কু-সন্তান
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
----বাবা, তোমার একটা পোষ্টাল কিছু ছিল। ----কোথায় ? এনেছিস নাকি ?
---- পিয়ন বলেছিল। সইর জন্য পিছিয়ে ছিলাম। আমি সইটা দেবো বলতে বলল, দাও - তবে বাবাকে দেবে কিন্তু । এই এনেছি । আমি তো তাই বললাম, -- হ্যাঁ গো কাকু এই সেদিন কয়েকটা তো দিয়ে গেছিলে না ? কিছুক্ষণ ভেবে ভেবে পিয়নকাকু বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ এরকম কত আসে । তোমার বাবা লেখক তো, তুমি জানো না ?
----জানি ।
বলে শান্তা পোস্টাল বইটা টেবিলে রেখে কলেজে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
---- আজ তোর ক্লাস ক'টায় ?
---- দেড়টায় ইকোনমিক্স দিয়ে শুরু ।
---- তোদের পার্মানেন্ট প্রফেসরের কি হল ?
----এম পি তার রিলেটিভকে পাঠিয়েছে । তিনি আবার গেস্ট লেকচারার ছিলেন বারাসাতে।
----নাঃ চাকরি আর কারো হবে না দেখছি ।
---- বাবা আসছি ।
শান্তা কলেজে বেরিয়ে গেল। প্রখর রোদে সানগ্লাসটা চোখে দিল। মাথায় বাদামি ছাতা। কুড়ি বছরে পা দিয়েছে । অনার্সে লাস্ট ইয়ার। বন্ধু বান্ধবী আছে । মিলে মিশে চলে । রেজাল্ট খুব ভালো।
বাবা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন। নিজস্ব কিছু প্রকাশিত গল্প -কবিতা- উপন্যাসের বই আছে । সংসারের সব ঝামেলা সামলে নিরালায় বসে লেখাপড়া করেন। স্ত্রী মানসীর অজানা নয়।
কলেজের বন্ধু -বান্ধবীরা অনেকে জানত শান্তার বাবা লেখালেখি করেন। এই নিয়ে কেউ কেউ তাকে সমীহার চোখে দেখেও কেউ আবার টোন টিপ্পুনী মারে । তৎক্ষণাৎ সংক্ষিপ্ত কথায় ইঙ্গিতে চেষ্টা করে কিছু বলার । তারপর ওদের থেকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। তার অহংকার ছিল না।
প্রমোদ চক্রবর্তীর পরিবারে আরো একজন আছে সে মৃণাল , এখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ফেলোশিপ নিয়ে দেরাদুনে চাকরি করে। সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা বেতনও ভালো পায়। তার ডিগ্রী প্রাপ্তি এবং চাকরিপ্রাপ্তির পর মনের আড়ালে গর্ব অনুভব করে । হ'বারই কথা । ইদানিং বাবার সাথে কম কথা বলে । মৃণাল প্রমোদের সঙ্গ ছাড়তে চায়। কারণ তার আত্মপ্রতিষ্ঠা বা স্বাবলম্বী হওয়ার কৃতিত্বতে বাবার যে সহযোগিতা বা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে তা অস্বীকার করে । এবারে শরতের পূজাবকাশে তাই সে প্রকাশ্যে বলে ।
প্রমোদ সেদিন একটি গল্প লিখছেন। এমন সময় কেউ তাঁকে ফোন করেছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর মৃণাল বললো, ওইসব বাদ দিয়ে আগের মত রোজগার করে সংসার মেনটেন করো ।
--- হঠাৎ এই কথা বলছিস ?
--- বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ? এখানে তো আমি থাকবো না। বুল্টির বিয়ের ব্যাপারে ভাবছো না কেন?
---- তোরই বা বুল্টির দিকে নজর পড়ছে কেন ? সে চিন্তা আমার।
---ও লেখাপড়া শিখে পরের ঘরে গিয়ে টাকা রোজগার করবে । তাহলে তোমার পড়িয়ে লাভ কি?
