সুপ্ত বাসনা
অশোক দাশ
সুশীল ভান্ডারী । পেশায় নরসুন্দর। অল্প বয়সে বাবাকে হারায়। মা এবং ছোট ছোট ভাইদের মানুষ করার দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। দারিদ্রকে কিভাবে হাসিমুখে বরণ করতে হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সুশীল। সাধ্যমত ভাইয়েদের লেখাপড়া শেখায় নিজে সংসারী হয়, ভাইয়েদের সংসারী করার দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠার সাথে।
সুখে -দুখে বেশ চলছিল। হঠাৎই নেমে এলো অশনি সংকেত। ঝড়ের পূর্বাভাস। সামান্য মনোমালিন্য। তা থেকেই শুরু হল সংসারের ভাঙ্গন। একে- একে ভাইয়েরা পৃথক হয়ে গেল। সুশীলের মনে নেই কোন আফসোষ।সে চায় সবাই সুখে থাক ।যে যার মত করে বাঁচুক। সে তার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে, তার সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবায়িত করার কাজে মনোনিবেশ করলো।
সুশীলদের বাড়ি হানিধাড়া গ্রামে। দামোদর নদের পশ্চিম পাড়ে। প্রতিবছর বন্যায় গ্রাম প্লাবিত হয়। মাটির ঘরবাড়ি পড়ে যায়। সুশীলের ঘরেও রেহাই পায়না। তার ধারণা বন্যার কবল থেকে বাঁচতে পারে একমাত্র পাকা ঘর। কিন্তু পাকা ঘর করার মতো সামর্থ্য এই মুহূর্তে সুশিলের নেই। তা বলে কি সুশীলের পাকা ঘর কোনদিন হবে না! সুশীল মনে- মনে প্রতিজ্ঞা করে পাকা ঘর সে করবেই।
সুশীলের কর্মক্ষেত্র দামোদর নদের পূর্ব দিকে ভোজান পশ্চিমপাড়ায়। মদের ধরে তার ছোট্ট একটি সেলুন। তার অমায়িক ব্যবহারে দোকানে খরিদ্দারের অভাব হয় না। এখন সুশীল যা উপার্জন করে, সংসার খরচ বাদ দিয়ে যতটুকু উদ্বৃত্ত থাকে, তা দিয়ে প্রতিদিন কাজ থেকে ফেরার পথে, বিল্ডার্সের দোকান থেকে একটি বা দুটি কোন- কোন দিন তিনটে পর্যন্ত ইঁট কিনে, ব্যাগে করে বাড়ি নিয়ে আসে। এইভাবে শীত- গ্রীষ্ম- বর্ষা কে উপেক্ষা করে ,প্রতিদিন ইঁট মজুদ করতে থাকে তার উঠোনে।
দীর্ঘ টানা পাঁচ বছর ধরে প্রায় হাজার পাঁচেক ইঁট মজুদ করে ফেলেছে। এবার তার ঘর গাঁথার পালা। আরো এক বছর ধরে তিল- তিল করে সঞ্চিত অর্থে গৃহ নির্মাণের কাজ শুরু করে। সুশীল স্বপ্ন পূরণের জন্য এক ধাপ অতিক্রম করেছে। মনে -মনে ভাবছে কঠিন পরিশ্রম আর ধৈর্যের কোন বিকল্প নেই । অতিরিক্ত পরিশ্রমে সুশীলের শরীরটা জীর্ণ হয়ে পড়েছে। তবুও তার বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য, তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে, এই অসক্ত শরীরেও একদিনের জন্য কাজ বন্ধ রাখেনি।
গাঁথুনির কাজ শেষ হয়েছে। সুশীলের মনে এক অনাবিল আনন্দ। সে পেরেছে। প্রতিটি ইঁটে লেগে আছে তার শ্রম- ঘামের মূল্য । কত লোক তাকে তাচ্ছিল্য করেছে। কত লোক তাকে পাগল বলেছে। কতজনে বিদ্রুপের হাসি এসে বলেছে এ অসম্ভব। সুশীল তোদের যোগ্য জবাব দিতে পেরেছে।
এবার ছাদ ঢালাই করতে হবে। আবার লড়াই। কঠিন পরিশ্রম। সুশীলের স্ত্রী তাকে নিষেধ করে।এত খাটনি তোমার শরীরের ক্ষতি করবে। সুশীল অনড়।সে ঘর বাঁধার কাজে কার ও সাথে আপোষ করবে না।
অবশেষে এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। সুশীলের স্বপ্ন পূরণ হল ।তার ঘর বাঁধা হল। কিন্তু সুশীল ক্রমশ রুগ্ন হয়ে পড়ল। অতিরিক্ত পরিশ্রমে তার শরীরে ক্ষয় রোগ বাসা বাঁধলো। ডাক্তারের শত চেষ্টা উপেক্ষা করে, তার বাসনা চরিতার্থ করে , একরাশ তৃপ্তির হাসি মুখে, চলে গেল না ফেরার দেশে।
====================
অশোক দাশ
ভোজান, রসপুর, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ ,ভারত।