কাশীনাথ হালদার
ভিখারি কথার অর্থ হলাে ভিক্ষাজীবী, ভিক্ষুক, প্রার্থী বা যাচক। আবার ভিখারি তাকে বলা যায়, যে দরিদ্র ও নিঃস্ব ব্যক্তি অন্যের কাছ থেকে পয়সা, চালডাল, কাপড়চোপড় ইত্যাদি দয়ার দান চায়। এই যে ভিখারি বা ভিক্ষাবৃত্তি এটি বিভিন্নযুগে সারা দেশে যেমন ছিল, তেমনি সারা বাংলা সহ পুরনাে দিনের কোলকাতায়ও তা ছিল। কোলকাতায় তখন বিভিন্ন ধরনের ভিখারির বিভিন্ন ধরনের ভিক্ষাবৃত্তিও ছিল।
○ ভিখারিদের রকমফের :
পুরনাে কোলকাতার রাস্তাঘাটে বিভিন্ন ধরনের ভিখারিদের দেখা পাওয়া যেত। ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল অন্ধ, পঙ্গু, বােবা, পক্ষাঘাতগ্রন্ত, কুষ্ঠ ও অগ্নিদদ্ধ ব্যক্তিরা।
এছাড়া অনাথ শিশু-ভিখারিরা এই পেশায় যুক্ত ছিল। আবার বিভিন্ন ভেকধারীদের সংখ্যাও কম ছিল না। এরা হলাে সাধু, বৈরাগী, ফকির, দরবেশ, সাঁই, আউল, নাগা, ন্যাড়া, সহজী, ব্রহ্মচারী, কনফটয়ােগী, দশনামীভাট, ভােপা, ভৈরব ও ভৈরবী, শীতলা পণ্ডিত ইত্যাদি। আর সেই সঙ্গে পাগলা-পাগলির দলতাে ছিলই।
○ ভিক্ষাবৃত্তির বিভিন্নতা :
তখনকার দিনে ভিক্ষাবৃত্তিরও রকমফের ছিল। কেউ সরাসরি কোনাে বাড়িতে ঢুকে ভিক্ষা চাইতাে। কেউ কেউ শ্রমের বিনিময়ে অর্থাৎ একতারা, বেহালা, সারেঙ্গী,
মন্দিরা, খােল ইত্যাদি বাজিয়ে ভিক্ষা করতাে। কেউ কেউ ভােজবাজি বা যাদু দেখিয়ে পয়সা চাইতাে। আবার কেউ বাঁদর নাচিয়ে রাস্তায়
লােক জড়াে কিংবা কোনাে বাড়ির মধ্যে বাঁদরের খেলা দেখিয়ে পয়সা রােজগার করতাে। আবার কেউ কেউ ফুটপাতের ওপর সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে পয়সা পেতাে। কেউ আবার হরবােলা অর্থাৎ নানা পশুপাখির ডাক শুনিয়ে ভিক্ষা করতাে কিংবা নানা ভাষার গান
গেয়ে বা আর্তনাদ করে ভিক্ষা করতাে।
আবার অদ্ভূত উপায়ে শারীরিক কসরত করেও ভিক্ষা করা হতাে। যেমন ফুটপাতে গর্ত করে সেই গর্তের মধ্যে নিজের মাথা
ঢুকিয়ে হাত দিয়ে মাটি চাপা দিতো এবং শরীরটাকে বেঁকিয়ে বসে ভিক্ষা করতাে। কেউ আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা একপায়ে দাঁড়িয়ে
ভিক্ষা চাইতাে।
কেউ কেউ আবার শারীরিক পীড়ন দেখিয়ে পয়সা ভিক্ষা করতাে। এদের বলা হতাে হাপু। ছেঁড়া ধুতি পরে খালি গায়ে খালি পায়ে কঞ্চি হাতে নিয়ে নিজের পিঠে জোরে জোরে মারতাে। পিঠে কঞ্চির দাগ দেখা যেতো। এরা এক হাতে কঞ্চি নিয়ে নিজের পিঠে
মারতাে আর অন্যহাতে পয়সা চাইতাে। আর মাঝে মাঝে 'পাগলা হাপু' ― 'পাগলা হাপু' বলে চিৎকার করে লােক জড়াে করতাে।
পুরনাে দিনের কোলকাতায় এক ভিখারি ঘােড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতাে। কেউ ডাকলে, ঘােড়ার খাবারের জন্য পয়সা চাইতাে।
যদিও এ ধরনের ভিখারির সংখ্যা বেশি ছিল না।
আবার উড়িষ্যার এক বৃদ্ধা রিক্সা চড়ে কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাে। গায়ে থাকতাে দশ-বারাে কেজি পিতল ও
তামার গয়না। এই বৃদ্ধার অদ্ভুত গহনা দেখে লােক জড়ো হতাে, সেই সুযােগে বৃদ্ধা পয়সা আদায় করতাে। এই বৃদ্ধা ভিখারি পরিচিত
ছিল গহনাবুড়ি নামে।
১৯৩০-৩২ সালে একজন বয়স্ক লােকের চটের লু্ঙ্গি, চটের ফতুয়া পরে বিদেশি জিনিষ কেনার বিরুদ্ধে স্বদেশী গান করতাে। ভিক্ষা না চাইলেও লােকে তার সামনে পয়সা রেখে যেতো। এই ব্যক্তিও 'চটবুড়ো' নামে পরিচিত ছিল।
○ ভিখারিদের আবেদনপত্র :
১৭৫৯ সালের ২০ আগষ্ট কোলকাতার ভিখারিরা ফোর্ট উইলিয়ামের কাউন্সিল ও প্রেসিডেন্টের
কাছে এক আবেদনপত্র জমা দেয়। আবেদনকারী ছিল জীবনদাস
