স্মৃতিচারণঃ সাহিত্যিক পুষ্পজিৎ রায়
রীতা রায়
[2/11/2021, 11:42 AM] Puspajit Roy Sir: মুড়ি (পরে লাগবে)/লাইজল/চাপাতা/ চিনি/ আটা /নাঃতেল/ সার্ফ/ ভিম সাবান/ স্কচ বাইট/ ডেটল লিকুইড/ পেস্ট /ওষুধও পরে লাগবে।
[2/12/2021, 2:54 PM] Puspajit Roy Sir: 😀😀😀
'বুড়ো' আঙুলের ভুলে এই বিড়ম্বনাকে মজার ছলে নেওয়ায় হালকা হলাম।শুভেচ্ছা রইল।
* * * * * * * * * *
এটা একটা হোয়াটস্যাপ মেসেজ। হঠাৎই মনে পড়ে গেল সাহিত্যিক ও অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায়ের শেষ মেসেজটির কথা। তাই বসে পড়লাম তাঁর স্মৃতিচারণ করতে। অজস্র স্মৃতির মধ্যে অল্পকিছু। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তবু তিনি আছেন আমাদের মাঝেই ।
সেদিন মানে ০৬-০৫-২০২১ দুপুরে গোপাল লাহা দাদা ফোন করে খবরটা দিলেন। মেসেজও পেলাম অনেকের কাছ থেকে।
করোনা আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন ডঃ পুষ্পজিৎ রায় স্যার। তিনি একাধারে ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, কাহিনীকার, ঔপন্যাসিক, গ্রন্থকার, গবেষক, লোকসংস্কৃতির সংরক্ষক, নাট্যকার, সম্পাদক, প্রকাশক, সংগঠক .. আরো আরো বহুদূর বিস্তৃত তার শিল্পসত্ত্বা। একনিষ্ঠভাবে তিনি শুধু সাহিত্যচর্চা করছিলেন না, গড়ে তুলেছেন কত কত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ এবং ভবিষ্যতের লেখক, কবি.. এক কথায় মানুষ তৈরির কারখানা খুলে রেখেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রাণপুরুষ ছিলেন। 'জোয়ার' পত্রিকা ও 'সময়ের সংলাপ' পত্রিকা দুটি তাঁরই সম্পাদনায় সুপুষ্ট। আজীবন বামপন্থী ভাবাপন্ন হলেও সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। ছোট ছোট অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি সকল উপস্থিত কবি লেখকদের সুযোগ দিতেন, উৎসাহ দিতেন। তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমার মনে হয়েছিল যে মালদা কলেজে বা বাংলা নিয়ে পড়াশুনা করলে আমিও তাঁর ছাত্রছাত্রীর দলে পড়তাম। স্মৃতি রোমন্থন করতে বসলে খেই হারিয়ে ফেলবো। খুব অল্পসময় তাঁর সান্নিধ্যে এসেছি কিন্তু তাতেই কাছাকাছি এসে থাকবো নইলে কোনো অনুষ্ঠান বা সামান্য বৈঠকী মিটিংয়ে নিজে কেন ফোন করবেন আর তাঁর ফোন পেলে না করতে পারতাম নাই বা কেন ? তাঁর অনুষ্ঠানে যে শ্রোতা পাওয়া যেত তা আর কোনো অনুষ্ঠানে পাই নি। সর্বোপরি তিনি নিজে প্রত্যেকের লেখা মন দিয়ে শুনতেন, আর এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
এমনিতে কলেজ লাইফ থেকে তাঁকে দূর থেকেই চিনতাম, কোনো রাজনৈতিক রঙ মাখবো না বলে একটু তফাতেই থাকতাম। ২০১১তে বামফ্রন্ট বিদায় নিলেও তিনি তার সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতেই লাগলেন। তার এক আহ্বানে কত দূর দূর থেকে লেখকেরা এসে হাজির হত! এরকমই এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমার প্রথম যাওয়ার সুযোগ এসেছিলো। সালটা ২০১৩ একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবসের একটি ছোট অনুষ্ঠান ছিল তাঁর স্কুল 'সবুজ অবুঝ শিশুঅঙ্গন'এর মাঠে .. বিকেলে। সাহসে ভর করে দ্বিধামুক্ত মন নিয়েই গেলাম। কিছু পরিচিত মুখ ছিল আর কিছু অপরিচিত। আশীষদা মানে আশীষ উপাধ্যায় সঞ্চালনা