Click the image to explore all Offers

গল্প ।। মা ।। দীনেশ সরকার






মা 

 

                                                                                 দীনেশ সরকার

 

 

            - ' নার্স দিদি ! নার্স দিদি ! শিগগির আসুন"

    সুলতা একটু আগে হাসপাতাল থেকে এসে সবেমাত্র স্টোভে দুটো ভাত চাপিয়েছে । এমন সময় অপরিচিতের ডাক শুনে স্টোভ নিভিয়ে  সুলতা বাইরে এসে দেখে কয়েকজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে । একজন বলে উঠলো,' নার্স দিদি শিগগির আসুন । আমাদের পাড়ার দীপক আগুনে পুড়ে গেছে ।'          

            সুলতা নার্সের ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে এলো । সুলতা এ তল্লাটে নার্সদিদি নামে খ্যাত । সুলতা এই গ্রামীন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একমাত্র নার্স ।  ডাক্তার মাত্র একজন । নার্স বলতে সুলতা । আর আছে সুবল নামে একটা স্থানীয় ছেলে ফাইফরমাস খাটার জন্য । ডাক্তারবাবু আসেন সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন । শোনা যায় তিনি তার বাড়ির কাছে কোন এক নার্সিংহোমে যুক্ত আছেন । বাকি দিনগুলো সুলতাকেই হাসপাতাল সামলাতে হয় । তবে সুবল খুব করে । বলা যায় সুলতার সহযোগী । হাসপাতাল ঝাঁট দেওয়ার পাশাপাশি ট্রলি টেনে আনা, রোগীকে খাটে শোয়ানো, স্লাইনের স্টান্ডটা টেনে আনা, প্লাস্টার করার সময় রোগীকে ধরে থাকা ইত্যাদি অনেক কাজই সুবল করে । 'সুবল' বলে ডাকলেই সুবল হাজির । সুবল ধারে কাছে থাকলে সুলতা মনে জোর পায় । ডাক্তারের অবর্তমানে হাসপাতালের  কাজ সুলতাকেই দেখতে হয় । নিজের শিক্ষাদীক্ষা আর অভিজ্ঞতায় ভর করে রোগীকে ওষুধ দেয় সুলতা ।  বছর পাঁচেক হ'লো সুলতা নার্সিং পাশ করে এখানে পোস্টিং পেয়েছে । যখন এখানে এসেছিলো তখন হাসপাতালের ভিতরে কুকুর-বিড়াল চরে বেড়াতো । রোগী ছিলো না বললেই চলে । ডাক্তারবাবু কখন আসতেন, কখন যেতেন কেউ জানতোই না । সুলতা এখানে এসে এর আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে । এখন আশপাশের চার-পাঁচটা গ্রাম থেকে প্রতিদিনই বহু রোগী আসে । সুলতাকেই সব সামলাতে হয় । সুলতা এ তল্লাটের নার্সদিদি নামেই পরিচিত । সুলতাকে তারা তাদেরই একজন বলে মনে করে । সুলতাও এখানকার মানুষজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে । বাবা-মা যখন বলে, 'পাঁচ বছর তো হ'লো এবার বদলি হয়ে বাড়ির কাছে আসার চেষ্টা কর ।'  সুলতা বলে, 'এখানে আমি ভালো আছি মা । এখানকার মানুষজন আমাকে খুব ভালোবাসে ।' বাবা-মা যখন খুব জোরাজুরি করে তখন 'দেখছি' বলে কাটিয়ে দেয় ।

             সুলতা হাসপাতালে গিয়ে দেখে একটা ন-দশ বছরের ছেলের পিঠটা আগুনে ঝলসে গেছে । হাত-পা ও কিছুটা ঝলসেছে । সুলতা জিজ্ঞেস করলো, ' কি করে এমন হ'লো ?'   

