অনিন্দ্য পাল
মহাবিজ্ঞানী আ্যলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে পৃথিবীর তাবড় সব পদার্থবিদদের সামনে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরী করে দিয়েছিলেন! কী সেই চ্যালেঞ্জ? ব্যাপক অপেক্ষবাদ তত্ত্ব । আর এই তত্ত্বকে সঠিক ভাবে বোঝা বা কাজে লাগিয়ে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন আজও একই রকম চ্যালেঞ্জিং। এই সদ্য জানা গেল যে, সেই তত্ত্বে উল্লিখিত এক মহাজাগতিক রহস্যের ঘোমটা খোলা গেছে। প্রায় একশো বছরের বেশি সময় কেটে গেছে ব্যাপক অপেক্ষবাদ তত্ত্বের জন্মের। এখনও তার বাস্তব প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে বার বার সেই তত্ত্বের নির্ভুলতা প্রমাণিত হচ্ছে।
তবু, এই সদ্য আবিষ্কার হওয়া বাস্তব তথ্য সম্পর্কে যা কিছু সংবাদ মহলে শোরগোল ফেলেছে সে সব কি এক বাক্যে মেনে নেওয়া যাবে? প্রশ্ন সেখানেই।
তাহলে প্রথমে জানা যাক কী সেই আবিষ্কার। তা হল কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। কী এই কৃষ্ণ গহ্বর?
১৯২৮ সালে ভারতীয় স্নাতক ছাত্র সুব্রমণ্যম চন্দ্রশেখর গণনা করে দেখান যে, সূর্যের ভরের দুই গুণের চেয়ে বেশী ভরের নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে এলে তারা নিজেদের অসম্ভব বেশি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ছোট হতে হতে, প্রচন্ড বলে নিষ্পেষিত হতে হতে কুড়ি মাইল বা তারও কম ব্যসার্ধের বস্তুতে পরিণত হয়। এই বস্তুগুলোর ঘনত্ব হয়ে ওঠে ভয়ানক বেশি। প্রতি ঘন ইঞ্চিতে কয়েক কোটি টন। এই সময় ভয়ানক প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এই ভেঙে পড়া নক্ষত্র গুলোকে এই অবস্থায় থিতু করে রাখে তাদের ভিতরের নিউট্রন আর প্রোটনের বিকর্ষণ। এই অবস্থায় তারা হয়ে পড়ে নিউট্রন স্টার। কিন্তু যদি নক্ষত্রের ভর হয় সূর্যের ভরের চেয়ে আরও বেশী? তিন গুণ, চার গুণ, বা তার ও বেশী তখন? কী হবে এদের জ্বালানি ফুরিয়ে এলে?
আসলে নক্ষত্রের মধ্যেকার জ্বালানি হাইড্রোজেন যত হিলিয়ামে পরিণত হতে থাকে, তত তার আয়ু কমে আসতে থাকে। আর যত আয়ু কমে, তত তার কেন্দ্রের দিকে বেড়ে ওঠে মহাকর্ষ বলের টান। এই টান, এই ধরনের বিপুল নক্ষত্রের জন্য এতটাই বেশি হয় যে তারা নিজেরাই নিজেদের কেন্দ্রের দিকে চুপসে ছোট হতে থাকে। এই রকম ছোট হতে হতে একসময় সে নিজের মধ্যেই বন্দী হয়ে পড়ে। আইনস্টাইন দেখিয়েছেন যে, এই অবস্থায় ওই চুপসে যাওয়া নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলের প্রভাবে আলোও তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, শুধু তাই নয়, এই চুপসে যাওয়া নক্ষত্রের টানে আলো বন্দী হয়ে পড়ে, একবার ওই ভয়ানক মহাকর্ষের বাঁধনে আটকে পড়লে আর সে বেরিয়ে আসতে পারে না। এরই পরিণতি হল নক্ষত্র টার দৃষ্টি ক্ষেত্র থেকে বিদায় নেওয়া বা আমাদের কাছে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। আর এই অদৃশ্য নক্ষত্র শবকেই বলা হয় কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। দেখা গেছে সূর্যের ভরের চেয়ে প্রায় কুড়ি গুণ বেশি ভরের একটা নক্ষত্র যখন মারা যায়, তখন যদি তার ব্যাস হয় ১২০ কিমি বা ৭৪ মাইল, তখন সেই নক্ষত্রের বাস্তবিকই মরণ ঘটে, কারণ সে তখন স্থান কালের এমন একটা বেড়া বা গণ্ডির মধ্যে আটকে পড়ে যার বাইরের মহাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার মধ্যে খাটেনা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নিয়ম। এই বেড়া বা গণ্ডির বিজ্ঞানের ভাষায় নাম হল ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন। ওই মৃত নক্ষত্রটা ঘটনা দিগন্তের মধ্যে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই ঘটনা দিগন্তের বাইরেটা হল তামাম মহাবিশ্ব আর ভিতরটা হল কৃষ্ণ গহ্বর।
এখন প্রশ্ন হলো, এই যদি হয় কৃষ্ণ গহ্বর, যাকে আদপেই দেখা সম্ভব নয়, তবে এই যে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যল জার্নাল লেটারস্ এ প্রকাশিত ছ-ছটি গবেষণা পত্রে দাবী করা হচ্ছে, কৃষ্ণ গহ্বর আবিষ্কার হয়েছে, দেখা গেছে তাকে -- ছবি তোলা হয়েছে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ,সেই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ঘটনা দিগন্ত পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপের সাহায্যে, সে সব কি ঠিক? যাকে দেখাই যায় না, তার ছবি তোলা যাবে কেমন করে? যে এক ফোঁটা আলোকেও চিহ্ন মাত্র না রেখে শুষে নিয়ে তার এতটুকু ভগ্নাংশও বাইরের মহাবিশ্বে ফেরত পাঠায় না, তাকে দেখা গেল কি করে?
