Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পরজীবী ( পর্ব- ৮) ।। অভিষেক ঘোষ

 

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

২০১৫

চন্দ্রকান্ত ছুটি নিয়ে বাড়িতে এলেও বেশিরভাগ সময়ে বাড়িতে থাকে না । পুজোর এই কদিন গ্রামের বাড়িতে এলেও তার বন্ধু-বান্ধব আছে, মদের আড্ডা আছে । সন্ধ্যা হলেই তাদের আড্ডা বসে ঘাটে । চমৎকার বসার ব্যবস্থা, সেই হাফপ্যান্ট বয়সের বন্ধুরা, বিয়ার আর ঝিরঝিরে হাওয়া – নেশা জমতে আর কী চাই ? ওই বিয়ার চন্দ্রকান্ত এলেই আসে, বাইক নিয়ে সেই মহকুমা থেকে কিনে আনা হয় । চন্দ্রকান্ত নিজে খায় বুঝে, কিন্তু মদ্যপদের সাথে বসে তাদের প্রলাপ শুনতে তার বেশ লাগে । চন্দ্রকান্তরা টালিগঞ্জের কাছে একটা ছোটো ফ্ল্যাটে থাকে । সে একটা প্রাইভেট এজেন্সিতে কাজ করে । তার কম্পানি মূলত পোশাকের ডিজাইন তৈরি করে ডিজিট্যালি । সে নিজে কাজ করে দক্ষিণ কলকাতায় কম্পানির ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ ইউনিটে । প্রায়ই সারাদিন তার কম্পিউটারের সামনে বসেই কেটে যায় । শুধু রবিবারটা কাজের ছুটি । সে পোশাকের বিভিন্ন স্টাইল ও রঙ্ নির্বাচন করে, ক্লায়েন্ট মিটিং অ্যাটেন্ড করে মাঝে-মধ্যে । তার কোনো প্রথাগত শিক্ষা নেই, কাজটা করতে করতেই শিখেছে । তাদের তৈরি পোশাকের প্রিন্ট বছরে প্রায় দু-তিনবার ফ্যাশন শো ও কর্পোরেট মিটিং-এর মাধ্যমে বিগ বাজারের মতো কয়েকটা হাউসের সামনে আনা হয় । পাঁচ-ছ'শো পোশাকের ডিজাইন থেকে ডিস্ট্রিবিউটর ও ডেভেলপাররা দশ-বারোটি বেছে নিলে, সেগুলির ছোটোখাটো পরিবর্তন হয় আলোচনার মাধ্যমে । তারপর সেই পোশাকের প্রোডাকশন শুরু হয় । সে প্রথমে নিজে ওই প্রোডাকশনে লেবারের কাজ দিয়ে কলকাতায় কর্মজীবন শুরু করেছিল । তার গ্রামের বাড়ি, স্কুল, কালচার - এইসব ভালো লাগতো না । গ্রামে বন্ধুবান্ধব না থাকলে, সে পুজোতেও আসতো না বাড়িতে । কিন্তু যে মানুষটির সাথে বনিবনার অভাব তাকে গ্রাম থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেললো, সেই কৃষ্ণকান্ত মিত্র তো আর আগের মতো নেই, একেবারেই কোনো মিল নেই দশ বছর আগের লোকটার সাথে । গত দশ-বারো বছরে পুরোটাই বদলে গেছেন তিনি । চন্দ্রকান্তর অফিসে একটি মারোয়ারি ছেলে কাজ শিখছে, বছর কুড়ি বয়স । কম্পানি তার বাবার । কিন্তু ওইটুকু ছেলের সামান্য দেরি বা ভুলচুকের জন্য তার বাবা ছেলেকে যেভাবে অফিসের সমস্ত কর্মচারীদের সামনে দাঁড় করিয়ে কথা শোনান, তাতেই বোঝা যায়, এরা ওয়ার্ক ভ্যালু বলতে ঠিক কী বোঝে... তখন চন্দ্রকান্তর নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায় । মানুষটা পনেরো বছর আগেও ঠিক ওইরকম ছিলেন, নির্মম । নইলে তার মা-কে ওরকমভাবে নিজের বাড়িতেই প্রায় একঘরে হয়ে থাকতে হতো না । চন্দ্রকান্ত একাই গিয়েছিলো কলেজে অ্যাডমিশন নিতে, একাই কলকাতায় গেছিলো, ঠকতে ঠকতে আর ধাক্কা খেতে খেতে নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে শিখেছে ।

