উপন্যাসটি যখন হাতে এলো বিভূতিভূষণের 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' নামের সঙ্গে খানিকটা মিল থাকায় ভাবলাম কী জানি কেমন হবে! 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল', লেখক কল্লোল লাহিড়ী। পূর্বে এঁর কোনো লেখা পড়েছি বলে মনে হয় না। ব্লার্বে দেখছি এটি এঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। ব্লার্ব আরও জানাচ্ছে লেখক চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যাপক, তথ্যচিত্র নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ফিল্ম, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য রচনা করেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের তাঁর লেখালেখি। জুলাই ২০২০-তে প্রকাশিত বই ডিসেম্বর ২০২১-এ দশম মুদ্রণে! ভাবা যায় না। অপত্যদ্বয়ের থেকে আচমকা পাওয়া উপহার, শীঘ্রই পড়তে শুরু করলাম। দু-এক পাতাতেই দোলা দিয়ে গেল। টানটা রয়ে গেল শ'দেড়েক পৃষ্ঠার পুরোটাজুড়ে। খুলনার কলাপোতা গ্রামের ইন্দুবালার বাবা মেয়েকে পার করেছিল। মেয়ের বিয়ে দেওয়াকে 'পার করা' বহুল প্রচলিত ছিল, আজও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে বলা যায় না। পরের ঘরে বা বরের ঘরে পার করা। এ পার করা আরও বড়, বিয়ে দিয়ে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় পার করে দেওয়া। খান সেনাদের তখন চরম অত্যাচার — পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার সেই পর্ব। যথেষ্ট খরচ করে মেয়েকে সে বিয়ে দিয়ে দিল এক লম্পট মাতাল জুয়াখোর দোজবর রতনলাল মল্লিকের সঙ্গে। বিয়ের পর বাসরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে শুরু করল নেশা-করে-আসা বরং। বউভাত বলে কিছু হল না। বংশরক্ষাতেই বেশি আগ্রহ যে শাশুড়ির, তার কাছে কেমন মর্যাদা ছিল ইন্দুর? 'বাঙাল মেয়ে কি সাধে বলি? রিফিউজির রক্ত যাবে কোথায়? আমারও ভাল কপাল।' জীবনের সাধ-স্বপ্ন চুরমার-হয়ে-যাওয়া ইন্দুবালার সংসার শুরু হল। এক সকালে পালিয়ে-আসা পাগলাটে এক লোকের কাছ থেকে জানা গেল, পাকিস্তানি মিলিটারি খান সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছে সবকিছু। মা, ভাই, বাড়ির লোকজন, ম্যায় ভিটে সবই গেছে সে আগুনে। ইন্দুবালার জীবন যেন অকালে অনেককিছু হারাবার। ওপার-হয়ে-যাওয়া আপন স্বদেশ। হারিয়েছে আবাল্য সঙ্গী ও ভালবাসার মানুষ মনিরুল।
একে একে জন্ম নিল দুই ছেলে এক মেয়ে। শাশুড়ি স্বামী গত হল একে একে। নিদারুণ দাম্পত্য বেশিদিন স্থায়িত্ব পেল না। তিন ছোট ছোট সন্তানকে নিয়ে তখন চরম দুর্দশায় ইন্দুবালা। উনানে হাঁড়ি চড়বে কীভাবে জানা নেই। কী খেতে দেবে ইন্দু তার বুভুক্ষু তিন সন্তানকে!
