সুপ্তা আঢ্য
প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসে সন্তানের স্পর্শসুখ অনুভব করল অনন্যা।হসপিটালের বিছানায় ওর বুকের ওমে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে একরত্তিটা।এই দিনটা দেখবে বলেই তো এতকষ্ট স্বীকার করে একা একা এতটা পথ চলা।অথচ এমনটাতো হওয়ার কথা ছিল না-----ও আর পরম একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়েটা করেছিল।সেই স্কুলবেলার প্রেম ওদের।তারপর কলেজ,ইউনিভার্সিটির দরজা পেরিয়েও হাত ছাড়েনি একে অপরের।এরপর একসাথে দুজনে চাকরীতে জয়েন করলে দুই পরিবার একসাথে মিলে ওদের চারহাত এক করে দেয়।বিয়ের পরের দিনগুলো স্বপ্নের মতো কেটেছিল ওদের।পরম ওকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে রাখত----ঝগড়া,খুনসুটি,মান অভিমান ওদের ভালোবাসার কাছে স্থায়ী হতে পারেনি কখনও।ওর মা আর শাশুড়িমা বলতেন"তোদের ভালোবাসায় কখনও যেন কারোর নজর না লাগে।" এসব কথা হেসে উড়িয়ে দিত পরম।
প্রায় চার বছর পর যখন শত চেষ্টাতেও অনন্যার কোল ভরছিল না তখনও ছন্দপতন হয়নি ভালোবাসার। আগের মতোই ভালোবাসায় যত্নে আগলে রেখেছিল পরম ওকে।বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল অনন্যার সেরকম কোনো সমস্যাই নেই।মাতৃত্বলাভের জন্য ওর শরীর একেবারে তৈরী।পরম ভীষণ উদারমনস্ক হলেও এসব ব্যাপারে ভীষণ গোঁড়া হওয়ায় কিছুতেই ডাক্তার দেখাতে রাজী হয় না ও।অনন্যার হাজারো মান অভিমান টলাতে পারেনা ওকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে।আর এতেই অনন্যার সন্দেহ জাঁকিয়ে বসে পরমের ওপর।আস্তে আস্তে একে অপরের থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছিল দুজনে।রোজ এই এক বিষয়ের আলোচনায় কোনো দিশা না পেয়ে দুজনের মধ্যে কথাবার্তাটাও কমে আসছিল আজকাল।আগের মতো মান অভিমান, খুনসুটিও হয়না ওদের ।একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলে দুজনের মধ্যে।মুখে কিছু না বললেও ছেলের প্রতিই শাশুড়ি মায়ের সমর্থন বুঝে চুপ করে আরও নিজেকে গুটিয়ে নেয় অনন্যা। ধীরে ধীরে একটা চাপা হতাশা গ্রাস করতে থাকে ওকে।
একই অফিসে চাকরী করার সুবাদে ওদের দুজনের বেশ কিছু কমন ফ্রেণ্ডস আছে।পরম আর অনন্যার জুটিটাকে সবাই বেশ অন্য চোখেই দেখত।তবে ইদানীং ওদের এই ছাড়ো ছাড়ো ভাবটাও নজর এড়ায়নি কারোর।আজকাল আর একসাথে লাঞ্চও করেনা দুজনে।ওদের একে অপরকে এই চোখে হারানোর ব্যাপারটা সকলের কাছে দৃষ্টিমধুর থাকলেও এখনকার ঠাণ্ডাযুদ্ধটাও চোখ এড়াচ্ছে না বলেই ওদের বন্ধুমহল ও বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ওদের নিয়ে।এখন প্রায়দিন একাই লাঞ্চ সারে অনন্যা। একদিন লাঞ্চটাইমে পল্লবী এসে কোনো ভণিতা না করেই বলে"কী রে,এতদিন তো তোদের ঝগড়া স্টে করেনা!তোদের ভালোবাসার কাছে সে তো পাত্তাই পায় না।এবার কী এমন হল যে দুজনে এরকম ছাড়োছাড়ো ভাবে রয়েছিস!"
নিজের মনের ভাব গোপনে রেখে ঠোঁটের কোলে হাসি ফুটিয়ে বলল"আরে না না-----সেরকম কিছুই না।কিছু হলে তোকে তো বলতাম পলি।আজকাল আর কিছু হয় না।"
"কী বলছিস কী-----তোদের ভালোবাসায় আমরা চার্মড হই।এভাবে হেরে যাচ্ছিস কেনো।চেষ্টায় কী না হয়!"
