মাঠের পাশের কুটির
নীলেশ নন্দী
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঠের পাশের মাটির কুঁড়েঘরটা আমায় ভীষণভাবে টানল। বিকেলে অস্ত যাওয়ার পথে সূর্য তার শেষ কিরণটুকু ছড়িয়ে দিয়েছে। এই কচি ঘাসে ভরা মাঠে কদাচিৎ ছেলেরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে আসে। আজ আসেনি। চারিদিকটা যেন থম মেরে রয়েছে। এই কুটিরেই কিছুদিন আগে পর্যন্ত শুক্লা দিদার বাস ছিল। আমার সঙ্গে তার কোনরকম রক্তের বন্ধন ছিল না, কিন্তু দিদা আমায় এত ভালোবাসত, এতটা আপন করে নিয়েছিল, যে রক্তের বন্ধনও সেই সম্পর্কের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়েছিল। দিদার কোন সন্তান ছিল না। দিদা কুলের আচার, আমের আচার, পাঁচমিশালি আচার তৈরি করে তা বিক্রি করে পেট চালানোর জন্য ডাল, ভাতের যোগাড় করত। তবুও কারও কাছে হাত পেতে টাকা-পয়সা নেয়নি। দিদা আমাকে ভালোবেসে আচার খাওয়াত। আহা! কি অপূর্ব স্বাদ! যেন অমৃত। মুখে লেগে থাকত। আমাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। দিদার মুখের কথাতেই বারে বারে তার প্রমাণ পেয়েছি। আমিও দিদাকে খুব ভালোবাসতাম। স্কুলে যাওয়ার আগে এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে তার কুটিরে যেতাম। দিদা আমাকে টিফিনে খাওয়ার জন্য রোজ কাটা ফলমূল এবং আচার টিফিন বাটিতে ভরে দিত। আমি একবার পয়সা দিতে গেলেও দিদা নেয়নি এবং আমাকে বলেছিল, "নাতির কাছে পয়সা কিসের? আমার যদি ছেলে থাকত, তাহলে তুই আমার নাতির বয়সেরই হতিস। আমি কি ভালোবেসে তোকে খাওয়াতে পারি না? যতদিন বেঁচে আছি, সাধ করে তোকে খাইয়ে যাই। মরে গেলে তো আর পারব না।"
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, "অমন কথা বলো না দিদা। কোথায় যাবে তুমি? আমি তোমায় কোথাও যেতে দেব না।"
শুক্লা দিদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, "পাগল ছেলে। আমি তোকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।"
আজ দিদা আর নেই। দু'দিনের জ্বরে জ্বলজ্যান্ত মানুষটা চলে গেল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে জানতে পারলাম দিদার জ্বর হয়েছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য জোরও করেছিলাম। কিন্তু দিদা শোনেনি। জানি না, কেন? বলল এমনি সেরে যাবে। এমন জ্বর তো কতই হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়ে ওষুধের দোকান থেকে জ্বরের ট্যাবলেট এনে দিয়ে বলেছিলাম, "এখনই খেয়ে নাও।"
দিদা অনেক কষ্টে ওষুধ খেয়েছিল। কিন্তু, তাতে কোন লাভ হয়নি। মানুষটার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল। তাই আমাকে কাঁদিয়ে মানুষটা পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গিয়েছিল। আমিও খুব একলা হয়ে পড়েছিলাম। বুঝতে পারলাম পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষ না থাকলে জীবন বড়ই একলা মনে হয়।
তবে আজ কুঁড়েঘরটা আমায় বড়ই হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল। আমি মোহাবিষ্ট হয়ে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই হঠাৎ দেখতে পেলাম শুক্লা দিদা আমায় ডাকছে! আমার সমস্ত বাহ্যজ্ঞান লোপ পেতে শুরু করেছে। মৃত্যুর পরেও মানুষটা আমায় ভুলতে পারেনি। হয়ত আমার সঙ্গে যে বন্ধন গড়ে উঠেছিল, সেই টানেই দিদা ফিরে এসেছে। দিদার সেই কথাগুলো আমার কানে বেজে উঠল, "পাগল ছেলে। আমি তোকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।"
====================
ছবি- ইন্টারনেট ।
---------------------------- নাম: নীলেশ নন্দী।
ঠিকানা: মধ্যমগ্রাম; কলকাতা: ৭০০ ১৩০।