প্রতিমা দর্শন
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
আমার ছোটোবেলায় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা মনে পড়লে নানা স্মৃতি আমাকে জড়িয়ে ধরে। আর আমি স্মৃতিমেদুরতায় বিভোর হয়ে সেদিনের জীবনে ফিরে যাই। সেদিনের কষ্ট ও আনন্দ ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে। কষ্টের দৃশ্যগুলো যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, এখন ওগুলো মনে পড়লে আমার অন্তর আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
একবার মহালয়ার ভোরে সাবাই জেগে উঠেছে। আমার মেজ জ্যাঠামশাইয়ের একটি বড় কাঠের ক্যাবিনেটের রেডিয়ো ছিল। তিনি কখন রেডিয়ো চালাতেন জানতাম না। প্রতি বছর মহালয়ার আগে তিনি নতুন ব্যাটারি কিনে আনতেন।
সেটি বেশ জোরে চালিয়ে দিতেন তিনি। গ্রামের অনেক বয়স্ক লোক ও মহিলা "মহিষাসুর মর্দিনী" শুনতে আসত। তার ছিল মাইকের মতো আওয়াজ।
আমি নিজের বিছানায় শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছিলাম।
বিছানায় আমি একা। আমি চোখ রগড়াতে রগড়াতে জ্যঠামশাইদের বড় উঠোনের দিকে গিয়ে দেখি বহু লোকের সমাগম। রেডিয়োটি একটি লম্বা টুলের উপর বসানো। তার চারদিকে মাদুর পাতা। সেখানে গ্রামের বহু মানুষ বসে মহালয়ার গান শুনছে। আর মহিলারা বসেছে লম্বা বারান্দার উপর।
আমি এদিক ওদিক দেখে পরিতোষদার পাশে গিয়ে বসলাম। তার পাশে ছিল নিমাইদা। তিনি বললেন,"এসেছিস? বস। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র চণ্ডীপাঠ করছে।" নিমাইদা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। পাঁচ বছর আগে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। রেডিয়োর অনুষ্ঠান শেষ হাওয়ার পর তিনি সেদিন বলেছিলেন,"এ বছর আমি কোলকাতায় ঠাকুর দেখতে যাব।" পরিতোষদা আমাকে বলল,"আমি চন্দনেশ্বরে ঠাকুর দেখতে যাব। দুর্গা ঠাকুর। আমি তিন টাকা জমিয়েছি।"
আমাদের বাড়ির সামনে মাঘমাসে রটন্তী কলিকা পূজা হয়। সে ঠাকুর দেখেছি। নস্করদের চন্ডীমন্ডপে সরস্বতী পূজা হতে দেখেছি। কিন্তু, দূরে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার ধারণা আমি এই প্রথম পেলাম।
আমার যত আবদার ছিল ঠাকুরমার কাছে। তাকে "তুই" করে ডাকতাম। গ্রামের সব ছেলেমেয়েরা ঠাকুরদা-ঠাকুরমাকে এভাবেই ডাকত। তখন আমরা সভ্যভাবে কথা বলতে শিখিনি।
আমার ঠাকুর দেখার খুব ইচ্ছা হল। আমি ঠাকুরমাকে বললাম,"সবাই ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে, আমিও যাব।" ঠাকুরমা আমাকে নানাভাবে ভয় দেখাতে লাগলেন। তিনি বললেন,"এবছর মা নৌকোয় আসছে। খুব ঝড়-বৃষ্টি হবে। নদী পার হবার সময় খুব ভিড় হবে। এ বছর ঠাকুর দেখতে হবে না।"
বাড়ির মধ্যে কয়েকজন ছেলে যাচ্ছে। আমি যেতে পারছি না। তাই ঠাকুরমার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আমি যাবার জন্য জেদ ধরলাম।
সপ্তমীর দিন বড়োরা ধানখেতের আগাছা নিড়োতে যাচ্ছে। মেয়েরা বাড়ির কাজে ব্যস্ত। গোয়ালা এসেছে গরুর দুধ দোয়ার জন্য। আমার ঠাকুরমা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে কে? আমিও বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বই নিয়ে বসলাম।
একটু পরে পরিতোষদা কাচা জামা-আর দড়ি দেওয়া হাফ প্যান্ট পরে চলে এলো। সে বলল,"ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি। এবছর চন্দনেশ্বরে দুটো ঠাকুর উঠেছে।"
আমার মনও নেচে উঠল। আমি ঠাকুরমাকে গিয়ে বললাম,"সবাই যাচ্ছে, আমিও যাব।" ঠাকুরমা কিছুতেই না ছাড়া হ্যাঁ করে না। মা অসন্তুষ্ট, বাবাও অসন্তুষ্ট। আমাদের রঙ-তামাশা দেখে পরিতোষদা কখন বেরিয়ে গেছে টের পেলাম না। বাবা ঠাকুরমাকে বললেন,"যাক। গিয়ে দেখে আসুক কি কষ্ট। কার সঙ্গে যাবে ও?"
আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম,"পারিতোষদার সঙ্গে যাব।"
বাবা বললেন," সে তো অনেকক্ষণ আগে চলে গেছে।"
আমি সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখলাম বাবার কথাই ঠিক। ভাবেনদা আর কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে যে কে ছিল তার কথা আজ আর মনে করতে পারছিনা। তারা এক-দুজন সঙ্গী পেলে ঠাকুর দেখতে যাবে। আমি ছুটে এসে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। তোরঙ্গ থেকে কাচা জামা আর দড়ি দেওয়া হাফ প্যান্ট বার করে পরে নিলাম। বারান্দা থেকে বই-স্লেট গুছিয়ে জানলায় তুলে রেখে বেরিয়ে পরলাম।
ঠাকুরমা পিছন পিছন ছুটে এলেন। তিনি বললেন,"তোর বাবা বাগানে গিয়েছে। এখন তোকে কে নিয়ে যবে?"
আমি ঠাকুরমাকে বললাম,"ভবেনদা যাচ্ছে। আমরা যেতে পারব।"
ঠাকুরমা আঁচলের গেরো খুলে চারটে আধুলি আমার হাতে দিয়ে বললেন,"পকেটে রাখ। খাবার খাবি।"
আমরা উৎসাহ নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ঢোষা পর্যন্ত যেতে দুটি ছিঁড়ে পড়ে। একটিতে কম জল। সহজে পার হয়ে গেছি। অপরটিতে আমার বুক পর্যন্ত জল। আমরা জলে নামার আগে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। পার হবো কী করে। একজন লোক হাটে যাচ্ছিল। সে ধান ক্ষেতের গা ঘেঁসে এদিক ওদিক পা ঘুরিয়ে জল ভেঙে ওপারে উঠলো। তার ধুতি ভেজে নি। আমরাও তাকে আনুসরণ করে দিব্যি পেরিয়ে গেলাম। বুঝলাম হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝখানের মাটি সরে গিয়ে গভীর হয়ে গেছে।
এরপর গ্রামের ভিতরের দিকের রাস্তা ঘুরে নদীর ঘাটে গেলাম। ধোনা মাঝি আমাদের পার করে দিল। ঢোষা খেয়াঘাট থেকে চন্দনেশ্বর গ্রামের ভিতর যাওয়ার পথ অনেকটা। কোথায় ঠাকুর উঠেছে আমরা জানতাম না। দল দল লোক যাচ্ছে। তাদের পেছনে পেছনে আমরা গ্রামের ভিতর ঢুকলাম। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ঠাকুর উঠেছে। কদিনের বৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের মাঠ কাদা হায়ে আছে। ঠাকুর দেখার পথ বাঁশ দিয়ে ঘেরা। ঘেরা পথে অন্যদের মতো আমরা প্রতিমা দর্শন করতে ঢুকলাম।
ভিড়ে বেশ অস্বস্তি লাগছিল। ভিতরে গিয়ে মা দুর্গাকে দেখলাম। ক্যালেন্ডারে দেবীকে দেখেছি। তেমন অনুভুতি হয় নি। এখানে এসে আমি দুর্গাকে আবিষ্কার করলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল দুটি ছেলে-মেয়ে। সঙ্গে ছিল তাদের মা-বাবা। তাদের পরনে নতুন জামা। মেয়েটি বড়ো বলে মনে হলো। তার মা তাদের কাছে দুর্গা, কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর বিবরণ দিচ্ছিল। গণেশের হাতির মাথা আর কলা বৌযের গল্প শোনাল। আমি মন দিয়ে সেগুলো শুনছিলাম। এই কাহিনি সেদিন জেনেছি আমি। কালো কোঁকড়ানো চুলের কদাকার অসুর এবং সিংহ দেখে আমার রীতিমতো ভয় লেগেছিল।
ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। কমিটির লোকজন আমাদের উল্টোপথে বেরিয়ে যেতে তাড়া দিল। অন্যদের দেখার সুযোগ করে দিতে হবে। তাই আমরা মন্ডপ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলাম। লক্ষ্য করলাম, অধিকাংশ মনুষের গায়ে নতুন জামা-কপাড় আর পায়ে নতুন জুতো। বেশ মজা লাগছিল। আমাদের তিনজনের গায়ে ছিল পুরানো
পোষাক। আমার বাবা পয়লা বৈশাখে সবার জন্য নতুন পোশাক কিনতেন। দুর্গা পূজায় নতুন পোষাক পরিধান করতে হয় তা এখানে এসে জানলাম।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে খুব। সকালে কিছু না খেয়ে বেরিয়েছি।রাস্তার দুধারে দোকান বসেছে। মণিহরি, মিষ্টি এবং তেলেভাজার দোকান বেশি। দোকানে প্রচুর ভিড়। বেগুনি, আলুর চপ এবং পাঁপড় খেয়ে আমরা ফিরতে শুরু করলাম।
