পরাহত জীবন
সৌমেন দেবনাথ
বয়স বেড়ে গেলো টের পেলাম না। কি পেলাম না এই হিসাব কষতে কষতে কি পেলাম একদিনও হিসাব করলাম না। এ বসন্ত এলে ভাবি সামনের বসন্তে সাজবো, ঘুরবো। কত বসন্তই গেলো, রংহীন জীবনে রং আর লাগলোই না। এ পহেলা বৈশাখে এলে ভাবি সামনের পহেলা বৈশাখে আর একা থাকবো না। বৈশাখ যায় চৈত্রও আসে। হাতটা ধরার মানুষটার দেখা মেলে না। সূর্য উঠছে ডুবছে, ভালো কিছু জীবনে দেখা দেবে, ভালো কিছু পাবো, আশা পূর্ণ হবে, স্বপ্ন বাস্তবতা পাবে, এসব নিয়েই দৌড়াচ্ছি, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি। সামনের ছুটি কাজে লাগাবো, কত ছুটি এলো গেলো, সংসারে ঢুকা আর হলো না। সংসারের আশা সবাই করে, সংসারে প্রবেশ বর্তমানে অত সোজা না। যোগ্য মানুষের সর্ব কালেই অনেক দাম। কিন্তু যোগ্য হলেই হয় না এখন, যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। কম যোগ্য মানুষই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারে। কত কত যোগ্য, মেধাবী মানুষ কান্না করছে নীরবে, নিভৃতে।
যারা ভেবেছে তাদের সংসারে ঢুকা হয়ে উঠেনি। যারা আগ-পাছ ভাবেনি তারা দিব্যি সংসারে প্রবেশ করে দক্ষ সংসারি হয়ে উঠেছে। নিজে সফলতা পাইনি, তাই জীবনে কেউ এসে উঁকি দেয়নি। সফল মানুষের পাশে আসতে চায় মানুষ, সফল মানুষের পাশে থাকতে রাজি মানুষ। আজ বিফল বলে মনে অনেক না পাওয়া, বিফল বলে পাওয়া নেই মনে; বিফল বলে জীবনের আবশ্যিক বিষয়েও ইচ্ছা পোষণ করা যেন রীতিমত অন্যায়। বিফল বলে পাশে থাকার মানুষটা জোটেনি, পাশের মানুষগুলোও পাশে নেই। আর তাই সময় ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে, ইচ্ছাগুলো মরে যাচ্ছে, শখ করা ভুলে যাচ্ছি।
জীবন জুড়ে যে যন্ত্রণা ভেবেছিলাম একটা চাকরি পেলে মিটে যাবে। কিন্তু চাকরি পাওয়ার যোগ্য করে নিজেকে তৈরি করতেই পারিনি। আমি কিছু পাবো এটা যেন একটা মিথ্যা বাক্য৷ আমার মত খুব কম মানুষই আছে যাদের ভেতর এত অপূর্ণতা, এত না পাওয়ার যাতনা। কিন্তু খুব বেশি খেদোক্তি প্রকাশ করি না। নিজে অযোগ্য, কেন আমি যোগ্যতার বেশি পাবো! আমি আমার না পাওয়াকে মেনে নিয়েছি। আমি অতৃপ্তি প্রকাশ করি না। আমি নিজেকে জেনেছি, বুঝেছি; প্রতিযোগিতায় টিকবো, সে মেধাবী আমি নই। চাকরির আশা দুরাশার নামান্তর। বাঁচতে তো হবে, করবো টা কি তবে? পুঁজি তো নেই, ব্যবসায় করবো কি দিয়ে? শিক্ষিত ছেলে মানুষ তো জানে, কাজ না করে বসে থাকি, কেউ তো ভাল বলে না। পথ না পেলে মানুষ পথেই নামে। হাটার পথের শেষ নেই, দিশা পাবো সে পথের দেখা নেই। সব দেখতে পাই, কিন্তু আমার জীবনের গতির পথ দেখি না। কত মানুষ কত কত রকমের কাজ করছে, আমি কি করবো বুঝে উঠি না। আমার জন্য কোন কাজ আমি ঠিক করতে পারি না। আমার কোনটা করা উচিত আমি জানি না। আমার সামর্থ্যের সীমা আমার জানা। আমার দৌড়ের গতি আমার জানা। আমি রচনা করতে পারি না আমার কোন একটা কাজের সূচনার।
চাকরি না হওয়ার কারণে কিছু একটা করে জীবন নির্বাহের চেষ্টা করতে কি আমি চাইনি? কি করবো সেই সিদ্ধান্তই নিতে পারিনি, তাই আজো কিছুই করছি না। অথচ কিছুই থেমে নেই। সাগর বইছে, বাতাস ধাইছে ; বয়স বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বাড়ছে না আমার জীবনের দাম। কাল কি খাবো ভাবতে ভাবতে প্রতিদিনের আহার ঠিকই মিলছে, কিন্তু কাজ মিলছে না। কাজের কাজী অকাজের ঢেঁকি হয়ে সমাজে বুড়ো হচ্ছি। আমার দিন নেই, কারণ আমার দিনকে আমি রাঙাতে পারিনি। যত দিন আসে আমার জীবনে সব অদিন কুদিন। প্রতিদিন আমার কাছে দুর্দিনের মত। এভাবে কদিন, কতদিন!
এক জীবনে মানুষের কত ধরনের দুঃখ লুকিয়ে থাকে! কাউকে বলা যায় না, বললেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে; হালকা হয়ে যেতে হয়। অনেক কথা বলি সারাদিন, কিছু কথা বলা যায় না কাউকেই। সেসব কথা মনের মধ্যে গুমড়ে কাঁদে। অনেক জ্বালা, ব্যথা, ক্ষোভ মনের মধ্যে, বুকের গহীনে লুকিয়ে রেখেছি। কেউ ভালো বলে না, শুধু কিছু একটা করি না তাই। মন্দ বলে, কথা শোনায় পরিবারের সবাই। পাত্তা পাই না কারো কাছে, বাড়ির কুকুরের মূল্য আছে, আমার কানাকড়িও মূল্য নেই। কাজ নেই, রোজগার নেই, কারো কাছে তাই নমস্য নই। নেহাত মূল্যের মানুষের পাশে কেউ থাকে না। ক্ষমতাহীন মানুষের আপন কেউ জোটে না। রোজগারহারা মানুষের পাশে কেউ থাকতে চায় না। আগাছা, পরগাছা হয়ে বটগাছে আশ্রয় বেশি দিন থাকে না। নীরব কষ্টে, নীরব অভিমানে দূরে দূরে থাকি। চাই না কারো কাছে কিছু, জানি কেউ আমায় কিছু দেবে না। অর্থহীন জীবনে কেউ জড়াতে চায় না, আপন মানুষও পরিচয়ে জড়াতে চায় না। শিক্ষা গ্রহণ উঁইপোকার ঢিবির মত আমার কাছে, উঁইপোকার ঢিবি দেখতে খুব সুন্দর, মিহি মাটির। কোন কাজে লাগে না। এই অসহায়ত্ব জীবন দেখলে কেউ আফসোস করে না, বিষাদে কারো মন ছেয়ে যায় না, বরং হাসে, অন্যের কষ্টে মানুষ খুশি হয়, এটাই মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কেউ কেউ লোক দেখানো বলে তোমার দ্বারা অনেক কিছু হত, তুমি পারলে না। এই না পারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি খুব কষ্টে। প্রতিটি দিন কাটে খুব বিষণ্নে, বিমর্ষে, বিপর্যয়ে।