করছিলেন। আলোচনা, বক্তব্য, বিশ্লেষণ, কবিতাপাঠ চলছিল। কিছুক্ষন বাদে আশীষদা কাছে এসে বললেন, আমি তো তোকে চিনতেই পারিনি। আমি হেসে বললাম -- ভালো আছেন ? দুটি কবিতা পাঠ করলাম। অনুষ্ঠান শেষে পুষ্পজিৎ রায় স্যার এর হাতে আমার সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি উপহার দিলাম। এই প্রথম মুখোমুখি। এরকমই কয়েকবার যেতে যেতেই পরিচিত হয়ে গেলাম এবং বুঝলাম সাহিত্য সেবাই আসল উদ্দেশ্য .. রাজনৈতিকতা আলোচ্য বিষয় নয়। প্রথমদিকে দেখা হলে চিরকুট হাতে দিয়ে অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে দিতেন। পরে তিনি নিজেই ফোন করে বা মেসেজ করে অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ও স্থান জানিয়ে দিতেন। অগুনতি ছোট বড় অনুষ্ঠানের স্মৃতি রয়েছে। সকাল দুপুর সন্ধ্যা .. স্কুলে, কারোর বাড়িতে বা হল বুক করে ..যখন যেমন, তবে সবক্ষেত্রে গুরুত্ব সমান। একবার সকাল দশটায় ডেকে পাঠালেন .. মদনাবতী যাবার সময় নির্ধারণ হল কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। উল্লেখ্য যে প্রতিবছর ১৭আগষ্ট তিনি সদলবলে শহর থেকে দূরে মদনাবতী নীলকুঠি গিয়ে উইলিয়াম কেরির জন্মদিন পালন করতেন। মিটিং শেষে কবিতাপাঠ .. বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো দেখে আমরা দোতলার বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। আমার কবিতা পাঠের পর উনি আমার বইটা হাতে নিয়ে কবিতাটি নিজে আবার পাঠ করে শোনালেন। আমার ভালো লাগলো এই ভেবে যে কবিতাটি মনোগ্রাহী হয়েছে। এমনও অনেকবার হয়েছে জনা কয়েকজন আমন্ত্রিত .. তার মধ্যে আমি একজন। আবার কখনো দেখা গেলো প্রচুর লোকের সমাবেশ .. উনি তবু বলবেন -- কবিতা পড়ে যেও। আমিই হয়তো ধৈর্য্য না ধরে চলে আসতাম।
অনেক লেখকদের দেখি তারা একটু নামী হয়ে গেলেই আর তাদের পাত্তা পাওয়া যায় না অর্থাৎ আমন্ত্রিত অতিথি হয়েই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে দেখা যায় কিন্তু পুষ্পজিৎ রায় স্যারের সে সব অহঙ্কার কখনো দেখিনি। তিনি স্বেচ্ছাই অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন, এমনকী বইমেলায় ষ্টল করে নিজে স্টলে বসে থাকতেন সারাক্ষন। কখনো কখনো আলাদা ষ্টল না করে সাধারণ লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে আর সব ছোটোখাটো পত্রিকার সাথেই বসে থাকতেন। সেবার 2016 সালে এরকমই লিটল ম্যাগে পসার সাজিয়ে বসেছিলেন। একদিন বিকেলে গিয়ে দেখি, তিনি একাই বসে আছেন, পুরো চত্বর ফাঁকা। একটু মন খারাপ নিয়েই বললাম, একটি গল্প পুরস্কার পেয়েছে.. এবার দ্বিতীয়। নির্বিকারে বললেন -- গতকালই জেনে গেছি, সব বার প্রথম হতেই হবে তাতো নয়, পুরস্কার পেয়েছো .. এটাই বড় কথা।
পরদিনও বিকেল বিকেল গিয়ে দেখি স্যারের সাথে তার স্ত্রী ছড়াকার স্বপ্নাদি বসে। এগিয়ে গিয়ে দুজনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
বললেন-- আবার প্রণাম কেন ?
বললাম, আজকাল প্রণাম করার মতো লোকের বড়ই অভাব, সবার পা তো প্রণাম নেওয়ার যোগ্য নয়। গতকাল সবার হুজুগে তাৎক্ষণিক ছড়া প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে প্রথম হয়েছি.. আজ পুরস্কার বিতরণ, তাই দুই ছড়াকারকে একসাথে পেয়ে একটু মাথা নুইয়ে নিলাম।
স্যার হেসে বললেন, বাহ্!
