গল্প ।। ক্ষণিকা ।। অরবিন্দ পুরকাইত
'না-না, আমি ই-ওয়ান ধরে নিয়েছি। কত? বড়জোর পঞ্চাশ মিনিট, ট্রেনের সময়ের অনেক আগেই হাওড়া পৌঁছে যাব — তুমি চিন্তা কোরো না।'
'আর সিট নেই দাদা, নেমে যান।'
— আমার জরুরি আছে দাদা।
'দাদা, এটা ই-ওয়ান — এখানে স্ট্যান্ডিং অ্যালাউড নেই। পরের বাসে যান।'
— জানি। বলছি তো আমার খুব জরুরি আছে।
'জরুরি সকলের আছে দাদা। এখানে স্ট্যান্ডিং যাওয়া যায় না জানেনই যখন, নেমে যাচ্ছেন না কেন?'
'কন্ডাক্টর, কী করছেন! — নামিয়ে দিন না ওনাকে।'
আমাদের এতকিছুতে আবশ্যক নাই। ইত্যবসরে বাসটি গতিপ্রাপ্ত হইল। যানটির অন্যতম বাতায়নপার্শ্বে আনুমানিক পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া এক। ধরিয়া লওয়া যাউক আমাদের সেই তাহার নামটি চন্দনা। তদর্থে সুন্দরী বলা যাইবে না, কিন্তু যথেষ্ট লাবণ্যময়ী। আজ তাহাতে বিশেষ মাত্রা যুক্ত হইয়াছে। সুবাসিত তাহার মুখমণ্ডল-সহ সর্ব অঙ্গ। তাহাকে দেখিয়া কবির ভাষায় অনায়াসে সম্বোধন করা যাইতে পারে, অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে! আজ তাহাদের কর্মস্থলে রাজধানী হইতে বিভাগীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী আসিতেছেন। সমবেত বরণের ব্যাপার রহিয়াছে। পুরা অনুষ্ঠানটির স্থির এবং চলমান আলোকচিত্র রক্ষিত হইবে। গতকাল একপ্রস্ত মহড়া হইয়া গিয়াছে। চন্দনার এ সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা যে খুব ভাল লাগে তাহা নহে, কিন্তু এড়ানো সম্ভব হইল না। তাহার উচ্চ আধিকারিক কমলাদি কহিলেন, সকলে এড়িয়ে গেলে হয় কী করে! তাহা যাহাই হউক, কোনো উপলক্ষ্যে একটু সাজিতে নেহাত মন্দ তো আর লাগে না! আজ আবার বরণকারিণীগণ সাদা-খোল লালপেড়ে। অফিসে আর একপ্রস্ত সুগন্ধী প্রয়োগ হইবে, বেলফুলের মালিকা জড়াইবে খোঁপাকে।
রঙিন কোমল বর্গাকার এক সুগন্ধী বস্ত্রখণ্ড সহযোগে অতি যত্ন সহকারে ফোনের দর্পণে সূক্ষ্ম অঙ্গুলিচালনে মৃদুভাবে মুখমণ্ডল মার্জনা করিতেছে চন্দনা। নারীর মুখমণ্ডল পরিমার্জনের সচরাচর বিশেষ এক রূপ ও রীতি পরিদৃষ্ট হয়। রুমালটি ঘর্ষণ অপেক্ষা স্পর্শনেরই কর্ম করিয়া থাকে অধিক। প্রসাধিত মুখমণ্ডলে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্পর্শদ্বারা ঘর্মাদি মঞ্ছন। অক্ষি নাসিকা অধরোষ্ঠ আদি স্থলে বিশেষ যত্ন। তর্জনী-অগ্রে রুমাল সংস্থাপিত করিয়া বিশেষ বিশেষ স্থলে শিল্পীসুলভ মুদ্রায় লঘু স্পর্শে পরিমার্জন। আমাদের নায়িকাটিও অতি যত্ন সহকারে তেমত মুখমণ্ডল মার্জনা করিতেছিল। কিছুতে যেন মনোমতো হইতে চাহে না! বিশেষত আজিকার দিনে।
দর্পণে একটি মুখ। উন্মুখ। এক যুবকের। বাম পার্শ্ববর্তী। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মসৃণ মুখ। বেশ একটু ভাল লাগিবার অনুভূতি হইল চন্দনার। বাতায়ন-পার্শ্ববর্তিনী হইলেও, বায়ু অপ্রতুল। প্রভাতে কিঞ্চিৎ বৃষ্টির পরে আষাঢ়ের জলদগম্ভীর নভোমণ্ডল, বেশ গুমোট ভাব। তাহা অগ্রিম অনুভব করিয়া ভাবিয়াছিল ট্যাক্সি লইবে, পরমুহূর্তেই কৌতুক করিয়া নিজেকে শুনাইল, তুমি যদি ট্যাক্সিতে যাও কে তোমারে দেখিবে! কেবল ড্রাইভারের আয়না আর ট্রাফিক সিগন্যালের শশব্যস্ত পথচারী! ব্যাগ হইতে গুটানো ছোট্ট বাহারি একটি পাখা বাহির করিয়া আপন অঙ্গে মধ্য মধ্য বায়ু সঞ্চালিত করিতে লাগিল। সাবধানে দু-একটি নিজস্বী লইল, তাহাতে যুবক না ঢুকিয়া পড়ে। নিজস্বী না লইয়া উপায় আছে! কখন আবদার আসিয়া পড়ে, কই, ছবি দিলি না যে! 'ছবি তুলিনি' কহিলে সে নায়ক শুনিবে নাকি! চন্দনার উক্তি সহাস্য উড়াইয়া দিয়া কহিবে, আজ ব্যাপক বিউটি পার্লার মারলি আর ছবি তুলিসনি বললে কাকেও বিশ্বাস করবে? ফটাফট পাঠা। এখানে কাক আসে কোথা হইতে! খালি উলটা-পালটা কথা! তাহার হইয়াছে এক জ্বালা! আলোকচিত্র না পাইলে বাবু চটিয়া লাল! অগত্যা...