"আর চেষ্টা করিনা রে।মন না মিললে শুধু শরীরী মিলনে কী কিছু লাভ হয় বল!"
"ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি?"
"পরম ডাক্তার দেখাবে না---আর আমার তো কোনো সমস্যা নেই।শুধু শুধু ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী হবে।"
"দেখ,তোদের এই দুরত্ব মেটাতে পারে শুধু একটা শিশু।এত চেষ্টাতেও যখন কিছু হচ্ছে না,তখন একটা বেবিকে দত্তক নিয়ে নে।"
"কি বলছিস কি তুই----দত্তক নেবো!পরম রাজী হবে?"
"তোরা দুজনেই শিক্ষিত, আধুনিক ----দত্তক নিলে একটা সবহারা শিশু মা বাবা পাবে আর তোরাও সন্তান পাবি।একটু ভেবে দেখিস ব্যাপারটা।"পল্লবীর কথাটা অনন্যার বেশ মনে ধরলো।সেদিন রাতে অন্যান্য দিনের মতো খাটের একপাশে সরে না গিয়ে পরমের শরীর ঘেঁষে সরে এল ও।পরম ওর এহেন আচরণে একটু অবাক হলেও মুখে কিছু না বলে জড়িয়ে ধরল অনন্যাকে।বহুদিন পর স্বামীর বাহুলগ্না হয়ে বেশ অন্যরকম অনুভূতি চ্ছিল ওর।একটু আদুরে গলায় বলল"একটা কথা বলব?"
ওর বুকে মুখ ডোবাতে ডোবাতে পরম বলল"হুঁ,বলো।"
"দেখো,আমরা তো চেষ্টা কিছু কম করছি না।এবার একটা অন্য উপায় বের করলে হয়না!"
"অন্য উপায়-----কী সেটা শুনি।"
"একটা বাচ্চাকে দত্তক নিলে কেমন হয়!"এক ঝটকায় ওর শরীর থেকে মুখ তুলে পরম বলল"এটা আবার তোমার মাথায় কে ঢোকালো?"
"কেউ না,আমার নিজেরই মনে হচ্ছিল---'তাই তোমাকে বললাম।নেবে দত্তক? "
"না অনু,অন্যের ফলানো ফসল দিয়ে ঘর ভরাতে পারব না।আর তাছাড়া----"
একটু আহত হয়ে অনন্যা বলল"তাছাড়া কি পরম!"
"একটা জাতেরও তো ব্যাপার আছে-----কোন জাত,কী বংশ এসব না জেনে আমি বাড়িতে ঢোকাবো না।"
"কী বলছ তুমি-----শিশুর আবার জাত কী?"
"বাবা মায়ের জাত থাকলে বাচ্চার ও জাত থাকবে।"
"পরম তুমি এত শিক্ষিত হয়ে একথা বলছ!তুমি চাওনা একটা অনাথ শিশু মা বাবা পাক।তুমি বাবা হতে চাওনা পরম!"