আত্মীয়স্বজন-ইয়ারবক্সি সরে পড়ল একে একে, পাওনাদারদের পড়ল লাইন, এমনই এক সময়ে ত্রাতার-ভূমিকা-নিয়ে আগমন ঘটল বিহারের কমলা নামের অজ গ্রামের তারই মতো বিড়ম্বিত-জীবন আর এক মহিলার — ক্যানিং লোকালয়ের যাত্রী মাছওয়ালি লছমীর। সে তার অতি সামান্য সামর্থ্য দিয়ে ইন্দুবালাকে এগিয়ে দিল মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার কাজে — কেবল কাজে না বলে, বলা যায় ব্রতে। সেসব কথা তোলা থাক পাঠকদের জন্যে। কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনে খুবই নগণ্যভাবে শুরু হল ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। সেদিনই পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হল। শুরু হল আর এক জীবন, যে জীবনে হোটেলই ইন্দুবালার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা — সর্বার্থে বাঁচার অবলম্বন। কেবল হারাবার জীবনে অর্জনও যা-কিছু। হ্যাঁ, আর এক সহায়-সম্বলহীন চরিত্র — যার নিজের বলতে কেউ নেই — ওড়িশার কোন খরাপীড়িত অজ গাঁ থেকে এসে-পড়া সেই হল তার সদা সহযোগী, তার হোটেলের একমাত্র সর্বক্ষণের কাজের সঙ্গী ধনঞ্জয়। কেবল দুটি ভাত খাওয়ার জন্যে দরজার কাছে বসেছিল তার ভাইয়ের বয়সি এই মানুষটি। কত মানুষের মুখে দু-বেলা ভাত তুলে দেওয়া! তার মধ্যে ইন্দুরই মতো বিড়ম্বিত-জীবন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সাক্ষাৎ হল দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর যুবাদের সঙ্গে। তারা তাকে কমরেড হিসাবে নিল। কালে কত যে সুনামের অধিকারী হল সেই হোটেল! অফিসের বাবু থেকে কলেজে-পড়া ছাত্রছাত্রীরা চেটেপুটে খেতে লাগল তার বিভিন্ন পদ সহযোগে রান্না। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা একেবারে আপনজনের মতো হাতও লাগায় কাজেকর্মে। তাদের ভাললাগা তাদেরই হাত দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক মাধ্যমে, দিনের পর দিন।
পরের বারের রান্নায় মেনু কী হবে তার মতোই যেন ক্রমশ প্রকাশ্য এ উপন্যাসের কাহিনি। অথবা তরিবত করে স্বাদ বুঝে বুঝে খাওয়ার মতো। বলা বাহুল্য, ইন্দুবালার আপন হাতের রান্না যারপরনাই স্বাদু, কিন্তু স্বাদু-স্বচ্ছন্দ ছিল না তার আপন জীবন। বিপরীতটাই যেন ঠিক, জীবন স্বাদু নয় বলেই স্বাদুতার স্বাদ দেওয়ার আজীবনের ব্রত! গোবরগাদায় পদ্মফুল ফোটানোর সাধনা তার, মাস্টার রতনলালের কোনো লক্ষণ না ফুটে ওঠে সন্তানদের মধ্যে! প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয়েছে কোনও পদের নামে। এক, দুই... সংখ্যাক্রমে আটটি অধ্যায়ের শিরোনাম এইরকম — কুমড়ো ফুলের বড়া, বিউলির ভাল, ছ্যাঁচড়া, আম তেল, মালপোয়া, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল, চন্দ্রপুলি, কচু বাটা। এক-একটা অধ্যায়ে তার পদের শিরোনামের অধীনে আস্তে আস্তে উন্মোচিত হবে সমগ্র কাহিনি। ধীরে ধীরে ইন্দুবালার ওপার বাংলার দিনগুলি উন্মোচিত হতে থাকবে। উন্মোচিত হতে থাকবে তার মনের মানুষ মনিরুল, ভিন ধর্মের হওয়ার জন্যে এবং এ বিষয়ে তার পরিবারের কঠোর অবস্থানের ফলে যে প্রেমের পরিণতি নিয়ে ঘোর সংশয় ছিল তার নিজেরই মধ্যে। একেবারে প্রথম থেকেই শুরু হবে এই উন্মোচনপর্ব। কোনও চরিত্রের উপন্যাসে আগমন — সঙ্গে সঙ্গে সেই চরিত্রকে পুরো প্রকাশ করে দেবে না। প্রতি অধ্যায়ে পূর্বকথার মনে পড়ে যাওয়া দিয়ে (ফ্ল্যাশব্যাক) কাহিনি এগোতে থাকবে — অনেকসময় নস্টালজিয়ার মতো। তার সঙ্গে থাকবে বর্তমান। আর পাঠক ক্রমশ দেখতে পাবে এক উত্তরণের যাত্রা। নিজের জীবনের ছায়া পড়তে দেবে না সেই দৃঢ়চেতা মহিলা তার সন্তানদের উপর। তাদেরকে কঠোর শৃংখলায় মানুষ করবে সে। প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠিত হবে জীবনে। তারা খেয়াল রাখবে, খবর রাখবে — মায়ের কাছে আসবে, মাকে কাছে রাখতে চাইবে। তাদের সঙ্গে স্নেহে-ভালবাসার মধ্যে দিয়েও তবু একটা দূরত্ব রচনা করে চলবে ইন্দুবালা। একেবারে একার মতো এক সত্তা বেঁচে থাকে তার মধ্যে। সন্তান, তাদের সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত জীবনে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে, দেশ থেকে বিদেশে। ইন্দু যক্ষের মতো কিংবা পরম ভালোবাসার নিধিস্বরূপ আঁকড়ে থাকবে সবেধন নীলমণি তার হোটেলটি। বাড়ি থেকে কোথাও প্রায় বেরোবে না, যেন দুবেলা তারই হাতে উনানে হাঁড়ি-কড়াই চড়ে!
