ভ্রমণকাহিনি ।। পুরী ভ্রমণ।। শংকর লাল সরকার
পুরী ভ্রমণ
শংকর লাল সরকার
কলকাতার দমবন্ধ করা গরমে যখনই প্রাণ হাঁফিয়ে উঠে তখনই ভ্রমণে যাবার ইচ্ছাটা চাগিয়ে উঠে। কিন্তু এই মে মাসের গরমে কোথায় যাওয়া যায়? পাহাড়ের দিকে যাবার কোন ট্রেনে সিট নেই। আই-আর-সি-টি-সি খুলে হতাশ। গিন্নি বলল, হাতের কাছে তো পুরী রয়েছে। আর জগন্নাথদেবের এমনই কৃপা যে তৎকালে গরিবরথের টিকিট মিলে গেল। নির্ধারিত সময়সীমার আধঘন্টা আগেই পৌছে গেলাম পুরী স্টেশনে, ভোরের আলো তখনও ফোটেনি।
দিনের শুরুতে পুরী পৌছানোর মজাই আলাদা। স্টেশনে নামতেই সমুদ্রের বাতাসে লোনা গন্ধ। সমুদ্র ডাকছে। একটা অটোভাড়া করে চলে এলাম স্বর্গদ্বারে। গতকাল হাওড়া স্টেশনে বসে অনেকগুলো হোটেলে ফোন করেছিলাম কিন্তু সর্বত্রই সেই একরব ঠাঁই নাই ঠাই নাই। আজ কী ভাগ্য স্বর্গদ্বারে সিইন নামের একটা হোটেলে ঘর পেলাম। ঘরে ঢুকেই একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দেওয়াল জোড়া বিরাট জানলার মুখোমুখি সমুদ্র। দুটো দিন সমুদ্রের সঙ্গে কাটানো যাবে। পুরী এসেছি অবসর যাপনের জন্য। কোথাও যাবার কোন তাড়া নেই। অখণ্ড অবসর। ঘরের ভিতরে বসেই উপভোগ করতে লাগলাম অপার জলরাশি। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্ররও রূপবদল ঘটতে লাগল। কালো রঙ চলে গিয়ে সমুদ্রের রঙ এখন নীল। সাদা ফেনার মুকুট পরে একের পরে এক ঢেউ ভেঙে পড়ছে সোনালি বালুকাবেলায়। সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত পর্যটক, রঙিন ছাতার তলায় ব্যস্ত দোকানী। উটের অলস গমন দেখতে দেখতেই সময় গড়িয়ে চলল।বাঙালির পুরী ভ্রমণের মুখ্য আকর্ষণ দুটো এক সমুদ্র আর দুই জগন্নাথদেবের মন্দির। যতবারই দেখা হোক না কেন এর আকর্ষণ চিরন্তন। করোণা কালে অনেক বাধা নিষেধ ছিল এখন নিষেধ না থাকলেও বাধার বেড়াজাল রয়ে গেছে। অটো যেখানে নামাল সেখান থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে মন্দিরের পূর্ব দিকের ব্যাঘ্রদ্বারের সামনে উপস্থিত হলাম। মন্দিরের সামনে পৌছেও হল না। অনেকটা দূর দিয়ে প্রবেশের ব্যবস্থা। প্রবেশ করতেই দেখলাম সামনের ভোগমণ্ডপকে লাল রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথার ছাদ সাদা।মন্দিরের প্রবেশপথেই একজন অল্পবয়সী পাণ্ডা আমাদের পাকড়াও করে গল্প শুরু করলে।জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণ প্রসঙ্গে উনি একটা সুন্দর কিংবদন্তীর গল্প শোনালেন। বিষ্ণুর পরম ভক্ত বিশ্বাবসুরের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভগবান বিষ্ণু কোন এক লুক্কায়িত স্থানে বিশ্বাবসুরের পূজা নিতে সম্মত হন। বিশ্বাবসুর ভূবনেশ্বর থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে মহানদীর তীরে কান্টিলো নামক পাহাড়ের মধ্যে অরণ্যসংকুল এক গোপন জায়গায় নীলমাধবরূপী ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। এদিকে বিষ্ণুর আর এক ভক্ত মালব্যরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর আরাধনা করার জন্য আকুল ভাবে প্রার্থনা করেন। তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু একদিন রাত্রে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন তিনি যেহেতু একজায়গায় পূজিত হচ্ছেন তাই তিনি অন্যত্র পূজিত হতে পারেন না। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন তার এক বিশ্বস্ত অনুচর বিদ্যাপতিকে বিষ্ণুর আরাধনার গোপনস্থানের সন্ধান করতে বললেন। অনেক খোজাখুজির পর বিদ্যাপতি কান্টিলো পাহাড়ের অরণ্যসংকুল গোপনস্থানের সন্ধান পান। বিদ্যাপতি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে কান্টিলো পাহাড়ের সেই অরন্যসংকুল এলাকায় ভগবান বিষ্ণুর দর্শন করানোর জন্য নিয়ে এলেন । কিন্তু রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের ভগবান দর্শন হলনা। সাধারণ মানুষ ভগবান বিষ্ণুকে দর্শন করে যাতে অমরত্ব লাভ করতে না পারে সেই জন্য দেবতারা বিষ্ণুকে কান্টিলো পাহাড়ের সেই গোপন জায়গা থেকে সরিয়ে দেন।
ভগবান বিষ্ণুর দর্শণ না পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিদ্যাপতির উপরে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের ক্রোধানল থেকে বিদ্যাপতিকে বাঁচাবার জন্য ভগবান বিষ্ণু আবার রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন জলে ভেসে আসা দারুখণ্ডের থেকে স্বয়ং তার, বোন সুভদ্রা আর দাদা বলরামের মূর্তি তৈরী করে পূজা করতে। কিন্তু কোন মানুষ ভেসে আসা সেই দারুখণ্ডে ছিদ্র করতে পারল না। বিষ্ণুর নির্দেশে দেবকারিগর বিশ্বকর্মা স্বয়ং ছুতোরের ছদ্মবেশে রাজদরবারে হাজির হলেন। তিনি ভেসে আসা দারুখণ্ড দিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণ করতে পারবেন তবে শর্ত একটাই মন্দিরের দরজা বন্ধ করে তিনি ভিতরে কাজ করবেন, যতক্ষণ না তিনি নিজে দরজা খুলে বাইরে আসছেন অন্য কেউ সেই ঘরে প্রবেশ করতে পারবেন না। যদি মন্দিরের দরজা কেউ বাইরে থেকে খোলে তবে তিনি আর মূর্তি নির্মাণ করবেন না। রাজা সানন্দে সেই প্রস্তাবে রাজী হলেন। ছুতোরবেশি বিশ্বকর্মাও দারুখণ্ড নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করলেন। কিন্তু রাজা ধৈর্য ধরতে পারলেন না। পনের দিনের পর অধৈর্য রাজা মন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। মন্দিরের ভিতরে কেবল অর্ধসমাপ্ত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি পাওয়া দেল। ছুতোরের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। ভগ্ন হৃদয়ে রাজা সেই অসমাপ্ত মূর্তিই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন। দেবতারা আজও সেই ভাবেই পুরীর মন্দিরে পূজিত হন।
জগন্নাথদেবকে প্রণাম জানিয়ে এসে বসলাম বাইরের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে। এখানে বসলে এক অদ্ভুত মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
