বিদেহী আত্মা
চাকরী থেকে অবসরের পর আমার বাড়ীর দোতলার দক্ষিণের বারান্দাটা হয়ে গেলো আমার অতি প্রিয়। বারান্দায় একটা বড় সোফা আর তার সামনে একটা টি টেবিল ছিল। যেমন দক্ষিণের হাওয়া পেতাম তেমনি শীতকালে প্রায় সারাদিন মিঠে রোদ পেতাম এই বারান্দায় বসে। একদিন শরৎকালে সন্ধ্যেবেলায় সোফায় বসে আছি। বিকেল থেকে বৃষ্টি পড়ছে অনবরত, কখনো জোরে কখনও টিপ টিপ। তাই দেখতে দেখতে হটাৎ চাকরী কালীন একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো।
সেই সময় আমাদের আধা সরকারি অফিসে একটি বিদেশী প্রজেক্ট আসে। কর্তৃপক্ষ আমাকে সেই প্রজেক্টে ডেপুটেশন দেয়। আমার পোস্টিং হয় পার্সোনাল ডিপার্টমেন্ট এ। এর আগে ছিলাম টেকনিক্যাল এ। অতএব সম্পূর্ণ নতুন কাজ। ওই সেকশনের মাথায় ছিলেন একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক। সিনিয়র পার্সোনাল অফিসার। ভারী বদমেজাজি। ওপর থেকে নিচে অবধি সবাই ওনাকে সমীহ করে চলতো। এদিকে আমি জয়েন করে দেখি এক বিশাল পাহাড় প্রমাণ কাজ আমার জন্য পড়ে আছে। কয়েক মাসের পেন্ডিং কাজ। এই কাজ আমাকেই একাই করতে হবে। সেটা কি করে সম্ভব। এদিকে শুনলাম এসপিও সাহেব আমাকেই চেয়েছেন ডেপুটেশনে। মহা চিন্তায় মুষড়ে পড়লাম। কি করি!
আমি যার পাশে বসলাম সে হলো মিত্র বাবু। বেশ কয়েক বছর ধরেই তার সঙ্গে আমার ভালই আলাপ ছিল। সে আমার পিঠে হাত দিয়ে বললো, ' কোনো চিন্তা কইরো না রায়, আমি আসি না, প্রজেক্টের কাজ তো আমি করতে পারুম না ঐটা ভাই তোমারেই করতে হইবো। কিন্তু আমি তোমারে দ্যাখাইয়া দিমু আর পরামর্শ দিমু খালি। যখন তোমার দরকার পড়বো আমারে কইবা '।
আমি জানতাম সি পি ও, এস পি ও, পি ও সবাই মিত্র বাবুর পরামর্শ নিয়ে থাকে। সবচেয়ে পুরনো ও অভিজ্ঞ স্টাফ তিনি। আজ বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে তার সহযোগিতা না পেলে আমি ওই সেকশনের কাজে অযোগ্য প্রমাণিত হতাম।
এইবার আসল ঘটনায় আসি। মাস চারেক পেরিয়ে গেছে কাজ অনেক হালকা হয়ে এলো। বুক ভরে শান্তিতে একটু বাতাস নিতে পারছি। বাঙালির উৎসব দুর্গাপূজা প্রায় সমাগত। আকাশে বাতাসে আগমনী সুর।
জামা কাপড়ের দোকানে ভিড় বাড়ছে একটু একটু। আমিও একদিন স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে কিছুটা হলেও পুজোর বাজার করে এসেছি এক রবিবার। অফিসেও পুজোর নানা রকম আলোচনায় সবাই মত্ত। এমন সময় পিয়ন মুকুল এসে বললো শর্মা সাহেব আপনাকে ডাকছে এখুনি। চেম্বারে ঢুকতেই আমাকে বসতে বললেন। বসলাম। অপেক্ষা করছি কি বলেন শোনার জন্য। ফাইল থেকে মুখ তুলে আমাকে বললেন, এবার তোমার আসল পরীক্ষা হবে। দেখি তুমি কতটা দায়িত্ব নিতে পারো। তোমাকে লখনৌ অফিসে যেতে হবে। তুমি তো জানো গতকাল আমি পাটনা অফিস থেকে ঘুরে এলাম। তুমি ফিরে এলে আমি যাবো ভূপাল। জম্বু তাওয়ায় তোমার জন্য টিকেট কাটতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি রেডি হয়ে থাকো, যেদিনের টিকেট পাবে সেদিন রওনা হয়ে যাবে।