পনেরো বছর আগে সুন্দরপুর বাজারে কাঠকলে সকালবেলা গেলেই দেখা যেত, একটা সাদা হাফ-হাতা শার্ট আর অফহোয়াইট অথবা, ছাই রঙের প্যান্ট পরে, কোমরে দু-হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ দেখাশোনা করছেন কৃষ্ণকান্ত মিত্তির । সকলের সামনে তিনি চিৎকার করে ছোটো ছেলেকে 'বেয়াদপ' বা, 'জুতিয়ে মুখ লাল করে দেবো' বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না । তাঁর কেমন যেন একটা ধারণা ছিল, চন্দ্রকান্তর স্কুল বয়স থেকেই প্রেমিকা ছিলো । চারিদিকে বাবার নিয়োগ করা চরদের দেখতে পেত চন্দ্রকান্ত । সে পোল পেরিয়ে টিফিনের সময় স্কুল থেকে বেরিয়ে কোথায় যায়, সাইকেল চালিয়ে কাদের সাথে ঘোরে, কোন্ কোন্ মেয়েদের তার আশেপাশে দেখা যায়, সব খোঁজ রাখতেন কৃষ্ণকান্ত । ভ্যানওলা নিরঞ্জনদা ছিল ওইরকমই একজন চর । সারাক্ষণ দূর থেকে লক্ষ করতো তাকে । পোস্ট অফিসের পিওন পল্টনদা আর একজন । কৃষ্ণকান্ত একবার কাঠকলে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "ফের যদি তোমায় অতসীর সাথে ঘুরতে দেখেছি আর সাইকেল নিয়ে পোল পেরোবার কথা শুনেছি, ঠাং ভেঙে রেখে দেবো ।" তখন সে টুয়েলভে পড়ে । স্বাভাবিক ভাবেই আজো সে এসব কথা ভোলে নি ।

তার মেজদার সাথেই এখন বাবার বনে ভালো, তবে তার বড়দা যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন মেজদাও তেমন পাত্তা পেত না – অবশ্য রাধাকান্ত যে মরেই গেছে, সে বিষয়ে সে মোটেই নিশ্চিত নয় । । সূর্যকান্তর সাথে বিকেলে একসময় প্রায়ই বাবাকে দেখা যেত ধানকলে । জমিজমার হিসেব, পাওনা আদায়, সুদের খতিয়ান এসব নিয়েই ওদের কথা হতো । কিন্তু চন্দ্রকান্তর এসবে প্রবেশের অধিকার ছিল না কোনোদিনই । মেজদার সঙ্গে তার ছেলেবেলায় কী ভাবই না ছিলো ! কিন্তু ওই অন্যের কথায় আড়িপাতা, ওপরচালাকি, সবজান্তা ভাব আর বাপের টাকায় ফুটানি – বয়স বাড়তেই মেজদার বদভ্যাসগুলো তার বিরক্তি উৎপাদন করতো । সে নিজে থেকেই তাই সরে গেছে । এখন এই আটত্রিশ বছর বয়সে স্ত্রী অনুশ্রী, বছর পনেরোর আদরের মেয়ে তনুশ্রী ও বছর দশেকের ছেলে অনিমেষকে নিয়ে তার ভরা সংসার । অনিমেষ অর্থাৎ বুবুনকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন তার । পড়াশোনায় ছেলেটা বড্ড ভালো, ঠিক তার উলটো । এই বয়সেই গুছিয়ে কথা বলতে পারে, ভালো ছবি আঁকে, চটপট যেকোনো জিনিস শিখে নিতে পারে । সেই তুলনায় তার বড়ো মেয়ে তনু বড্ড রোমান্টিক, যাকে বলে আবেগী । খালি গল্পের বই পড়ে, ওইসব ভূত-প্রেত, হ্যারি পটার আর ডিটেকটিভ গল্প । আর ওই শালা বেজন্মা রজতটার সাথে সারাক্ষণ ঘুরছে টো-টো করে । বললেও কথা শোনে না । কিন্তু তাই বলে সে কি পারবে তার বাবার মতো মেয়েকে কড়া শাসন করতে ? কৃষ্ণকান্ত যে ভাষায়, যে ভাবে তার সাথে কথা বলতো, তার পক্ষে সেটা তার ছেলে-মেয়েদের সাথে করাটা একেবারেই অসম্ভব । সে কি বোকা ? কৃষ্ণকান্তর ভাষায় সে কি 'ম্যাদামারা' ?

