ভ্যানিশিং মেডিসিন
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
গ্রামের মহিলারা প্রতিদিন জঙ্গলে গিয়ে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করত। জঙ্গলের গভীরে যাবার দরকার পড়ত না তাদের। আশপাশে প্রচুর শুকনো কাঠ পাওয়া যেত। মাসখানেক আগে গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য লোক লাগিয়ে শুকনো ডালপালা ও বেশকিছু গুঁড়ি কেটে নিয়ে বেচে দিয়েছে। গ্রামের লোক আপত্তি করেছিল। তিনি তাদের কথায় পাত্তা দেননি। এখন হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয় উপেক্ষা করে গভীর জঙ্গলে তাদের যেতে হয় কাঠের সন্ধানে।
অমলা সাহসী মেয়ে। সে অন্যদের সাহস দিয়ে বলে,"তোদের কোনো ভয় নেই। আমি আগে যাচ্ছি, তোরা আমার পিছনে আয়। বাঘে খায় আমাকে খাবে। তোদের মরতে দেব না।"
জ্বালানির সঙ্কটে পড়ে গ্রামের মানুষ জীবনের বাজি রেখে গভীর জঙ্গলে বাঘের মুখে যেতে বাধ্য হলো। সবাই যেতে সাহস করে না। প্রথমে অমলার সঙ্গে পাঁচ জন মেয়ে গভীর জঙ্গলে গেল। তারা প্রচুর শুকনো কাঠ পেল। আরও অনেক কাঠ রয়ে গেছে। একশ জন মেয়ে এলে এক বছরেও কাঠ নিয়ে ফুরোতে পারবে না।
কাঠের বোঝা মাথায় তোলার আগে তারা চারদিক ঘুরে দেখতে লাগল। কী আশ্চর্য, বনের মধ্যে তাঁবু! তাহলে কি এখানে কোনো মানুষ বাস করে? সে কি খায়? সুন্দরবনের নোনা জঙ্গলে গেঁওয়া, গরাণ, বানী, কেওড়া গাছের ছড়াছড়ি। পেট ভরানোর মতো কোনো ফল এই জঙ্গলে পাওয়া যায় না।
অমলা তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। রান্নার গ্যাস, হাঁড়ি, কড়াই, থালা, বাটি, জগ, বসার চেয়ার, টেবিল,জলের জার, চালের প্যাকেট, সব্জি কি নেই তাঁর তাঁবুতে? কিন্তু, লোকটি গেল কোথায়? কোনো ডাকাতের সর্দার থাকে না তো ? ভাবে অমলা।
অমলা বলল,"আরও একটু ভিতরের দিকে গিয়ে দেখি কেউ আছে কিনা।" অন্যরা যেতে নারাজ। তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়। এখানে সাঁঝের দিকে বাঘ বা হরিণ আসতে পরে। জীবনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু, অমলাকে ছেড়ে যেতেও তাদের মন চায় না।
অমলার বয়স খুব কম, সাহস বেশী। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সে অনেক কাজে দৃষ্টান্ত রেখেছে। পাড়ায় সবাই তাঁকে নানা কাজে ভরসা করে। আজ তেমনই এক সাহসী কাজ করতে চায় সে। কিন্তু, বনের মধ্যে এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকা কাজের কাজ হবে না। বাকি মেয়েরা বলাবলি করল। তারপর তারা তাকে জোর করে নিয়ে বন থেকে বেরিয়ে এলো।
অমলা বড়ি ফিরল। কিন্তু তার মন খুঁত খুঁত করছে। তখন ভরসন্ধ্যা। চারিদিকে মেয়েরা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালছে। অমলা একটি দেশলাই বাক্স নিল। তারপর সে কালো ওড়নায় মাথা ঢেকে বেরিয়ে পড়ল বনের উদ্দেশ্যে। বনে যাবার রাস্তা এড়িয়ে চাষের ক্ষেতের উপর দিয়ে দ্রুতপায়ে চলেছে সে। সে চায় তাকে যেন কেউ দেখতে না পায়।
এবার বনের কিনারে ঢুকে পড়েছে অমলা। সেখানে অন্ধকারে কাঁটাগাছে আটকে গিয়েছে তার চুড়িদার। অনেক কষ্টে কাঁটা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। সদ্য সন্ধ্যায় পাখির কাকলি শুনলেও মন ভালো হয়ে যায়। তবু কেন যে বাঘের মতো ভয়ঙ্কর জানোয়ার বনে থাকে! আমরা এই বনে বাস করতে পারতাম। ভাবে অমলা।
