গর্বের অধিকার
বদরুদ্দোজা শেখু
দেলোয়ার সামান্য খেটে-খাওয়া মানুষ। সে দিনমজুর ,রাজমিস্ত্রী,ফেরিওয়ালা,ঘরামি,তলপেটে এইসব।যখন যে মরশুম আসে বা যখন যে কাজ জুটে যায় সেই কাজ তখন করে ; কিছু কাজ না জুটলে সে ফেরিওয়ালা। মজার মজার প্লাস্টিকের খেলনা বাঁশি পুতুল চিরুণী চুলের ক্লিপ রিবনের ফিতে রবারের বেলুন রকমারী লজেন্স এইসব সে ফেরি করে। বিশেষ ক'রে গ্রামগঞ্জে বাচ্চাদের স্কুল হাইস্কুল মেলা বা ছোট শহরের রাস্তায় সে ডুগডুগি বাজিয়ে তার পসরা ফেরি করে। রঙবেরঙের বেলুন বাঁশি পুতুল ম্যাজিক শ্লেট এসবই বেশী বিক্রি হয়। বাড়িতে তার বুড়ী মা,স্ত্রী আর দুই ছেলে মেয়ে।বর্তমান দূর্মূল্যের বাজারে বেশ টানাটুনি করেই সে সংসার চালায়।
গতবছর আজিমগঞ্জের শহরতলিতে সে ফেরি নিয়ে গেছিল। সেদিন ছিল স্বাধীনতা দিবস। সকাল থেকে ডন বস্কো স্কুলের সামনে সে ফেরি করছিল। সেদিন ওখানে অনেক মানুষের সমাগম । বাচ্চাদের সাথে তাদের অনেক অভিভাবকও জুটেছিল।একটু দূরে একটি স্থানীয় ক্লাব আছে। সেখানেও ভারতের জাতীয় পতাকা তোলার আয়োজন হয়েছিল। এই পতাকা তোলার ঘটনাটা তার মনে দাগ কেটে আছে। তাদের গাঁয়ে এসব হয় না।তবে গাঁয়ের লোকজন টিভিতে এই পতাকা তোলার ঘটনা দেখেছে। তাতে কত কী দেখায়। প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী পার্টির নেতারা ক্লাবের কর্তারা স্কুল-কলেজের হেডমাস্টার সবাই সেই পতাকা তোলে।
সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পতাকা তোলা হয় দিল্লীতে। ওখানে প্রধানমন্ত্রী পতাকা তোলেন। তার কী এলাহি ব্যবস্থা।সে মুগ্ধ নয়নে দ্যাখে আর ভাবে , সে তো দেশের স্বাধীনতার পরে জন্মেছে ,তাই স্বাধীনতার ঘটনা তার সব জানা নাই। তবে সেদিন অনেক বাড়িতেও জাতীয় পতাকা তোলা হয়। দেখে তার ভালো লাগে। তারও ইচ্ছা হয় ,তার একটা ঐরকম পতাকা থাকলে সেও তার বাড়ির উঠোনে বাঁশ পুঁতে পতাকা তুলবে। সেদিন তার বিক্রিবাট্রা বেশ ভালই হয়েছিল। সে তার অন্তরে ইচ্ছাটা পুষে রাখে।আর মনে মনে বলে, আগামী বছর সে একটা পতাকা কিনবে আর তার বাড়ির উঠানে ঐভাবে তুলবে বা বাঁশের ডগায় বেঁধে বাঁশটা পুঁতে দিবে। সারাদিন পতাকাটা বাতাসে ফরফর ক'রে উড়তে থাকবে।তাদের সবার খুব আনন্দ হবে। কিন্তু তার যা সামর্থ্য তাতে ব্যাপারটা শুনে সবাই হয়তো হাসবে। তাই সে কাউকেই বলেনি।