বাবা, বড় ভাই আর মামার ঐকান্তিক ইচ্ছায় বিয়েটা হলো। নিজে বিয়েটা করতে পারলাম না, সবাই মিলে আমাকে বিয়ে দিলেন। কত মেয়েকেই ভালো লাগত, ভাবতাম বিয়ে করবো; অথচ আজ না ভালো লাগার মত একজনের সাথে সবাই আমাকে বিয়ে দিলেন। যা চাই তা না পাওয়া আর যা চাই না তার সাথে থাকা এক কি করে হয়? নিজের অভিমত কি কেউ জানার চেষ্টা না করেই আমাকে দায়গ্রস্ত পিতা, দাদা, মামা কন্যাস্থ করলেন। পছন্দগুলোকে অপছন্দের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার পছন্দ থেকে তার পছন্দ আরো উন্নত। আমি তার পছন্দ তালিকার বেশ নিম্নেই মনে হচ্ছে। আমার কাছে সে যত না অপছন্দের তার কাছে আমি আরো বেশি অপছন্দের। কাজ করি না -অকর্মণ্য, কাজ পারি না - অকর্মা, কাজ পাই না - অদক্ষ এসব বলেই সে আমায় ডাকে। মামা একটু ভালোবাসতেন তাই বড় ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানেন আমার কর্ম করার, কর্ম খোঁজার গুণ নেই। শ্বশুরের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেলে বাকিটা জীবন সুখে কেটে যেতে পারে এই আশাটুকু ছিলো মামার। কিন্তু মামা জানছেন না কোন সুখে আছি আমি! কোন সুখের সাগরে আমি সাঁতার কাটছি! পছন্দের মানুষের কটু কথাও শুনতে ভালো লাগে, অপছন্দের মানুষের মিষ্টি কথাও ভালো লাগে না। পছন্দের মানুষের অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেও প্রশান্তির তৃপ্তি খোঁজা যায়, অপছন্দের মানুষের শুভদৃষ্টিতে চেয়েও তৃপ্তির ছিটেফঁটাও মেলে না। আবার আদর্শগত দিক থেকেও আছে অনেক অমিল। গাঁয়ের ছেলে আমি সভ্য সমাজের মেয়ের সাথে অনেক কিছুতেই মেলে না আমার। তার যাতে রুচি আমার তাতে অরুচি। দুই মেরুর ভিন্ন আদর্শের মানুষকে কেউ বেঁধে দিলে কখনো কি জোড়া লাগে! মানুষের জীবন তো আর গাছের জীবন না যে এক গাছের ডাল অন্য গাছে জুড়ে দিলে লেগে যাবে।
মনের মধ্যে কত কথা জমা, বলবো বলে জমিয়ে রেখেছিলাম। জমা কথা জমাই থাকলো, ব্যক্ত আর হলো না। যাপিত জীবনের কিছু কথা বলতে গেলেই সে কখনো বলে বসে 'স্টপ', কখনো বলে বসে 'ওয়েট'। থমকে যেতে হয়। ভাবটা নানা অভাবে ক্ষত হয়, ক্ষত ঘায়ে ওষুধের আর প্রলেপ পড়ে না। তার সাথে কথা বলতে গেলেই মনে হয় তার কতই ব্যস্ততা। ব্যস্ত মানুষের সাথে কথা বলার রুচি উঠে গেছে।
আগে কোথাও নির্বিঘ্নে যেতে পারলেও এখন কোথাও যেতে পারি না। সবাই বলে বিয়ে করেছিস, এখনো কাজ করবি না?
