ভুল ফুল নয় কাঁটা
অজিত কুমার বাগ
জগতে জন্মের মধ্য দিয়ে জীবনের যে পথচলা শুরু....তার পরিসমাপ্তি ঘটে অমোঘ মৃত্যুতে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় জমা হয়ে যায়, মানবজীবনে সীমাহীন ভুলের পাহাড়। তাইতো আজও প্রাসঙ্গিক আপামর বাঙালির হৃদয়বিদারণ চিরন্তন নস্টালজিক হয়ে পড়া সেই গান....
" ভুল সবই ভুল....
এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা, সে ভুল...."( অতল জলের আহ্বান //ছায়াছবি )
অথচ সময় যত গড়ায়, এই সকল
ভুলের কিছু কিছু যায় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে....কিছু-বা মনের মণিকোঠায় স্মৃতির অ্যালবাম দেয় ভরিয়ে। ভুল ভুলাইয়ার এই গোলকধাঁধায় তাদের ভুলতে চাইলেও, ভোলা যায় না কখনও। হয়তো সবার অলক্ষ্যে জীবনভর শুধু চোখের জলে ভাসায়....নয়তো অজান্তে অন্তরকে পোড়ায় অনুশোচনার আগুনে। এমনি একটি মর্মান্তিক সংবেদনশীল ঘটনা ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর আগে অরুণের জীবনে।
সেদিন হাসপাতালের একক কেবিনে লিভার-ক্যান্সার-পেশেন্ট মৃত্যুপথযাত্রী অরুণিমার যন্ত্রণাকাতর করুণ সেই আকুতি অরুণ আজও ভুলতে পারে না....
--- প্লিজ! আমাকে আই.সি. ইউ.-তে পাঠিও না, দোহাই তোমাদের! শেষের ক'টা দিন তোমাদের মাঝে আমি বাঁচতে চাই।
কাঁপা কাঁপা শীর্ণ ফ্যাকাসে দু'হাত জড়ো করে, কাতরকণ্ঠে মিনতি করে অরুণিমা।
--- হ্যাঁ-গো , তুমি বাঁচবে। ডাক্তারবাবু তোমাকে বাঁচানোর প্রাণপণে চেষ্টা করবেন সেখানে।
অবশ্য অরুণ ভালো করেই জানে
ফোর্থ স্টেজ থেকে লিভার ক্যান্সার পেশেন্টকে বাঁচানোর চেষ্টা করা, আর জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার প্রায় সামিল। তবুও ভবিতব্য জেনেও মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে অরুণ।
--- না-গো, তোমাদের দু'টি পায়ে পড়ি ! ওখানে পাঠিও না আমায়। যদি পাঠাও, কাল এসে আমাকে আর দেখতে পাবে না!
এ-কথা বলে আবার নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অরুণিমা।
--- ছিঃ! অমন অলক্ষুণে কথা বলো না, লক্ষ্মীটি !
বার বার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করে অরুণ। তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, একটু কান্না থামিয়ে অরুণিমা বলে....
--- ঠিক আছে, আমি রাজি। তবে তোমরা কিন্তু আমার কষ্ট বুঝলে না। আমার একমাত্র ছেলে অরুণাভকে বোর্ডিংস্কুল থেকে এনে, আমাকে একবার শেষ দেখা দেখতে দিলে না। কতদিন তাকে আদর করিনি! কত কথা-না তোমাদের বলার ছিল। পরে শুনবে বলে, তাও বলতে দিলে না আমায়।
--- শোন--শোন ! বিশ্বাস করো খোকাকে তো আনার চেষ্টা করেছিলাম। গতকালও আমার দার্জিলিং কনভেন্ট স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। উনি জানালেন, পুজোর ছুটির আগে ছাত্রদের থার্ড সেমিস্টার পরীক্ষা চলছে। সুতরাং ছুটি নিয়ে খোকার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। তাছাড়া খোকা নাকি তোমাকে হপ্তাখানেক আগে একখানা চিঠি লিখেছে বাড়ির ঠিকানায়। হয়তো দু'- একদিনের মধ্যে পাওয়া যাবে। বলতে বলতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় বরুণ .... অরুণের ছোট ভাই।
--- দাদা! ভাইপো অরুর চিঠি এসেছে আজ।
--- ও-তাই! কই ? দেখি দেখি! .... বলে হাতটা বাড়িয়ে দেয় অরুণ বরুণের দিকে।
--- না-- না, আমায় আগে দাও! আমার খোকার চিঠি, আমি আগে দেখব। .... বলে ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করে অরুণিমা। অরুণ এবং বরুণ দু'জনেই তাকে শান্ত করে এবং ধরে শুইয়ে দেয়। তারপর বরুণ অরুণাভর চিঠিটা তার বৌদির হাতে অর্পণ করে।
--- আহা! কতদিন পরে খোকাকে কাছে পেলাম। .... বলে দুর্বল দু'টো হাতে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে দু'চোখ বন্ধ করে সোহাগভরে খোকাকে যেন আদর করতে থাকে।
অরুণ-বরুণ চুপচাপ নির্বাক। সে দৃশ্য দেখে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেনা।
কিছু সময় পরে সম্বিৎ ফেরে অরুণিমার। কপোল গড়িয়ে অবিরত চোখের জল ঝরে পড়ছে উপাধানে। অরুণের হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো অরুণিমা ....
দেখো , আমার চোখ তো ঝাপসা। আমি ভালো দেখতে পাচ্ছি না। তুমি পড়ে শোনাও তো খোকা কী লিখেছে!
