নীলেশ নন্দী
নিলয় গ্রামের ছেলে। গরীব পরিবারে তার জন্ম। গ্রামেরই একটা কোয়েট স্কুলে সে পড়াশোনা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে দারুণ ছবি আঁকে। যদিও ছবি আঁকা সে নিজে নিজেই শিখেছে। একবার হাতের সামনে কাগজ পেন্সিল পেলেই তার ছবি আঁকা শুরু হয়ে যায়। কখনও বইয়ের পাতার ছবি দেখে, কখনও নিজের কল্পনায় খাতার পাতায় শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলে। শ্রেণীকক্ষের কেউই তার মত নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে না, যদিও বেশ কয়েকজন ভালো ছবি আঁকতে পারে। নিলয় জানে তারা আঁকার মাস্টারদের কাছে আঁকা শিখেছে। কিন্তু নিলয়ের তো সেটুকু শেখারও সৌভাগ্য হয়নি। নিলয় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে তার কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু কোন একটি শিল্পকর্ম এঁকে তার উপর তুলির টান দিচ্ছে। শুধুমাত্র জলরং এবং তুলির ছোঁয়ায় সেই শিল্পকর্ম অপূর্ব সুন্দর হয়ে উঠেছে। সে মনে মনে ঠিক করল বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের কাছে তুলি রং কেনার আবদার করবে। সেইমত স্কুল ছুটির পর কুটিরে ফিরে মায়ের আঁচল টেনে বায়না ধরল, "মা, মা, আমায় একটা তুলি রং কিনে দাও না। আমি তুলি রং দিয়ে ছবি আঁকব।"
তার মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "বায়না করে না শোনা। তুই তো জানিস আমাদের অবস্থা। একটু বোঝার চেষ্টা কর। বাবা অনেক কষ্টে তোকে পড়াশোনা করাচ্ছে। একটু মন দিয়ে শুধু পড়াশোনা কর। অন্যদিকে আর মন না দেওয়াই ভালো।"
নিলয়ের মন ভেঙে পড়ল। মনের ভিতর অভিমান বাসা বাঁধতে শুরু করল। সে জানে, মা না বলে দিয়েছে মানে তুলি রং আর সে পাবে না। পয়সা জমানোর মত ক্ষমতাও তার নেই। টিফিন মা বাড়ি থেকেই করে দেয়। সে সামান্য কিছু হাত খরচও পায় না। টিফিন পিরিয়ডে সে দেখে অনেকে আচার খাচ্ছে, ঝালমুড়ি যাচ্ছে। সে শুধুই হা করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কারও কাছে সামান্য ভাগ চাইতেও তার লজ্জা করে। মাঝে মাঝে পল্টু যেচে এসে তাকে একমুঠো ঝালমুড়ি দিয়ে তার পরিবর্তে হোমটাস্ক করিয়ে নেয়।
একদিন নিলয় তার খুব ভালো বন্ধু অয়নকে তুলি রং দিয়ে ছবি আঁকতে দেখে শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল, "ভাই, আমায় তোর তুলি রংটা দিয়ে একটু ছবি আঁকতে দিবি? আমার খুব ইচ্ছে পেন্সিলে আঁকা সাদা-কালো ছবির ওপর তুলির টান দেওয়ার। একটু প্র্যাক্টিসও করতে পারতাম।"
অয়ন কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা করল। তারপর বলল, "ঠিক আছে। দিতে পারি। তবে তুই তো খুব ভালো আঁকিস। আমার পরিবেশ পরিচয়ের প্র্যাক্টিক্যাল খাতায় তোকে ছবি এঁকে দিতে হবে। বল পারবি কিনা? তাহলে তোকে তুলি রং দেব।"
নিলয় রাজি হয়ে গেল। তার কত বন্ধুই তো তাকে ব্যবহার করেছে। আর মানুষ তো মানুষের জন্যেই। তাছাড়া অয়নের প্র্যাক্টিক্যাল খাতায় ছবি এঁকে দেওয়ার বিনিময় তো তাকে সে তুলি রং দিচ্ছে। তাই বন্ধুর এই প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল।