পরদিন কোথায় ঘুরতে যাওয়া হবে? ঠিক করলাম এবারে যাব সাতপাড়া। পুরী অনেকবার এলেও চিল্কায় ডলফিন দেখা হয়নি। ওড়িষা পর্যটন দপ্তরের অনলাইন সাইট থেকে ট্যুর বুক করলাম। ট্যুর বুক করার মিনিট দশেকের মধ্যেই ফোন। পর্যটন দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মী জানালেন পরদিন সাতপাড়া ট্যুরের একটিও সিট খালি নেই। ট্যুরে জায়গা হবে না। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম তবে অনলাইন বুকিং নিল কেন? টাকা পেমেন্ট করা হয়ে গেছে। উনি জানালেন টাকা ফেরত চলে আসবে । তবে ইচ্ছা করলে আমরা ভুবনেশ্বর কোনারক দেখার স্বর্ণ ত্রিভূজ ট্যুরটা করতে পারি। উনি ব্যবস্থা করে দেবেন। রাজী হয়ে গেলাম।
ভোর সাড়ে ছয়টায় ট্যুর শুরু হল। প্রথমেই ধৌলির শান্তিস্তুপ। মেরামতির কাজ চলছে তাই শান্তি স্তুপের উপরে উঠা মানা। তবে পাহাড়ের উপর থেকেই দেখে নেওয়া যায় উদার উন্মুক্ত সেই বিস্তৃত প্রান্তর। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এই প্রান্তরেই হয়েছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ। প্রান্তরের ধার ধেঁষে বয়ে যাওয়া ক্ষীণ স্রোতস্বিনী সেদিন রক্তনদীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এই যুদ্ধই জন্ম দিয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোককে। চণ্ডাশোক পরিনত হয়েছিলেন ধর্মাশোকে।
পর্যটন সংস্থার বাস যেখানে দাড়াল সেখান থেকে সামান্য একটু পথ পার হয়ে এলাম লিঙ্গরাজ মন্দিরের দ্বারে। বিরাট প্রাচীর ঘেরা তিনটি প্রবেশদ্বারের প্রধান সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলাম। গঙ্গারাজা ললাট কেশরী ১০০০ খৃষ্টাব্দে মন্দিরটি তৈরী করেন। মন্দিরে প্রবেশ করে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম।
পুরাণে বলা হয় বারাণসীর মতোই পুণ্যধাম ভুবনেশ্বর ‘লিঙ্গকোটি সমাযুক্তং বারাণসী সমপ্রভম’। মন্দিরের শহর ভূবনেশ্বর একদা এখানে নাকি সাত হাজার মন্দির ছিল। এখনও শখানেক মন্দির স্বমহিমায় দাড়িয়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষকে অতীতের কাহিনী শোনায়।
এ যেন দেবদেবীর এক বিরাট কলোনি, ছোট ছোট অনেকগুলি মন্দির পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে। ১০৮টি মন্দিরের উপনিবেশ লিঙ্গরাজ মন্দির। সমস্ত মন্দির ছাড়িয়ে লিঙ্গরাজ মন্দিরের ১৬২ ফুট উচু বিমান আপন শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশ করছে। বিমানের যে অংশ দূর থেকে দেখা যায় সেখানে কারুকার্যের বাহুল্য নেই,তবে গা সমতল নয় কতকটা ঢেউ খেলানো। মন্দিরের নীচে দাড়িয়ে যতটুকু দেখা যায় সবটাই অপূর্ব শিল্প মণ্ডিত। শিল্পীর দক্ষ হাতের ছোঁয়া সর্বত্র। সমতল ছাদের সভাগৃহের প্রবেশ পথের দুপাশে বীণাবাদনরত সুরসুন্দরীদের মূর্তি। গর্ভগৃহের ভিত্তিভূমিতে আমলক, তার উপরে স্তরে স্তরে বিরালমূর্তি, মানুষের উপরে হস্তীমুখ বিরাল কখনওবা সিংহমুখের বিরাল মূর্তি নির্মিত হয়েছে মানুষের মুর্তির উপরে। তার উপরের স্তরে অপরূপ সব সুরসুন্দরীদের