বিগত সাত বছর ধরে প্রায় দুশো জন মহাকাল বিজ্ঞানীর লাগাতার চেষ্টার পর যখন ২০১৭র এপ্রিলে পৃথিবী থেকে প্রায় পাঁচকোটি ত্রিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে থাকা মেসিয়ার ৮৭ নামের উপবৃত্তাকার ছায়াপথের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে আসা এক্স রশ্মির সাহায্যে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ এক বিশেষ ছবি তুললো আনন্দে নেচে উঠেছিলো সমস্ত সংশ্লিষ্ট গবেষক মহল। আসলে এই ছবিগুলো ছিল একটা সীমানার, যে সীমানার বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে ভিতরে একটা ভয়ানক ভারী এবং মারাত্মক ভাবে সক্রিয় কিছু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। কেমন ভারি? সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৮ টা টেলিস্কোপের সাহায্যে নেওয়া প্রায় এক পেটাবাইট (এক বাইটের সঙ্গে ১ এর পর পনেরোটা শূণ্য গুণ করলে যা হয় আর কি!) তথ্য প্রায় দু'বছর ধরে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ওই সীমানা বা ঘটনা দিগন্তের মধ্যে আছে প্রায় ৬৫০ কোটি সূর্যের মতোই ভর! কিন্তু এই তথ্য দিল ওই ঘটনা দিগন্ত বা সীমানা, যা আসলে প্রায় সাতশো কোটি মাইল জুড়ে থাকা একটা বেড়া। আরও ভালো করে বলতে গেলে এই ঘটনা দিগন্ত বরাবর ছড়িয়ে আছে একটা ঘুরন্ত চাকতি। এই চাকতি বরাবর টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ দেখালো যে সেখান থেকে প্রায় আলোর গতিতে ছুটে আসছে পদার্থকণার এক স্রোত বা জেট। ৪৯০০ আলোকবর্ষ জুড়ে থাকা এই দৃশ্যমান জেট বা স্রোত এক অসামান্য মহাজাগতিক সৌন্দর্য। একটা প্রচন্ড রকমের গরম ধুলো আর পদার্থ কণার স্রোত ওই ঘটনা দিগন্তের গা বরাবর তৈরি করেছে একটা ঘূর্ণিপাক আর তীব্র বিকিরণ। এই বিকরণই আসলে বুঝিয়ে দিল যে ওই চাকতি কোন একটা ভয়ানক ভারী কিছুর চারদিকে ঘুরে চলেছে আজন্মকাল। আসলে যখন চাকতি টা ঘুরে টেলিস্কোপের থেকে দূরে সরে যায় তখন এটা হয়ে যায় খানিকটা অনুজ্জ্বল কিন্তু যান সেটা টেলিস্কোপের দিকে আসতে থাকে তখন সেটা হয় অনেক বেশী উজ্জ্বল। এমনটা যে কোন কৃষ্ণ গহ্বর এর চারধারে আটকে থাকা ওই চাকতিতেই হতে পারে তা আবার মহাবিজ্ঞানী আ্যলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ব্যাপক অপেক্ষবাদ তত্ত্বে বলেই গেছেন। ফলে কৃষ্ণ গহ্বর সরাসরি দেখতে না পেলেও এই ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরন্ত চাকতি আর ঘটনা দিগন্তের থেকে ছুটে আসা বিকিরণ বিশ্লেষণ করে বলা গেল যে সে আছে, শুধু আছে তাই নয়, ৬০০০০ আলোকবর্ষ ব্যসার্ধের বিরাট একটা অঞ্চল জুড়ে প্রায় ৬৫০ কোটি সূর্যের ভর নিয়ে M87 বা মেসিয়ার ৮৭ নামের বিপুল, বিশাল ছায়াপথের ঠিক মাঝখান জুড়ে অবস্থান করছে।কেমন বড় হতে পারে এটা তার একটা বোঝার মত উদাহরণ দেওয়া যাক , যদি কোন ভাবে ওই কৃষ্ণ গহ্বর টাকে এনে আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে বসিয়ে দেওয়া যায় তবে চারদিকে ঘিরে থাকা ঘটনা দিগন্ত প্লুটোর কক্ষপথ ও ছাড়িয়ে যাবে। এর আগে কখনো এত নিখুঁতভাবে এই সক্রিয় ঘটনা দিগন্তের এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা ওই ঘুরন্ত চাকতি থেকে ধেয়ে আসা পদার্থকণার স্রোত এত সূক্ষ্ম আর সুন্দর ভাবে দেখা যায় নি, এই প্রথম সম্পূর্ণ সরাসরি না হলেও কৃষ্ণ গহ্বরের অস্তিত্বের জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেল যা আগামী দিনে মহাকাশ গবেষণায় একটা ঘটনা দিগন্ত হয়ে থাকবে? আর আমরা? ওই ঘটনা দিগন্তের ভিতরে ঢুকে যাবোনা তো! তাহলে সমূহ বিপদ!
================
ছবি- ইন্টারনেট ।
----------------------------অনিন্দ্য পাল।
চম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ।