Click the image to explore all Offers

প্রবন্ধ ।। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির এক অনন্য দলিল ।। রোকেয়া ইসলাম


 
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির এক অনন্য দলিল
রোকেয়া ইসলাম 
 

'আমি নারী আমি মুক্তিযোদ্ধা' গ্রন্থে অত্যন্ত সচেতনভাবে পরম মমতায় শুধু নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই গ্রন্থে প্রাথমিকভাবে ৫১ জন বীরকন্যার পরিচয় যুদ্ধের পটভূমি এবং পরবর্তী অবস্থা তুলে আনা সম্ভব হয়েছে।
হাজার হাজার নারী যোদ্ধার খবর বের করা অনেকটাই অসম্ভব  ছিল।
প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধা সেল থেকে এই মহতি কর্মের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর সেলিনা আপার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সানন্দে  এগিয়ে আসেন।
প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল  থেকে প্রকাশিত মুক্তিবার্তা  পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকাসহ  এলাকার মুক্তিযোদ্ধা,  মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ স্বাধীনতার স্বপক্ষের সাংবাদিক ও মানুষজনের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের একদল  কর্মী।
তারা তথ্য ধরে ধরে বিভিন্নজনের কাছ থেকে খোঁজ খবর করে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা নারীদের সাথে কথা বলে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার,  পুরানো মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে ভালভাবে। বুঝেছে কেন এই যুদ্ধ।
বিভ্রান্তি এড়াতে একাধিকবার খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে।
মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি লিঙ্গ  ভিত্তিক নয়,  সাধারণভাবে বলা যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ  করেছেন তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা  ; কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্মানিত এই শব্দটি শুনলেই অজান্তেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে দুরন্ত যৌবনের এক বীরপুরুষের। অথচ মধ্যদুপুরের প্রখর সূর্যালোকের মত সত্য  আমাদের স্বাধীনতা  যুদ্ধে হাজার হাজার নারী যুদ্ধ করেছেন,  আহত হয়েছেন শহীদ হয়েছেন। এসব বিষয়ে আমরা এখনও আঁধারেই আছি।
খুব কম সংখ্যক সম্পর্কে জানি বেশিরভাগ আড়ালে পড়ে আছেন।
আমরা তাদের বলি নারী মুক্তিযোদ্ধা  কিন্তু একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার নামের আগে পুরুষ বলি না।
বীর  "হিরোইজম" শব্দটি শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রেই একচেটিয়া ব্যাবহার করি। সমাজের অনেক অসংগতির মত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি  না দেওয়া ছিল নিয়ম, তাদের অবদানকে ছোট করে দেখার তাদেরকে দমিয়ে রাখার কৌশল,  অনেকটাই অনিহা। অবশ্য অনেক পুরুষরা যারা সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা তারাও তালিকার বাইরে আছে। সেখানে নারী তো চিরকালের আড়ালে থাকা মানুষ, তার অবদানকে আজীবন অস্বীকার করা হয়েছে সব বিষয়েই। যুদ্ধের মত বিষয়ে  নারীর অবদান উপেক্ষিত  পড়ে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।