তোমাকে আমি কিছু ক্ষমতা দেবো পেপারে সই করার। কারণ ওখানে কোনো সিগ্নেটরি নেই পার্সোনাল পেপারে সই করার। তাই ওখানকার ফিল্ড স্টাফ আর অফিস স্টাফরা খুব অসুবিধায় আছে। একাউন্টস ডিপার্টমেন্টও কাজের অভাব এর জন্য ভুগছে ডিসবর্সমেন্ট না হবার জন্য। ওখানে বহু কাজ জমে আছে। সেগুলো খুব ঠাণ্ডা
মাথায় চিন্তা করে করবে, ঠিক আছে? যাও এখন।
যথারীতি একদিন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে এক প্রাক মধ্যাহ্নে জাম্বুটাওয়াই এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। সময় কাটানোর জন্য দুটো জার্নাল কিনে নিয়েছিলাম।
তাতে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে জানলার বাইরে চোখ রাখলাম। পরের দিন সকাল প্রায় সাতটা নাগাদ লখনৌ স্টেশনে পৌছালাম। মালপত্র কিছু ছিল না খালি পিঠে একটা ঝোলা ব্যাগ। অতি সহজেই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে বাইরে সিড়িতে এসে দাঁড়ালাম। একটু এদিক ওদিক তাকালাম। একটা লোক আমার সামনে এসে অতি সংকোচে জিজ্ঞেস করলো, ' আপনি কি সৌমেন রায় কলকাত্তা থেকে এসেছেন?' আমি মাথা নাড়াতে
সে একটা জীপ দেখিয়ে বললো, ' আসুন '। উঠলাম জীপে ড্রাইভারের পাশের সিটে। যেতে যেতে সে বললো,
' হামার নাম রঘুনাথ প্রসাদ। আপনাকে বেঙ্গলি হোটেলে নিয়ে গিয়ে উঠাবো। কলকাতার হামাদের সব অফিসের বেশির ভাগ বাঙালি ওই হোটেলে উঠে।'
হোটেলের দোতলায় একটা কোনার ঘরে আমার
জন্য বরাদ্দ হলো। সিঙ্গেল রুম অ্যাটাচ বাথ। রঘু নাথ বললো, ' আপনি একটু বিশ্রাম করে স্নান সেরে রেডি হয়ে নিন। আমি আপনার ব্রেকফাস্টের কথা বলে দিচ্ছি। হামি নিচেই সোফাতে বসে থাকবো। আপনি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসুন। ' ঠিক আছে ' বলে আমি কাঁধের ব্যাগ থেকে টাওয়েল আর একটা গেঞ্জি বার করলাম। স্নান সেরে আর ব্রেকফাস্ট করে আধ ঘণ্টার মধ্যে নিচে নেমে এলাম। ঘড়ি দেখলাম সাড়ে নটা প্রায় বাজে। রঘুনাথ উঠে গাড়ির দিকে গেল। আমিও ওকে অনুসরণ করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। রঘুনাথ গাড়ি ছেড়ে দিল। যেতে যেতে সে বললো, ' রায়বাবু, একটা কথা বলবো?' আমি বললাম, ' কি বলুন '। ' হামার একটা আর্জি আছে। আজতক বুঝলেন, তিন মাহিনা হয়ে গেলো আমার এল টিসি, এক মাহিনা লিভ এনক্যাশমেন্ট ঔর দশ দিন লিভ অ্যাপ্লিকেশন আছে। আপনি যদি মেহেরবানী করে এটা তাড়াতাড়ি বানিয়ে দেন তবে হামার খুব উপকার হয়।' আমি বললাম, ' এলটিসি নিয়ে কোথায় যাবেন?' সে বললো, ' কোথায় আর যাবো, পরিবার নিয়ে দেশে যাবো দেওঘর। আমি আমার পরিবার নিয়ে এখানেই থাকি।' বললাম, ' ঠিক আছে কথা দিলাম, যদি আজকে সম্ভব হয় তবে আজকেই করে দেবো যদি আপনার পেপার হাতে পাই, ঠিক আছে '। লখনৌ অফিসে গিয়ে প্রথমেই রিজিওনাল চিফের ঘরে ঢুকে নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন। চেয়ারে বসে আমি সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাকে পেশ করলাম। পিয়নকে ডেকে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে সব কাগজপত্রগুলো দেখলেন। তারপর নিজের পি এ আর একাউন্টস অফিসারকে ডেকে পাঠালেন। তারা আসার পর তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং কেনো এসেছি সেটাও বললেন। পি এ তিলক বাবু আমাকে নিয়ে গিয়ে পিওন দেবুকে নিয়ে আমার বসার ব্যবস্থা করলেন। তারপর আলমারি খুলে দুটো ফাইল বার করে আমার টেবিলে রাখলো। ফাইলগুলো কাগজপত্র ভর্তি। রঘুনাথ সামনে আসলো। আমি একটা ফাইল টেনে নিলাম। অন্য ফাইলটা দেবু খুলে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। আমি দেবুকে বললাম, ' তুমি এই অফিসে যে কজনের এলটিসি, লিভ এনক্যাশমেন্ট, ইনক্রিমেন্ট পেন্ডিং পড়ে আছে সেগুলো বার করে ও তাদের ফাইল গুলো বার করে সেই ফাইলগুলোর ওপর গুঁজে রাখো।
আমি এখন কাজ শুরু করবো। আরো দু একজন আমার আশে পাশে ছিল তারা সবাই হাত লাগলো। বুঝলাম এদের সবারই কিছুনা কিছু পেপার পেন্ডিং আছে। অল্প সময়ের মধ্যে আমি সবার প্রিয় হয়ে গেলাম। সব মিলিয়ে দশটা ফাইল ওরা আমার টেবিলে এনে রাখলো। আমি
অলরেডি কাজ শুরু করে দিয়েছি।
বেলা দেড়টার সময় তিলক বাবু আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বললো, ' এবার উঠুন কিছু খেতে হবেতো।' আমি বললাম, ' কোথায় যাবো '? সে বলে,' 'চলুন না ' অনেকেই দেখছি তিলক বাবুর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। একটা গ্যারেজ ঘরে ঢুকে দেখি একটা নেভানো
স্টোভ, একটা ডেকচিতে ভাত, একটা পাত্রতে ডাল আর
একটা পাত্রে আলু ফুলকপির তরকারি। একটা তাকে থালা, বাটি, গ্লাস সাজানো। তিলক বাবু বললো, ' এই আমাদের দুপুরে খাবার ছোট্ট ব্যবস্থা। আজ আমাদের এখানে আপনার নিমন্ত্রণ। আমাদের সঙ্গে বসে যান। খুবই সামান্য ব্যবস্থা।' এখানে দেবুও আছে। সেই ভাত বেড়ে সবাইকে দিচ্ছে, আমাকেও দিল। খুব সংকোচে হাত বাড়িয়ে থালাটা নিলাম। বললাম,' আপনাদের কম পড়ে যাবে, খারাপ লাগছে।' সবাই বলে উঠলো ' না না আপনার জন্যও রান্না হয়েছে। যে কদিন আছেন এখানেই খাবেন।' আর কিছু বলার নেই। খেয়ে দেয়ে আবার কাজে
গিয়ে বসলাম। ঘন্টা দেড়েক পড়ে চা এসে পড়ল টেবিলে। দেবু বসে আছে আমার সামনের টেবিলে। চা খেতে খেতে কথা হচ্ছে ওর সঙ্গে। খুব করিৎকর্মা ছেলে এই দেবু। যে পেপার আমি ক্লিয়ার করছি সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে নিয়ে ও Despatch করিয়ে একেবারে এ ওর টেবিলে দিয়ে আসছে আর অফিস কপি সেইসব ফাইলে ফাইল করে দিয়াসছে। একেবারে পরিষ্কার কাজ। এর মধ্যে এ ও ঘোষ বাবু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে বললো,
' আপনি আসাতে মশাই অফিসে একটা বেশ ব্যস্ত ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একজন স্টেনো, তিলক বাবু না, বলে ওঠে, ' কেনো হবে না পুজোর মুখে সবাই হাতে টাকা পাবে কিনা, সবাই যার ধন্দে ছিল, হয়তো পুজোর আগে এলটিসি অ্যাডভান্সটা হবেনা বোধহয়। তাই সবাই খুশি।' ঘোষ বাবু বললো, ' রঘুনাথ পর্য্যন্ত চৌধুরী বাবুকে নিয়ে যাবার আগে আমাকে বলে গেল স্যার ক্যাশ খুল্লে আমার টাকাটা রেখে দেবেন। আমি ফিরে এসে যেনো পাই।'
বিকেল সোয়া পাচটা নাগাদ চৌধুরী বাবুকে নিয়ে
ফিরলো রঘুনাথ। এসেই ছুটলো ক্যাশে। টাকা পেয়ে গুনতে গুনতে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। স্বভাবতই