"তবে বেশি রং খরচ করিস না। কালকেই স্যারের ক্লাস। বাড়িতে এসে যদি দেখেন আমার রং ফুরিয়ে গেছে, তাহলে মা আমায় ভীষণ বকাবকি করবে।"
"ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না। আমি বেশি রং খরচ করব না।"
সেই প্রথমবার নিলয় সাদা-কালো ছবিতে তুলির টান দিল। আর সেই জলরঙের ছোঁয়ায় ছবিটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। তার ভাগ্যে সেই একবারই বন্ধুর তুলি রং লেখা ছিল। সেটা যেন স্বপ্নের মত। সেই ছবিটা সে সবসময় নিজের ব্যাগেই রাখত। এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি মাস। দুর্গাপুজো দোরগোড়ায় উপস্থিত। নিলয়দের পাড়ার মণ্ডপে পুজো উপলক্ষ্যে অঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। নিলয় মনে মনে ঠিক করল সে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। অয়নও প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। কিন্তু সে কি তাকে রংয়ের ভাগ দেবে? নিলয় তার কাছে গিয়ে কথাটা বলতেই সে বলল, "সরি ভাই। আমি তোকে আমার ভাগের রং দিতে পারব না। এমনিতেই সেদিন আমায় মায়ের কাছে বকা খেতে হয়েছিল তোকে রং দিয়েছিলাম বলে।"
নিলয় ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ল। তারপর একসময় হঠাৎ সে ভাবল একবার পরিতোষ জেঠুর সঙ্গে গিয়ে কথা বলবে যিনি এই প্রতিযোগিতার আয়োজক। সেইমত নিলয় নাম লেখানোর আগে তাঁকে বলল, "জেঠু, আমি আঁকার প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে চাই।"
"সে তো খুব ভালো কথা। তোমরাই তো আমাদের গ্রামের ভবিষ্যত। এই দেশের ভবিষ্যত।"
"তোমার কাছে একটা অনুরোধ করতে পারি কি জেঠু?"
"অবশ্যই। নিশ্চিন্তে করো।"
"আমার কাছে রং করার জন্য তুলি রং নেই জেঠু। আমার খুব ইচ্ছে তুলি রং দিয়ে ছবি আঁকব। আমার ব্যাগে তুলি রং করা একটা ছবি আছে। দেখবে জেঠু?"
"বলছ যখন, দেখাও।"
নিলয় ব্যাগের ভেতর থেকে ছবিটা বের করে পরিতোষবাবুকে দেখল। ছবিটা দেখে তিনি মুগ্ধ।
"বাঃ! তুমি তো খুব ভালো ছবি আঁকো। তুমি কোন চিন্তা করো না। নিশ্চিন্তে তোমার নামটা লিখিয়ে যাও। রংয়ের ব্যবস্থা আমি তোমায় করে দেব।"
নিলয় তখন আনন্দে আত্মহারা। প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেও সে বাড়িতে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানাল না।
দেখতে দেখতে অষ্টমীর স্বর্ণোজ্জ্বল দুপুর উপস্থিত। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা, নিলয় ও তার বন্ধু-বান্ধব সকলেই এসে জড়ো হল পুজো মণ্ডপের পাশে, ছাউনি ঘেরা জায়গায়। নির্দিষ্ট সময় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে একটা সময় তা শেষও হল। নিলয় বাইরে এসে হঠাৎই তার বাবা-মাকে দেখতে পেল। তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। সে মনে মনে ভাবল রংয়ের ব্যাপারটা তারা জানতে পারেনি তো? যদি জানতে পারে, এই পুজোটার দিনে তার কপালে নির্ঘাত শনি নাচবে। তার মা এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "আমায় একবারের জন্যেও জানালি না তুই অঙ্কন প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিস? আমায় জানালে কি আমি না করতাম?"