" হ্যাঁ চাই-----কিন্তু এভাবে নয়।অত সমাজসেবা আমার চলবে না।একটা অজ্ঞাতকুলশীলকে নিজের সন্তান ভাবতে আমি পারব না।আর তাছাড়া মা ও এটা মেনে নেবে না।"পরমের কথায় আহত হয়ে খাটের অন্যপ্রান্তে গিয়ে চোখের জল লুকোতে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল অনন্যা।
এসব ভাবতে ভাবতে সময় যে কখন বয়ে চলেছে খেয়ালই ছিল না অনন্যার। হঠাৎই একরত্তিটার কান্নার আওয়াজে চমক ভাঙতেই দেখল ছোট্ট মানুষটা ঘুম ভেঙে খিদেয় কাঁদছে।কান্নার আওয়াজে সিস্টার দৌড়ে এসে অনন্যার বুকের ওপর থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে খাইয়ে বেডের পাশে রাখা বেবি কটটায় শুইয়ে ওকে বলল"আপনি এবার একটু বিশ্রাম করুন দিদি।আমি তো আছি।"সিস্টারের কথায় অল্প হেসে শুয়ে পড়ল ও।বেশী নড়াচড়া করলেই সদ্য হওয়া সিজারের সেলাইটা টনটন করে উঠছে।তাই অতি সাবধানে শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেও ঘুম আসছেনা কিছুতেই।চোখটা খুলে বালিশে হেলান দিয়ে খুদেটার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল এখন ওর অনেক দায়িত্ব----সিঙ্গল মাদার হয়ে একলা হাতে মেয়েটাকে যথোপযুক্ত করে বড়ো করে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে বসে একলাই লাঞ্চ সারছিল পরম।বেশ কিছুদিন ধরেই অনন্যা অফিসে আসছে না-----হয়ত ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে।একই অফিসে থাকার সুবাদে অনন্যার মাতৃত্বকালীন পরিবর্তন চোখে পড়লেও সেটা দুচোখ ভরে অনুভব করার সুযোগ হয়নি ওর।তার আগেই বাড়ি ছেড়েছিল অনন্যা-----পরমের কোনো কথাই শুনতে চায়নি।স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ডোনারের স্পার্মের সাহায্যে মা হতে চলেছে অনন্যা-----এই খবরে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল পরম।অন্যের সন্তান নিজের স্ত্রীর গর্ভে বেড়ে উঠবে,এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি ও।অনন্যাকে অ্যাবরশন করিয়ে নিতে বলায় একরাশ ঘৃণা ভরা চোখে পরমের দিকে তাকিয়ে সেদিনই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অনন্যা। শিক্ষিত, আধুনিক হয়েও অন্যের ঔরসজাত সন্তান বেড়ে উঠবে নিজের স্ত্রীর গর্ভে-----এই ব্যাপারটায় বড্ড পৌরুষে লেগেছিল পরমের।নিজের অক্ষমতা ঢাকতে জাত,বংশ এসব নিয়ে বেশীই মেতে উঠেছিল ও।তাই অনন্যার বাড়ি ছাড়ার কথাতেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও টলেনি পরম।
অফিসে ওদের বন্ধুরা ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অফিসের কিছু মানুষ অনন্যার সাহসিকতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে অবশ্য ফেমিনিজম এর সুরও কিছুটা মিশেছিল।তাতে অবশ্য কোনো হেলদোল ছিল না পরম আর ওর বন্ধুদের। নিজেদের পুরুষত্বের তকমাটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছিল সদর্পে।তবে এই অবস্থায় অনন্যাকে দেখে মাঝেমধ্যেই বুকের ভেতরটা এক অজানা ব্যথায় টনটন করে উঠত।নিজের সন্তান হলে পরমও তো এই সুখসময়ের ভাগীদার হতে পারত।কিন্তু অন্যের সন্তানকে কিছুতেই নিজের বলে ভাবার মতো উদার হতে পারছিল না বলেই নিজের প্রতি হওয়া রাগটা অনন্যার ওপর গিয়ে পড়ছিল। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই লাঞ্চ সারছিল পরম।হঠাৎই উল্টোদিকের চেয়ারে পল্লবী এসে বসতেই বুকের ভেতরটা এক অজানা আশঙ্কা ,আনন্দ মিশিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল ওর।কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে একটু সামলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে জিজ্ঞেস করল"কিছু বলবে ?"
"হ্যাঁ পরমদা,অনন্যার মেয়ে হয়েছে।"
ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হলেও বাইরে তা প্রকাশ না করে বলল"ও ভালোই তো।কেমন আছে তোমার বান্ধবী?"
"ভালো আছে পরমদা।বাচ্চাটার কথা জানতে চাইবে না?"