রাতের অন্ধকারে বনের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অমলা তাঁবু পেরিয়ে একটি বন্য পুকুরপাড়ে গিয়ে উপস্থিত। পুকুরের চারদিকে বড়ো বড়ো গাছ। নীচে ঝোপ-জঙ্গল। অন্ধকারে জলের রঙ কালো দেখাচ্ছে। অমলা অনুভব করল, পুকুরের পাড়ে ঝোপের মধ্যে কারা কথা বলছে। সে চুপ করে একটা গাছের তলায় বসে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করল। কোনোভাবে তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পায়নি সে। সে বুঝল, সে সেখানে বসে থেকে কিছুই জানতে পারবে না। তখন সে উঠে তাঁবুর সন্ধান করতে লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে অমলা কোথায় পৌঁছেছে সে ঠিক করতে পারছিল না। ডানদিকে ঘুরে তাকাতেই তার চোখে পড়ল বিদ্যুতের আলো। এই বনের মধ্যে বিদ্যুতের আলো এলো কোথা থেকে। তাহলে কি ওটা ভূতের আলো!, ভাবে অমলা।
অমলা তার ঠাকুরমার কাছে অনেক ভূতের গল্প শুনেছে। এক গ্রাম থেকে মাঠ পেরিয়ে আর এক গ্রামে যেতে অনেকে ভূতের পাল্লায় পড়েছে। খালের পাশে পচা পানার উপর ভূতের আলো নাচতে দেখা গেছে। সেগুলো নেভে আর জ্বলে। এরকম একটানা আলো ভূতের হয় না। সে সাহস করে এগিয়ে গেল আলোর দিকে।
আলোকে নিশানা করে প্রায় ছুটতে লাগল অমলা। আলো যত কাছে মনে হয়, জায়গাটা তত কাছে নয় । প্রায় আধঘন্টা যাবার পর সে পৌঁছে গেল আলোর কাছে। হ্যাঁ, এতো সেই তাঁবু! এখানে বিদ্যুতের আলো! এর মধ্যে নিশ্চয়ই মানুষ আছে। অমলা ডাকল,"ভিতরে কে আছিস?"
সাত-আট বার ডাকার পর অমলা কারো সাড়া না পেয়ে ভিতরে উঁকি মারল। ভিতরেও আলো জ্বলছে। সেখানে কোনো মানুষ নেই। এবার অমলা ভিতরে ঢুকে জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখল। সব বিকালের মতই আছে। তাহলে আলো জ্বালালো কে? ভাবতে থাকে অমলা।
কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেবার পর সে চাল, ডাল, সব্জি নিয়ে রান্নায় বসে গেল। সেখানে মাত্র দুটি থালা দেখে তার মনে হলো, দুজন মানুষ এখানে থাকে। এত রাতে আজ সে ঘরে ফিরতে পারবে না। তাই সে তিন জনের জন্য রান্না করার কথা ভাবল। কিন্তু, গ্যাস জ্বালতে জানে না সে। বাধ্য হয়ে শুকনো কাঠ জ্বেলে সে ভাত, ডাল ও একটা সব্জির তরকারি করে লোক আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে তার ঘুম পেয়ে গেল। সেখানে একটি ত্রিপল পাতা ছিল। তার উপরে শুয়ে পড়তেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত তখন এগারোটা। কে যেন অমলাকে ডাকল। অমলা ঘুম ঘোরে উঠে বসে চোখ রগড়ে বলল,"আমি ভাত খাবো না। আমি ঘুমাবো।"
প্রতিদিনের অভ্যাসমতো সে কথাগুলো বলছিল। তারপরে কে যেন তার মুখে জল ছিটিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সম্বিত ফিরে পেল অমলা।
অমলা তাকিয়ে দেখল, দুই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা এসেছেন। বয়স তার ঠাকুরদা ও ঠাকুরমার সমান। বৃদ্ধ লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলেন,"তুই কে?"