বৈরাগী, ব্ৰহ্মচারী এবং অন্যান্য ভিখারিরা। আবেদনপত্রের মূল বিষয়বস্তু ছিল : প্রায় ২০০ জন ভিখারি প্রেসিডেন্ট ও কাউন্সিলর
আদেশবলে প্রতি দোকানদারের কাছ থেকে ৫টি করে কড়ি ভিক্ষা-পেতাে কিন্তু কোম্পানীর ঘাটগুলাে তৈরি হবার পর থেকে দোকানদাররা ভিক্ষা দিতে অস্বীকার করছে ― আবেদনকারীগণ নিরতিশয়, নম্রতার সঙ্গে অনুনয় করে জানাচ্ছে যে, কোম্পানী বাহাদুর এই বিষয়টি বিবেচনা করে যেন এক আদেশ জারি করেন, যাতে ভিখারিরা আগের মতাে ডিক্ষা পায়।
○ ভিখারিদের লাইসেন্স :
ভিখারিদের ভিক্ষার জন্য "লাইসেন্স" দেওয়া হয়েছিল, একথা শুনলে এখনকার অনেকেই অবাক হবেন। কিন্তু এটা সত্যি। সত্যিই ১৭৬৫ সালের ৩১ জুলাই ভিখারিদের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সেই সনদের প্রতিলিপিতে উল্লেখ ছিল :
"নিমাই চরণ দাস ব্রজবাসী ফকিরকে এই আদেশ করা হলাে যে, সে কোলকাতা শহর ও তার আশেপাশের গ্রামসমূহের প্রত্যেক দোকান থেকে দৈনিক এক কড়া করে কড়ি ডিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।"
○ অনশনে ডিখারি :
খাদ্যাভাব এবং অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য
বৃদ্ধির জন্য বাড়ির গিন্নিরা অনিচ্ছাসত্বেও ভিক্ষা দেওয়া বন্ধ করেছেন। এজন্য তাদের বাঁচার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।― এই মর্মে চাইবাসার ৩০জন ভিখারি (বৃদ্ধ, কুষ্ঠ ও অন্যান্য রােগে বিকলাঙ্গ) ১৯৬৫ সালের আগষ্ট মাসে সিংভূমের ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সামনে অনশনে বসে পড়েন।
○ প্রচারমাধ্যমে ভিখারি :
১৪ জুলাই ১৯৬৮, আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল। সংবাদটা এরকম :
সম্প্রতি ঢাকায় ভিখারিদের এক সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে যে, ভিক্ষাদানের সর্বোচ্চ পরিমাণ ১৫ পয়সা হতে হবে। তাছাড়া
আর একটি দাবি করা হয়েছিল, বাড়ির দরজায় গিয়ে ভিক্ষা চেয়ে ভিক্ষুকেরা ৪৫ সেকেণ্ডের বেশি অপেক্ষা করতে পারবে না।
ভিক্ষাবৃত্তি যুগে যুগে ও ভিক্ষাবৃত্তি বা ভিক্ষা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। প্রাচীন ভারতেও যে ভিক্ষাবৃত্তির প্রচলন ছিল, তার উল্লেখ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে। সেখানে বলা হচ্ছেঃ
"ভিক্ষুক ও কুহক (ঐন্দ্রজালিক) ও এই প্রকার অন্যান্য কার্যকারীদিগকে (রাজা) দেশের (লােকেরা) পীড়া উৎপাদন
দয়া করে বারণ করবেন।"
আবার শ্রীশ্ৰীচৈতন্যভাগবতেও ভিক্ষার উল্লেখ আছে :
"সর্বগণ সহ প্রভু করিলেন ভিক্ষা।
সন্ন্যাসীর ভিক্ষা-ধর্ম করয়েন শিক্ষা।
(অ/২/৫৫)
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ (লালাবাবু) বৃন্দাবনে মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহের জন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে বৈষ্ণব শাস্ত্রানুযায়ী 'মাধুকরী' ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।
যাই হােক, কয়েক দশক আগেও কোলকাতা ও অন্যান্য জেলায় যেকোনাে অনুষ্ঠানবাড়ীতে প্রচুর ভিখারি উপস্থিত থাকতাে। নিমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়ার শেষে শুরু হতো ভিখারিদের খাওয়ার ব্যবস্থা, যাকে তখন বলা হতাে 'কাঙালিভােজন'। এখন আর সে দৃশ্য দেখাই যায় না। তা সে কোলকাতা বা মফঃস্বল কিংবা গ্রাম, যেখানেই হােক না কেন !
●
-----------------------------------
কাশীনাথ হালদার
জেলেরহাট • পোঃ - দোলতলা ঘোলা
থানা - বারুইপুর • জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ • ভারত • ডাকসূচক - ৭৪৩৩৭৬।
☆☆☆