Click the image to explore all Offers

গল্প ।। মানুষই ।। অরবিন্দ পুরকাইত

     

 মানুষই

 

অরবিন্দ পুরকাইত

 

 

 

বই পড়া দেখাচ্ছে! দেখো আমি কত পণ্ডিত! মানুষের সঙ্গে ব্যবহারই শেখেনি এখনও, বই দেখাচ্ছে! কেউ একটা কথা বললে যে তার উত্তর দেওয়ার ভদ্রতাটা দেখাতে হয় সেটাই জানে না – পণ্ডিতি ফলাচ্ছে! ঠিক শুনল তো বিভূতি! দু-এক-পা এগিয়ে এমনই স্পষ্ট উচ্চারণে কম্পার্টমেন্টের সেই অংশের অন্য ট্রেনযাত্রীদেরকে শুনিয়ে তার উদ্দেশে ভিখারির বলা কথাগুলো! এবং তাকেই তো বলা, কেন-না আর অন্যান্যদের মতো তার দিকেও হাত বাড়িয়েছিল মহিলা, সে নির্বিকার তাকিয়েছিল পলকমাত্র।

  

বিভূতি লোকটা খুব হিসেব করে ভিক্ষে দেয়। অল্প বয়েসি দেখলে, দিব্যি গতর আছে দেখলে, লাইনে প্রথম-আসার হাঁউমাউ-হা-হুতাশ দেখলে সচরাচর এড়িয়ে যায়। ভিক্ষে তো আর সবাইকে দেওয়া যায় না। এত ভিখারি! তো ঝাড়াই-বাছাই খানিকটা এভাবেও হয়ে যায়। অফিস আসা-যাওয়ার সময় অন্তত ট্রেনে ভিখারির ঝক্কি প্রায় থাকেই না। যা ভিড়! বেলার দিকের ট্রেন বা ছুটির দিনের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ট্রেনে তাদের দেখা যায় একের পর এক। আর অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে যেমন পেশাগত হিসেব থাকে, ভিক্ষেতেও থাকে। মগরাহাটে যেমন সপ্তাহের ছ'দিন কোনো বিরক্ত করে না তারা দোকানদারদের, তাদের বাঁধা আছে জুম্মাবার। একের পর এক তারা এসে দাঁড়াবে দোকানের সামনে। নীরবে বিদায়।

সঙ্গে নিজের বউ-বাচ্চা থাকলে হিসেবের বাইরে গিয়েও মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে দিতেই হয় অবশ্য বিভূতির। আবার কাউকে কাউকে না দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনও করতে হয় তাদের সামনে। সবাই তো আরত্যিই অভাবে ভিক্ষে করতে বেরোয় না, স্বভাবও হয়ে যায় কারও কারও। তাছাড়া ভিক্ষাব্যাবসার কথাও অমূলক নয়। যাদের বিকলাঙ্গতা যত সহানুভূতি-আকর্ষক, ভিক্ষাব্যবসায়ীদের কাছে তাদের নাকি তত দাম!সেটাও বাচ্চাদের একটু-আধটু টের পাইয়ে রাখা ভাল। তাছাড়া নিজের প্রিয়জনের কঠিন অসুখে অসহায় পরিজনের ভিক্ষে, কারও কঠিন অসুখে সাহায্যদানের নিমিত্ত পরোপকারীর ভূমিকা নিয়ে অর্থগ্রহণ বা বাপ-মা মারা যাওয়ায় অন্ত্যেষ্টি ইত্যাদির দরুন অর্থভিক্ষা তো আছেই। এসবের মধ্যে কম দু-নম্বরি নাকি! একবার পাঁচ-ছ'জনের ধোপধুরস্ত যুবক-যুবতীর একটি দল ট্রেনে অর্থ সংগ্রহ করছিল হাসপাতালে-ভর্তি কঠিন-অবস্থায়-থাকা এক কিশোরের ছবে দেখিয়ে, অতি শীঘ্র যার অপারেশন করাতে হবে। এক সমাজসেবামূলক সংস্থার হয়ে তারা সহৃদয় মানুষদের কাছে আবেদন রাখছে। এভাবেই সংগৃহীত অর্থে একাধিক বার কিশোরটির হাসপাতালের বিল মিটিয়েছে তারা। দরকার মনে করলে ছেলেটির বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারে যে-কেউ, ফোন তারা ধরিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বিভূতি বলে বসল, আচ্ছা, আপানারা একাধিক বার হাসপাতালের বিল মিটিয়েছেন বলছেন, তার কোনো রসিদ আছে কাছে?

যে লোকদুটি তার একেবারে সামনে ছিল, বেশ বোঝা যায় বেশ অপ্রতিভ হয়ে পড়ল তারা। পরক্ষণেই সপ্রতিভতা দেখিয়ে একজন বলল, না, তা কাছে নেই।

 - রাখলে ভাল হত না কি? অসহায়দের জন্যে আপনাদের এমন উদ্যোগ লোকের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠত।

ব্যস্ততার মধ্যে অন্যজন পাশ থেকে বলল, ঠিক বলেছেন। এবার থেকে কাছে রাখব। শুনলে মনে হবে, এমন একটা সহজ ব্যাপার তাদের মাথায় আসেনি এতদিন! বিভূতিকে তারা যেন ধন্যবাদই জানাল এমন একটি পরামর্শের জন্য!