            একজন বললো, 'আমাদের পাড়ার নকুলের খড়ের ঘরে আগুন লাগে । দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে । আশপাশের সবাই ছুটে আসে । বালতি বালতি জল ঢেলেও আগুন নেভে নি । এমন সময় নকুলের বউ চেঁচাতে থাকে, ' আমার খোকন ভিতরে আছে । ওকে বের করে আনো ।' সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে । আগুনের মধ্যে কি করে ঢুকবে !  আমাদের কারও সাহস হ'লো না আগুনের মধ্যে থেকে নকুলের দেড় বছরের ছেলেকে বের করে আনার ।  কিন্তু দীপককে রোখা যায় নি । দীপক কাউকে কিছু না বলে সোজা আগুনের মধ্যে ঢুকে নকুলের দেড় বছরের ছেলেকে বুকের ভিতর চেপে বের করে নিয়ে আসে । বাচ্চাটার গায়ে একটুও আগুনের আঁচ লাগতে দেয় নি । আর ও কেমন পুড়েছে দেখুন । আপনি ওকে ভালো করে দিন নার্সদিদি । ওর মা নেই । ওর বাবা সেই সকালে জনমজুর খাটতে গেছে । আপনি ওকে ভর্তি নিয়ে ওর চিকিৎসা করুন নার্সদিদি ।'

            আর একজন পাশথেকে বললো, ' গত সপ্তাহে আমাদের পাড়ার একটা বাচ্চা পকুরে পড়ে যায় । দীপক দেখতে পেয়ে সঙ্গেসঙ্গে পকুরে ঝাঁপিয়ে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে আসে । এমন সাহসী ছেলে খুব কম দেখা যায় ।'    

             ওইটুকু ছেলের সাহস দেখে সুলতা বিস্মিত হ'লো । সুলতা বললো, 'কিন্তু আজ তো ডাক্তারবাবু নেই । পোড়া রোগী, আমি কি করি বলুন তো । আপনারা ওকে বরং কোনো বড় হাসপাতালে নিয়ে যান ।'

            একসঙ্গে কয়েকজন বলে উঠলো, ' আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ । আমরা কোথায় নিয়ে যাবো নার্সদিদি ? যা করার আপনি করুন ।'

             পাশথেকে একজন বললো, 'তাহলে আপনি লিখে দিন কোন্‌ হাসপাতালে নিয়ে যাবো ।'  

            সুলতা বোঝানোর চেষ্টা করলো, 'আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না আমি কাউকে রেফার করতে পারি না । ওটা ডাক্তারবাবুর কাজ ।'

            সবাই বলে উঠলো, 'নার্সদিদি, আপনি থাকতে ছেলেটা ওইভাবে মরে যাবে । আমরা কিচ্ছু জানি না  । আপনি আমাদের যেমন চিকিৎসা করেন সেইমতন দীপকের চিকিৎসা করুন ।'

           সুলতা আবার বোঝানোর চেষ্টা করে, 'জ্বর-সর্দিকাশি, ডাইরিয়ার চকিৎসা একরকম  আর পোড়া রোগীর চিকিৎসা সম্পূর্ণ অন্যরকম  । ডাক্তারবাবুরাই শুধু পোড়া রোগীর চিকিৎসা করতে পারেন ।'

           একজন বললো, 'নার্সদিদি, আপনি থাকতে ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মরে যাবে ? ওকে দেখেও কি আপনার একটু মায়া হচ্ছে না  । দেখুন না ছেলে্টা যন্ত্রণায় কেমন ছট্‌ফট্‌ করছে । আমরা কিচ্ছু জানি না,  আপনার উপর আমাদের ভরসা আছে, আপনি ওর চিকিৎসা করুন । আমরা সবসময় এখানে থাকবো । ডাক্তারবাবু এলে ডাক্তারবাবুর সাথে আমরা কথা বলবো । আপনার কোনো ভয় নেই নার্সদিদি ।'

           সুলতা ভালোই জানে এখানে কোনো বার্ণ ইউনিট নেই । তাই পোড়া রোগীর চিকিৎসা করা খুবই কঠিন । এও জানে ডাক্তারবাবু খুব রাগারাগি করবেন । কিন্তু সহজ-সরল গ্রামের মানুষের দাবীর কাছে সুলতাকে হার মানতে হ'লো । সুবলকে ডেকে দীপককে ভিতরে নিয়ে গেল ।  

           সুলতা ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল । এত যন্ত্রণা হচ্ছে তবু ওর মুখে হাসি লেগে আছে যেন ওর কিছুই হয় নি ।  ড্রেসিং করতে করতে সুলতা জিজ্ঞেস করলো,' হ্যারে তুই যে আগুনের মধ্যে ওইভাবে ঢুকে গেলি,  তোর একটুও ভয় করলো না  ?

