কথাকাহিনি # ইভেন্ট ।। আজাদি কা অমৃত মহোৎসব ।। অজিত কুমার বাগ
আজাদি কা অমৃত মহোৎসব
অজিত কুমার বাগ
স্বাধীনতার-"আজাদি কা অমৃত মহোৎসব"-উদযাপনের দিনে ইটভাটি থেকে মাস -চারেক পরে বস্তিতে ফিরল সাজাদ আলি ও কোয়েল বিবি। সাজাদের মাথায় হাল্কা বিছানা-পত্রের সাজ, হাতে রঙচটা একটা সুটকেস। কোয়েলের বাম কাঁখে পুঁটলি আর তালি-দেওয়া ময়লা একটা কাপড়ের থলে ডান হাতে। কী যেন সযত্নে ভরা আছে তাতে!
গলিপথে অসংখ্য জনতার ভিড়। কোনক্রমে ভিড় ঠেলে আস্তে আস্তে দু'জনে দাঁড়াল গিয়ে তাদের ছোট্ট ঝুপড়ির উঠোনে। তারপর, যা দেখল....কী বীভৎস! কী ভয়ংকর, কী লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক সে দৃশ্য! দাঁড়িয়ে চোখে দেখা তো দূরের কথা, বিবরণ শুনলেও শিউরে রক্ত হাড় হিম হবে!
তবে চেনা-জানা কৌতূহলী জনতার মধ্যে চলছে বিবিধ ধারণার নানা জল্পনা ও আলোচনা। কেউ বলছে দুর্বৃত্তদের কাজ। আবার কেউ বলছে না-না, দুর্বৃত্তরাও তো মানুষ, ন্যূনতম লজ্জা-শরম তাদেরও আছে, তাদের পক্ষে এমন গর্হিত কাজ করা সম্ভব না। এ-কুকর্ম নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে দ্বিপদ মাতাল নারীমাংস লোলুপ হিংস্র হায়নার! কেমন করে খুবলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে ফুলের মত পবিত্র ময়নার নরম তুলতুলে সুঠাম দেহটাকে, দেখোনা!
ময়না....সাজাদ-কোয়েলের তের বছরের বড়ো আদরের একমাত্র কিশোরী মেয়ে। ইটভাটিতে ইজ্জত নষ্টের ভয়ে নিজেদের ঘর নিরাপদ ভেবে তাকে প্রতিবেশীদের ভরসায় রেখে গিয়েছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভয়াবহ পরিণতি ঘটবে স্বপ্নেও তারা ভাবেনি। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত বিবস্ত্র ছিন্নভিন্ন নগ্ন নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে ময়নার।
ময়নার বহুদিনের পোষা খাঁচাবন্দি তোতাপাখিটা তখনও কী ভীষণ যন্ত্রণায় ডানা ঝাপটাচ্ছে ! সাজাদ তো বাবা, পুরুষ মানুষ, চিৎকার করে কাঁদতে হয়তো তার মানা! যে কারণে গভীর অন্তর্দহনে অশ্রুসজলনয়নে বাকশক্তি হারিয়ে সাজাদ একেবারে হতভম্ব। কিন্তু কোয়েল, সে যে মা! গর্ভধারিণী মায়ের সে কী কান্না! কেউ বুঝবে না তার বুকের ভিতরের যন্ত্রণা!
----ও মোর ময়নারে---ময়নারে---! আমায় ছেড়ে তুই কোথায় চলে গেলি ? তোকে ছাড়া আমি তো বাঁচবো নারে!....বলে হাউ হাউ করে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়ল মেয়ের উপর।
কোয়েলের হাতের থলেটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। থলে থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ময়নার দেহের উপর একটি পুরনো লালচে রঙের আটপৌরে শাড়ি। বোধহয় চৈত্রসেলে দোকান থেকে সস্তায় ময়নার জন্য প্রথম কেনা এটা। শাড়িটার মলিন রং ময়নার দেহের চাপ চাপ জমাট-বাঁধা রক্তের রঙের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার।
জনতার মধ্যে প্রায় সকলেই এই হৃদয়বিদারণ করুণ দৃশ্য দেখে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। নিকট প্রতিবেশী আব্দুল সজলচোখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বললো....
----ময়না তো চলে গেল, সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে! তার তোতাটাকে খাঁচাবন্দি রেখে আর লাভ কি ? স্বাধীনতা দিবসে তাকে মুক্ত করে দেওয়া হোক।
কথাটা শুনে সাজাদ এগিয়ে যায় গুটি গুটি পায়। কম্পিত হস্তে খুলে দেয় খাঁচাটা। বন্ধন মুক্ত তোতাটা উড়ে এসে প্রথমে বসলো, জ্ঞান হারানো ময়নার মা কোয়েলের মাথার উপর। সহানুভূতি জানাতে সান্ত্বনা দিয়ে ভীষণ আদর করলো তাকে, তার লাল ঠোঁট দিয়ে চুলে বিলি কেটে কেটে। তারপর ময়নার মাথায় বসে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক আশপাশ বেশ কয়েকবার দেখে নিয়ে চুপিচুপি কানে কানে যেন বললো....
----ময়না দিদি! আমি যে খাঁচাবন্দি, তাইতো হায়নাদের লালসা থেকে তোমায় রক্ষা করতে কোন উদ্যোগ নিতে পারিনি। সেই অভিমানে কি আমায় ফেলে তুমি একা চলে যাচ্ছো না-ফেরার-দেশে ? একটু দাঁড়াও না! আমিও পথ হাঁটবো পাশে পাশে তোমার সাথী হয়ে।
এই কথা বলে ডানা মেলে তোতাটা উড়ে যায় আকাশের অসীম নীলিমায়। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে হারিয়ে যায় সুদূর নীহারিকায়। সাজাদও বোবাদৃষ্টিতে ভগ্নহৃদয়ে অপলকে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে.....!!!
===================
অজিত কুমার বাগ
গ্রাম + পোস্ট:- ইন্দ্রপুর
জেলা:- দক্ষিণ ২৪ পরগনা