----সে যেমনই করবে তেমনি তোর যে বউ নিশ্চয়ই হবে শিক্ষিতা ; সেওতো যদি চাকরি করে তাহলে তার বাপের বাড়ি থেকে একই প্রশ্ন তুলবে । তোকেই পড়িয়ে তো--
----- পরের কথা ভেবে লাভ নেই ঘরের কথা ভাবো।
---- তোমার আর বুল্টির পিছনে অনর্থক ব্যয় মানে তো ভষ্মে ঘি ঢালা । নিষ্কর্মা লোক যেমন ফালতু কাজে মনোনিবেশ করেছ আর ওকে পড়িয়েও ফালতু অপচয় করতে পারবো না ।
---- আমার কাজটা ফালতু ! আমাকে ফালতু বলছিস ? বোনকে বলছিস গলার কাঁটা কারণ তো বুঝলাম না । টাকা রোজগার করিস বলে ?
---- তা একপ্রকার ভাবতে পারো ।
---- তাহলে টাকা কে তোকে চায় ? কখনো দিস নি তো !
---- বেশ তো। আমার কাছে এই বিষয়ে এসো না। --- না যাবোই না । আগুন ধরিয়েছিস যখন নেভাবার লোক আছে তো ? একা সামলে নিবি।
---- আমি সামলে নেব।
---- হয় কি করে ? যার গায়ে আগুন লাগে সে কি একলা নেভাতে পারে ? যেহেতু সেই বুদ্ধিবৃত্তিটুকু ক্রমে হ্রাস পেয়েছে তোমার থেকে । তোমার সেই মূল্যবোধ বিবেক একেবারে নেই । ঠিক আছে , দেখছি । তোমার ভাবনা তুমি ভাবো আমাদের নিয়ে অহেতুক ভাবতে বলবো না ।
---- কি হিজিবিজি লেখো, তারপর পয়সা ব্যয় করে ! শুধু শুধু বসে বসে বিলাস যাপন ?
---- নাঃ। মৃণাল তোমাকে আর আমার বিষয়ে কিছু না বলতে অনুরোধ করছি। যথেষ্ট পেয়েছি ! আর নয়।
---- হ্যাঁরে দাদা --, এই মতিচ্ছন্নের জন্য কেউ ব্রেইন ওয়াশ করাচ্ছে মনে হয় ? চাকরি পাওয়ার আগে আর পরে দেখছি তো ---
----ছোটো যেমন তেমনই থাক । ছোটো মুখে বড়ো কথা একেবারে মানায় না । যেদিন টাটিয়ে গালে এক চড় পড়বে সেদিন বুঝবি ।
----মৃণাল !! মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ! ভেবো না আমি মরে গেছি ?
স্বার্থসর্বস্বতা তাকে গ্রাস করেছে । অহংকার আর আত্মকেন্দ্রিকতা সময়ের শৃঙ্খলে যুগপৎ ।
মানসী সোফা থেকে উঠে মৃণালের হাত ধরে টেনে তার ঘরে দিয়ে আসল ।
তারপর আর কোনও কথা হয়নি। শারদ উৎসব শেষ করে সে কর্মস্থলে চলে গেছে । মনমরা সকলে এখনও।
সে বিয়ে করেছে পর্যন্ত জানায়নি । ধুমধাম করে ওই স্কুলের দিদিমণি অর্চনা গুপ্তকে বিয়ে করেই আছে। বিয়েতে ডেকেছিল সব ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর । প্রমোদের কাছে প্রস্তাব মানসী পাড়লেও সরাসরি না বলে এড়িয়ে গেছেন । অবশেষে ফোনে মানসীকে মৃনাল বলেছে , বাবার জন্য মাথাটা হেঁট হয়ে গেছে । ওই সব ছাইপাঁশে সময় দিতে পারে ছেলের বিয়েতে একদিন সময় দিতে পারে না ?