 

একবার বেশ অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল সে নিজেই। রাজভবনের ফুটপাথ দিয়ে হনহন করে অফিস যাচ্ছিল বিভূতি। দেরি হয়ে গেছে আজ বেরোতে, পরের ট্রেন ধরতে হয়েছে। ডানপাশে মধ্যবয়স্ক একজনের কাতর সাহায্যপ্রার্থনার আর্জি কানে এল। আর্জির ধরন বা অন্য কোনও কারণে আজ হাত ঢুকে গেল পকেটে। পাঁচটাকার কয়েন উঠলে ভাল হয়, অন্তত দু-টাকার কয়েন যেন হাতে উঠে আসে, এমনই ভাবছিল বিভূতি। লোকটির দিকে সামান্য একটু ঘুরতে গিয়েই হঠাৎ নজরে পড়ল উপবিষ্ট-তার গায়ে সাদা থান জড়ানো! মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পালটিয়ে নিজের পথের দিকে পা বাড়াল। লোকটি ততক্ষণে ধরে নিয়েছে, এ লোকটা কিছু দেবে। ফিরে এক পা ফেলতে-না-ফেলতেই লোকটি সরাসরি বলল, কী হল?

- না, এইরকম কাপড় পরা থাকলে আমি ভিক্ষা দিই না।

- কেন?

- বেশির ভাগ সময়েই এই পোশাকটা ভেক হয়। তাছাড়া বাবা-মায়ের কাজের জন্যে পথে ভিক্ষে করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর মাধ্যমেই কোনওপ্রকারে হয়ে যাওয়ার কথা। দরকার হলে কালীঘাট আছে। এতে যা ওঠে তাতে বাপ-মায়ের কাজ হয় বলে মনে হয় না আমার। আর তাছাড়া এই শ্রাদ্ধশান্তিতে আমি বিশ্বাসও করি না।

লোকটা বলল, আপনার বিশ্বাস করা-না-করায় কী আসে যায়! আপনি কি ভাবেন আপনার – আপনাদের মতো লোকেদের ভরসায় আমি বসে আছি?

হঠাৎ এরকম উত্তর বা প্রশ্নে বিভূতি একটু আমতা-আমতা হয়ে পড়ে, না, তা নয় জানি...

- ধুর মশাই, যান তো। পেটটা জানেন তো, পেটটা!

বিভূতি আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ায় তার কর্মক্ষেত্রের দিকে।

 

কোনও ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলে, ভিক্ষা না দেওয়ার হলে অনেকে কপালে হাত ঠেকায় বা সেই সঙ্গে বলে, মাপ করো। বিভূতি সেটাও করে না। মাত্র এড়িয়ে যায়। অথবা সরাসরি কখনও হালকা মাথা নাড়িয়ে নিজের অনিচ্ছা বা অপারগতা জ্ঞাপন করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরবে এড়িয়ে যায়, কোনোরকম প্রতিক্রিয়া তার শরীরেও চোখে পড়ে না। তো এবারের ঘটনা তেমনই, যখন কোনো প্রতিক্রিয়াই ধরা পড়েনি তার কথায় বা শরীরে।

রবিবার হলেও মাঝারিমতো ভিড় রয়েছে। বিভূতি একবার ভাবল পড়তে-থাকা কোলের ব্যাগের উপরের খোলা বইটা বন্ধ করে রাখে, পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পালটাল। এমনিতে ট্রেনে সামান্যতম সুযোগ থাকলে বইপড়া তার একটা অবশ্যকৃত্য। ...

 

না, ভুল শোনেনি সে। ওই তো তিলমাত্র বিরামের পরেই আরও জোর দিয়ে আবার উচ্চারণ করল এবং মুখ না তুললেও বিভুতি বুঝতে পারল যে বলছে তার দিকে মুখ করেই, পোশাকে সব ভদ্দরলোক, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারটা শেখেনি! একটা মানুষ কথা বললে যে তার উত্তরে কিছু বলতে হয় সেই শিক্ষাটাই নেই! দেখো আমি বই পড়ছি! পণ্ডিতি দেখাচ্ছে! বিদ্বান হয়েছে! ভেতরে ভোম-ভাম! ভিখারিরাও যে মানুষ সেই বোধবুদ্ধিটুকুই নেই! কথাকয়টি বলে আরও এগিয়ে গেল মহিলাটি। নিজের কাজে।

এতটা হজম করা বিভূতির পক্ষে কঠিন ছিল। ভাবল একবার কথা ধরে। পরক্ষণেই কী ভেবে নিজেকে নিরস্ত করে বইয়ের পাতায় চোখ রাখল।

কিন্তু আর মন বসল না বইয়ে।

তবু চোখ তুললও না বিভূতি বইয়ের পাতা থেকে।

=========================

   অরবিন্দ পুরকাইত

গ্রাম ও ডাক - গোকর্ণী,
থানা - মগরাহাট,
জেলা - দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.