কাজ খুঁজি, কাজ পাই না। যেমন তেমন কাজে যোগ দিতে ইগোয় বাধে। ক্ষুধায় ক্ষুদ জোটে না যার, ক্ষুদ খেতে ইচ্ছে নেই তার। ছোট একটা দোকান নিয়ে বসবো, অম্বিকার পক্ষ থেকে নারাজী মত আসলো। বলে, ঘরে থাকবে, ঘরে অনেক কাজ।
এমন কথা শুনামাত্র কেমন যেন হয়ে গেলাম। অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু জীবনে পাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনবো কখনোই ভাবিনি। নামতে নামতে এখন আমার অবস্থান তলানিতে। জুতা খুলতে গিয়ে হাত পায়ে লাগলে হাত সাবান দিয়ে না ধৌত করলে ধুয়ে দেয় বাক্যবাণে আমাকে। কোন পরিবার থেকে উঠে এসেছি বলতেও দ্বিধা করে না। ঘুমের মধ্যেও মশা মারলে হাত ধুতে হবে, নতুবা জাত তুলে বলবে। কত সহজ একটা মানুষ আমি কত বড় বড় কথা অনায়াসেই শুনিয়ে দেয়। সহ্য করা মানুষও অসহ্যশীল হয়ে উঠবে, তার আচারে-আচরণে। আমি যে সব মেনে সব সয়ে বেঁচে আছি এটাই বড় সুখবর।
কী এক আজব প্রাণী আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেলেও অতিষ্ঠতা প্রকাশ করতে পারি না। কেন এমন দুর্ব্যবহার করে বলতেও পারি না। সহ্য করতে পারি না, ভেতরে ভেতরে যে একটা রাগের সত্ত্বা বাড়ছে যেন বিস্ফোরিত না হয় তার জন্য ভীষণ চেষ্টা করি। শান্ত মনে বলি, যেমনটা করো, এমনটা ঠিক না।
ভীষণ রেগে অম্বিকা বলে, সুন্দর হাসি চাও, সুন্দর ব্যবহার চাও, নাকি সুন্দর নারী চাও? কোন যোগ্যতাবলে তুমি আমাকে বিয়ে করেছো?
আমার যে কোন যোগ্যতা নেই বরাবরই স্বীকার করতে আমার কার্পণ্য নেই। সুন্দরী নারী আমার বিয়ে করা ঠিক হয়নি, সুন্দরী নারীদের হাসি সুন্দর, ব্যবহার সুন্দর আমি ভেবে ভুল করেছি। সুন্দর হাসির চেয়ে সুন্দর মুখকে প্রাধান্য দেয়া আমার ঠিক হয়নি। মনে মনে মামাকে বকি, দাদাকে বকি। অসহায় একটা মানুষকে তাঁরা কোন এক অসহায়ের হাতে তুলে দিলেই পারতেন। কথায় ক্ষত হওয়ার চেয়ে ক্ষুধায় ক্ষত হওয়া অনেক ভালো। কথায় এভাবে নিয়ত যারা ক্ষত হয় তারাই শুধু তা জানে।
শ্বশুরালয়ে যাই না, সবাই জানে আমি কিছু করি না। যারা জানে না তারা জিজ্ঞাসা করে, কি করো?
জবাব দিতে পারি না। জুতসই উত্তর দিয়ে দিয়ে ভালো ভালো ফল করেছি। এই প্রশ্নের জুতসই উত্তর আমার জানা নেই। এত বয়সেও একটা পরিচয় তৈরি করতে পারিনি। জীবনকে নিয়ে যখনই ভাবি এতই হীনমন্যতায় ভুগি বলে বোঝানো দায় হবে। নিজের একটা পরিচয় হলে অনেকের সে পরিচয়টা পরিচয় হয়ে উঠে। নিজের পরিচয় না থাকলে তার সাথে জড়িত অনেকেই অসম্মানিত হয়। আমার স্ত্রীকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে আমি কি করি, তখন সে সুন্দর উত্তর দিতে পারে না। তার সামনে গেলে কি আমি সুন্দর ব্যবহার পাবো?
মনে মনে শুধু বলি, কেন এমন করো? একদিন উচ্চারণ করে বলেই ফেললাম, কেন এমন করো?
ভীষণ আশ্চর্য হয়ে সে বললো, কেমন করি?
