উইলিয়ম কেরি, বাংলা ছাপাখানা, ও জেলা মালদহ :
রীতা রায়
আধুনিকতম প্রযুক্তিবিদ্যার সুবাদে, আজকের সময় কত দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যোগাযোগ মাধ্যম কত সহজ হয়েছে। শুধু মুখের কথা দিয়ে নয়, অক্ষর সৃষ্টি ও বিন্যাসের মাধ্যমে মানুষ কত সহজে তার মনের ভাব অন্যের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আবার ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে আপ্লুতও হচ্ছে.. কারন প্রতিটি হাতের মোবাইল ফোনটিই আজ এক একটি ছাপাখানা। ইংরেজি অক্ষরের পাশাপাশি এসেছে আঞ্চলিক ভাষায় ছাপার অক্ষর। কিন্তু, সবাই কী জানে ছাপাখানার ইতিহাস? বিশেষতঃ বাঙালিরা কী জানে বাংলা ছাপা অক্ষর আবিষ্কারের কথা?
ভারতে ছাপাখানার কাজ শুরু হয় ১৫৫৭ খৃষ্টাব্দে, গোয়ায়। কিন্তু বাংলা অক্ষরের ছাঁচ তৈরি ও ছাপাখানা স্থাপন করতে আরও দুশো বছর অতিক্রম করে। বাংলা অক্ষরকে ছাপার ছাঁচে ঢালার প্রথম চেষ্টা করেন উইলিয়াম রোলটস্ লন্ডনের অভিজ্ঞ কারিগর দিয়ে, কিন্তু তিনি সক্ষম হননি। পরবর্তীতে হেস্টিংস সাহেব যখন বড়লাট তখন কোম্পানীর এক কর্মচারী চার্লস্ উইলিয়ামস্ বাংলা অক্ষরের ছাঁচ তৈরি করতে সক্ষম হন এবং তিনি হুগলীর পঞ্চানন কর্মকারকে বিষয়টি শিখিয়ে দেন। এই পঞ্চানন কর্মকারের মাধ্যমে ছাপাখানা সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
মূলতঃ পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে তার থেকে জন্ম নিল স্বদেশিকতা। আর তখনই ভাব বিনিময়ের জন্যে প্রয়োজন পড়ল বাংলা সংবাদপত্রের। সুতরাং প্রয়োজন পড়লো বাংলা ছাপাখানা। বাংলা সাংবাদিকতার জন্মের দেরি হওয়ার মূল কারন বাংলা গদ্যের অপরিনত অবস্থা।
ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের শ্রীরামপুরের মিশন বাংলা গদ্যের আঁতুর ঘর হলেও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান অনস্বীকার্য। উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড এবং যশূয়া মার্শম্যান এই মিশন আঠারোশো খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০০-১৮১৮ খৃঃ অবধি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে বেশকিছু মূল্যবান বই প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে উল্লেখনীয়, কেরীর 'Bengali Grammer', রামরাম বসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র', ও 'লিপিমালা', রাজীব মুখোপাধ্যায়ের 'মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম', মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের 'বত্রিশ সিংহাসন', ও 'রাজাবলী', গোলকনাথ শর্মার 'হিতোপদেশ' ও হরপ্রসাদ রায় এর 'পুরুষ পরীক্ষা'। এছাড়া, ' রামায়ন' (১৮০১) ও 'মহাভারত' (১৮০২) প্রকাশিত হয়।
উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় 'কথোপকথন' (১৮০১) ও 'ইতিহাসমালা' (১৮১২) গ্রন্থ রচনা করেন।
জ্ঞাতব্য বিষয় হল বাংলায় তথা দেশে প্রথম দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা ১৮১৮ সালে প্রকাশিত "বাঙ্গাল গেজেটি"। একই বছরে "মাসিক দিগদর্শন" এবং সাপ্তাহিক "সমাচার দর্পন" শ্রীরামপুর মিশন থেকে মার্শম্যান সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। বাংলা তথা দেশিয় ভাষায় পত্র পত্রিকার যাত্রা এখান থেকেই শুরু।
বাংলা ছাপাখানা স্থাপন ও বাংলায় প্রথম পুস্তক ও পত্রপত্রিকা প্রকাশে উইলিয়াম কেরির অবদান অনস্বীকার্য। (William Carey)র জন্ম ১৭ই আগষ্ট ১৭৬১ ও মৃত্যু ৯ই জুন ১৮৩৪। তিনি ছিলেন একাধারে মিশনারি ও ব্রিটিশ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক, যাজক, ব্যাপটিষ্ট, অনুবাদক, সামাজিক সংস্কারক, এবং সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ। ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, প্রথম ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর কলেজ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে বাংলাভাষায় পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক বলা হয়।
প্রতিবছর 'সতেরই আগষ্ট' নিয়ম করে পালিত হয়ে থাকে উইলিয়াম কেরীর জন্মোৎসব মালদহের 'মদনাবতী'তে। কেরী সাহেব হুগলী জেলায় শ্রীরামপুরে ছাপার কাজ শুরু করার পূর্বে ঐ মূদ্রণ যন্ত্রটি মালদহের' নীলকুঠী'তে স্থাপন করেছিলেন। কেরী সাহেব মালদহে এসেছিলেন ১৭৯৪ খৃস্টাব্দে । এখানেই তিনি রামরাম বসুর সহায়তায় বাংলা ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ কার্য্য শুরু করেছিলেন। রামরাম বসুকে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা এবং আদি লেখক ও দেশিয় পন্ডিত বলা হয়ে থাকে। এই মালদাতেই তিনি 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। তিনি মদনাবতী নীলকুঠীতে কেরীসাহেবের মুন্সী হিসাবে কাজ করতেন।
সুতরাং বাংলা অক্ষর মূদ্রণ যন্ত্রটি প্রথম মালদহেই স্থাপিত হয়। আর মালদহবাসী হিসাবে আমরা গর্ববোধ করি। আগামী ১৭ই আগষ্ট কেরী সাহেবের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কয়েকটি ছাপার অক্ষর দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানালাম।
*******************
----রীতা রায়
মহেশমাটি রোড, মালদা