এবছর ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫তম দিবস। সেটা সে মাচান ক্লাবের টিভিতে প্রচার দেখেছে।এবার তার পুরনো ইচ্ছাটা জেগে উঠলো। কিন্তু ঐ দিন যদি সে পতাকা তোলে ,তবে সেদিন তাকে পতাকার দেখভাল করতে হবে। ফুল দড়ি পতাকা বাঁশ এইসব যোগাড় করতে হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, সেই দিন তার কাজে যাওয়া যাবে না।সবাই যেমন আনন্দ করে ,তারাও পরিবারের সবাই মিলে একসাথে আনন্দ করবে। সে দেখে দেখে শিখে নিয়েছে , তিনবার বন্দে মাতরম ব'লে পতাকা তোলা হয়। তারপর "জনগণমন " গাওয়া হয়। শুনে শুনে সে সব সে শিখে গেছে। কিন্তু শুধু সে শিখলেই বা জানলেই তো হবে না।পতাকা তোলার সময় যে সব বাচ্চা বা যারা হাজির থাকবে সবাইকে নিয়ে গাইতে হবে। সে মনে মনে বলে, এইটাই বেশ সমস্যার হবে। দরকার হ'লে সে ক্লাবের দু-একজনকে আগে থেকে রাজী করাবে।
তবে এবার সে তার বাড়ির উঠানে পতাকা তুলবেই , এমন মনস্থির করলো।
১৫ই আগষ্টের আগের দিন অর্থাৎ ১৪ই আগষ্টের দিন সে ফেরী ক'রে সন্ধ্যায় ফিরে এলো।প্রতিদিন সে বাড়ি ফেরার সময় মুদীর দোকান থেকে বাজারটা ক'রে আনে।কিন্তু আইজ তার কাছে তো কিছু দেখছে না তার স্ত্রী নাইরা । সে শুধালো , বাজারের ব্যাগ কই ? দোকানে ফেলে এইছো নাকি? দেলোয়ার আর কী বলবে ? সে বললো, আজ বাজার করা হয় নি।আজ একটা অন্য জিনিস এনেছি।-- কী? কী অন্য জিনিস ? তাইলে রাতে কি খাবে সবাই ? দেলোয়ার বললো,তোমার কাছে তো কিছু আছে।তাই নিয়ে রহিম ভাইয়ের কাছে যাও আর অল্প কিছু নিয়ে আসো।আজ আর কাল তাই দিয়েই চালাতে হবে।ব'লে সে তার ফেরীর বাঁশ থেকে ব্যাগটা নামালো আর বললো,এই দ্যাখো,কী এনেছি। ভারতের জাতীয় পতাকা। কাল তো স্বাধীনতা দিবস।তাই এটা কিনে আনলাম , দড়িও এনেছি আর লগাটা তো আছেই।খালি সকালে কিছু ফুল যোগাড় করতে হবে।আর পাড়ার বাচ্চাদের ও মায়েদের ডাকতে হবে।ক্লাবের ছেলেদেরও দু'জন আসবে। বলা আছে। সবাইকে দেওয়ার জন্য কিছু লজেন্সও নিয়ে এসেছি।এসব কিনতে গিয়ে আইজকার সব রোজগার চ'লে গেছে। ব'লে সে জাতীয় পতাকা বের ক'রে খুলে দেখালো। তার এহেন কীর্তিকলাপ দেখে নাইরার তো মাথায় খুন চ'ড়ে গেছে। সে রাগতভাবে বললো,এ সব তুমাকে কে করতে বলেছে ? টাকা নাই তো আইজ আর খাবে কি? দেলোয়ার বললো, কেউ বলেনি। বহুদিন থেকে আমার ইচ্ছা, স্বাধীনতার দিন আমরাও পতাকা তুলবো বাড়িতে।সারাদিন থাকবে।বাতাসে উড়বে।সন্ধ্যায় নামিয়ে নিবো। নাইরা ব্যঙ্গের সুরে চেঁচিয়ে উঠলো ,ঘরে নাই ভাত আর পতাকা তুলবে হাত ! শখ কতো ? আমার কাছে কিছু নাই। আমি রহিমের দোকানে যেতে পারবো না।তোমার বোকামির জন্য আমাকে ধার চাইতে হবে ? এটা আমি পারুম না। তুমি যাও।