সাধারণ উপকরণে অসাধারণ সব পদ উপহার দিতে পারে ইন্দুবালা। কত রকমের তার সম্বৎসরের আচার! তার অনেকখানিই শেখা ইন্দুর ঠাকুমার কাছ থেকে। রান্নায় আগে চাই ঠিকঠাক তার উপকরণ বা সামগ্রী চেনা। যেমন, কচুবাটার জন্যে যেমন তেমন মানকচু হলেই চলে না, 'সেই মানকচুর ভেতরে দুধে টইটম্বুর হতে হবে। গাছ দেখলে বুঝতে হবে গর্ভিনী সে। অনেক তরিজুত করে তুলতে হবে। রান্না করতে হবে।' প্রথম ব্লার্বে লেখা হয়েছে, 'এই উপন্যাসে ছেনু মিত্তির শেষের ইন্দুবালা ভাতের হোটেল ছুঁয়ে থাকে এক টুকরো খুলনা আর আমাদের রান্নাঘরের ইতিহাস — মন-কেমনের গল্প।' এ বই উৎসর্গীকৃত লেখকের কয়েক আত্মজন ছাড়াও 'বাংলার সেইসব অসংখ্য মানুষদের যাঁদের হাতে এখনও প্রতিপালিত হয় আমাদের খাওয়া দাওয়া। জিভে জল পড়ার ইতিহাস।' বইয়ের শেষে কৃতজ্ঞতা স্বীকারে বেশ কয়েকটি নামের নিচে রয়েছে এই বয়ান, 'এবং দুই বাংলার সেইসব বন্ধুরা, যাঁরা প্রতিনিয়ত আমাকে বলে চলেছেন আমাদের রান্না ঘরের ইতিহাস। মন কেমনের গল্পগুলো।' অর্থাৎ এ বইয়ের সর্বাঙ্গজুড়ে স্বাদু রন্ধনের ঘ্রাণ!
ইন্দুবালার জীবন পরিণতির দিকে গেছে, পরিণাম দেখানো হয়নি। দেখানো হয়েছে তার পরম শুভাকাঙ্ক্ষীকে, বলতে হয় তার উত্তরণের একমাত্র পুরোধা। ইন্দুবালার হোটেলেরই জন্যে রান্নার সামগ্রী — বিশেষ করে বলতে গেলে, মানকচু — আনার পথে যার জীবনপথের ইতি ঘটবে। আর শোকে মূহ্যমান ইন্দুর হোটেলে সেই থেকে, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও, কচুবাটা আর কোনোদিনই পদ হিসেবে আসবে না। বহুদিন পরে সেই পদের সিদ্ধান্ত আসবে ইন্দুর ঠাম্মার মতো চোখ-নিয়ে-আসা একান্ত নাছোড় তরুণী সঞ্চারীর অনুরোধে, লছমীরই স্মরণে।
মেখলা ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ ও প্রতি অধ্যায়ের পূর্বে এক পৃষ্ঠাজোড়া বিষয়ানুগ অলংকরণ ভাল লাগে।
প্রতি অধ্যায়ে অতীতচারিতার ভঙ্গি কিঞ্চিৎ ক্লান্তিকর বোধকরি।
প্রুফ আরও ভাল করে দেখার দরকার ছিল। ড় আর র গুলিয়েছে, চন্দ্রবিন্দু উধাও হয়েছে মাঝে মাঝে, অনেকস্থলেই বিস্ময়সূচক চিহ্নের অনুপস্থিতি দেখা গেছে, বহু জায়গায় উদ্ধৃতিচিহ্ন নিয়ম মেনে বসেনি, শব্দ বিভাজিত হয়ে গেছে। বানানরীতিও সব জায়গায় অধুনাতন নয়।
লেখককে অভিনন্দন কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী মনোগ্রাহী এই উপন্যাসটি উপহার দেওয়ার জন্যে।
============
উপন্যাসের নাম : ইন্দুবালা ভাতের হোটেল
লেখকের নাম : কল্লোল লাহিড়ী
প্রকাশকের নাম : সুপ্রকাশ
প্রকাশকাল : জুলাই ২০২০ (ডিসেম্বর ২০২১-এর দশম মুদ্রণ এটি)
মূলত : ২৬০ টাকা