একবার মাঠ থেকে ফুটবল খেলে ফিরে, বাথরুমে চানে গিয়ে দেরি হয়েছিল বলে তাকে শুনতে হয়েছিল, "মেয়েছেলেরও এর চেয়ে তাড়াতাড়ি হয় ।" তখন ঘরে তার দুই বন্ধু বসে । কথায় কথায় 'ক্যালানে' শুনতে হতো তাকে । আরো ছেলেবেলায় ঘাটে তার বাবা তাকে ভিজে গামছা দিয়ে মারতো স্নানে দেরি হলে । মা কিন্তু কোনোদিন তাকে বকাবকিও করে নি, খালি কষ্ট পেলে দুঃখ-দুঃখ মুখ করে থাকতো । সে কি সত্যিই অতটা অপদার্থ ছিল ? সে যতটুকু মায়ের কাছে, জ্যেঠুর কাছে শুনেছে, বাবা কখনও সেভাবে ফুটবল ক্রিকেট খেলে নি । তাই কি তার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে বাবা অত বিরক্ত হতো ? বাবা কি চাইতো ? সেও তার দাদাদের মতো জমিজমা, কাঠকল, ধানকল, পাওনা আদায় আর সুদের অঙ্ক বুঝবে ? মা অবশ্য বরাবরই উৎসাহ দিয়েছে তাকে । মা-ই ছেলেবেলায় শিখিয়েছিল, বাবাকে 'আপনি' বলতে । কিন্তু ওই রাগী আর গোঁয়ার লোকটাকে আপনি বলতে তার কোনোদিনই ভালো লাগতো না, এখনও লাগে না । তার মনে পড়ে না, কোনোদিনও লোকটা তাকে কাছে ডেকে আদর করেছিলো বলে ! কম মার সে খেয়েছে ? বাগানে লিচু গাছে একবার দা দিয়ে খেলার ছলে এক কোপ বসিয়ে দিয়েছিলো বলে সে বাবার কাছে যে চড়টা খেয়েছিলো, দু দিন গালে ব্যথা ছিলো ।

তার সবসময়ই মনে হয়েছে, বাবা আসলে চেয়েছিলো, তারা পরের দুই ভাই তার প্রথম সন্তান রাধাকান্তর মতো ডাকাবুকো হোক্ । সেজদাকে লোকটা নিজের ছেলে বলে মনেই করতো না, বলা ভালো ঘেন্না করতো । বাবার দোষেই সেজদাটা মরে গেলো । বাবা কি ভাবতো, বড়দা আর ওই মাধবীকে হাতের ইশারায় নাচাবে ? কিন্তু যেটা বাবা ভাবতে পারে নি, বুনো গাছকে নাগাড়ে বাড়তে দিলে, দেখতে ভালোও লাগে না আর বেশি দেরি হয়ে গেলে উপড়ে ফেলাও দুঃসাধ্য হয় । রাধাকান্ত তেমনি হয়ে উঠেছিলো । বাবা যখনই বুঝলো, বড়ো ছেলের উপর তার আর নিয়ন্ত্রণ নেই, অমনি ব্যস্ত হয়ে পড়লো । কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছিল । তবু তার একটা ধাক্কা দরকার ছিলো, দরকার ছিলো একটা শিক্ষার । একেই বোধহয় নিয়তি বলে ! তারপর থেকেই মানুষটা ধীরে ধীরে বদলে গেলো । এখন সে বাবাকে 'তুমি'ই বলে, যখন করুণা হয়; আর যখন রাগ হয়, তখন মুখোমুখি হলে বলে 'আপনি' ।

