাঁর ঐ আয়ত দুটি আঁখির মায়াময় অমোঘ টান
নিঃশেষে ভুলিয়ে দেয় সকল শোক, শরীরে বুলিয়ে দেয় যেন চামরব্যজন, স্নাত
করে পূতঃ বারিধারায়,সকল দুঃখের পরপারে থাকা অমৃত আনন্দ যেন স্বয়ং তিনি।
সকল কণ্টক মোচন করে তিনি ফুল ফোটাবেন, এ বিশ্বাসে শ্রান্ত মন দুখের পরপারে
অমৃতনিষ্যন্দী দিব্য কোন্ চেতনার মর্মরধ্বনি শুনতে পায়। কিন্তু এখানে
জনপদবাসীর অধিকাংশই অজ্ঞানাচ্ছন্ন। ক্ষুত্কাতর। এতকথা তারা জানে না।
গৌরাঙ্গের
আবির্ভাবে ব্যস্ত হয়ে পাশের নৌকা থেকে দুই নবীন শিষ্য উঠে আসে। গৌরাঙ্গ
ইতঃস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বলেন, "গঙ্গার জল বড় ই উষ্ণ। কোথায় শরীরের
শ্রান্তি লাঘব হয়? সুশীতল পবিত্রবারির জলাশয় আছে কোথাও"?
এক
শিষ্য বলে, "গুরুদেব, গতকাল আমি সন্ধান করে কিঞ্চিৎ দূরে একটি পবিত্র
জলাশয়ের কথা শুনলাম। স্থানটি বটচ্ছায়ায় সুশীতল, পুষ্করিণীর জল
অহোরাত্র-ই হিমস্পর্শী ও সুভগ। কিন্তু পথটি দুর্গম জঙ্গলাকীর্ণ, উপরন্তু
তস্করকবলিত"। গৌরাঙ্গের ঠোঁটে ঈষত্ হাস্য সঞ্চারিত হয়। তিনি বলেন,
"দুর্দমকে শান্ত, দুর্গমকে সুগম, অধৃষ্যকে আপন করে নিতে না পারলে এ
মনুষ্যজন্মের সার্থকতা কোথায়? আমাকে পথ দেখাও"।
ছায়ানিবিড়
শ্যামঘন পুষ্পবাটিকার মধ্যে হিমশীতল দূরবিসারী জলরাশি, পদ্মদীঘী। এখন
কমলদলের সমাহার নেই, শারদরজনীতে পূর্ণচন্দ্রের মায়াময় জ্যোত্স্নায়
কোজাগরীর দিনে এ স্থানে স্বর্গ নেমে আসে। শ্রীচৈতন্য পদার্পণমাত্রেই মনে
মনে শিহরিত হলেন। এই অপরাহ্নের দাবদাহে শীতল জলের মেদুর-মদির স্পর্শসুখ, এই
মনোলোভা বৃক্ষবাটিকা, এই অঙ্গ অবশ করা মন্দানিল, এই শ্যামকান্তি নিবিড়
ছায়ায় ঢাকা একচিলতে মরুদ্যান দেখে ভাবাবেশে আকুল হলেন যুগপুরুষ। তারপর
নেমে গেলেন ধীর পদক্ষেপে, গভীর থেকে গভীরতর শ্যামঘন জলরাশির পানে। আহা!
নীলাচল যে বড় আকুল করলো গো। ওগো শ্যাম, তোমার মধুর বংশীর ধ্বনি আমার কানে,
প্রাণে-মনে যে কুহুতান তুলছে অহর্নিশ, তার বিপুল রব, তার চিত্তহারী আহ্বান
দুর্নিবার খরস্রোতে বইছে আর সকল বন্ধন, সকল জাড্যকে মুহূর্তে নিঃশেষে
বিখণ্ডিত করছে বারংবার। আহা!
গভীর জলে আজানুলম্বিত বাহুযুগল দ্রুতছন্দে সঞ্চালন করে সাঁতরে চলেন ইতঃস্ততঃ।
চারিদিকের সকল বন্ধদ্বার যেন একে একে খুলে যায়।
ডুবসাঁতারে দীঘী পারাপার করেন বারকয়েক।
যেন সকল সদ্যোন্মুক্ত দ্বারপথে অনন্তবায় বয়ে আসে।
পরিতৃপ্তচিত্তে ক্রমে উঠে আসেন সিক্তবসনে, পারের তৃণাচ্ছাদিত সান্দ্র মৃত্তিকার বুকে পদপাত করেন।
সকল ভববন্ধন, সকল দীনতা, কলুষের স্তরীভূত আঁধার যেন প্রবল আর্তরবে ভেঙে ভেঙে পড়ে অনৈসর্গিক দিব্য আলোক যেন ঘিরে ধরে চারপাশ।
হে
হরি, হে বহুব্যাপক বিষ্ণু, হে অনন্ত, হে আনন্দ, হে সচ্চিদানন্দস্বরূপ!
ভক্তির আনন্দপ্লাবন তোলো এই ভারতভূমে, হে পরমেশ! লঘুস্রাবী ক্ষীণতোয়া
ঝর্ণাধারাকে, অন্তরের অচিন কূলে বয়ে চলা আনন্দের ফলল্গুধারাস্রোতকে
বন্ধনমুক্ত করো, খরস্রোতে বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে নিঃশেষে বাহিত করো উষ্ণ
শোণিতধারা, অঝোরবর্ষণ করো হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে, বিপুল ভক্তিস্রোতে,
অনিঃশেষ কল্লোলে পূর্ণ হোক মুখরিত হোক মনের গোপন কোণ।
ধীরে
ধীরে আকাশ ঢেকে আসে পুঞ্জীভূত গহন কালো আঁধারে, মন্দানিল দ্রুত হয়, শ্যাম
মেঘের কোলে ঝিলিক দেয় হীরকদ্যুতি বজ্র, তালিবনের মর্মর রব দ্রুত হয়,
আমের বনে, জামের বনে, পনসশাখায়, বেল-জুঁইএর ঝোপে ঝোপে দীর্ঘ দহনবেলার
আর্তি, ক্ষোভবিহ্বল শ্রান্ত দিনের হাহাকার যেন মূর্তিমতী বারিধারা হয়ে ঝরে
পড়ে বিন্দু-বিন্দুতে। বৃক্ষশাখার আন্দোলন তীব্রতর হয়, নারিকেলের বনে বনে
দারুণ ক্ষোভে ধেয়ে চলে বাদল হাওয়া। ক্রমে ক্রমে অনন্ত বর্ষণে প্লাবিত
হতে থাকে দিগ্বিদিক। সিক্ত কচুর পাতায় পাতায় ঝরে পড়ে বারিধারা
অমৃতবিন্দুর মতো।
********************************
তখন
বৃষ্টি ধরে গেছে। সিক্ত পত্ররাজি থেকে ঝরে পড়ছে শেষ জলবিন্দু। স্নাত
হংসের মেদুর ডানার মতো বৃহত্ গজপিপুলের ঝাড় থেকে সুখস্বপ্নের মতো ঝরে পড়ে
জলবিন্দু। কাজল মেঘের শ্যামল ছায়া ঢেকে রেখেছে ধরণীকে। বায়ুর শীতস্পর্শে
শিহরণ জাগে। কদম্বের কেশর আসন্ন শুভ পরিপূর্ণতার প্রস্তুতি নেয়।
সন্ধ্যা
আসন্নপ্রায়। দ্রুত পদসঞ্চারে সপার্ষদ গঙ্গার পানে ফিরে আসছেন চৈতন্যদেব।
আজ তাঁর মনোলোক কোন্ এক অজানার আহ্বানে, কোন্ এক আকাঙ্ক্ষিতের পুলকে
রোমাঞ্চিত, কোন্ এক নবীন অনুভূতি, যাকে এতদিন খুঁজে ফিরেছেন পাগলপ্রায়, সে
কি আজ দিল ধরা?
