.
হায় স্বাধীনতা
জয়শ্রী সরকার
'স্বাধীনতা'--- ছোট্ট শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে কী অপার অন্বেষা আর অভিজ্ঞতালব্ধ সমর্পণ। মনে পড়ে গেলো ছোট্টবেলায় দেখা 'সুভাষচন্দ্র' সিনেমায় বাউলের কন্ঠে সেই বিখ্যাত গানটা -- 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ......!' ঠিক ১১৪ বছর আগে নির্ভীক-অকুতোভয়-সত্যের পূজারী শহিদ ক্ষুদিরাম বসু স্বদেশের মুক্তির জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিল। বয়স মাত্র উনিশ। শিহরিত হতে হয়। ভাবি ----- এতবড় হৃদয় পেলো কোত্থেকে ! আজ থেকে বহুদিন আগে ' দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ' জুনিয়র এ. সি. সরকারের লেখা রোজনামচায় একদিন চোখটা আটকে গিয়েছিল ----
" স্বাধীনতা ? দেশটা ভাগ ,
বললে সবাই ---- যা ভাগ !
গেলাম দন্ডকারণ্যেই -----
পেলাম দন্ড, কারণ নেই ! "
চোখ-কান খোলা রেখে যখন বিশ্বটাকে দেখি, মনে হয়--- স্বাধীনতা মানে কী শুধুই মহোল্লাসে একটি দিনের উদযাপন ? না। স্বাধীনতার দায় আমাদের যাপনপর্বের প্রতিটি পদক্ষেপে। স্বাধীনতা কোনো বনসাঁঁই নয়। অনেক গভীরে এর শিকড়। আসলে, স্বাধীনতা মানে হানাহানি নয়, মানবতাবাদ। স্বাধীনতা মানে প্রতিশোধ নয়, অন্যায়রোধ। স্বাধীনতা মানে শৃঙ্খল নয়, শৃঙ্খলাবোধ। ড্রয়িংরুমেই আজ বিশ্বায়ন। বিশ্বের ভান্ডারে শুধুই বারুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাজারটা একটু বেশিই রমরমা। হায় স্বাধীনতা, ছোট্ট শিশুটাও আজ হারিয়ে ফেলছে ওর সবুজ শৈশব। বিশ্বের তাবড় তারুণ্য আজ আই টি সেক্টরে হুমড়ি খাচ্ছে বিদেশ গিয়ে ডলার আনবে বলে। আনাচে-কানাচে বৃদ্ধাশ্রম। এত অন্ধকারে দেশ--- তবু, আনন্দের বেলোয়াড়ি বন্যায় মাতোয়ারা।
স্বাধীনতা, ভারতবর্ষ, আমার মা ! একটা নয়, দু'টো নয়, পঁচাত্তরটা বছর পার করে দিলি মা ---- আমার স্বদেশ, আমার স্বাধীনতা ! রক্তক্ষরণ হয়েছে অনেক, ঝরিয়েছিস অফুরান অশ্রু ! কী পেলি ? ইতিহাসের পাতা উলটে যা !
মহাসমারোহে পালন করতে চলেছি স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী। শুধু চেতনায় ভুলতে বসেছি তাদের কথা, যাদের আত্মবলিদানে আজকের এই স্বাধীনতা । চারিদিকে শুধুই মিথ্যার বেসাতি । আমার দেশ, আমার জন্মভূমি ! বিজ্ঞান তোকে গরিয়সী করেছে, ড্রয়িংরুমেই বিশ্বায়ন । তবু, এত বারুদ কেন তোর ভান্ডারে ! আন্ডারওয়াল্ডের বাজারটা একটু বেশীই রমরমা, বণিকবিশ্ব হাতছানি দেয়, ওপরের আধপোড়া মানুষগুলো কবে যে থিতু হবে মৃত্তিকার শিকড়ই তা জানে ;
এত অশ্রু, এত অন্ধকারে দেশ তবু, আনন্দের বেলোয়াড়ি বন্যায় মাতোয়ারা ।
ভারতবর্ষ, আমার মা, আমার জন্মভূমি ! স্বাধীনতার এতগুলো সূর্যোদয় পার করলি ---- তবু, তোর চোখে জল, শূন্য বুকে এক পাহাড় জমাটবাঁধা অভিমান ! কত আজনবি পেয়ে গেল রাজতিলক ----- তবু, তোর বীর সন্তানকে দিতে পারলি না যোগ্য স্বীকৃতিটুকুও । আমরা যেন সেই ফিনিক্সপাখি, ধোয়াশাচ্ছন্ন হাজার বছরের ভস্ম ভেদ করে যারা আজকের দিনটাতে ফিরে ফিরে আসি তোর কর্মযোগী বীর সন্তানদের সেলাম জানাতে !
