পাঠশালা বসানো গেল
-প্রদীপ বিশ্বাস
তেঁতুল তলায় বসে বাখারি চেঁছে ঠিক করছিল শীতল কাকা, ছাউনির চটা তৈরী করছে। দুলুর মা কলকেতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে এইমাত্র। চেঁচাড়িগুলো একপাশে জড় করে রেখে গেল, জ্বালানি হবে।
শীতল কাকা হুঁকোতে টান দিতে দিতে কী যেন চিন্তা করছে। কাল রাতে সিন্ধু এসেছিল, শুতে যাবার সময়। উঠোনে দাঁড়িয়ে ডেকেছিল - খুড়ো ঘুমালে নাকি?
- না, ক্যানরে! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
- এই এলাম একটু কথা বলতে।
সিন্ধু মানে সিন্ধু কাকা। শশী বুড়োর একমাত্র ছেলে। দরজার আগল খুলে দাওয়ায় এসে বসে শীতল কাকা।
- আয়, কী ব্যাপার! এত রাতে কি কথা!
- শোনো খুড়ো, এ পাড়ায় একটা পাঠশালা খুললে কেমন হয়!
- পাঠশালা! তা হঠাৎ পাঠশালা খোলার কথা মাথায় এলো ক্যান্?
- শোনো কথা! এপাড়ার ছেলেমেয়েদের কথা একবার ভাবতো খুড়ো! পাঠশালায় না গেলে এরা মানুষ হবে কী করে! খাচ্ছে আর ডাংগুলি খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর ওর গাছের পেয়ারা, ডালিম, আম পেড়ে পেড়ে খাচ্ছে। মগডালে উঠে পাখির বাচ্চা খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর একটু বড় হলেই চাষের কাজে লেগে যাচ্ছে, নয়তো চারো-পাটা-জাল নিয়ে বিলে নেমে পড়ছে। এরম হলে ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যত কী হবে ভেবে দেখেছো খুড়ো!
- হুঁ, সরকারি স্কুলটাও পুবপাড়ায়। ওখানে ছেলেমেয়েদের পাঠানো যায়, কিন্তু মাঝের খালটাই যা সমস্যা। পারাপারের ভালো কোনও ব্যবস্থা না হলে ওরা যেতে পারবে না। আমাদেরই অসুবিধা হয় ভাঙা সাঁকোটা পেরোতে। ওরা যাবে কী করে!
- তাই বলছিলাম খুড়ো একটু চিন্তা করো। এপারে ছেলেমেয়েদের তো অভাব নেই। প্রায় প্রতি বাড়িতে পাঠশালায় পাঠাবার ছেলেমেয়ে আছে। দরকার শুধু পাঠশালা বসানোর উদ্যোগ আর জায়গা।
- সমস্যা আরো আছে। মাথা চুলকায় শীতল কাকা। - পাঠশালা বসাতে হলে সবার মতের দরকার। না'লে সবাই ছেলেমেয়ে পাঠাবে না। তিন/চার রকমের দলাদলি আছে। জদ্দাররা পুবপারের দিকে ঝুঁকে। বাড়ইরা হয়তো সাথে থাকবে। মাঝে রইলো তোদের পাড়া। তুই শুরু করলে অমূল্য থাকবে না। সমস্যা বাড়বে।
সিন্ধু কাকা জানে শীতল অমূল্যর বন্ধু। সেই তাকে পথে আনতে পারবে, তাই কথাটা পেড়ে রাখলো। বাসু সেদিন যে কান্ড ঘটিয়েছে তাতে বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেই হচ্ছে। এরম ইচ্ছে আরও অনেকের থাকতে পারে। সেই ইচ্ছেগুলোকে উসকে দিলেই কাজটা সহজ হবে।
শীতল কাকা কথা দিয়েছিল ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে, অমূল্যর সাথে কথা বলবে।
বিনু জ্যেঠুর গলা শোনা গেলো - আমি আজ সন্ধ্যেয় চারো চেয়ে (মাছ তুলে নিয়ে) বাড়ি ফেরার পথে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, কিছু কিছু কথা কানেও শুনেছি। বড় পুকুরের ঘাটে অমূল্য রসিককে বলছিল - শুনেছো বড়ো'কা, গিশ্যের ছাওয়াল নাকি পন্ডিত হতে গেছিলো কাল। পুন্য'র ছাওয়ালের সাথে, সতীশ ঢালির পাঠশালায়। দিগগজ হবে! আর তো বসে থাকা যায় না। একটা কিছু করতে হবে।
- তাই নাকি! পন্ডিত হবে! গিশ্যের ছাওয়াল!!! হিঃ হিঃ হিঃ---!
- তা'লে বাড়ির সবাইকে ডেকে বসা। আমাদের বাড়িতেও তো পোলাপান আছে না কী! ওদেরকে নিয়েও তো ভাবতে হবে!
- তা'লে দেখ্ সিন্ধু, জলঘোলার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
- তবু আমাদের বসে থাকলে চলবে না, পাঠশালা বসাতেই হবে, সিন্ধু কাকা বলল।ভাগাভাগি না হয় সে চেষ্টাও করতে হবে। অমূল্যদা'র সাথে শীতল খুড়োর গলায় গলায় ভাব। চাইলে শীতল খুড়োই অমূল্যদা'কে রাজি করাতে পারবে।
- চেষ্টা করবো, মাথা চুলকে শীতল খুড়ো বলল।
শীতল কাকা কথা রেখেছিল। অনেক কষ্টে অমূল্যকে বুঝিয়ে ছিল ব্যাগড়া দিলে তারই অপযশ হবে। সবাই বলবে ভালো কাজে ব্যাগড়া দিয়েছে।
কিছুতেই অমূল্যর মন মানতে চায় না যে গিশ্যের ছাওয়াল সতীশ ঢালির পাঠশালায় গেছে বলেই এপাড়ায় পাঠশালা বসানোর কথা ভাবা হচ্ছে।
অমূল্যকে বোঝানো হলো উদ্যোক্তাদের মধ্যে তার নাম উপরের দিকে থাকবে।
শেষমেশ পাঠশালা বসানো গেল। খালপাড়ে বাণিকান্ত ঠাকুরদার বাড়ির সামনে। পাঠশালার প্রথম মাষ্টার হ'লো মাদার পন্ডিত।
সিন্ধু কাকার উদ্যোগ সফল হ' লো।
======================