নীলাচলের শ্যামঘন কোন্ এক দীর্ঘছায়ার চৌম্বকপ্রায় আকর্ষণ পথ ভোলাচ্ছে।
ঘন
বনের কোণে কোণে শীতল হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে। ঘনায়মান
আষাঢ়সন্ধ্যায় দীর্ঘ বিলীয়মান বৃক্ষের শ্রেণী ভেদ করে এক দীর্ঘকায়
মনুষ্যছায়া আবির্ভূত হয়। মাথায় কেশদাম, কষ্টিপাথরে কোঁদা যমমূর্তির মতো
বিভীষিকাবাহী
এক
ভয়াল-করালছায়া পথরোধ করে দাঁড়ায়। হৃদ্বিদারী হুংকারে হাতের তৈলমর্দিত
বংশদণ্ডটি এগিয়ে ধরে বলে ওঠে, "প্রাণে বাঁচতে চাস তো দিয়ে দে সব"।
মহাভয়
শিষ্যদুটির কণ্ঠরোধ করে ধরে। পাথেয় যা কিছু সামান্য, তা নৌকায় সঞ্চিত
আছে। এখন প্রাণসংশয়, এখানের মাটির অগভীরে রাশি রাশি পথিকের শব, করোটি,
কঙ্কালের হাড় প্রথিত আছে। রাত্রির অন্তরালে অশরীরীর করুণ হৃদয়ভেদী
ক্রন্দন দূরের শ্মশানবায়ুর উগ্রতায় মিশে ভস্মবাহী হয়ে আকস্মিক হাস্যরোলে
ছুটে যায় অরণ্যের গভীরতর প্রদেশে। আকস্মিক বিপদপাতে হত হতভাগ্যের অতৃপ্ত
আত্মার দুরপনেয় আকাঙ্ক্ষার স্রোত যেন কালচক্রের ঘূর্ণিপাকে জর্জরিত হতে
হতে উদগ্র আবেগে সংসারপানে ছুটে যেতে চায়।
অনিন্দ্যকান্তি
সেই যুবক সন্ন্যাসীকে দেখে দস্যুর ওষ্ঠে বক্র ক্রূর হাসি ফুটে ওঠে।
শ্রীচৈতন্য মৃদু হাস্যে বলেন, "তোমায় যা দিতে পারি তা বহনের শক্তি কি
তোমার আছে?"
দস্যুর চোখ রত্নরাজির লোভে চকচক করে ওঠে। কোন্ সম্পদ আছে এর কাছে?"
কর্কশস্বরে তর্জন করে ওঠে সে। "কী আছে তোর কাছে? কে তুই"?
শিষ্য
রঘুনাথ আহত ব্যাঘ্রের মতো চিৎকার করে ওঠে, "দুবৃত্ত! বাক্-সম্বরণ করো। তোর
ওই পাপমুখে শ্রীচৈতন্যদেবের নিন্দা করলে বাকরোধ হবে রে পাতক। যে নাম ভজলে
জীব সংসার পারে যায়, তাকে অসম্মান করিস"!
দস্যুর
কোনও ভাবান্তর দেখা যায় না। মহাপ্রভু বলে ওঠেন, "রঘুনাথ! যে মানুষ
অজ্ঞানের আবরণে আচ্ছাদিত, যে নিদ্রিত, যে প্রকৃত-ই দীনাতিদীন, মৃত সে জন
কেমন করে অনন্তের মহাসঙ্গীত শুনবে? সংসারের পঙ্কিল কল্মষে যে নিমজ্জিত
একমাত্র হরিনামেই তার উদ্ধার। ওরে! তুই একবার বল হরি, জগতের নাথ, আমাকে
জাগাও"।
মরণ যে জন করেছে বরণ, হে প্রভু তাকে বাঁচাও।
দস্যু
বিরক্তমুখে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল। এবার তার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এই পথিক
সন্ন্যাসীদের কাছে কানাকড়িও নেই তা সে বুঝেছে তা বলে তো ছেড়ে দেওয়া যায়
না। আজ পর্যন্ত তার কাছ থেকে বেঁচে কেউ ফেরেনি। ভীম খড়্গ উত্তোলন করে সে
হেঁকে ওঠে।
মহাপ্রভু স্মিত হেসে বলেন, "অক্রূর, তোমার এ ক্রূরতা কেন"?
চমৎকৃত
হয়ে তস্কর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে আগন্তুককে। তার পিতৃদত্ত এ নাম
কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আজ সে শুধুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাধাই ডাকাত। মাধাই
ডাকাতের নামে শিশু ভূমিষ্ঠ হতে ভয় পায়, সদ্যোজাত শিশুর ক্রন্দনরব মূক
হয়ে যায় তার না শ্রবণে। আর এ কোন্ আশ্চর্য মানুষ তার সামনে অনায়াসে
দাঁড়িয়ে বাক্যাঘাতে তাকে থামিয়ে দিল?