মৃণাল আত্মসমালোচনা করেনি মনে হয়। বাবার ব্যক্তিত্বে আঘাত লেগেছে। আশাহত হয়েছেন। সব ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর বলাটা সমীচীন নয় । সে মাকে ফোন করে জানাল , বাবা নাইবা আসুক তুমি এসে এখানে থাকো।
---- কেনরে ? আমি আবার এই বয়সে তোর ওখানে বাবাকে ছেড়ে যাব কেন ? বুল্টির সামনে পরীক্ষা ,তোর বাবার এখন পরিশ্রম হচ্ছে ! নতুন করে আবার কাজে যাচ্ছে ।
----উনি তো আর লিখছে না ! বেশ তো সুবিধা হয়েছে ।
----- তুই কি তাহলে লেখা বন্ধ করে দেবার জন্য তোর বাবাকে এই বয়সে খাটতে নামালী ?
---- ঠিক তাই । তবে শোনো মা, তোমার বৌমা আমার একই স্কুলে চাকরি করেন। একার উপরে প্রেসার পড়ে যাচ্ছে । তারপর উনি এখন মা হতে চলেছেন।
---- বাহ ভালো সংবাদ ! কিন্তু তোর বাবা আসুক আলোচনা করি তারপর না হয় -
অনেকক্ষণ বারান্দায় এসে কান পেতে শুনেছিলেন।
-----কার ফোন ? নিশ্চয় তোমার গুণধরের ?
---- হ্যাঁ। কথা বলবে ? ফোনটা এগিয়ে দিল ।
---- নাঃ । এত ভালো গুণী ছেলের সাথে তুমি কথা বলতে পারো , আমার সঙ্গে কোনওদিন সম্ভব নয়।
প্রমোদ সারাদিন ক্লান্তির পর পড়ার টেবিলে গেলেন । শান্তা একমনে বই পড়ছে । অবশেষে মানসী এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার কপাল ! রাখ । সুখ-শান্তি সব জলাঞ্জলি ।
---- তোমার আবার কপালের কি হলো ? দেখ মানসী তোমার ভালো না লাগে ছেলের কাছে যাও ।
----একমাত্র ছেলে তাকে ছেড়ে থাকা যায় ?
---- থাকা তো যায় না । তাহলে শিগগির যাও ছেলের কাছে কাজের মেয়ের অভাব মেটাতে। ওরা দু'জনে ব্যস্ত চাকুরিজীবী । যারা বাবা মার অবস্থা বিবেচনা করে না শিক্ষিত হয়ে নীচ মানসিকতা নিয়ে চলে হামবড়ামি আর আত্ম অহংকারে দিশেহারা অলীক স্বপ্নের দিকে ঝোঁক সেখানেই সুখ বলছো ? মেয়েটার কথা ভাবছ ? ওর বিয়ে দিতে হবে না ! ওর লেখাপড়া শেষ হলো না !
মানসী শুনে অন্যত্র চলে গেল ।
রাত এগারোটা বেজে গেছে । শান্তা হাই তুলছে। ঘুম ঘুম চোখে বাবাকে বলল , ও বাবা সারাদিন পরিশ্রম করেছো ঘুমিয়ে যাও । খাবে এসো।
---- এক কাজ কর বুল্টি, আমার কথা না ভেবে তোর মাকে নিয়ে তোর দাদার কাছে যা । এখানে আমি সামলে নেব।
---- না বাবা। -মা যায় যাক আমি যাবোই না।
প্রমোদের বিষাদগ্রস্ত মন বুঝেছে বুল্টি ।খাওয়ার টেবিলে ডাল রুটি খেতে খেতে অনেক কিছু বিষয়ে মাথায় আসলেও কেউ কাউকে কিছু বলল না ।
রাতের ঘুমের জন্য যে যার ঘরে চলে গেল ।
অতি প্রত্যুষে উঠে প্রমোদ বেরিয়ে গেছেন । তিনি সব্জির আড়তে কাজ করে । হিসাব করে এবং মাথায় ঝাঁকা তুলে দিতে হয় । সামান্য সঞ্চয় দিয়ে আর কিভাবে চলবে কতদিন । মানসিক চাপে মাঝেমধ্যে অন্যমনা হয় । শিব গড়তে বাঁদর হয়ে যাবে ভাবেননি কোনওদিন ।