সে বলল,"জানিস না? আমি অমলা।"
লোকটি বলল,"আমি ড. নস্কর। ইনি আমার স্ত্রী। তোর দিদা।"
অমলা টক্ করে তাদের দুজনের পায়ে প্রণাম করে দাঁড়াল। ড. নস্কর খুশি হয়ে বললেন,"অমলা, তুই কোথায় থাকিস?"
"এই বনের পশ্চিম কিনারা থেকে দু মাইল দূরে একটা ছোটো গ্রাম আছে। আমি সেখানে থাকি।" বলল অমলা।
"তুই এখানে এলে কিভাবে?" জানতে চান ড. নস্কর।
অমলা সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। তারপর সে বলল,"তোরা এখানে কিভাবে এলি?"
শ্রীমতি নস্কর বললেন,"তোর দাদু একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছে। সেটার একফোঁটা জিভে ফেললেই দুই ঘন্টার জন্য আমরা অদৃশ্য হয়ে যাই। তবে আমরা দুজনে দুজনকে দেখতে পাই।"
অমলা বলল,"দারুণ ওষুধ। আমি খেলে তোদের দেখতে পাব?"
"নিশ্চয়ই।" বললেন শ্রীমতি নস্কর।
"তাহলে আমাকে খেতে দে।" সে বলল।
শ্রীমতি নস্কর বললেন,"তুই কি ঘরে ফিরবি না? তোর মা-বাবা কাঁদবে।"
সে বলল,"আজ আমি এখান থেকে যাব না।"
ড. নস্কর বললেন,"তুই কি খাবি?"
সে বলল,"আমি সবার জন্য ভাত রান্না করেছি। দিদা, তুই দেখ আমার রান্না তোরা খেতে পারবি কিনা?"
শ্রীমতি নস্কর ভাত-তরকারি দেখে খুব খুশি। তারা খাওয়ার পর এক জায়গায় বসল। ড. নস্কর নাতনির বয়সী মেয়েকে কাছে পেয়েছেন। তাঁর নাতনির কথা মনে পড়ে গেল। তিনি সস্নেহে বললেন,"আমি জঙ্গলে এসেছি কেন জানিস?"
অমলা বলল,"কেন, দাদু?"
তিনি বললেন,"আমি বিদেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। চাকরি শেষ হলে দেশে ফিরলাম। আমার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে বিদেশে রোজগার করতে চলে গেল। আমাদের মনে হলো, মানুষের সঙ্গে থেকে লাভ কি? যখন এই বুড়ো বয়সে আমাদের দেখার কেউ নেই। বরং আমরা বনে গিয়ে থাকব। তাই এখানে চলে এলাম। বনের হাওয়া-বাতাসে আমাদের অসুখ হয় না। এখানে সোলার লাইট লাগিয়ে আলো জ্বালাতে পেরেছি। খুব ভালো আছি?"
অমলা বলল,"আমি তোদের দেখব, দাদু। তুই চিন্তা করিস না।"
ড. নস্কর বললেন,"সমস্যায় পড়লে মানুষ সমাধানের রাস্তা বের করে নেয়। আমিও অনেক চেষ্টা করে 'ভ্যানিশিং মেডিসিন' তৈরি করে ফেললাম।"
অমলা বল,"এই ভারি জিনিসগুলো তোরা আনলি কি করে?"
ড. নস্কর বললেন,"মজুরেরা বয়ে এনেছে।"
অমলা বলল,"তারা এখানে আসে না।"
ড. নস্কর বললেন,"তাদের এই ওষুধ খাইয়ে নিয়ে আসি। তাদের বিপদ হয় না। আর কোলকাতা থেকে গরিব মজুর বনের মধ্যে এসে কী লাভ পাবে! তাছাড়া, তারা ভয়ে বনে আসতে চায় না।"
সে বলল,"দাদু, আমাদের গ্রামের লোক ভয়ানক বিপদে আছে। তুই তাদের রক্ষে কর।"
ড. নস্কর বললেন,"আমি কি করতে পারি?"