মূর্তি। পিতার কাঁধে চড়া শিশুর মূর্তি, পাঠদানরত শিক্ষক, মৈথুন মূর্তি, অশ্বারোহী যোদ্ধা, তপস্যারত যোগীর মূর্তি কি নেই সেখানে। নাটমন্দিরের শীর্ষে দেখলাম শিবলিঙ্গ আরাধনায় ব্যস্ত পুরোহিত মূর্তি। প্রতিটি খাঁজে বলদর্পী সিংহের মূর্তি। গর্ভগৃহ লাগোয়া তিনদিকে তিনটি ছোট মন্দির। একদম পিছনে জগন্নাথ, একপাশে পার্বতী ও অন্যপাশে লক্ষী মন্দির। মন্দিরের উপর থেকেই ভিত্তিভূমি পর্যন্ত ফিতার মতো নেমে এসেছে অপরূপ আলিম্পন। গর্ভগৃহের চূড়ায় আমলক আর কলস।
মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালের কারুকার্য ছাদের ভাস্কর্যের সঙ্গে মানানসই। সুরসুন্দরীদের মূর্তিতে খাজুরাহোর মন্দির ভাস্কর্যের ছাপ। লাল কঠিন পাথরের উপর শিল্পীর কবি মনের পরিচয়। উড়িষী নৃত্যের ছন্দে কিছু মূর্তি দেখলাম। সময় এখানে পাথরে বন্দী। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের খোপে খোপে কালো গ্রাণাইট পাথরের অষ্টদিকপালের মূর্তি। গর্ভগৃহে সয়ম্ভূ লিঙ্গরাজ। কালো কষ্ঠী পাথরের গৌরীপট্টের উপর রূপার পাত দিয়ে মোড়া লিঙ্গ। জানলাহীন অন্ধকার গর্ভগৃহে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। এখানেই শিব আর বিষ্ণু একসঙ্গে পূজিত হন।
লিঙ্গরাজ মন্দিরের ভিতরে ছবি তোলার মানা। পর্যটকদের আক্ষেপ দূর করার জন্য পর্যটন দপ্তর মন্দিরের গা ঘেঁষে একটা উঁচু মঞ্চ তৈরী করে দিয়েছে। সেখান থেকে মন্দিরের ভিতরের পুরো চত্ত্বরটা দেখা যায়। ছবি, সেলফি তোলার জন্য একেবার আদর্শ।
লিঙ্গরাজ মন্দির দেখে আমরা চললাম শহরের অন্যপ্রান্তে উদয়গিরি, খণ্ডগিরি দেখতে। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ১২৩ ফুট উচু গ্রানাইট পাথর কুঁদে তৈরী হয়েছিল খণ্ডগিরি। জৈন সন্নাসীদের জন্য নির্মিত খণ্ডগিরির চুড়া থেকে ভুবনেশ্বর শহরের দৃশ্য চমৎকার। মহাবীর আর পার্শ্বনাথের মন্দিরের পাশাপাশি হিন্দু মন্দিরও আছে এখানে।
উচ্চতায় কম হলেও উদয়গিরির আকর্ষণ অনেক বেশী। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য এগুলি নির্মিত হয়েছিল। সিড়ি দিয়ে কিছুটা উঠলেই বাঘের মুখের আকৃতির বাঘগুহা। প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ ব্যাপক মেরামতির কাজ চালিয়ে গুহাগুলিকে কোনমতে খাড়া করে রেখেছে। নয় নম্বর গুহাটি দ্বিতল। চারটি ছোট ছোট কক্ষবিশিষ্ট একতলাটির নাম মঞ্চপুরী। কলিঙ্গরাজ খারবেলের রাণীর জন্য উৎসর্গকৃত উপরের তলাটির নাম স্বর্গপুরী গুম্ফা। একে একে দেখতে থাকি হাতি গুম্ফা, গণেশ গুম্ফা। গণেশ গুম্ফার সামনে দুপাশে দুটি হাতির পূর্ণাবয়ব মূর্তিগুলি আকর্ষণীয়। ভিতরের দেওয়ালে হাতির পিঠে রাজকীয় শোভাযাত্রার অধোৎকীর্ণ ভাস্কর্যটি দেখতে ভালো লাগে। উদয়গিরির সবকটা গুহা খুটিয়ে দেখতে বেশ অনেকক্ষণ সময় লাগে। গাইডের তাড়ায় ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোনরকমে দেখা শেষ করি।
এরপরের গন্তব্য কোনারক। তবে সে প্রসঙ্গ আর একদিন।
==================
শংকর লাল সরকার