"তুমি জানলে কি করে এই নাম? এ তো তোমার জানার কথা নয়!!!"
স্খলিতস্বরে বলে ওঠে দস্যু সর্দার।
"তোমার
এ বহুসঞ্চিত পাপভার লাঘব করবে কী করে মাধাই? অগণ্য নিরপরাধ মানুষের রক্তে
রাঙা ঐ হাত, ঐ শাণিত কৃপাণ, ঐ লুণ্ঠিত ধনভার তোমাকে অহর্নিশ যে অনন্ত অতলে
নিয়ে যাচ্ছে, তার থেকে মুক্তি পাবে"?
"মুক্তি??
হেঁকে ওঠে মাধাই, "কে চায় মুক্তি" বলে সে, "জগত্ আমার পায়ে লুটায়,
জাগতিক কোনও চাহিদাই আমার অপূর্ণ নেই, কামিনী-কাঞ্চনের চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত আর
কী হতে পারে?" সংশয়দীর্ণ কণ্ঠে বলে সে।
"তোমার পুত্র তো ভবিষ্যতে এই হীনবৃত্তি গ্রহণ করে পাপভারে আকীর্ণ হবে। পিতা হয়ে পুত্রকে মৃত্যু ব্যতীত আর কী দিতে পারবে তুমি?"
চমৎকৃত
হয়ে দস্যু মাধাই তাকায় ঐ আয়ত দুই মর্মভেদী অতল আঁখি দুটির পানে। কী
শান্তি ঐ চোখে। ক্রমে তার মুখে নেমে আসে শ্রাবণের কাজল মেঘের আঁধার। এই
আগন্তুক কী করে জানছে তার সব কথা।
"পুত্র!!"
পথপ্রান্তের
প্রস্তরবেদীমূলে বসে পড়ে সে। স্খলিত স্বরে বলে চলে মাধাই। তার বালক পুত্র
গত চার বত্সর অশক্ত জীবন্মৃত হয়ে শয্যালীন। গোবিন্দপুর থেকে সুন্দরবনের
বাঘা বাঘা হাকিম-কবিরাজরা রোগনির্ণয় করতে পারেনি। তবু সে কী যাদুবলে বেঁচে
আছে, বলা কঠিন।
"অবশেষে
হালিশহরের এক ধন্বন্তরির সন্ধান পেলাম। আমার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল
খায়। সেই বৃদ্ধকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে নিয়ে আসতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য
করিনি। কিন্তু সেই খট্টারূঢ় ব্যাটাকে অন্তর্জলি করতে হয়েছে। আমার ছেলেটা
বুঝি…"
"তোমার
পাপেই তোমার সন্তান আজ মরতে বসেছে। তুমি সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ ত্যাগ
করেছো। নিয়তি তোমাকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে"।
"মানি না নিয়তি" লাফিয়ে উঠে হাত চেপে ধরে আকর্ষণ করে মাধাই।
"চলো,
নিজের চোখে দেখবে, তুমি যদি আমার সন্তানের জীবন দান করতে পারো, তোমাকে
সসম্মানে মুক্তি দেব। আর যদি না পারো, তাহলে তোমার প্রতি বাক্যের মূল্য শোধ
করতে হবে তোমায়। জীবন দিয়ে"।
"তোমার
সন্তানকে জীবন দিতে পারেন একমাত্র জগত্পতি পরমেশ্বর। তাঁকে স্মরণ করো।
তাঁর পায়ে শুভ-অশুভ সকল কর্মফল অর্পণ করো। তিনি তোমাকে পথ দেখাবেন"।
"এসব কথায় আমার কাজ নেই। তুমি আমার সঙ্গে চলো"।
একটি
নিষ্প্রদীপ কক্ষে প্রবেশ করে দীপ জ্বেলে দেয় মাধাই। তার পরিজন, অনুচররা