একটু ইতস্তত করে বলল"হ্যাঁ ----মানে কেমন আছে বেবি।"
"ভালো আছে।খুব মিষ্টি দেখতে হয়েছে মেয়েটা-----অনন্যার মতোই হবে মনে হল।"
"তাহলে তো ভালোই হবে।"কথাটা বলেই মুখ নামিয়ে বসে রইল পরম।আজ তো ওরই থাকার কথা অনন্যার পাশে-----কিন্তু কী যে হয়ে গেল।অনন্যা আর একটু সময় দিতে পারত ওকে।ওর কথা না শুনে নিজে নিজেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।আর তাছাড়া অনন্যা তো ওকে আজকাল দেখেও দেখে না।কী নাকি নিজের লড়াই নিজেই লড়বে।দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কী হয়।
"কী হল পরমদা,চুপ করে আছ যে।দেখো ,আমরা সবাই চাই তোমাদের ঝামেলাটা মিটে যাক।"
অল্প হেসে পরম বলল"তোমার স্বাধীনচেতা বান্ধবী বোধহয় সেটা হতে দেবে না।চলো অফিসে যাওয়া যাক।"
পরম চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বসে রইল পল্লবী।ও ভীষণভাবে চায় পরম আর অনন্যা আবার আগের মতো থাকুক।ও বুঝতে পারে ,দুজনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে---‐-অথচ কেউ কাউকে বলতে পারছে না।বাচ্চাটার কথা শুনে পরমের মুখচোখের পরিবর্তন চোখ এড়ায়নি পল্লবীর। শুধু পল্লবী নয়,যারা অনন্যার পক্ষে থেকে ফেমিনিজমের সুর চড়িয়েছিল-----তারাও চায় ওরা একসাথে থাকুক।পরম মেনে নিক সবটা।আর অন্যদিকে যারা পুরুষত্বের মালা গলায় পরেছিল,তারাও চায় --‐--অনন্যা ফিরে আসুক পরমের কাছে।কোল আলো করে সন্তান যখন এসেছে তাকে মেনে নিক পরম।এরকম তো আজকাল হয়েই থাকে।এতে লজ্জার কিছু নেই।তবে এগুলো সবই ওদের নিজেদের কথা------কেউই সাহস করে ওদের দুজনকে বলতে পারেনা কথাগুলো।
এরপর প্রায় ছমাস কেটে গেছে।অনন্যা এখন ওর মা বাবার কাছেই থাকে বাচ্চাটাকে নিয়ে।ওদের ডিভোর্সটা এখনও হয়নি।আসলে বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এদিকে মন দেওয়ার সময়ই পায়নি বোধহয় অনন্যা। পরমের মা প্রায়ই বলেন,"ও তো ভালোই আছে বাচ্চাটাকে নিয়ে।তুই ওকে ডিভোর্স দিয়ে আর একটা বিয়ে করে বাবা হওয়ার আনন্দ উপভোগ কর।ওকে ভুলে যা।"মাকে কিছু না বললেও পরম আজকাল ভীষণ ভয় পায়।নতুন করে বিয়ে করলেই যে ও বাবা হতে পারবে তার কী গ্যারাণ্টী আছে।অনন্যার যে কোনো প্রবলেম নেই সেটা তো প্রমাণ হয়েই গেল।তবে কী ও ই অক্ষম? আর তাছাড়া অনন্যাকে ও আজও একইরকম ভালবাসে।অনন্যা চলে গিয়ে সেটা আরও বেশী করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে ওকে।এই বেশ ভালো আছে ও।অনন্যা ভালো থাক।সেটা দেখেই ও ভালো থাকবে।বেশ কিছুদিন হল অনন্যা অফিস জয়েন করেছে।মাতৃত্বের সৌন্দর্যের দ্যুতি ওর চোখেমুখে।চেহারাটা আগের থেকে অল্প ভারী হলেও তা ওর সৌন্দর্যকে ঢাকতে পারেনি বরং তা আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।ওর এই সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখার অধিকার বোধহয় ওর আর নেই।তাই চোরাচাহনি দিয়ে অনন্যার সৌন্দর্যসুধা পান করেই মনে মনে শান্তি পায় ও।অনন্যাকে দেখে মনে হয় না ওর কোনো কষ্ট আছে।বরং সন্তানস্নেহ ওর সব কষ্ট, হতাশা ভুলিয়ে ওকে আগের মতোই প্রাণবন্ত করে রেখেছে।এই দৃশ্য পরমকে আনন্দ দিলেও বুকের গভীরে একটা কাঁটা বিঁধতে থাকে------যে কাঁটার আঘাত বাইরে থেকে দেখা না গেলেও বুকের ভেতর ক্রমাগত রক্তক্ষরণ করেই চলেছে।