টাকা পেয়ে খুশি। বললো, ' শুকরিয়া রায় বাবু। কখুন
যাবেন?' আজকে আমার কাজ সারা। কালকের কাজ
গুলো গুছিয়ে রাখছি। বললাম,' যখন নেবেন '। 'তবে
চলুন এখন। আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গাড়িটা
গ্যারেজ করে বাড়ি যাবো '। জিজ্ঞেস করলাম, ' কেনো
গাড়ির আর কি প্রয়োজন নেই?' ' না।, চৌধুরী সাব নিজের গাড়িতে আর ঘোষ বাবু স্কুটারে আর সবাই
সাইকেল করে বাড়ী ফিরবে।' রঘুনাথ একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো। গাড়ি থেকে নেমে
দোকানটাতে ঢুকলো। কিছু পরে দুহাতে দুটো শালপাতায়
করে চারটি করে গরম গরম কচুরি আর আলুর তরকারি
নিয়ে এলো। তারপর একটা ছেলে দু গ্লাস চা দিয়ে গেলো।
খাবার পর পকেটে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ' কতো
হয়েছে রঘু '? রঘু কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে
স্টার্ট দিয়ে বললো, ' হামি দিয়ে দিয়ে দিয়েছি। মনে করুন হামি খিলালাম। ' ' কেনো রঘু কাজ করে দিয়েছি, তাই
বলে। ' ও বললো, ' কেনো আপনি আমাদের মেহেমান,
একদিন কি আপনাকে খিলাতে পারবো না।' কি আর বলি তাকে। গাড়ি এসে দাঁড়ালো হোটেলের সামনে। কাল
সকাল সাড়ে নটায় আসতে বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে
এলাম। রুমে ঢুকে জুতো জামাটা খুলে টান টান করে শুয়ে পড়লাম। খুব ক্লান্ত লাগছে। গতকাল থেকে বড় ধকল গেছে। চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে
পড়েছি যে টের পাইনি একদম। ঠক ঠক আওয়াজে ঘুম
ভেঙে গেলো। বিছানায় উঠে ঘড়ি দেখলাম, আটটা বেজে
গেছে। তার মানে বেশ খানিকটা ঘুমিয়েছি। দরজা খুলে
বাইরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। অবাক হয়ে ভাবলাম
তাহলে কি আমি ভুল শুনলাম নাকি অন্য কোনো দরজায় আওয়াজ হয়েছে। যাই হোক দরজা বন্ধ করে
বিছানায় কিছুক্ষণ বসলাম তারপর চোখে মুখে জল দিয়ে
জামাটা গলিয়ে জুতোটা পরে বেরোলাম বাইরে।
শহরের এইদিকটা বেশ পুরনো আমলের। বেশির ভাগ বাড়িগুলো অতি পুরনো ধাঁচের। রাস্তাও বেশি চওরা
নয়। গাড়ির গতি তাই ধীর। কিন্তু হাঁটতে খুব ভালো লাগে।
নবাব ওয়াজেদ আলীর শহর। ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে। একটু এদিক ওদিক পদচারণা করে একটা রেস্টুরেন্টে
ঢুকলাম। বেশ বড় রেস্টুরেন্টটি গম গম করছে লোকে।
একটা খালি চেয়ারে গিয়ে বসলাম। একজন এসে জিজ্ঞেস করলো কি নেবো। আমি চিকেন আর তন্দুরির
অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাম দিক থেকে
হঠাৎ কে যেনো বলে উঠলো, ' আরে সৌমেন রায় না? '
তাকিয়ে দেখি কলকাতা মার্কেটিং অফিসের দুই অ্যাসটনট অফিসার মনোজ দত্ত ও প্রদীপ সাহা। বললাম
' আরে! তারপর, এখানে ইন্টারনাল অডিট করতে '? 'ঠিক তাই। আপনি '? আমি বললাম, ' পার্সোনাল সেকশনের কাজের জন্য এসেছি।' প্রদীপ বললো, 'কোথায় উঠেছেন '? হোটেলের নাম বলতেই ওরা বললো,
' আরে, আমরাতো ওই হোটেলেই উঠেছি। কলকাতা থেকে যখন কাজে আসি তখন আমরা ঐ হোটেলেই উঠি। আমরা আছি এখন তিন নমবার রুমে। আপনি?'