নাইলে না খেয়ে থাকবো। লাল চা খেয়ে । এই ব'লে সে পতাকাটা ব্যাগ সমেত ছিনিয়ে নিলো। দেখছি তোমার পতাকা তোলা ! আগে এটাকেই বিদায় করতে হবে। ব'লেই সে ব্যাগ থেকে সব বের ক'রে ফেলে দেওয়ার উদ্যোগ নিতেই, দেলোয়ার ব'লে উঠলো, খবরদার ! জাতীয় পতাকার অসম্মান কোরো না ! যদি কেউ থানায় লাগায়,তাইলে বাড়িতে পুলিশ এসে ধ'রে নিয়ে যাবে।খবরদার, ফেলবে না বা কাটাকুটি করবে না,বলছি। দাও, দাও, ওটা আমাকে দাও।তাদের ছেলে মেয়ে দুটো প্রাইমারীতে পড়ে। ওরা ওর মায়ের কাছ থেকে ওটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করলো, ওরা ওটা দেখবে ।ওদের স্কুলে ঐ পতাকা তোলা হয় না ,শুধু ছুটি দেওয়া হয়। সত্যিই ওরা ঝাঁপাঝাঁপি ক'রে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিলো আর পতাকাটাও। তারপর খুলে দেখলো।বেশ বড়ো আর সুন্দর।নতুন কাপড়ের গন্ধ লেগে আছে।ওরা শুঁকে' দেখলো আর ধরাধরি ক'রে ওটাকে টাঙানোর মতো ক'রে দেখলো। বেশ বড়ো। তার মধ্যেই ওদের মা ব্যাগের থেকে একটা ছোট ঠোঙা বের ক'রে ফেললো।দেখলো, কিছু লজেন্স আছে।দেলোয়ার কেড়ে নিলো। বললো ,এটা আইজ খাওয়া হবে না। কাল পতাকা তোলার পর সবাইকে একটা একটা ক'রে দেওয়া হবে।সে সব নিয়ে ব্যাগে ভ'রে বললো,এই রিন্টু ,দু'টো ব্যাগ আনতো। বলতেই রিন্টু তার মাকে শুধালো,মা ,আর ব্যাগ কই ? অমনি নাইরা ওর গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে বললো,পতাকা তুলে' তোর পেট ভরবে ? আইজকার সব রোজগার এই এর পিছনে খরচ ক'রে আসছে ! সহ্য হয় ?
রিন্টু কাঁদলো না।শুধু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো। ওর বোন ছোট, সেও ওর মায়ের দিকে বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলো যেন ওর বাপ মস্ত বড়ো দোষ ক'রে এসেছে ! বাজার ক'রে না এনে পতাকা লজেন্স দড়ি এইসব কিনে এনেছে !
নাইরার শাশুড়ি পাশেই দাঁড়িয়েছিল,ব'লে উঠলো, বাচ্চারা কী দোষ কইরেছে ? ওদের মারছো কেনে?
এই দেলু,--- এতো বড়ো হলো,তাও ওর আক্কেল হলো না ! এই বাজে খরচ ক'রে কি পেট ভরবে ? বাচ্চা দু'টো খাবারের জন্য যখুন কাঁদবে,তখুন কী করবে ওর মা ? লবেন্চুস খেয়ে থাকবে ? আর কাইল কাজে যাবি না তো কাইল কী খাবি ? দেলু যেন মস্ত বড়ো অপরাধ ক'রে ফেলেছে, এমন মুখ ক'রে পতাকার ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো।ঘটনা যে এমন হবে , সে আন্দাজ করতে পারেনি।
ওর মা নিজেই বললো, নাইরা, তু থাক্। আমিই রহিমের কাছে গে' সব বুলছি। তাতে যদি ধার দ্যায় তো ভালো, নাইলে - - - লাল চা-ই খাবি ! মরণ !