এমন একখান ভাব যেন কিছুই করে না। একটা কথা বলার পর দুটি কথা বলার রুচি থাকে না। যার সাথে মনের সব দুঃখ-কষ্ট খুলে বলা যায় তার সাথে কথা বলার ইচ্ছাটুকুও মরে গেছে। একা একা ভাবি, একা একা কথা বলি। অর্থওয়ালার আনাড়ি কথাও গুরুত্ব পায়, অর্থ না থাকলে তার শ্রেষ্ঠ কথাটিও ডাস্টবিনের কাঁচামাল হয়।
নিজের কাছে নিজের চেয়ে আপন কেউ নেই৷ আহা, ভাবতাম প্রিয় মানুষটা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বলে চমকে দেবে, অথচ এখন কতই না ভয়ে ভয়ে থাকি কখন কোন কথা বলে রক্তাক্ত করে দেয়। ভাবতাম, প্রিয় মানুষ কাছে ঘেঁষে থাকতে থাকতে বিরক্ত করে তুলবে। অথচ মানুষটা কাছেই আসে না। দূর সব আপন তার, বাইরের জগতে অনেক বেশি বিচরণ। হাসি যত সব মানুষের জন্য, আমার জন্য ঘৃণার নজর, ক্রোধের নজর। মিষ্টি কথাগুলো সব মানুষের জন্য, আমার জন্য কটাক্ষ উচ্চারণ, রাগের বাতাবরণ। সেজেগুজে সুন্দর রূপ বিলায় পরপুরুষে, আমার জন্য রূদ্ররূপ। নানান মানুষের দেখে হয় বিস্মিত, আমায় দেখলেই হয় রুষ্ট, ক্ষুব্ধ।
একজন অপরিচিত মেয়েও যদি নানান দিন নানান মানুষের সাথে ঘুরে বেড়ায় তা দেখেও খারাপ লাগে। সেখানে নিজ স্ত্রী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়, ঘুরতে যায় কেমন অনুভূত হতে পারে বলেন! কিছু যে বলবো, বলবে, অনধিকার চর্চা করবে না।
থেমে যাই, নিজ স্ত্রীকে কিছু যে বলবো সে অধিকারটুকুও নেই। অথচ আমি ভেবেছিলাম আমার স্ত্রী পাশের বাসার মহিলার সাথে দিনভর ঝগড়া করবে, কাজ শেষে বাড়ি এলে নালিশ দেবে। স্ত্রীর গণ্ডি এত সংকীর্ণ হোক এটাও কখনো চাওয়া না, আবার এত বেশি উদারপন্থী হবে সেটাও অকাম্য। চাওয়া-পাওয়ার মাঝে কখনো মিল হবে না যতটুকু লেখাপড়া শিখেছি সে জ্ঞানে আমি জানি। কিন্তু চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে এত বেশি তফাৎ থাকবে তা আমার বোধে মেলে না। মানুষ যা চায় তার থেকে ন্যূনতম হলেও পায়, কিন্তু প্রাপ্তিশূন্য বড় বেমানান। এত বেশি অপ্রাপ্তি জীবনের জন্য অন্যায্য। এত বেশি শূন্যতা কেউ বহন করে না। এত বেশি অপ্রাপ্তি কারো জীবনে নেই। এত বেশি শূন্যতা যার ভেতর তার সাথে কেউ সময় কাটাবে না। তাকে শুনতেই হবে, তুমি কে? তুমি কি?
জীবনের শুরুতে যারা ভুল করে তাদের তা পুষিয়ে নেয়া আর হয় না। জীবন বদলের সিদ্ধান্তগুলোতে আমার ভূমিকা অত্যন্ত বাজে। তাই জীবন জুড়ে তার মাসুল দিতে হচ্ছে। সকাল নিরানন্দ হলে দিনভর রৌদ্রকরোজ্জ্বল আশা করা যায় না। অনেক ভুল সিদ্ধান্ত ঠিক করা যায়। কিন্তু জীবনের কিছু ভুল শুদ্ধ করা যায় না। সেই ভুলের পাঁকে দলিত হতে হয় আজীবন, আমরণ। যখন মন মরা হয়ে বসে থাকি কেউ এসে বলে না, কি হয়েছে। একজন ঠিকই কিছু বলে। বলে, সারাদিন ঝিম ধরে বসে থাকো, তোমার কাছে সময়ের কি কোন মূল্য নেই?