আমাদের দেশের সামাজিক  পেক্ষিতে ১৯৭১ সালে কতটা স্বাধীন ছিল। কতটুকু মুক্ত ছিল যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।? 
তারপরও হাজার হাজার নারী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের এই বীরত্বগাঁথা আমরা কতটুকু জানি। কতটুকু জানতে চাই,  বেশিরভাগই তো  এখনো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখে এই প্রজন্মের একটা অংশ তাদের দলে।
একজন যোদ্ধার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তার নিজের মতামতই চূড়ান্ত কিন্তু একজন নারী প্রথমেই তার সাথে পরে পরিবারের সাথে এবং সর্বশেষ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যুদ্ধ শেষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। প্রতিটা যুদ্ধই ছিল তার কাছে পাহাড় ডিঙানো,  প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে হয়েছে সে যোগ্য।
আর যুদ্ধের পর আবার তাকে নতুন যুদ্ধে আবর্তীন হতে হয়েছে।
পরিবার তাকে গ্রহণ করেনি লোকলজ্জায়।  সমাজের দৃষ্টিতে সে কলংকিনী।
যুদ্ধ  শেষের দুরবস্থা সইতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাদেরকে পিতার নামের জায়গায় নিজের নাম লিখতে বলায় যদিও তারা সন্মান ও স্বীকৃত পেল,  কিন্তু তাদের কারো কারো পরিবারকে একঘরে করেছে সমাজ। ভয়াবহ ৭৫ এর পরের অবস্থা আরো কঠিন আরো করুণ।
এরকম অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ দেশান্তরি হয়েছেন কেউ কেউ ধর্মান্তরিত হয়েছে অনেকেই রয়ে গেছেন আজীবন অবিবাহিত।
আমরা জানি  হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অত্যাচারী নারী যেমন আছে তেমনি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা বীর নারীও আছে।
এমন একজন বাবুগঞ্জ,  বরিশালের করুণা বেগম, তার নিজের কাহিনিতে বর্ণনা করেছেন,  রাজাকার বাহিনী কিভাবে তার দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক স্বামীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে  জয়ন্তী নদীর পাড়ে গুলি করিয়ে হত্যা করে। স্বামীর মৃত্যু শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে  প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে  ঝাপিয়ে পড়েন,  সহযোদ্ধাদের সাথে অনেক সমূখ যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। পরে আহত হন,  মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী, তাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে আসেন।
আশা লতা বৈদ্য ছিলেন হেমায়েত বাহিনীর একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।
তিনি অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধ শেষে আশা লতা বৈদ্য নিজের লেখাপড়া শেষ করে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হন। বিভিন্ন সমাজ কল্যান মূলক কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
বর্তমানে সূর্যমূখী সমাজ কল্যাণ সমাজকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক।
ছায়ারানী সরকার  নাগরপুর টাংগাইল।
তার বাবা ত্রৈলোক্যনাথ সরকার  মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন,  তার সাথে তার কন্যাটিও কাজ করতেন,। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দেবার খবর শুনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী নার্সিং এবং আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন ছায়ারানীকে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গর্ববোধ করেন ছায়ারানী। তিনি বলেন - আমাদের সেবায় অনেক যোদ্ধা সুস্থ হয়েছেন আবার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন এটাই অনেক বড় পাওয়া।
৫১ জন নারীর ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধের  অভিজ্ঞতা,  তবে পটভূমি অভিন্ন। চেতনা একই। আনন্দ একই বেদনাও একই।
তাদের সকলেরই চাওয়া এই স্বাধীন দেশে যেন আর কোনদিন রাজাকার পূনর্বাসিত না হয়। তাদের অর্জিত পতাকার দেশ যেন স্বাধীনতা স্বপক্ষ দল পরিচালনা করে। মুক্তিযোদ্ধারা যেন পূর্ণ সন্মান নিয়ে তাদের যুদ্ধ জয়ী দেশে বসবাস করতে পারে।
বরেণ্য কথাসাহিত্যক  সেলিনা হোসেন যথার্থ মূল্যায়নমূলক একটি কাজ করেছেন।
তার দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে  " আমি নারী আমি মুক্তিযোদ্ধা  "
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য  সন্মানজনক স্বীকৃতিও বটে।
স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের অনেক সভায় মূল্যবান বক্তারও বলে স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী সম্ভম ও ইজ্জত হারিয়েছেন। এই কথাগুলো বীরাঙ্গনা নারীদের জন্য লজ্জা এবং অপমান। তারা নির্যাতিত হয়েছে শারীরিক ও মানসিকভাবে।
বীরাঙ্গনা শব্দটাও সন্মানজনক। এই শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে তার যুদ্ধের অবদানের স্বীকৃতি।
সেলিনা হোসেন  অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন তারমধ্য অন্যতম এই গ্রন্থটি। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে তিনি দরদী এবং সংবেদনশীল মন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের বিচক্ষন  এবং দূরদর্শি সিদ্ধান্ত ওএকদল কর্মীর সাথে লেখক দিনরাত পরিশ্রম করে  একটি সময়োপযোগী ঐতিহাসিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে জাতিকে উপহার দিয়েছেন, ভবিষৎ প্রজন্ম জানতে পারবে একাত্তর সালে নারীদের অবদানও কম নয়। 
===================

রোকেয়া ইসলাম
১ নং সেকশন ডি ব্লক এভিনিউ ৪
বাসা ৩২
মিরপুর
ঢাকা ১২১৬
০১৭১২৫১২৯৩১ হোয়ার্সএ্যাপ নম্বর 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.