   ***  ***  ***  ***

ধাপে ধাপে কতকগুলো অদ্ভুত মানসিক সমস্যা কৃষ্ণকান্তকে পেয়ে বসেছে । খালি ওই দক্ষিণের ঘরে যাবে আর বারবার হাত ধোবে । খালি বিড়ি খাবে আর এমনভাবে লুঙ্গি আর জামা ঝাড়বে যেন আগুন লেগে গেছে কাপড়ে । ওই ঘরের সামনের ইজিচেয়ারটায় সারাক্ষণ বসে থাকে এখন । বসে বসে কী ভাবে কে জানে ? কাউকে ওই ঘরে ঢুকতে দেবে না, মেজদা আর নিতাইদা ছাড়া । বারান্দায় ছোটোরা ছোটাছুটি করলে, তাতেও বিরক্ত । আজকাল মাঝেসাঝে জ্যেঠুর লেখাওয়ালা পুরোনো পত্রিকাগুলো উলটে পালটে দেখে, কখনোবা পড়ে । জ্যেঠুর এরকম অনেক লেখাই এই বাড়িতে ছড়িয়ে আছে, লাইব্রেরিতে বসে জ্যেঠু অনেক লিখেছে, গল্প কবিতা এমনকি নাটক । সে দুয়েকটা পড়েওছে, একটু আদিরসাত্মক । হয়তো পাব্লিক খায় বলে । বাবা বইতে হাত দিলেও, হাত ধুয়ে নেয় । নখগুলো চেয়ারের হাতলে, দেয়ালে মাঝেমাঝে ঘষে, যেন ওইভাবে ছোটো রাখছে নখগুলো । ঘনঘন বাথরুমে যায়, না পেলেও যায়, গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । বাবার এই সমস্যাটা শুরু হয়েছে বছর পাঁচেক হলো, অবশ্য সে আর ক’দিন বাড়ি থাকে যে এসব তুচ্ছ খবর রাখবে ? । তাই এখন বাবার সেপারেট বাথরুম করে দেওয়া হয়েছে । কমোড বসানো রয়েছে সেখানে । পুরুষাঙ্গটি ধরে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে, হয় না প্রস্বাব । স্বাভাবিক, এত গরমে বারবার হয় নাকি ? ঘাম হয়েই তো সব জল শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ! অথচ চানটাও করবে না রোজ ! আগে তো পুকুরেই যেত, গরমকালে দু’বার চান করতো । এটা আবার বছর দুয়েক হল, নতুন সিম্পটম । একদিন অন্তর একদিন চান করে, জোর করলে অজস্র অজুহাত দেয়, চেঁচামেচি করে । এদিকে বাথরুম যাবে ঘনঘন । খালি মগে করে জল নিয়ে নিয়ে অথবা হ্যান্ড শাওয়ারের জল বাথরুমের দেয়ালে ঢালবে, কমোড ধোবে । যতো পাগলামি । ওই জন্যই এখন জল সংরক্ষণে তাঁর অতি উৎসাহ । কতো জল যে লোকটা এভাবে নষ্ট করে, তার ইয়ত্তা নেই । বাকি সময় ইজিচেয়ারে বসে আনমনে নিজেরই ঘরের দরজাটার দিকে চেয়ে চেয়ে কী যেন ভাবে ! বাড়ি থেকে বেরোয় না, বহু বছর হয়ে গেলো । ধুরর্… যতই সে ভাবে, ওদের ব্যাপারে আর মাথা ঘামাবে না, কিন্তু বাড়ি এসে চোখের সামনে এইসব ভুলভাল ব্যাপারগুলো ঘটতে দেখলে, মাথা না ঘামিয়ে উপায় থাকে না । তাই চন্দ্রকান্ত গ্রামে এলেও, নিজের বাড়ির মধ্যে থাকে কম । এই পরিবেশে তার দমবন্ধ লাগে ।

===============

ক্রমশঃ---------- 

Post a Comment

2 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. এর শেষটা কী হল জানার অসম্ভব কৌতূহল বোধ করছি ।

    ReplyDelete
  2. কাজল সাহাAugust 16, 2022 at 9:48 AM

    দেখুন মশাই, গ্রামের প্রেক্ষাপটে এইরকম ধারাবাহিক পড়তে দিব্য লাগছে। চালিয়ে যান।

    ReplyDelete