বাজারের থলে আর টাকা হাতে এসে পড়ে। নিজ ইচ্ছায় কিছু কিনতে পারি না। অন্যের ইচ্ছায় চলি, অন্যের ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছা। অন্যের মতই নিজের মত। অন্যের স্বাদই নিজের স্বাদ। স্বমত নেই, স্বাধীনতা নেই, নেই স্বকীয়তা। এ জীবন ভীষণ বিড়ম্বনার। সহ্য করা যায় না, প্রতিবাদ করা যায় না। শক্ত মানুষ শক্তিহীন অর্থহীন হলে। অর্জিত জ্ঞান, অর্জিত সনদ মূল্যহীন কর্ম না পেলে। রাস্তা দিয়ে হাঁটি আর ভাবি সবার জীবনই কি এমন? সবাই কি বাইরে এসে অভিনয় করে ভালো থাকার? সবাই কি বিবর্ণ মনে-প্রাণে? নাকি আমার জীবনটায় কেবল এমন বর্ণহীন, পাণ্ডুর? আমিই কি কেবল বিরল প্রাণী যার সুখ নেই, শান্তি নেই, স্বপ্ন নেই, মানে নেই নেই, নেহাত, নগণ্য, অগণ্য।
বাইরে বাইরে ঘুরি, ঘরে ফিরি না। ঘরের চেয়ে আপন কিছু নেই, সেই ঘরে ফিরতে নেই তৃষ্ণা। ঘর যদি পর হয়, তার আর আপন কিছু থাকে না। বাইরের আলো, আনন্দ নিরানন্দ হয়ে যায় ঘরে যদি আলো, আনন্দ না থাকে। ঘর থাকতে ঘরহীন আমি, আপন থাকতে আপনহীন আমি। শক্ত কথা শোনার চেয়ে বাইরেই ভালো, অযাচিত কথা শোনার চেয়ে বাইরেই ভালো। অতি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ শোনার থেকে রক্ষা পেতে বাইরে বেশি থাকাও বেমানান। ঘরের জ্বর, ঘরে জ্বরা, সে ঘরে ফিরতেই হয়, আর শুনতে হয়, বাইরে গেলে ফেরই না, তোমার মত মানুষের সাথে কোন দুর্ভাগা সময় কাটাই?
অম্বিকার কি দৃঢ় বিশ্বাস আমার সাথে সময় কাটাতে পারে এমন দুর্ভাগা পৃথিবীতে নেই। আমাকে সে ভাবনাতে কত নিচেই না রাখে! পাগলের সাথে কেউ কথা বললেও আমার সাথে কেউ কথা বলবে না, আমাকে নিয়ে এই তার অভিমত। নিজেকে কি এমন করে গড়লাম, নিজেকে কিভাবে তৈরি করলাম কিছু যে জানি-বুঝি-পারি কেউ বিশ্বাসই করে না। রোজগার না করতে পারলে দুটি দক্ষ হাতেরও কোন মূল্য নেই। রোজগার না করতে পারলে উর্বর মস্তিষ্কেরও কোন দাম নেই। সমাজে ন্যূনতম পাত্তা পাই না, গৃহে দূর ছাই দূর ছাই করে সবাই। আমার আশা কেবল দূর আকাশেই ঘুরে বেড়িয়েছে, বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। জেদ করিনি জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে। আর তাই মনে হয় জীবনে জেদী বৌ পেয়েছি। জেদ করা ভালো, কিন্তু সব কিছুতেই জেদ করা কতটুকু ভালো? তিক্ত কথায় সিক্ত হই সারাদিন। যখন আর পারি না বলি, এত ঝাঁঝালো কথা না বললেও পারো।