দেলোয়ার তার ফেরীর সামগ্রী গুছিয়ে তুলে রাখতে লাগলো।বাচ্চা দু'টা মুখ চূণ ক'রে বারান্দার এক কোণে ব'সে রইলো। আর নাইরা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘাটের দিকে চ'লে গেল।
রহিমের দোকানে গিয়ে দেলুর মা সব ঘটনা ব'লে চেঁচামেচি করলো ; আর কিছু চাল ডাল আলু পেঁয়াজ সব্জী ধার চায়লো।রহিম বললো, এই ব্যাপার ! আরে , পতাকা তোলা কি তোর সাজে ?তু খেটে খাইস। না খাটলে এক বেলা তোর সংসার চলে না।তু কেনে এটা করবি ? ওসব বড়লোকদের ব্যাপার শহরের লোকদের ব্যাপার।ছি,ছি,ছি ! ওর আক্কেল হলো না । অসন্তোষের সাথে রহিম বললো,বলো চাচী কী কী দিবো।যতোস্সব আনথাবড়ি শখ। দোকানেই আরো অনেকেই ছিল।তারা নানা জন নানা রকম মন্তব্য করতে লাগলো।কেউ বললো, তাইলে তো দেখতে যেতে হবে।কেউবললো, পতাকা তোলার পর যে গান গাইতে হয় ও তা জানে ? ইত্যাদি - -
দু' বেলার মতো ধারে বাজার নিয়ে দেলোয়ারের মা গজগজ করতে করতে ফিরে এলো। ততক্ষণে ব্যাপারটা অনেকের কাছেই ছড়িয়ে গেছে। আর তা গ্রামের মাচান ক্লাবের কাছেও পৌঁছে গেল। মাচান ক্লাব হলো সেই ক্লাব যার অস্তিত্ব শুধু কোনো গাছতলায় বাঁশের মাচানে । কোনো চালাঘরও নাই। মাচান ক্লাবের সদস্যদের আঁতে ঘা লাগলো। একজন ফেরিওয়ালা তার বাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলবে, দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে, আর তারা সব ঢেঁড়স ! তারা ওসব দেখবে ? হ'তে পারে না ! তারা পরামর্শ ক'রে দেলোয়ারের কাছে এলো। এসে বললো, শুনছি ভাই তুমি পতাকা কিনে এনেছো,কাল বাড়িতে পতাকা তুলবে ? আমরা থাকতে তুমি একাই ওসব করতে যাবে কেনে ?
আমাদের গ্রামের আর ক্লাবের বদনাম হবে। তুমি ওটা আমাদেরকে দাও, আমরাই সব ব্যবস্থা করবো।তুমিও থাকবা। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের খরচ তো আছে ।গণ্যমান্যদের ডাকতে হবে , মিষ্টি বিতরণ করতে হবে,ফুল দিয়ে বেদী সাজানোর খরচ আছে, তারপর জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে !অনেক হ্যাপা । তুমাকে ওসব করতে হবে না।আমরাই চাঁদা তুলে সব করবো। আমরা চাঁদা তুলে তোমার পতাকার দামও দিয়ে দিবো। তুমি ওটা আমাদেরকে দাও।
দেলোয়ার সাফ জানিয়ে দিলো , সে ওই পতাকা কাউকেই দিবে না।আর সে নিজের বাড়ির খোলা উঠানে বাঁশ পুঁতে ওই পতাকা নিজে তুলবে। এ পাড়ার বাচ্চাদের ও মায়েদের ডাকবে, যারা আসবে ,আসবে। না আসবে ,না আসবে।এটাই তার ইচ্ছা। সে কোথাও যাবেও না। আর কাউকে ওই পতাকা দিবেও না। এই নিয়ে মাচান ক্লাবের সাথে একপ্রস্থ ঝামেলাও হ'য়ে গেল। তারা শাসিয়ে গেল, যার ঘরে এক বেলার খাবার নাই ,তার আবার পতাকা তোলার শখ ! চল্ , আমরাও কাল পতাকা কিনে এনে আমাদের ক্লাবের উদ্যোগে তুলবো।তুমার এখানে কেউ আসবে না।
চেঁচামেচি ঝামেলা হচ্ছে শুনে পাড়ার আরো কয়েকজন দেলুর বাড়িতে এসে জুটলো।কেউ দেলোয়ারকে সমর্থন করলো, তো কেউ ক্লাবকে।কেউ উৎসাহ দিলো তুমি দেশের স্বাধীন নাগরিক,তুমি তুমার বাড়িতেই পতাকা তোলো। আমরা তোমাকে সাহায্য করবো ইত্যাদি ইত্যাদি।তুমার পতাকা তোলার খবর শুনে ক্লাবের গা জ্বালা করছে ! এদ্দিন কোথায় ছিলি তোরা ? খালি মাচানে বস্যি তাস খেলা আর ধার -করা টিভি দেখা। ক'বছরে একটা চালাঘরও তুলতে পারলো না, আবার ফুটানি ?