আট-দশ জনের একটি দল আমাদের পিছন পিছন ফিরছিল। তারা বলাবলি করছিল, সামনে আরো এক জায়গায় ঠাকুর উঠেছে। তারা সেখানে ঠাকুর দেখবে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে তাদের পিছু ধরলাম।
পুকুরের পাড় দিয়ে চলে গেছে সরু রাস্তা। রাস্তায় এক হাঁটু গদ। আমরা কাদা মাড়িয়ে বটতলায় গেলাম। সেখানে একটি মন্দিরে দুর্গা প্রতিমা তোলা হয়েছে। মন্দিরের বাইরে রাখা বেহুলা-লখিন্দর, সাবিত্রী-সত্যবানের মূর্তি দেখে আমার মন কেমন করে উঠেছিল। আমাদের পাড়ায় মনসামঙ্গল যাত্রা দেখেছিলাম। বেহুলা-লখিন্দরের আমি চিনি। বিবাহিত মেয়েরা তাদের প্রণাম করে সিঁদুর এবং পয়সা দিয়ে যাচ্ছে।
মন্দির থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ এসেছি। এমন সময় আকাশে মেঘ ডাকতে শুরু করল। শরৎকালে হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি। কয়েকজন লোকের সঙ্গে আমরা গিয়ে উঠলাম একটি চণ্ডীমণ্ডপে। ভারী বৃষ্টিতে রাস্তার কাদা তরল হয়ে গেছে। পা দিলে পিছলে যাচ্ছে। যখন খেয়াঘাটে এলাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এক হিন্দুস্থানী ভদ্রলোক খেয়া ডেকে নিতেন। তিনি যেমন ফর্সা তেমনি মোটা ছিলেন। তাকে সবাই ঘাটবাবু বলে ডাকত। হ্যারিকেন জ্বেলে তিনি গদির উপর বসে পয়সার বাক্সের উপর খাতায় হিন্দিতে কী লিখছিলেন। তিনি খেয়াপারের জন্য আমাদের কাছে পয়সা চাইলেন। আমরা ইতস্তত করছি দেখে তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন,"ইতো টাকা খেচ্চা করে নৌকা কিনেছি, প্যায়সা দিবে না।" সেদিন তার ভাঙা বাংলায় কথা বলা আমি হিন্দি বিবেচনা করেছিলাম। খেয়া পার হতে মাথাপিছু দশ পয়সা লাগে। সকালে খেয়া পার হয়েছি। পয়সা চায় নি। এখন সে কথা বলার সাহস পেলাম না। পাছে যাতায়াতের পয়সা কেটে নেয়। তিনজনে তিরিশ পয়সা দিতে যেতেই তিনি হেসে ফেললেন। তিনি মাঝিকে বললেন,"ধোনা, এদের পার করে দে।"
ঘাটবাবু আমাদের পয়সা নিলেন না। ধোনা মাঝি আমাদের পার করে দিল।
বৃষ্টিতে নদীর রাস্তা পিছল হয়ে উঠেছে। অন্ধকার পথে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি। একসময় আমরা বড়ো ছিঁড়েটার কাছে এলাম। বৃষ্টিতে জল বেড়ে গেছে। নেমে জলের টান অনুভব করলাম। ওরা ঠিক আমার পিছনে ছিল। ছিঁড়ের মাঝখানে গিয়ে আমি গাড্ডায় পড়লাম। গিয়ে ভেসে উঠলাম ধানখেতে। আমি তাদের চেঁচিয়ে বললাম,"ওখানে অনেক জল। পিছিয়ে যা।" ওরা পিছিয়ে গেল। ছিঁড়ে পার হতে ওদের পেট পর্যন্ত ভিজে গেছিল। আর আমার স্নান হয়ে গিয়েছিল।
কোন রকমে বাড়ি ফিরতেই ঠাকুরমা বকতে লাগলেন। লম্ফ হাতে পুকুরে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে দিলেন। খাবার পর শুয়ে ঠাকুরমার কাছে হাতিমুখো গণেশের গল্প শুনতে চাইলাম। ঠাকুরমা গল্প শুরু করলেন। আমার আর গল্প শোনা হয় নি। কারণ, সারাদিনের ক্লান্তিতে আমি শিগগির ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
__________________
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
পেশা-প্রাথমিক শিক্ষক
গ্রাম ও পো- আমতলা,
থানা-ক্যানিং,
জেলা-দক্ষিণ ২৪ পরগনা,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ,
পিন নং-743337
মোবাইল নং- +91 9733702450
হোয়াটস অ্যাপ নং-+91 9733702450