           ছেলেটি হাসতে হাসতে সংক্ষেপে উত্তর দিল, 'না ।'

           সুলতা বললো, 'তুইও তো পুড়ে মরে যেতে পারতিস্‌ ।'

          দীপক নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো, 'মরে গেলে যেতাম । তাইবলে ছোট্টভাইটা পুড়ে মরবে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো ? কেউ বিপদে পড়লে আমি চুপ থাকতে পারি নে ।'

           সুলতা জিজ্ঞেস করলো, 'তুই স্কুলে যাস, ?'

           দীপক হাসতে হাসতে বললো, 'হ্যা, আমি ফোরে পড়ি ।'

          একটা ফোরে পড়া ছেলের অমন সাহস দেখে ছেলেটার প্রতি সুলতার একটা টান পড়ে গেল ।

 

         পরেরদিন ডাক্তারবাবু হাসপাতালে এসে একটা পোড়া রোগীকে সুলতা বেডে তুলেছে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন । সুলতাকে ডেকে মনের রাগ উগরে দিলেন, 'আপনি জানেন এখানে কোনো বার্ণ ইউনিট নেই, তবু আপনি একটা পোড়া রোগীকে বেডে তুললেন । আপনি তো অন্য হাসপাতালে রেফার করতে পারতেন ।'

           সুলতা  খুব শান্তভাবে উত্তর দিল, ' সে ক্ষমতা কি আমার আছে স্যার ।'   

          ডাক্তারবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, 'আপনি রোগীকে ফেরৎ পাঠাতে পারতেন । ওরা যেখানে খুশি  নিয়ে যেত তাতে আমাদের কিছু আসে যেত না ।

          সুলতা আরও শান্তভাবে উত্তর দিল, 'তা ঠিক স্যার । কিন্তু তারপরে যদি একটা কমপ্লেন হতো, ডাক্তারবাবু হাসপাতালে থাকেন না, সেটা কি ভালো হ'তো স্যার ।'

           ডাক্তারবাবু এবার নরম হলেন, 'তাই বলে একটা পোড়া রোগীকে বেডে তুলবেন ।'

          সুলতা বললো, 'কি করবো স্যার । অনেক করে বোঝালাম, কিন্তু গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো বুঝতেই চাইলো না । ওরা আমাদের উপর অনেক ভরসা করে বসে আছে স্যার ।'

          ডাক্তারবাবু বললেন, 'এখন  আমি কি করি । আপনি জানেন, যদি অঘটন কিছু ঘটে, তখন যারা আজ আপনার উপর ভরসা করেছে তারাই কাল আপনাকে হেনন্থা করবে ।'

            সুলতা বললো, 'কিচ্ছু হবে না স্যার । আপনি ট্রিটমেন্ট করুন ।'

            ডাক্তারবাবু আবার উত্তেজিত হয়ে বললেন, ' আপনি যেন সব জেনে বসে আছেন ।'

           দীপকের গ্রামের লোক যারা বাইরে অপেক্ষা করছিলো তারা ভিতরে ঢুকে বললো, 'নার্সদিদির কোনো দোষ নেই ডাক্তারবাবু । উনি আমাদের অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন । আমরা গ্রামের মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, আমরা কোথায় নিয়ে যাবো ডাক্তারবাবু ? তাই আমরা নার্সদিদিকে বলেছিলাম এখানে চিকিৎসা করতে । আপনি দীপকের চিকিৎসা করুণ ডাক্তারবাবু । দীপকের যাই হোক আমাদের গ্রামের কেউ আপনাদের একটা কথাও বলবে না ।'

            অগত্যা ডাক্তারবাবুকে  রণে ভঙ্গ দিতে হলো । বললেন, ' ঠিক আছে । আপনারা আসুন আমার সঙ্গে খাতায় সই সাবুদ করতে হবে ।'  

          

           অন্যরোগীদের মতো দীপকও ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় ও সুলতার সেবায় ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকলো । সুলতা দায়িত্ব নিয়ে দীপকের শুশ্রূষা করতে লাগলো । অন্য রোগীদের থেকে দীপককে একটু বেশি যত্ন নিতে থাকলো,কেননা, দীপককে সেই ভর্তি করেছে । তাছাড়া দীপকের সাহস সুলতাকে মুগ্ধ করেছে । তাই দীপকের প্রতি সুলতার একটু বাড়তি টান পড়েছিলো ।  দীপক হাতদুটো ঠিকমতো তুলতে পারতো না । সুলতাই ওকে তিনবেলা চামচে করে খাইয়ে দিত । সেদিন দুপুরে সুলতা যখন চামচে করে খাওয়াচ্ছিলো, দীপক একদৃষ্টে সুলতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল  । সুলতা জিজ্ঞেস করলো, 'কি রে আমার মুখের দিকে কি দেখছিস্‌ ?'