বলে, সত্য কথার ঝাঁঝ বেশিই।
আসলেই তাই, সবাই আমার সাথে সত্য কথা বলে। কিন্তু অভাগার সাথে একটু মিথ্যে কথা বললে তো হয়, আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিলে তো পারে মানুষ। আমাকে মিথ্যে স্বপ্ন তো কেউ দেখালেও পারে। সেই মিথ্যে স্বপ্নে না হয় একটু হাসবো, আমি তো জানি আমার জীবনে সত্য কিছু ঘটবে না। অলীক নিয়েই আমাকে থাকতে হবে। বড্ড কষ্টের মাঝে একটু মিথ্যে সুখের বাণী শুনলেও যে শান্তি লাগে।
বাবা কখনো কাজ করতে দেননি, কত কষ্ট করে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমাকে ঘিরে তাঁর কত বড় বড় স্বপ্ন ছিলো। বাবার স্বপ্ন মেরে ফেলেছি। তিনি এই বয়সেও এখনো কাজ করেন। বাবার কষ্ট লাঘব না করে এখনো বাড়িয়ে চলেছি। খুব কষ্টে বাবা বলে ফেলেন, তুই পারলি না।
আমি সত্যই পারলাম না। কিছুই না পারা মানুষ খুব কম আছে পৃথিবীতে। সবার কাছে ভারবোঝা হয়ে আছি। ভারবোঝাদের কেউ ভালো চায় না। ভারবোঝাদের কেউ পছন্দ করে না, সম্মান করে না, মূল্যায়ন করে না। জীবনে কখনো ভাবিনি কারো কাছে ভারবোঝা হবো, অথচ আমার সাথে সেই ভারবোঝা শব্দটাই কত সুন্দর মানিয়ে গেছে। আমার কপালে এত দুর্ভোগ লেখা ছিলো ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। হার মানা জীবন এক আমার, যার আহারের নিশ্চয়তা নেই, বাহারের সক্ষমতা নেই।
অম্বিকা চলে যাচ্ছে, আমাদের বাড়ি থেকে, আমার জীবন থেকে। বুঝেছিলাম সে থাকবে না, থাকার হলে থাকতই সব মেনে নিয়ে। অথচ আমি বাধা দিতে পারছি না। দৃঢ় পায়ে হেটে চলে যাচ্ছে। অনায়াসে। একটুও মায়া জন্মেনি মনে। ব্যক্তি যতই ভাল হোক, ব্যক্তির রোজগার না থাকলে ঐ ভাল কোন ভালই না। ব্যক্তি যতই খারাপ হোক, ব্যক্তির অর্থ থাকলে সেই সম্মানিত ও সেরা। হে সুভাষ, ভাবিস না, জীবন জুড়ে তোকে আরও অনেক অপ্রত্যাশিত বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে, জীবনকে গড়তে পারিসনি কেন? তুই জানিস না, সাজানো ঘরে ছাড়া পায়রা থাকে না! কি পেলি সেরা সেরা রেজাল্ট তো করেছিস? জীবনে তো কম দৌড়ালি না, দৌড়ালে হবে? গোল করতে হবে, গোলদাতাকেই মানুষ দেখে। তুই হেরে যাওয়া মানুষ, তোর আক্ষেপ থাকবে কেন? তুই খেদোক্তি করবি কেন? তুই থাক একাকিত্ব নিয়ে, শূন্যতা নিয়ে, না পাওয়া নিয়ে। অপ্রাপ্তিই তোর ঐশ্বর্য। দুঃখ, কষ্টই তোর ঐশ্বর্য। ভালো রেজাল্ট করার জন্য আর কখনো নিজেকে যোগ্য ভাববি?
===============
যশোর থেকে