পরদিন দেলোয়ার ভোর ভোর গ্রামের আশেপাশের ফুলগাছ থেকে এক কোঁচা নানা রঙের টাটকা ফুল তুলে' এনে জড়ো করলো।নিকটবর্তী দু'চারটে বাড়িগুলোতে বাচ্চা ও মাদের আসতে ব'লে এলো তার বাড়িতে। সকাল আটটার সময় পতাকা তোলা হবে ,সবাই যেন তার আগেই ওর বাড়ির উঠানে জড়ো হয়। উঠানের মাঝখানে কিছুটা জায়গা গোল ক'রে নিকিয়ে নিলো ও তার মাঝখানে শাবল দিয়ে লগি পোতার জন্য গর্ত করে ঠিকমতো বেদী তৈরী করলো।বাঁশের লগি তো ছিলই। সেটার মাথায় আলাদা দড়ি দিয়ে একটা ছোট আলগা লুপ তৈরী ক'রে নিলো আর সেটার মধ্য দিয়ে পতাকার কিনে-আনা দড়িটা গলিয়ে এনে দড়িটার এক প্রান্তে পতাকা বাঁধলো । আর কিছু ফুল ওই পতাকার মধ্যে রেখে হালকাভাবে বেঁধে দিল যাতে দড়ির অন্য প্রান্ত ধ'রে টানলে সটান পতাকাটা লগির মাথায় উঠে যায় আর ফুলগুলো খুলে ছড়িয়ে পড়ে।এরপর লগিটা খাড়া ক'রে ওই গর্তে পুঁতে দিল।এবার পতাকা ও দড়ির অন্যপ্রান্ত লগির গোড়ায় ঝুলে থাকলো। ক্লাবের দু'জন যারা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে জানে তারা ইতিমধ্যেই এসে গেছে।তারা সব বাচ্চা ও মা-বাবাদের নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মহড়াও ক'রে নিলো।সবাইকে বললো ,তারা যখন গাইতে শুরু করবে তখন সবাই একসাথে তাদের সাথে সাথে গেয়ে যাবে। না পারলে চুপ থাকবে, ভুলভাল গাইবে না।দেলোয়ার ও তার স্ত্রী নাইরাও ওদের সাথে কয়েকবার মহড়া ক'রে নিলো। বাড়ির ছেলেমেয়েরা তো উত্তেজনায় মুখিয়ে আছে কখন পতাকা তোলা হবে।জাতীয় সঙ্গীত গাইতে আসা ছেলে দুটার কাছে ঘড়ি ছিল।পৌনে আটটা বাজতেই তারা বললো,দেলু ভাই এবার রেডী হও।সাথে সাথে ঘরের সবথেকে ভালো লুঙ্গী ও হাফশার্ট প'রে দেলোয়ার তৈরী।পাড়ার কিছু উৎসাহী বাচ্চা ও মা-বাবাও ওখানে জড়ো হ'য়েছিল। সবাইকে শিখিয়ে দেওয়া হলো ,পতাকাটা দেলু ভাই যখন দড়ি টেনে তুলবে , তখন সবাই তিনবার "বন্দে মাতরম্" ব'লে উঠবে জোরে জোরে ।তারপর তোলা হলে,"জনগণমন " গাওয়া হবে একসাথে।
আটটা বাজতেই দেলোয়ার বললো, আজ ইংরাজী মাসের পনেরোই আগষ্ট । আজকের দিনে ১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ বৃটিশ শাসন থেকে নিজেদের শাসনের ক্ষমতা পায়। এই স্বাধীনতার জন্য আমাদের লাখো বীর জনতা শহীদ হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন এই পতাকার মর্যাদার জন্য । তাই আজ আমাদের দেশ ভারতের পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস ।সেই উদ্দেশ্যেই আমরা এখন আমাদের জাতীয় পতাকা তুলবো। দড়ি টেনে পতাকা তুলতে তুলতে দেলোয়ার ব'লে উঠলো , জোরে বলো সবাই " বন্দে মাতরম" ! সবাই ওর সাথে সাথে তিনবার ব'লে উঠলো "বন্দে মাতরম্" !