           'তোমাকে দেখছি । তুমি কত ভালো । আমার মা-ও নিশ্চয় তোমার মতো ভালো ছিল ।'

           'কেন, তুই তোর মাকে কোনোদিন ভালোকরে দেখিস্‌ নি ।'

           ' না গো নার্সদিদি । আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই আমার মা আমাদের ছেড়ে স্বর্গে চলে গেছে । আমার মার মুখটা যে কেমন আমার মনে পড়ে না  । আমাদের ঘরে তো মার কোনো ছবি নেই তাই আমার মা দেখতে কেমন ছিলো আমি জানি নে । হয়তো তোমার মতো ছিল ।'

            মাতৃহারা দীপক কেমন ভাবুক হয়ে যায় । দুচোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে । সুলতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে , 'কি করবি বল্‌ । সব কিছুকে মেনে নিতে হয়, এটাই এই দুনিয়ার নিয়ম ।'

            'জানো নার্সদিদি, আমি কোনদিন কাউকে মা বলে ডাকতে পারি নি । মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা কাকে বলে আমি জানি নে । কোনোদিন কেউ আমাকে তোমার মতো আদর করে খাওয়ায় নি । তাই আমি তোমাকে দেখছিলাম । আচ্ছা নার্সদিদি, আমি যদি তোমাকে "মা" বলে ডাকি তুমি রাগ করবে ?'

             অবিবাহিতা সুলতা পড়লো মহা ফ্যাসাদে । এ রকম কোনো প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না । কি বলবে সে দীপককে ? একটা নিষ্পাপ মাতৃহারা শিশুকে কষ্ট দিতেও মন চাইছে না । এই ক'দিনে সাহসী এই ছেলেটার প্রতি সুলতার একটা টান পড়ে গেছে । অনেক ভেবেচিন্তে দীপকের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, 'না রে রাগ করবো না । কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে , তোকে লেখাপড়া শিখতে হবে । তোর যখন যা দরকার আমাকে বলবি আমি তোকে সব দেবো । যখন আমি এখানে থাকবো না তোকে আমার ঠিকানা দিয়ে যাবো, তুই আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখবি । আমি তোর নামে টাকা পাঠিয়ে দেবো । তোকে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে হবে । তোকে এই অশিক্ষিত গ্রামে আলো দেখাতে হবে ।'

           দীপক অবাক হয়ে বললো, 'তুমি আমাকে লেখাপড়া শেখাবে নার্সদিদি ? জানো নার্সদিদি আমার না খুব পড়তে ইচ্ছে করে । কিন্তু আমার বাবা যে বলেছে এই ক্লাসটা পাশ করলে আমাকে সঙ্গে করে কাজে নিয়ে যাবে ।'

          'এরপর তোর বাবা যে দিন তোকে দেখতে আসবে আমি তোর বাবার সাথে কথা বলবো যাতে তোকে স্কুল থেকে না ছাড়িয়ে আনে ।'

          'তুমি কত ভালো নার্সদিদি ।'

          'আবার নার্সদিদি বলছিস্‌ ? এক্ষুণি আমাকে কি বলে ডাকবি বললি ?

           দীপক জিভ কাটলো, তারপর  আস্তে আস্তে ডাকলো 'মা, মা ।' 

          এই ছোট্ট শব্দটার মধ্যে যে কি মাধুর্য লুকিয়ে আছে তা দীপক এই প্রথমবার উপলব্ধি করলো ।

          আবার ডাকলো, 'মা ।'   

 

 

****************************************************************************************************** 

ছবি- ইন্টারনেট ।
----------------------------

   

দীনেশ সরকার

১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,

প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।

       

  

            

 

 

 


                    

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.