সে ভেবে রেখেছিল ছেলেটা চাকরি পেয়ে বাবার পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে । সৃজনীশক্তি সবার থাকেনা । মৃণালকে বোঝাতে হবে। অনেক আশা ছিল বেতনের টাকাগুলো হাতে তুলে দেবে । আর সেই টাকায় জমে থাকা পান্ডুলিপির সদগতি করবে ভালো প্রকাশকের হাত ধরে। পাবলিশার্স মাত্রেই টাকা ছাড়া কথা নেই । যদিও চারিদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়বে । কত লেখকের জীবনী এই ভাবেই গেছে ! এ বিষয়ে কি মৃণাল জানেনা ? সে জানতেও চায়নি । সারাদিন পরিশ্রমের পর রাত জেগে বসে লেখাপড়া এই বয়সে চাপ বলে মনে হয় । ভাঙ্গা মন নিয়ে তবুও চেষ্টা করেন।
প্রমোদের টেবিলে ফরমায়েশি লেখার জন্য অনেক চিঠি এসেছে । এইসব লিখতে গেলে সম্পাদকের হয়ে বিভিন্ন বই অনুসন্ধান করে তথ্যসমৃদ্ধ লেখা দিতে হবে ; যা সময়সাপেক্ষ । এদিকে নিজের মতো করে লেখায় তিনি মন দিয়েছেন। পরশুদিন মহীতোষ চাটুর্জে এসে বলে গেল, প্রমোদ ভাই তোমার একটা গল্পের বই আমাদের পাঠাগারে পাঠকদের মনে সাড়া ফেলে দিয়েছে। বইটার ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল ! আমি পাঠ প্রতিক্রিয়া নিয়ে জায়গা মতো পাঠিয়েছি ।
---- আর শেষ জীবনে শুনে শুধু সন্তুষ্ট হলাম। এতেই শান্তি পেয়েছি যথেষ্ট ভাই ।
সেদিন রবিবার । শান্তার হাতে খবর কাগজ। বাবা নেই ঘরে। নিজের পড়ার ফাঁকে দেশ- বিদেশের খবর জানতে সে চোখ বুলিয়ে নেয়। খবরের পাতার মধ্যে ছোট্ট কলামে দেখল , এ বছরের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন প্রমোদ চক্রবর্তী তাঁর "গ্রাম আখ্যান" গল্পগ্রন্থের জন্য । আগামী 15 -ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি ভবনে সম্মানিত করা হবে ।
শান্তার মনে আনন্দের জোয়ার। সে দৌড়ে গেল মায়ের কাছে । --মা এই দেখো দেখো বাবাকে দেশ সম্মানিত করবে !!
---- কোথায় ? দেখি দেখি । মানসী পড়ার পর পুলকিত মনে বলল, তোর দাদাকে ফোন করে বল না ।
---- সে কি বলবে মা ? দাদা তো বাবার এই সৎকর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা করে ?
মুঠো ফোনটা বেজে উঠল ।
---- ওমা -,এই নাও ,দাদা -- ফোন করেছে। দেখো কবে যাবে বাবার সাথে আলোচনা করে বলো।
---- হ্যালো মা -?
---- বল । তোর বাবাকে না বলে যেতে পারছি না রে !
---- না না ; আমি ওকথা বলবো না।
---- তাহলে কি বলবি তো ?
----বাবা কি এখনও কাজে যাচ্ছেন ?
---- কেন যাবেন না ? সংসারে কিভাবে চলবে ? ---- আমার বন্ধু খবর কাগজে কি পড়েছে তাই নিয়ে আমাকে খুব তিরষ্কার করছে ! প্রেস্টীজ লুজ করার মতো আরও কি করবেন ?
---- অমন ছেলে আমারও প্রয়োজন নেই রে । রাখ। ফোনটা কেটে মোবাইলটা শান্তার হাতে দিল।
---------------------------
ছবি- ইন্টারনেট ।====================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম - পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর )
পোষ্ট - অক্ষয় নগর
কাকদ্বীপ,দঃ চব্বিশ পরগণা
পিন কোড - 743347
মোঃ 9734591074
7479274263 (হোয়াটস আপ)
নেশা /পেশা : সাহিত্যচর্চা
email sudam1964krishna@gmail.com