স্বপ্নাদি বললেন, মাঝে মাঝে এভাবে নিজেকে যাচাই করে নেওয়াটা দরকার।
খুব ভালো লাগলো শুনে। অনেক নিরুৎসাহের মধ্যে একটুখানি খুশি উৎসাহ দেয় আগামীর পথ চলতে।
প্রথম যেবার সৌহার্দ্যের অনুষ্ঠানে গেলাম .. (ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান) স্যার কে দেখলাম। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ্য লেখক তার গবেষণা কার্য্যটি বই আকারে প্রকাশ করেছেন, তার একটি কপি স্যারকে দিলেন। আমি বইটি চেয়ে পাতা উল্টে পাল্টে কিছু জায়গা পড়ে দেখে ফেরত দিতে গেলে উনি বললেন, 'তোমার পড়তে ইচ্ছে করলে বইটি নিয়ে যাও, পড়া হয়ে গেলে ফেরত দিও '। খুব খুশি হয়ে বইটা নিয়ে এসে পড়ে ফেরত দিতে গেছিলাম যেদিন সবুজ অবুঝ স্কুলে বিশেষ একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম।
এই রকম অনেক ছোট ছোট ঘটনা আছে। ২০১৯ এ দুটো অনুষ্ঠানে উনি ফোন করে ডেকেছিলেন। 2020 থেকে বিষময় চলছে .. কেড়ে নিলো তাঁকেও | মাঝে মাঝে হোয়াটস্যাপ এ শুভেচ্ছা বিনিময় চলতো। ডাঃ সুব্রত সোমের ভার্চুয়াল শোকসভার মেসেজও পাঠিয়েছিলেন। শেষবার যে মেসেজটা পাই সেটা একটু অদ্ভুত ও মজার ছিল। কি একটা মুড়ি-চিড়ে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ফর্দ ফরওয়ার্ড হয়েছিল। কিছুক্ষন বাদে আবার একটি মেসেজে লিখলেন, আগের মেসেজটা বুড়ো আঙুলের ভুলে চলে গেছে। আমি বেশ মজা পেয়েছিলাম .. লিখলাম , আমি বুঝেছি ওটা ভুল করেই এসেছে। এভাবেই যোগাযোগ ছিল। ফোন করবো করবো করে করা হয়নি আর অনেককিছু আলোচনা করার ইচ্ছে থাকলেও আমিই সময় বার করতে পারি নি। ক্ষতিটা আমারই হয়েছে, হাতের মুঠোয় পেয়েও কিছুই নিতে পারিনি। মনে পড়ছে একটি মেসেজের কথা.. বছর দুয়েক আগে হোয়াটস্যাপ এ 'হাট্টিমা টিম টিম' ছড়াটি নিয়ে একটি মেসেজ বারবার ঘুরছিলো বিভিন্ন গ্রুপে ও গুগল এ ..পুরো ছড়াটি বাংলাদেশের এক কবির লেখা দাবি করে। অনেক তর্ক করেছিলাম এ নিয়ে। কেউ মানছিল, কেউ মানছিল না। আমি তখন পুরো ছড়াটি সমেত স্যারকে পাঠায়। কদিন বাদে উনি আশ্বস্ত করে জানালেন -- 'এই ছড়াগুলো বহু আগে মুখে মুখে তৈরী। এগুলোর রচয়িতার নাম পাওয়া যায়নি। তবে এগুলোর অনুকরণে অনেকেই অনেক ছড়া লিখেছেন বা ভবিষ্যতেও লিখবেন তাতে মানা নেই। তাই বলে কেউ এই পুরোনো মৌখিক ছড়াগুলো নিজের বলে দাবি করতে পারে না।'
তার সম্বন্ধে লিখতে থাকলে চলতেই থাকবে .. কিন্তু যিনি চলে গেলেন , তিনি আর ফিরবেন না। তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্যভান্ডার ভবিষ্যতের অমূল্য সম্পদ। যদিও আমার খুব একটা পড়া হয়ে ওঠেনি। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা 'আমাদের স্যার, অধ্যাপক পুষ্পজিৎ রায়' শীর্ষকে একটি বই তাঁকে আগেই শ্রদ্ধাঞ্জলীরূপে দিয়েছে |
আমি আমার এই সামান্য স্মৃতিচারণে শ্রদ্ধা জানালাম। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। আমরা একে একে হারিয়ে ফেলছি আমাদের প্রিয় মানুষদের।
আমার শুধু একটি জিজ্ঞাসা থেকে গেল, সাহস হয়নি তাঁকে জিজ্ঞেস করবার। তিনি ছিলেন অতি সাধারণ আড়ম্বরহীন একটি মানুষ। হিন্দুত্বে বিশ্বাস থাকলেও পূজা আরাধনা মূর্তিপূজা এগুলো মানতেন না। 'সবুজ অবুঝ কিন্ডারগার্টেন' স্কুলে কোনোদিন সরস্বতী পূজো হত না, সেদিন সন্ধ্যায় ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। অথচ তিনি মালদার গম্ভীরা নিয়ে গবেষণা করেছেন। মালদহের গম্ভীরা একটি পূজা নির্ভর উৎসব। লোকাচার যা তার লেখার মাধ্যমে লোকসংস্কৃতির মর্যাদা পেয়েছে। রবীন্দ্র-নজরুলসহ অন্যান্য মনীষীদের জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন করতেন কবিতা গান আলোচনা এগুলোর মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন সংগঠনের সবাইকে নিয়ে।
আমি শেষ যেদিন যাই, বিকেল তিনটেই মিটিং ছিল সেই ঘরটায় যে ঘরে তাঁর পাওয়া সম্মাননা, উত্তরীয় , বইপত্র রাখা আছে। সেদিন কোনো কবিতাপাঠ ছিল না, উইলিয়াম কেরীর শতবর্ষ উদযাপন ও তাঁর জীবনী বিষয়ে আলোচনা ছিল।
ঘরটি খুব সুন্দর সাজানো, যেখানে যত পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন সব রাখা আছে। একটাই আপসোস, শেষপর্যন্ত্য করোনা মহামারিতে তার প্রাণ কেড়ে নিলো, অগুণতি ছাত্রছাত্রী থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুকালে কারো মুখ দেখতে পেলেন না | তিনি যেখানে থাকুন ..ভালো থাকুন। তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।
===================
কলমে : রীতা রায় (মালদা )