আমি সাত নাম্বার রুমে আছি শুনে ওরা পরস্পর মুখ
চাওয়াচাওয়ি করলো। মনোজ বললো, ' উপরে উঠে ডান
দিকের একদম কোণের সিঙ্গেল রুমটাতে তো? ' মাথা
নাড়লাম আমি। আবার ওরা মুখ চাইলো পরস্পরের দিকে। কেনো জানিনা। খাওয়া শেষ করে তিনজনে এক
সঙ্গে ফিরছি হোটেলের পথে। একটা পানের দোকানে এসে দাঁড়ালো ওরা। মনোজ তিনটে পানের অর্ডার দিল।
পানওআলা একসঙ্গে ছটা মিষ্টি পাতা সারি করে রেখে
পর পর সাজাতে থাকলো। আমিতো আশেপাশে কাউকে
আর দেখছিনা। এবার লক্ষ্য করলাম দুটো করে পান সাজিয়ে একসাথে খেতে দিচ্ছে। আমাকেও তাই দিল।
মনোজ বললো, ' এরা পান চাইলে একসাথে দুটো করে দেয়। খেয়ে দেখুন কি চমৎকার।' মুখে দিতেই পান প্রায় গোলে গেলো। আর কি সুন্দর খেতে কি বলবো আর। হোটেলের সিড়ির কাছে এসে পরস্পর শুভ রাত্রি জানিয়ে
বিদায় নিলাম। রুমের তালা খুলে দরজা ঠেলতে দরজাটা
খুললো না। একটু জোর দিলাম তাতেওনা। এবার গায়ের
জোরে ঠেলা দিলাম। ধরাম শব্দ করে দরজাটা খুললো বটে কিন্তু আমি সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বেচেঁ গেলাম প্রায়। অবাক হলাম ভারী। সকালে সন্ধ্যায় তো এই দরজাটা দুবার খুলেছিলাম, তখনতো অতি সহজেই খুলে গিয়েছিল কোনোও অসুবিধে হয়নিতো সে সময়। মনোজ বাবু আর প্রদীপ বাবু কেনইবা পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল? আর ভাবতে পারছি না।
জামা প্যান্ট পাল্টে একটা পায়জামা পড়ে হাত পা ধুয়ে জার্নাল দুটো নিয়ে বিছানায় উঠে দেয়ালে হেলান
দিয়ে পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে একসময় চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে এলো। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
একটা দমকা হাওয়ায় খোলা জানলার কপাট দুটো মনে
হয় পরস্পর বাড়ি খাওয়ার জন্য কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলো। অনুভব করলাম মাথার কাছে যেনো কেউ দাড়িয়ে আছে যার প্রশ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছে। টপ
করে উঠে লাইট জ্বালালাম। কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না। জানালাটা পরখ করলাম, বাইরে তাকালাম। রাতের
শহর শুনশান। একটা কুকুর খালি রাস্তার ওপর শুয়ে আছে। জোরে বাতাসের কোনো চিন্হ নেই। লাইট নিভিয়ে
আবার শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আর আস্তে চাইছে না। একটা সময় ঝিমুনি এলো, যেই আপনাআপনি চোখ দুটো বন্ধ হয়েছে অমনি মনে হলো কেউ একজন অতি
সন্তর্পণে হেঁটে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। লাফ
দিয়ে উঠে আবার লাইটটা জ্বালালাম দেখলাম কিছুই না।
কিন্তু এবার গাটা ছম ছম করে উঠলো কেমন। লাইটটা আর নিভালাম না। ভয় ভয় করতে লাগলো। জার্নাল দুটো আবার টেনে নিলাম। পড়া তো হচ্ছেনা খালি পাতা
উল্টনো হচ্ছে। ঘুম একদম ছুটে গেছে। পড়া শুরু করার
চেষ্টা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ হলো আর কোনো
অঘটন না হওয়ার দরুণ প্রায় রাত দুটো নাগাদ ঘুমিয়ে