ভারতবর্ষ, আমার জন্মভূমি, আমার দেশ ! এত বিদ্বেষ বুকে নিয়ে হাঁটুর নিচে মুখ গুঁজে আর কতদিন হাঁটবি ? অথচ দ্যাখ্, তোর ছোট্ট শিশুটাও হারিয়ে ফেলেছে সবুজ শৈশব, বোকাবাক্স আর অন্তর্জালে বন্দি । শুধু কানামাছি ভোঁ-ভোঁ ------- দেশের তাবড় তারুণ্য আই টি সেক্টরে হুমড়ি খাচ্ছে বিদেশ গিয়ে ডলার আনবে বলে ; আনাচে-কানাচে বৃদ্ধাশ্রম ------ তবু, সন্তানের শুভকামনায় আজও তুই বেঁচে আছিস আরও একটা সূর্যভোর দেখবি বলে ।
সোসালিজম্-অ্যানার্কিজম্- অ্যানিহিলিজম্ বুঝি না কিছু,বুঝি শুধু মানব-উত্থান । তাই, আর কোনো জনযুদ্ধ নয়, মনযুদ্ধ নয়, অশান্তির ঘূর্ণাবর্ত নয়, নয় কোনো রক্তপাত ; শুধু ফিরিয়ে দে শান্তির বাতাবরণ আর স্বাধীন দেশ গড়ার সবুজ স্বপ্নটাকে । ভারতবর্ষ, আমার দেশ, আমার মা, আমার রক্ত,আমার জন্মভূমি, আমার স্বাধীনতা !
'বন্দেমাতরম্' ছোট্ট শব্দের গভীরে কত না ঐশ্বর্য, কত না আত্মবলিদান ! ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জাগে শিহরণ, জাগে রোমাঞ্চ;ছোট্টবেলায় জেনেছি 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনির অপার মর্মকথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্ষুদিরাম বসু-প্রফুল্ল চাকী,বিনয়-বাদল-দীনেশ প্রমুখের সপ্রতিভ মুখগুলো....
আর কত আন্দোলন সংঘটিত হলে একটা সুসংহত দেশ গড়ে উঠবে ! আলোর মুখ দেখবে ? সত্যিকারের মানবতা প্রতিষ্ঠা পাবে ? বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে। বর্তমানের ভেঙে পড়া সমাজ-ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য-শিক্ষা-অর্থনীতি-বিচারব্যবস্থা --- সবকিছুই প্রায় ঠান্ডাঘরে আশ্রয় নিয়েছে। শিক্ষিত যুবক-যুবতীর ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। যে সমাজে শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যরা যোগ্যের আসনে বসে , আর শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের অপরিসীম লোভের শিকার হতে হয় সত্যিকারের যোগ্যদের। কী দোষ করেছিল এরা ? বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। সেখানেও দালালচক্র। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা একপ্রকার প্রহশনে পর্যবসিত। দেশের তাবড় সম্পদ ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু। বাকিদের জীবন অন্ধকার থেকে আরো গভীরতর অন্ধকারে। এরই নাম স্বাধীনতা ? সভ্যতা সবসময়ই আলোর দিশারী। অথচ আবেগ-মথিত কন্ঠে আমরা গেয়ে উঠি ---- " মুক্তির মন্দির সোপান তলে / কত প্রাণ হ'লো বলীদান / লেখা আছে অশ্রু-জলে ...... ! " দেশভক্তি কাকে বলে জানে না এইসব চেতনাবিমুখ মুষ্টিমেয় ভ্রষ্টাচারী কিছু মানুষ। আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আর শোষণ দূর হ'লো না। ' সর্বশিক্ষা অভিযান ' শুধুই খাতায়-কলমে। প্রতি মুহূর্তে খন্ডিত হচ্ছে ' স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার ' বাল গঙ্গাধর তিলকের সেই বজ্রনির্ঘোষ। অতুলপ্রসাদ সেনের ' নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান / বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান ' প্রত্যক্ষ করতে পারছি কী ? এও এক মস্ত জিজ্ঞাসা।
সেদিন দু'শো বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে মঙ্গলশঙ্খে ত্রিভুবন মুখরিত করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার বিজয়মন্ত্র 'বন্দেমাতরম্'! কিন্তু আজ? ফুল-মালা আর চন্দনচর্চিত তিরঙ্গা পতাকায় মহোল্লাসে স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তী পালন করলাম সেই 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনিতে; তাই তোর চোখে জল ! ভারতবর্ষ, আমার মা, আমার জন্মভূমি, আমার রক্ত, আমার স্বাধীনতা, নতুন করে জাগিয়ে দে মা আমাদের ব্রহ্মচেতনা ! 'বন্দেমাতরম্' !
========================