ভীড় করে থাকে দ্বারপ্রান্তে। এই দীর্ঘবাহু মুণ্ডিতকেশ স্বয়ংপ্রভ তরুণ
সন্ন্যাসীকে দেখে তাদের মনে সম্ভ্রম জেগে উঠেছে।
প্রজ্জ্বলিত
দীপালোকে নিমাই দেখলেন, শয্যায় মৃতপ্রায় এক বালক, তার দেহ শোণিতহীন
পাণ্ডু, তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ, ওষ্ঠ কালিমালিপ্ত, কোটরগত নেত্রযুগলের তলে
দীর্ঘ রোগভোগের চিহ্ন। বালকটি নিদ্রিত অথবা নির্জীব।
নিমাই
মহাপ্রভু ধীরে ধীরে বালকের কপাল স্পর্শ করে শিহরিত হলেন। প্রবল দাহজ্বর।
ধীরে ধীরে মাথায় করসঞ্চালন করেন। মুখে ধীরস্বরে কিছু বলেন। শোনা যায় না।
তারপর বালকটির বিশীর্ণ মুখপানে দৃকপাত করে ইষ্টনাম স্মরণ করে করে ধীরে ধীরে
কক্ষ পরিত্যাগ করেন।
*********************************
আরেকটি
উজ্জ্বল সকাল। আদিগঙ্গার বুকে মঝিমাল্লার হাঁকডাক, বণিকের ব্যস্ত
আসা-যাওয়া। গঙ্গার তীরে বিপণিতে নিত্যদ্রব্যের সম্ভার। হাঁড়ি-কলসি নিয়ে
ছোট ছোট ভড় ইতঃস্ততঃ আসে যায়। খড়-বিচালি গবাদি পশু নিয়ে অপেক্ষাকৃত বড়
নৌকাগুলি কিছু ভিড়েছে ঘাটে, কিছু আবার স্থানাভাবে আদিগঙ্গার বুকে ভাসমান।
সুদূর চক্রতীর্থ থেকে একদল পুণ্যার্থী কালিক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছিল। তারা
যাবে আরও পশ্চিমে। ঘাটের সোপানশ্রেণীতে মগ্ন এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে
কৌতূহল ও সম্ভ্রমে তারা তাকিয়ে ছিল আর অনুচ্চস্বরে আলাপ করছিল।
রঘুনাথ
ও রামতনু এসব-ই দেখছিল ঘাটে বসে। প্রাতঃকালে দধি ও উৎকৃষ্ট চিপিটক সহযোগে
ফলার সম্পন্ন করে তারা খানিক জিরোচ্ছে। এখান থেকে আগামিকাল পুনরায়
যাত্রারম্ভ হবে। নৌকার মাঝিরা তাই মহাব্যস্ত। এরপর জল বাড়বে, নৌকায়
বিন্দুমাত্র ছিদ্র থাকলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
মহাপ্রভুর
এসব দিকে কোনও লক্ষ্য নেই। তাঁর মানসলোকে শ্যামঘন যে দূরলোকের বংশীধ্বনি
অহরহ ধ্বনিত হচ্ছে, তার মধুর অনুরণন তাঁর মস্তিষ্ক ও হৃদয়কে আপ্লুত করছে,
ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নীলাচলের দিকে।
আকাশে মেদুর মেঘের আনাগোনা। প্রভাতবেলার খররৌদ্র শ্যামকান্তি মেঘের অন্তরালে বিলীন হয়। বায়ুর শৈত্য স্পর্শ করে যায় মর্মস্থল।
আদিগঙ্গার বুকে ব্যস্তজীবনযাত্রা মুহূর্তে শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
মঝিমাল্লা
আর বণিকের দল আবরক পট নিয়ে বিপণি আর পণ্যের সম্ভার ঢাকা দিতে ব্যস্ত হয়ে
ওঠে। আকাশ আষাঢ়ের আকস্মিক বাদলমেঘে সমাচ্ছন্ন। প্রায়ান্ধকার এই