বাচ্চাটাকে নিয়ে অনন্যা সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও কিছুই ভুলতে পারেনা।মেয়েটার দিকে তাকালেই অফিসে দেখা পরমের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।আজকাল পরম নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজের মধ্যে------অফিসে বেশী কথাই বলে না।সেই জেদী,হুল্লোড়বাজ,পুরুষত্বে ভরপুর পরমকে বড্ড মিস করে ও।চেহারাটাও কেমন যেন ভেঙে গেছে মানুষটার।যে মানুষটা অন্য কারো ওর দিকে তাকানো নিয়ে ভীষণ পসেসিভ ছিল,সে আজ ওর দিকে চোখ তুলে তাকায়ও না।তবে পরম যে একটা চোরাচাহনি দিয়ে ওকে দেখে এটা অনুভব করতে পারে ও।বাবা মা প্রথমদিকে প্রায়ই বলত,পরমকে ডেকে মিটমাট করে নিতে।কিন্তু এতগুলো দিনেও পরমকে না দেখে ওনাদের সেই মোহ কেটে গেছে।এখন বলে,ওই পিছুটান আর না রাখতে।পরমকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে।কিন্তু চোখের সামনে নিত্যদিন ওই মানুষটাকে ক্ষয়ে যেতে দেখে কি করে ওকে শেষ হয়ে যেতে দেবে অনন্যা। আর তাছাড়া পরমকে ডিভোর্স দিলে সবচেয়ে বেশী কষ্ট বোধহয় অনন্যা নিজেই পাবে।যতই ও পরমকে ছেড়ে চলে আসুক,ওর এখনও আশা নিজের ভুল বুঝে ওকে পরম ফিরিয়ে নিতে আসবেই।
ইদানীং অফিসে পরমের একটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে অনন্যার। অফিসে আসার ঘণ্টাখানেক পর থেকেই কেমন যেন উসখুশ করতে থাকে।তারপর বেলা বারোটা বাজলেই কোথায় একটা বেরিয়ে যায়-----ফিরে আসে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর।অফিসে এটা নিয়ে চাপা আলোচনা শুরু হয়ে গেলেও পরমের কোনো হেলদোল নেই।বরং বেশ হাসিখুশিই দেখায় আজকাল ওকে।পুরোনো পরম ফিরে এসেছে আবার।অফিসে পরমকে নিয়ে চাপা আলোচনায় লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে ওর।পরমের বন্ধুরা এই ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করলে হেসে উড়িয়ে দেয় ও।ভীষণই রাগ হতে থাকে পরমের প্রতি।অনন্যা ঠিক করে ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করেই ও ছাড়বে।যদি পরম কারোর সাথে জড়িয়ে পড়ে ,অনন্যা নিজেই ওকে মুক্তি দিয়ে দেবে।এসব সাতপাঁচ ভেবে পরম একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর পিছু নিয়ে অনন্যা দেখে পরম একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যেন কারোর জন্য অপেক্ষা করছে।চরম উত্তেজনায় জায়গাটা চেনা চেনা মনে হলেও কিছুতেই চিনতে পারছিল না অনন্যা। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখল বাড়ির বড় দরজাটা খুলে একপাল কচিকাচা বেরিয়ে আসছে।একটু হলেও অবাক হওয়ার আরও যে বাকী ছিল তা একটু পরেই বুঝতে পারল অনন্যা। হঠাৎই দেখল ওই বাচ্চাদের থেকে একটা বাচ্চা দলচ্যুত হয়ে পরমের কোলে উঠে পরল।দূর থেকে বাচ্চাটাকে ওর মেয়ে রেশমের মতো মনে হচ্ছিল। দূর থেকে দেখতে পেল বাচ্চাটা কোলে উঠে পরমের গলা জড়িয়ে ওকে আদর করছে।তারপর বাচ্চাটাকে নিজের গাড়িতে তুলতেই অনন্যাও একটা ট্যাক্সি ডেকে ওদের অনুসরণ করতে শুরু করে যেখানে পৌঁছল-----সেই জায়গাটা দেখে অনন্যার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না-----ওর নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে।আর পরমের কোলে রেশম গলা জড়িয়ে আছে।হঠাৎই গাড়ি থেকে নেমে অনন্যাকে সামনে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় পরম।ততক্ষণে গাড়ির আওয়াজে ওর বাবা মাও বাইরে বেরিয়ে এসেছেন।অনন্যাকে দেখে সবাই তোতলাতে থাকলে রেশম আধো আধো স্বরে বলে উঠল "তুমি কি বাবাইকে বকবে মাম্মাম?"
একটু গম্ভীর গলায় অনন্যা বলল"তোমাকে একথা কে বলল ?"