ঠিক আছে। তুমি শান্ত হও, আমি পড়ে শোনাচ্ছি তোমায়। .... বলে খোকার চিঠিটা পড়তে শুরু করে অরুণ।
পূজনীয়া আমার সোনা-মা!
তুমি কোন চিন্তা করোনা। আমি ভালো আছি। মন দিয়ে পড়াশুনা করছি। আমাকে ডাক্তার হতে হবে না!দেখবে, আমি একদিন মস্ত বড় বিলেৎ ফেরৎ ডাক্তার হব।তোমার সব অসুখ সারিয়ে দেবো। সেদিন তোমাদের আর কোন দুঃখ থাকবে না। আর তো মাত্র ক'টা বছর! তুমি এবং বাবা আমাকে আশীর্বাদ করো, যেন তাড়াতাড়ি আমি বড় হতে পারি। তুমি ভালো থেকো।
তোমরা সবাই আমার প্রণাম নিও।
ইতি
তোমার আদরের খোকা
অরুণাভ
চিঠিটা পড়া শেষ হতে না হতেই অরুণিমার অঝোরে সে-কী কান্না!
তবুও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাকে সেদিনই আই.সি.ইউ.-তে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
পরের দিন....
রুদ্ধশ্বাসে হাসপাতাল এসে পৌঁছালো অরুণ। ভোররাতে অরুণিমা তার পাশে বসে অশ্রুভেজাচোখে হাত দু'টি ধরে অনুরোধ করে বলেছে ....
--- এবার তো আমার যাবার সময় হলো। বেশি কথা বলার তেমন সুযোগ নেই। আমাদের অরুনাভকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। মিনতি আমার, মায়ের অভাব কখনো তুমি বুঝতে দিও না তাকে। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন যেন তার সফল হয়।
--- কথা দিচ্ছি , অরুনাভকে নিয়ে তোমার আমার এ-স্বপ্ন আমি যেভাবেই হোক সার্থক করব।
--- ভালো কথা .... আমার চিকিৎসার সুযোগ তো খোকা আর পেল না! কিন্তু আমার মত হাজার হাজার অসুস্থ মায়েদের চিকিৎসার সৌভাগ্য থেকে যেন সে কোনদিন নিজেকে বঞ্চিত না করে। শহরে অনেক ডাক্তার। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে বড় অভাব তার। তাই আমার একান্ত ইচ্ছা খোকা গ্রামে গিয়ে ডাক্তারি করুক। আমার এই অন্তিম ইচ্ছাটুকু তুমি খোকাকে জানিয়ে দিও।
--- নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবো। কথা দিলাম, তোমার কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকবে না।
--- আরেকটা কথা .... আমি জানি, তুমি আমাকে বড্ড ভালোবাসো। তাই আমি যখন থাকবো না....আমার জন্য কখনো চোখের জল ফেলো না ! শরীরের যত্ন নিও।যদি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস কর, দেখো, পরজন্মে আমি আবার ফিরে আসবো ঠিক তোমার কাছে তোমারই হয়ে। সেদিন তুমি আগের মত আমায় ভালবাসবে তো? ভালো থেকো তুমি।
লোকে বলে .... ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। তাই ভগ্নহৃদয়ে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে ডিউটিরত পরিচিত এক নার্সকে জিজ্ঞাসা করল অরুণ ....
--- সিস্টার! ১৩ নম্বর বেডের পেশেন্ট কেমন আছে ?
--- সরি! মাফ করবেন আমাকে। খুব দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি , আপনাদের পেশেন্ট ভোর রাতেই এক্সপায়ার্ড করেছে।
ধরা গলায় মাথা নিচু করে জানালো নার্স।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল অরুণের। বড়ো নীরব অভিমানে তার প্রিয়তমা অরুণিমা ততক্ষণে চলে গেছে না-ফেরার-দেশে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অরুণ। শূন্যদৃষ্টিতে সজলচোখে তাকিয়ে থাকে খোলা আকাশের দিকে। শারদ সকালের মেঘমুক্ত আকাশে সূর্যকরোজ্জ্বল আলোর গভীরে সুদূর নীহারিকায় অদৃশ্য নক্ষত্রমন্ডলীর মাঝে খুঁজতে থাকে .... আকাশে তারা হয়ে যাওয়া তার প্রিয়াকে। কেবলই তার মনে হয় .... মহাকালের নিয়মে তার জীবনসাথীর মরণ আজ না হয় কাল হত ; কিন্তু তার শেষ ইচ্ছাটুকু তো পূরণ করা যেত! তাহলে ? এ-ভুল কেন করল সে!
সাত বছর অতিবাহিত....
দেওয়ালে টাঙানো অরুণিমার ফটোটার দিকে তাকালে এখনও দু'চোখ জলে ভরে ওঠে অরুণের। অথচ একথা সত্য ...." সময় ও স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না ''।
তবুও সময় অনেক কিছু ভুলিয়ে দিলেও, আজও অরুণ শুনতে পায় .... তার হৃদয়বীণায় অরুণিমার কান্নাভেজা করুণ মিনতির অনুরণিত সেই সুরমূর্ছনা--"শেষের ক'টা দিন তোমাদের মাঝে আমি বাঁচতে চাই .... তোমাদের মাঝে আমি বাঁচতে চাই।"
********************
অজিত কুমার বাগ
গ্রাম + পোস্ট:- ইন্দ্রপুর
দক্ষিণ ২৪ পরগনা
পিন কোড নং:- ৭৪৩৩৭১