প্রাতঃকালে নবীন মেঘের দল হস্তিযূথের মতো মত্ত তাণ্ডবে ঝাঁপিয়ে নামে
আদিগঙ্গার বুকে। তাদের শ্যামকান্তি ধারাপ্রপাত হয়ে নামে তীরবর্তী ধুতুরার
ঝোপে, বনচম্পার দল তীব্র আশ্লেষে দোলে, শ্যামের ঝুলনদোলার মতো। পক্ব কদমের
রেণু বয়ে আনে সুগন্ধ, অদূরে দেবমন্দিরে বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি, নিত্যপূজার
পুষ্পরাশির সুগন্ধ বাদলবায়ুতে মেশে। অনুপম সুগন্ধ ছড়ায় অগুরু-গুগগুলের
ধূম্রজাল, বনটিয়ার ঝাঁক সোল্লাসে ডেকে ওঠে, নবীনা বর্ষা তার সকল গন্ধ ও
রূপ নিয়ে আমোদিত করে, রসসিক্ত করে প্রান্তর-অরণ্যানী-হৃদকন্দর।
মহাপ্রভু
পরমানন্দে দুই হাত উত্তোলিত করে শ্যামনামে বিভোর হন, রামতনু নৌকা থেকে
মৃদঙ্গ এনে বাদ্যধ্বনিতে মুখর করে তোলে। অন্যান্য নৌকা থেকে সকল বৈষ্ণব
হরিধ্বনি করে সেদিন মর্ত্যের বুকে নামিয়ে আনে স্বর্গীয় আনন্দধারা। তাদের
দুই নয়নে অশ্রান্ত অশ্রুধারা দরদর বেগে নামে, গঙ্গার বুকে ভাসমান নৌবহর
থেকে কৌতূহলী যাত্রীর দল সেই বৃন্দনৃত্যের মধ্যমণি উদ্বাহু বিভোর তরুণ
যুবাকে দেখে বিস্ময়াঘাতে হতবাক হয়।
মধ্যাহ্নে
পদ্মদিঘীর কপোতাক্ষ জলে অবগাহন করলেন মহাপ্রভু। আকাশ আজ মেদুর সঘন। দিঘীর
পাড়ে পাড়ে মধ্যদিনের ম্রিয়মাণ আলোয় বনপুষ্পের বিচিত্র বর্ণ ভবনশিখি-র
পেখমের মতো ভাস্বর, দীঘির জলে পানকৌড়ির ছায়া আন্দোলিত হয়, দূরে
দিগন্তবিসারী শস্যক্ষেত্রে আলোর নাচন, আষাঢ়দিনের স্পর্শে জেগে ওঠা কোমল
পত্রপল্লবে বাদলপোকার আলোড়ন, নাগচম্পায় ভ্রমরের কলরোল…. চারিদিকে এক মধুর
প্রশান্তি। এ বিশ্ব মধুময়, এই বায়ু, এই তরঙ্গভঙ্গ, এই বৃক্ষরাজি সকলই
মধুক্ষরা। এই নদী মধুমতী। জগত্-জীবনে অনন্ত মধু, যা কিছু প্রত্যক্ষগ্রাহ্য
সকলই মধুময়, বিষ্ণুর পদক্ষেপে মধুর স্থান। সে বড়ই রহস্যঘন, গোপনীয়। তাকে
জানা যায় নিজেকে জানার পথেই, আত্মানং বিদ্ধি।
নীলাচল টানছে যে বড়।
শীতল
জলে অঙ্গমার্জনা করে দৈব আনন্দে উদ্বেল হলেন মহাপ্রভু। এ স্থানটি বড়ই
মনোরম ও পবিত্র। নীলাচল থেকে প্রত্যাগমনকালে এই স্থানটিতে পুনরায়
রাত্রিবাস করবেন, মনস্থ করেন মহাপ্রভু।
মুহূর্তে
মনে হয়, ঘনশ্যাম পীতবাস বংশী মধুরতানে হাতছানি দেন, কখনও কুরুক্ষেত্রে,
কখনও যমুনাতটে, কখনও দ্বারকা-মথুরায়, কখনও নীলাচলে শ্যাম গানে গানে প্রাণে
প্রাণে মঙ্গলবার্তা শোনান। "রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব"
আহা!! নীলাচল কী মায়াবী টানে ডাকে গো!
"ঈশাবাস্যং জগত্ সর্বম্"….