তার বাবা মাকে থামিয়ে বলল, "ছাড়ো না ওসব কথা। ছেলেটার আজ বড় খাটুনি গেছে। খুব খিদেও হয়ত পেয়ে গিয়েছে। চল, কিছু খেয়ে আসি।"
নিলয় বলল, "বাবা আমার খিদে নেই। কিছুক্ষণ পর প্রতিযোগিতার ফল ঘোষণা করা হবে। বিচার করার জন্য অয়নের আঁকার স্যার এসেছেন। জানিনা কি হবে? আমি এখানেই থাকব যতক্ষণ না পর্যন্ত ফলাফল ঘোষিত হয়।"
নিলয় বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কেমন যেন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। স্কুলের রেজাল্ট বেরোনোর থেকেও এই প্রতিযোগিতার ফলাফল প্রকাশ তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে।
একসময় পরিতোষবাবু মাইকে ঘোষণা করলেন সকল প্রতিযোগীকে পুজো মণ্ডপের সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্যে। নিলয়ের বুক ঢিপঢিপানি আরও বেড়ে গেল। সকলে মণ্ডপের সামনে উপস্থিত হলে তিনি ঘোষণা করলেন, "আজকের এই অঙ্কন প্রতিযোগিতায় সকলের আঁকাই খুব প্রশংসিত। তবে যার আঁকা সকলের আঁকাকে ছাপিয়ে উচ্চ প্রশংসিত, সেই হবে এই প্রতিযোগিতার প্রথম স্থানাধিকারী। তাছাড়া, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারীদের নামও পরপর ঘোষণা করা হবে। প্রথম স্থান অধিকার করেছে..."
নিলয়ের হার্টবিট দ্বিগুণ হওয়ার পাশাপাশি তার কানের পর্দা বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু এরই মধ্যে সে শুনতে পেল, "প্রথম স্থান অধিকার করেছে নিলয় সামন্ত।"
উপস্থিত সকলে করতালি দিয়ে উঠল। নিলয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে উঠল। তার বাবা-মা দুদিক থেকে তার পিঠ চাপড়ে দিল। নিলয় শুনতে পেল অয়ন তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।
পরিতোষবাবু ঘোষণা করলেন, "বিজয়ীরা তাদের পুরষ্কার এখানে এসে নিয়ে যাও।"
নিলয় পুরষ্কার গ্রহণ করে সেখান থেকে চলে আসতে যাবে এমন সময় পরিতোষবাবু তার বাবা-মাকে পেছন থেকে ডাক দিলেন। তারপর বললেন, "নিলয় খুব প্রতিভাবান ছেলে। এই বয়সেই ও কত নিখুঁত আঁকে। আমি জেনেছি ও কারও কাছে আঁকা শেখেনি। প্রতিযোগিতার বিচারক হরিপদবাবু ওর আঁকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি আপনাদের বলে রাখলাম ও একদিন খুব বড় মাপের চিত্রশিল্পী হবে। আমার অনুরোধ ওর প্রতিভার যথাযোগ্য মর্যাদা দেবেন। ওর মনে সবসময় অনুপ্রেরণা যোগাবেন। তাছাড়া, আমরাও ওর পাশে আছি। আমরাও ওর জন্য সাধ্যমত করে যাব।"
নিলয়ের বাবা বলল, "ঠিক বলেছেন আপনি। আমরা আমাদের একমাত্র ছেলের প্রতিভাটাকে কোনদিন বোঝার চেষ্টা করিনি। ও তুলি রং কেনার জন্য বায়না করলেও ওকে কিনে দিইনি। ভেবেছিলাম ওর সখ মেটালে ওর বায়না দিনদিন আরও বাড়বে। তবে আমি ভুল ভেবেছিলাম। আর নিলয় আমার ভুল ভাঙাল। আমরা ওর প্রতিভার মর্যাদা অবশ্যই দেব।"
নিলয়ের বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "চল। এখন একটু কিছু মুখে দিবি। অনেকক্ষণ না খেয়ে রয়েছিস।"
নিলয় দুর্গা মাকে প্রণাম করে বাবা-মায়ের হাত ধরে মেঠো পথের দিকে পা বাড়াল।
===================
নানীলেশ নন্দী।
ঠি মধ্যমগ্রাম।