সে বলল," গ্রামের লোক আগে বনে কাঠ আর মধু নিতে আসত। বাঘ তাদের ধরে ধরে খেত। এখন ধারে কাছের কাঠ পঞ্চায়েত সদস্য বিক্রি করে দিয়েছে। মেয়েদের জ্বালানির জন্য বনের ভিতরে আসতে হচ্ছে। তাদের বাঘে খেতে পারে। এই ওষুধ যদি তুই তাদের দিস, দু'ঘন্টার মধ্যে কাঠ ভেঙে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পরবে। দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে তাদের জীবন বাঁচবে।"
ড. নস্কর বললেন,"আমার ওষুধের পেটেন্ট বিক্রি করলে আমি কয়েক কোটি টাকা রোজগার করব।"
শ্রীমতি নস্কর বললেন,"তোমার প্রচুর টাকা আছে। তাও বনে বাস করতে হচ্ছে। এবার টাকা রোজগার করে তুমি কি শ্মশানে যবে?"
ড. নস্কর বললেন,"ঠিক বলেছ। শোন অমলা, তোদের গ্রামের মানুষদের আমি অসুধ দেব। কিন্তু, ওষুধ খেয়ে চুরি-ডাকাতি করা যাবে না। তাহলে ওষুধ দেওয়া বন্ধ করে দেব।"
অমলা ড. নস্করকে জড়িয়ে ধরে বলল,"তুই খুব ভালো দাদু। এবার গ্রামের মানুষ বন থেকে কাঠ, মধু এনে বেচে টাকা পাবে। তা দিয়ে তাদের খাবার, পোশাক আর থাকার জায়গা পাবে। মানুষগুলো বেঁচে যবে।"
ড. নস্কর তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করল। এইটুকু মেয়ে গ্রামের মানুষের জন্য কত ভাবে!
হঠাৎ অমলা তাঁবুর বাইরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,"দাদু, বা-ঘ-।"
ড. নস্কর বললেন,"ভয় করিস না। আমি তো আছি।" তিনি একটি শিশি পকেট থেকে বের করে দুজনের মুখে এক ফোঁটা করে ওষুধ দিলেন এবং নিজেও খেলেন।"
বাঘ ঘরের মধ্যে ঢুকে ঘোরাফেরা করে বেরিয়ে গেল। অমলা বলল,"বাঘ আমাদের দেখতে পায় নি, দাদু?"
ড. নস্কর বললেন,"না, দুঘণ্টা আমাদের কোনো জীব দেখতে পাবে না। দশ বছর গবেষণা করে আমি এই ওষুধ আবিষ্কার করেছি।"
"তোরা সারাদিন কোথায় থাকিস?" অমলা জিজ্ঞেস করল।
ড. নস্কর বললেন,"বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই। তুই যখন পুকুর পাড়ে গেছিলি তখন আমরা ওষুধ খেয়ে ওই পুকুরের অন্য পাড়ে বসে গল্প করছিলাম। নয়তো বাঘ-শিয়ালে আমাদের খেতে পারে।"
সে বলল,"তাই আমি তোদের দেখতে পাই নি। দাদু, আমাকে সারা বন ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।"
ড. নস্কর বললেন,"সে কাল থেকে হবে। এবার চল, তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি।"
সে বলল,"গভীর রাতে বাড়িতে গেলে আমাকে বকবে।"
ড. নস্কর বললেন,"তুই গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়বি। কেউ টের পাবে না। সকালে তোকে দেখে সবাই হকচকিয়ে যবে।"
সে বলল,"এখন কেউ দেখতে পাবে না?"
ড. নস্কর বললেন," না।"
সে বলল,"ভারি মজা হবে। ওষুধের কী গুন!"
ড. নস্কর ও শ্রীমতি নস্কর অমলাকে বাড়িতে দিয়ে বনে ফিরে গেলেন। সকালে আমলার ঠাকুরমা দেখল,"তার নাতনি পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।"
গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেল।
___________________
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
গ্রাম ও পো- আমতলা,
থানা-ক্যানিং,
জেলা-দক্ষিণ ২৪ পরগনা,9ব
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ,
পিন নং-743337