সর্বব্যাপক
বিষ্ণুর মায়ার জালে এ জীবন পদ্মপাতায় জলের মতো টলটলায়, তা ক্ষণিক,
জীর্ণবসনের মতো এই শরীর ছেড়ে যে আত্মা অপর দেহরথ খুঁজে নেবে, সে তো
পরমাত্মার আংশিক প্রকাশমাত্র। অহং কেবল জীবকে স্বরূপোপলব্ধিতে বাধা দেয়,
মায়ার বশবর্তী জীব ভেদবুদ্ধির শিকার হয়। হে হরি! হে দয়াময়! নিখিল
আশ্রয় হে দীনবন্ধু! হে কমলাক্ষ! এ ধরাপানে চাও।
চিন্তাহরণের চরণকমলে সকল চিন্তা সঁপে দিলেও চিন্তামণি চিন্তা দেন। তাই বাধা পড়ে চিন্তাস্রোতে।
জবার
ঝোপের অন্তরাল থেকে অকস্মাত্ আবির্ভূত হয় গতকালের সেই করাল মূর্তি। মাধাই
ডাকাত ত্বরিতে মহাপ্রভুর চরণযুগল জড়িয়ে ধরে আছড়ে পড়ে। কিছু বোঝার আগেই
অশ্রুধারায় ধুইয়ে দিতে থাকে প্রভুর পদযুগল।
"ওঠো, ওঠো মাধাই! পা ছাড়ো!!"
"না
প্রভু!! আপনার চরণে শরণাগত আমি, আমি আপনার শিষ্য হওয়ার যোগ্য নই। আমি
মন্ত্রহীন, অভাজন। আমার মুক্তি নেই। অনন্ত নরক আমার অপেক্ষায়। আমার কর্মফল
আমি ভোগ করব ঠাকুর। আমার ছেলেটাকে আপনি রক্ষা করেছেন। ওর প্রাণ আপনারই
দান। কাল যে ছেলের প্রাণসংশয় ছিল, আজ দীর্ঘ চারবছরের পর সে পথ্য পেয়েছে।
আজ প্রথম দিন, যেদিন ওর জ্বর নেই… ঠাকুর তুমি আমার ছেলেকে নবজীবন দিয়েছো।
আমি মরতে ভয় পাইনা ঠাকুর, জানি, আমার পাপের ক্ষমা নেই। তুমি আমায় শাস্তি
দাও ঠাকুর"। ভেঙে পড়ে দস্যুসর্দার।
"ইষ্ট
নাম জপ করো। যে নামে জগত্ উদ্ধার পায়, সেই জগত্তারণকে স্মরণ করো, তিনি
তোমায় উদ্ধার করেছেন পাপের পঙ্কিল আবর্ত থেকে। তুমি আত্মোপলব্ধি করেছো।
তোমার অনুতাপ তোমাকে দগ্ধ করে নিখাদ করেছে। আজ থেকে তুমি পরম বৈষ্ণব।
জগত্স্বামীর দাস তুমি। তোমার হাতেই উদ্ধার পাবে পতিতের দল, তোমার মুখেই
তাঁর নাম সহস্রধারে ছড়িয়ে পড়ুক"।
আদিগঙ্গার
বহমান স্রোতধারায় জীবন-মরণের সীমাহীন আনন্দছন্দ জেগেছে। পূর্ণিমার
জোয়ারের টান জেগেছে নদীখাতে। আকাশে নভশ্চর বিখণ্ডিত মেঘমালা। শ্যামসমান
মরণ বুঝি আজ জীবনতরীর কর্ণধার, গঙ্গার জলে বেগ বাড়ে, তরঙ্গভঙ্গে
দোদুল্যমান নৌবহর, ছোট ছোট ভড় আর ডিঙিনৌকাগুলি তিরতির করে কাঁপে শীতার্ত
পক্ষিশাবকের মতো। কোনও কোনও ছিপ নৌকো জোয়ারের তাড়নায় মুমুক্ষু সাধকের
মতো বাঁধন ছেঁড়ে। কোনওটা বা সংসারতরঙ্গে দুলতে থাকে খড়কুটোর মতো। ভেসে
যাওয়ার অপেক্ষায়।
আজ বুঝি বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে।
মহাপ্রভু
নৌকায় চড়ে বসেন সপার্ষদ। জোয়ারের টানে এখনই এ নাও দরিয়া বেয়ে
গ্রন্থিচ্ছেদ করে ছুটবে জোয়ারের বেগে। তবুও কোথাও বন্ধনহীন গ্রন্থি থেকে
যায় বুঝি? তা না হলে আজ ঘাটে অশ্রুসজল এরা কারা? মাধাই ডাকাতকে এমন শিশুর
মতো আকুল সুরে কাঁদতে দেখেছে কেউ?