"বাবাই তো বলেছে,তুমি জানতে পারলে বাবাইকে ভীষণ বকবে।বাবাইকে বকোনা মাম্মাম------বাবাই ভীষণ ভাল।"
অনন্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল"সে তো বটেই,আমিই তো খারাপ।"
রেশমকে বুকের সাথে আরও আঁকড়ে ধরে পরম বলল"না অনু,তুমি ভাল মা তাই তো রেশমকে প্রথম থেকে আগলে রেখেছ।আর আমি নিজের অক্ষমতা ঢাকতে পুরুষত্বের ধ্বজা কপালে সাঁটিয়ে অহংকারে মদমত্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।আজ সন্তান স্নেহ আমার সেই অহংকার ভেঙে দিয়েছে অনু।আমাকে রেশমের বাবা হওয়ার একটা সুযোগ দেবে?"
ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে কখন যেন অনন্যার বাবা মা ঘরে চলে গেছেন।মানুষটার আকুতি অনন্যাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিচ্ছিল তবু যথাসম্ভব নিজেকে স্থির রেখে ও বলল"তুমি পারবে তো পরম অন্যের সন্তানকে নিজের ভাবতে!"
"একথা বলে আমাকে আর লজ্জা দিও না অনু -----তোমাদের ছেড়ে আমি একটা দিনও আমি ভাল ছিলাম না।আমাকে ছেড়ে আসার সাথে সাথে আমার অহংকারটাকেও ভেঙে দিয়েছিলে তুমি।সন্তানসম্ভবা তোমাকে চোখের সামনে দেখে ভীষণ ইচ্ছে করত তোমার সাথে একাত্ম হয়ে তোমার গর্ভে কান দিয়ে ওর হৃদস্পন্দন শুনতে।রেশম হওয়ার খবরটা শুনেই ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে দুহাতের পাতায় নিয়ে আদর করতে।আমার মেল ইগো আমাকে যেতে দেয়নি অনু।তবে যেদিন তোমার বাবার সাথে রেশমকে দেখলাম------সেদিন আর নিজেকে সামলাতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বুভুক্ষু হৃদয়কে শান্ত করেছিলাম।তোমার বাবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম ,আমিই ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসব-----তবে সবটাই হবে তোমাকে লুকিয়ে।"
"আমাকে লুকিয়ে কেন?"
"না মানে -----তুমি যদি রাগ কর----তাই----।আমি এখন চলি রেশম-----মায়ের কথার অবাধ্য হবে না।"রেশমকে আদরে আদরে ভরিয়ে কোল থেকে নামিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই অনন্যা বলল"কোথায় যাচ্ছ একা।আমাদের সঙ্গে নেবে না?"
"তুমি যাবে অনু!তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ!"
"কী করব----তোমাকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখতে পারব না যে----"
"মানে?"
"আমার থেকে লুকিয়োনা পরম-----রেশমের জন্মের পর থেকেই তোমার মধ্যেকার বদলটা আমার চোখ এড়ায়নি। আর ইদানীং তোমার এই নবরূপ সব্বাইকে ভাবাচ্ছিল।আর তাই আজ তোমার পিছু নিয়েছিলাম শেষ দেখব বলে।"
"কী পেলে অনু আমাকে ফলো করে-----"
"পেলাম আমার স্বামীকে-----আমার মেয়ের বাবাকে।চলো ঘরে চল।"
"তুমি অফিস যাবেনা মাম্মাম?"
"আজ আমরা কেউ অফিস যাবনা-----আজ তোমাকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব।"
"কোথায় যাব বাবাই?"
"তোমার মাম্মামকেই জিজ্ঞেস করো।"
রেশমের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল"আজ আমরা আমাদের বাড়িতে যাব।কীগো,নিয়ে যাবে তো!"
"কী যে বলো----আমার প্রিন্সেস নিজের বাড়িতে যাবে,এর থেকে আনন্দের আর কিছুই নেই।মা ভীষণ খুশী হবে তোমাদের দেখলে।"কথাগুলো বলে অনন্যার কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে বলল"আমার একটা আব্দার আছে অনু।"
পরমের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পরম বলল"আমার এবার একটা প্রিন্স চাই।আর এবার সবটা আমি নিজের হাতে করব।"
লজ্জায় লাল স্বামীর হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে ফিসফিসিয়ে বলল"ঘরে চলো।"
===================
Supta Auddy
23/1 Dixon Lane
Kolkata 700014