পড়লাম আবার।
রাত কতো কে জানে, হঠাৎ বাথরুমে কমোডের
ফ্ল্যাশ টানার শব্দ আর কমডে জল পড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো। কানটা খাড়া করলাম। খানিক পরে সিনকের কল খোলার শব্দ আর সিংকে জল পড়া সঙ্গে সঙ্গে নিচে জল পড়ার শব্দে আস্তে করে উঠে বসলাম
বিছানার উপর। দেখি বাথরুমের দরজা খোলা। আমার
ঠিক মনে আছে আমি বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে শুয়েছিলাম। তাহলে? বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে
গিয়ে বাথরুমের লাইটটা জ্বালালাম। আলোয় ভরে গেলো
বাথরুম। কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। সিনকের কল খোলা জল পড়ে চলেছে অনবরত। বাইরে থেকেই যতটা সম্ভব
হাত ঢুকিয়ে কলটা বন্ধ করলাম। আবার মনে ভয় করতে লাগলো। হাত ঘড়িতে দেখলো রাত চারটে বেজে কুড়ি।
ব্যাগ থেকে মোবাইলের চার্জার আর হেডফোনটা বার করলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে এফএম শোনার চেষ্টা
করতে লাগলাম। কি করবো সকালের অপেক্ষা করতে হবে এখন। একটা সময় পাখির কিচির মিচির আর মুরগির উচ্চ রবে ডাক শোনা যেতে লাগলো। আরো পরে
সূর্যের রোদ এসে পড়লো বিছানায়। তারপরেই দরজার
হ্যাজ বোর্ড দিয়ে দরজার পাল্লায় জোরে জোরে শব্দ।দরজা খুলে দেখি মনোজ বাবু আর প্রদীপ বাবু দাঁড়িয়ে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মনোজ বাবু বললো, ' তিনটে চায়ের
অর্ডার দিয়ে এলাম এই রুমে। এখুনি আসবে। তারপর
বলুন কাল রাতে কেমন ঘুম হলো আপনার '? কাল রাতের সব ঘটনার কথা ওদের বললাম। মনোজ বাবু বললেন, ' কাল রাতে যখন শুনলাম আপনি সাত নাম্বারে
আছেন তখন আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু
আপনাকে এই রুমের কথা বলতে পারিনি আমরা পাছে
আপনি ভয় পান। আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজনের কাছে এই রুমের কথা শুনেছিলাম। সে তখন এই রুমে ছিল একদিন। আপনার কাছে শুনে কনফার্ম হলাম। আর
কোনো রুমে কিন্তু এই ব্যাপারটা নেই।' সুদীপ বাবু বললো, ' শুনেছি কোনো এক বোর্ডার র্এই সিলিং ফ্যানে
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকেই
মনে হয় তার আত্মা রাত্রিবেলা অন্ধকারে ঘরের মধ্যে ঘুরে
বেড়ায়। কিন্তু শুনেছি সে কারো কোন ক্ষতি করে না।' চা
এলো। চা খেতে খেতে মনোজ বাবু বললেন, ' আজই আমাদের পাশের রুমটা খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা দুজনে
ম্যানেজারকে বলে আপনার রুমটা ওটাতে ট্রান্সফার করিয়ে নিয়েছি। আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে আপনি নিচে গিয়ে সেটা কনফার্ম করে নিন।' আমি বললাম, ' তা আর বলতে, আমি এখনই গিয়ে কনফার্ম
করছি। আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ।' তিনি বললেন, 'এবার আমরা তাহলে উঠি। আপনাকেও তো বেরোতে হবে। আবার সন্ধ্যেবেলায় দেখা হবে।' চলে গেলো ওরা।
আমি নিচে গিয়ে দু নাম্বার রুমটা কনফার্ম করে এলাম।
=============
ছবি- ইন্টারনেট