নেমে আসেন গৌরাঙ্গ।
মাধাই
বলে "প্রভু! এরা তোমার দাস। এতদিন পরের দ্রব্য লুঠেছে। আজ এই মুহূর্তে সকল
অস্ত্র আমরা এই গাঙের জলে দিলাম। আমরা মন্ত্রহীন। আমাদের কী হবে প্রভু?"
স্মিতসজলহাস্যে
আপ্যায়িত করে নিমাই বলেন "তোমরা প্রকৃত বৈষ্ণব। অহংমুক্ত হয়েছো আজ থেকে।
জানবে জীবের মাঝেই তাঁকে পাবে। তোমাতেই তাঁর অধিষ্ঠান। বাসনামুক্ত হলে জীব
তাঁকে পায়। তাঁকে পেলে আর পাওয়ার কিছু থাকে না, শুভমস্তু"।
মাধাই
বলে "প্রভু, একটি নিবেদন ছিল। আপনার পদধূলিধন্য এই ভূমি। আমার একান্ত
মনোবাসনা এই যে, ফেরার পথে কিছুদিন এখানে আপনার অধিষ্ঠান হয়, আপনাকে ধরে
রাখি সে সাধ্য কই? একটা কিছু দেন যদি তো বুকে আঁকড়ে রাখি"।
নিমাই
পণ্ডিত হেসে বলেন, "নীলাচল ডাকছে বড়। ফেরার কালে এখানে কাটাই কিছুদিন, ঐ
পদ্মদীঘির কোলে বসে শ্যামনাম গাই, এ বড় সাধ। প্রভু যদি চান, হবে"।
নিমাই
পণ্ডিত নৌকায় উঠে একটি রক্তবর্ণ পুথি নিয়ে আসেন। মাধাই-এর হাতে দিয়ে
বলেন, এ আমার একান্ত নিজের। নীলাচলপতির নাম গেয়ে রচতে শুরু করেছিলাম।
পদকটি আমার স্মরণে আছে। তুমি এটা রাখো। পরম ভক্তিভরে তাঁকে ডেকো। তিনি
জগদগুরু। তিনি কল্যাণ করবেন"।
জগন্নাথস্বামি! নয়নপথগামি! ভবতু মে।
নৌকা
ছাড়ে। জোয়ারের টানে দ্রুত ভেসে চলে। ক্রমশঃ নয়নপথের বাইরে, দূরে চলে
যায়। যা কিছু ফুরায় শুধুই তা চোখের তরে। তোমার চপল আঁখি বনের পাখি যে,
তাকে ধরে, সাধ্য কার? হৃদয়ে যেদিন মোহনরবে সেই বাঁশি বাজবে, তার সুরলহরীর
তালে তালে দুলে দুলে তোমার পাতার তরণী ভেসে যাবে দূরে, কুসুমবনের তরে।
ফুরায়, তবুও, কী জানি সে আসবে কবে, এই ভেবে হৃদয় বিনিদ্র নিদাঘ যাপন
করে।
আদিগঙ্গার বুকে বাদল হাওয়া উদ্বেল হয়, মধ্যদিনের শ্যামসজল আলো-ছায়া মেখে জেগে থাকে বৈষ্ণবঘাটা, তার পুণ্যস্মৃতি নিয়ে।
নৌকা ছাড়ে। জোয়ারের টানে দ্রুত ভেসে চলে। ক্রমশঃ নয়নপথের বাইরে, দূরে চলে যায়। যা কিছু ফুরায় শুধুই তা চোখের তরে। তোমার চপল আঁখি বনের পাখি যে, তাকে ধরে, সাধ্য কার? হৃদয়ে যেদিন মোহনরবে সেই বাঁশি বাজবে, তার সুরলহরীর তালে তালে দুলে দুলে তোমার পাতার তরণী ভেসে যাবে দূরে, কুসুমবনের তরে। ফুরায়, তবুও, কী জানি সে আসবে কবে, এই ভেবে হৃদয় বিনিদ্র নিদাঘ যাপন করে।
আদিগঙ্গার বুকে বাদল হাওয়া উদ্বেল হয়, মধ্যদিনের শ্যামসজল আলো-ছায়া মেখে জেগে থাকে বৈষ্ণবঘাটা, তার পুণ্যস্মৃতি নিয়ে।
=================
ডঃ অভিষেক ঘোষ
সহকারী অধ্যাপক
সংস্কৃত বিভাগ
বাগনান কলেজ