পতাকা সোজা লগির ডগায় পৌঁছে খুলে গেল আর ফুলগুলো বেদীতে ছড়িয়ে পড়লো আর পতাকা পতপত ক'রে উড়তে লাগলো। ছেলেমেয়েরা খুঁটির নীচে আরো অনেক ফুল ছিটিয়ে দিলো। তারপর সবাই গেয়ে উঠলো,
"জনগণমন- অধিনায়ক জয় হে,ভারত- ভাগ্যবিধাতা।
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছ্বল জলধি-তরঙ্গ ।
তব শুভ নামে জাগে
তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়-গাথা ।
জনগণ মঙ্গলদায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা।
জয় হে ,জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।"
ক্লাবের একজনের সাথে স্মার্টফোন ছিল, সে কিছু ছবি ও ভিডিও-ও তুললো। সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো।তারপর দেলোয়ার নাইরার হাত থেকে লজেন্সের ঠোঙা -টা নিয়ে সব বাচ্চাকে ও মা-বাবাদেরকে একটা একটা ক'রে দিলো। বাচ্চাদের মধ্যে তখন কী আনন্দ ! দেলোয়ার যেন বাচ্চাদের মতোই খুশী। তার চোখদুটো আনন্দে ছলছল করছে। গনাইরা ও দেলুর মা পতাকার দিকে অবাক চোখে মূহ্যমান হ'য়ে তাকিয়ে রইলো। তারাও গর্ব বোধ করলো।
খবর শুনে আরো লোকজন আর রহিম মুদী এসে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চায়লো। কিন্তু দেলোয়ার তা নিতে অস্বীকৃতি জানালো। এমনিতে অনেকে অনেক কথা শুনাচ্ছে।এর পর খোঁটা দিবে, অন্যের টাকা নিয়ে নিজের উঠানে পতাকা তুলেছে। তার থেকে কারো কোনো সাহায্য নিবো না। জাতীয় পতাকা তোলার ইচ্ছা ছিল , তাই ইচ্ছা পূরণ করেছি।সে ঘোষণা দিলো, সন্ধ্যা ছ'টার সময় পতাকা নামানো হবে, যারা থাকতে চাও তারা এসো। তখন দেলোয়ারকে একজন বীরের মতো দেখাচ্ছিল ।
ওদিকে মাচান ক্লাবের সদস্যরা সকালে শহর থেকে একটা জাতীয় পতাকা কিনে এনে সেটা মহা ধূমধামে বেলা ১০৹০০ টার সময় তাদের মাচানের কাছে ফাঁকা জায়গায় বেদী সাজিয়ে সেই পতাকা তুললো। তাদের অনেকেই ছবি ও ভিডিও-ও তুললো। মাইকে বিচিত্র গান বাজলো।
আজ থেকে চালু হলো এই গ্রামে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা তোলার রেওয়াজ। দেলোয়ার মনে মনে শপথ করলো,সে তার এই কর্তব্যকে আজীবন ধ'রে রাখবে। কারণ তার বাপ দাদুরা স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই এদেশে জন্মেছে,মরেছে। তাই সে ও তার পরিবারের সদস্যরা এখন আইনতঃ সবাই ভারতের নাগরিক।কাজেই স্বাধীনতার দিন জাতীয় পতাকা তোলা তাদের গর্বের অধিকার । সে এই অধিকার ও কর্তব্যকে আজীবন আঁকড়ে' থাকতে গর্ব বোধ করবে। আর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মহান স্বতঃস্ফূর্ত আত্মত্যাগের কাহিনী কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। সে মনে করে,দেশের সব অখ্যাত গ্রামে গঞ্জে যদি এই মহান পতাকা প্রতি বছর কিছু কিছু বাড়িতেও তোলা হয় তবে শিশু বয়স থেকেই বাচ্চাদের মনে দেশের প্রতি ভালবাসা জন্মাবে।
=======================
ছবি- ইন্টারনেট ।
----------------------------
বদরুদ্দোজা শেখু
18 নিরুপমা দেবী রোড , বহরমপুর , মুর্শিদাবাদ,
পঃ বঙ্গ , ভারত ।
লেখক-পরিচিতি-
বদরুদ্দোজা শেখু-র জন্ম ১৯৫৫ সালে ফেব্রুয়ারীতে মুর্শিদাবাদ জেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে ।- - - -নেশায় কবিতা লেখালিখি। - - -বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী থেকে একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন।- -- - এছাড়া কবি তাঁর "আরো থোড়া দূর" কাব্যগ্রন্থের জন্য "পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরষ্কার ২০২০" - অন্যতম "বিশেষ সেরা" সম্মাননা পেয়েছেন।
তিনি কিছু কিছু অণুগল্প ও ছোটগল্পও লিখেন ।