কৌতূহলী হইয়া দর্পণ অভিমুখে আরও একবার তাকাইয়া দেখিল, যুবক আনমনা। অঙ্গে অঙ্গ সূক্ষ্ম স্পর্শিত হইয়া-থাকা যুবকের দিকে সরাসরি একবার তাকাইয়া দেখিবে কি না ভাবিয়া আবার সংবরণ করিল নিজেকে। কিন্তু ইচ্ছা থাকিলে অনেকসময় উপায় হয়। ইত্যবসরে বাস পরিচালক আসিয়া দাঁড়াইল তাহাদের সারিপার্শ্বে। টিকিট কাটিবার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিয়া কিয়ৎক্ষণ অন্তর পলকে বার-দুই তাকাইয়া লইল চন্দনা। যুবক তখনও আনমনা। আনমনা, না আনমনার ভান! দেখো, আমি দেখছি না! ওসব যেন কেউ বোঝে না! শার্টের পকেটে মোবাইল, অথচ আর পাঁচজনের মতো তাহাতে মগ্ন না; তাহা হইলে অঙ্গাঙ্গী অঙ্গনার দিকে দুই-একবার সরাসরি অবলোকনেই বা অস্বাভাবিকতা কী ছিল! এত ঘ্যাম কীসের বাপু! এইসব সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্য একসময় যুবকের মধ্যে এক উসখুস ভাব অনুভূত হইল। তদনন্তর সে উঠিবার উপক্রম করিল। উঠিল। রবীন্দ্রসদন নিকটবর্তী হইলে অবতরণ করিল। পুরা সময়টুকু সেদিকে তাকাইয়া রহিল চন্দনা।
অবতরণান্তে আঁখি ফিরাইল পার্শ্ববর্তী বাতায়নপথে। শূন্য আসনে কেহ আসিয়া বসিল বোধ হইল। গ্রাহ্য করিল না সে। যুবকের অবতরণকালে দ্বারপথে তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে বোধ হইতেছিল যেন চালকের বামদিক হইতে উঠিয়া কেহ আসিতেছিল। তাহার আঁখি আভাসে অনুভব করিল, দেখিল না। এই ব্যাপারটাই তাহার কেমন যেন ভাল বোধ হয় না! অল্পকালের যাত্রা হইলেও, পার্শ্ববর্তীর সহিত সান্নিধ্যজনিত কেমন এক ক্ষণকালিক সম্পর্ক স্থাপিত হইয়া থাকে, অনুভূত হয় খানিক ওম। হঠাৎ সে উঠিয়া যাইলে, সে স্থানে অন্য একজনের বসিয়া পড়া — কেমন বিদঘুটে ঠেকে যেন! কিন্তু করিবারই বা কী আছে!
একবার ভাবিল নিজস্বী কয়টি পাজিটিকে পাঠাইয়া দিবে, পুনরায় ভাবিল দাবি উঠিবার পূর্বে কভি নেহি। সুতরাং বাতায়নপথে তারামণ্ডল, ইন্দিরা, ভাষাশহীদ, সেতু, ময়দানই দেখিতে দেখিতে চলিতে হইল!
সহসা হুড়মুড় করিয়া কখন আকাশবাণী আসিয়া পড়িল! ক্রোড়ের সুদৃশ্য ক্ষুদ্র পেটিকাটির ক্ষীণ ফিতা স্কন্ধে স্থাপিত করিয়া উঠিতে তৎপর হইল চন্দনা। বাম চরণ অগ্রসর করিতে গিয়া চমকাইয়া উঠিল! এমন করিয়া কেহ চাহিয়া থাকিতে পারে কোনও নারীর দিকে! পারশ্ববর্তিনী যে নামিবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে সেদিকে তাহার ভ্রূক্ষেপই নাই! কুঞ্চিতকেশ, চাঁপদাড়ি, লম্বাগড়ন-মুখ সুদর্শন যুবককে মৃদুকণ্ঠে বলিতেই হইল, নাববো। শাহজাদা এমনভাবে তখনও তাকাইয়া রহিল মনে হইতে পারে, তাহা আবার হয় নাকি! নাকি, যেতে নাহি দিব! পরক্ষণেই একটু জোর দিয়া বলিতে হইল, নামব আমি। সহসা, সুপ্তোত্থিত কিংবা ভঙ্গ-ধ্যান সে শশব্যস্ত হইয়া উঠিল তাহাকে পথ করিয়া দিতে।
তাহাকে এবং তাহার পরবর্তী জনকে পার হইয়া দরজার সম্মুখে দাঁড়াইবার পর্বে মনে হইতে লাগিল চন্দনার যে দুইটি অক্ষি তাহাকে অনুসরণ করিতেছে। ইচ্ছা হইল নামিবার জন্য দণ্ডায়মান সম্মুখের একজন ও পশ্চাতের দুইজনের ফাঁক দিয়া কায়দা করিয়া একবার দেখিয়া লয়। ভাবিতে ভাবিতে আকাশবাণী আসিয়া গেল। ব্যস্তসমস্ত হইয়া নামিয়া গেল সে।
* * *
- অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক - গোকর্ণী,