রঞ্জনপল্লীর বাড়ির দক্ষিণমূখী বারান্দায় বসে আছে সুশান্ত কুমার ঘোষ। চেয়ার পেতে বসতে হয় না ওদের, বাড়ি তৈরির সময়ই সিমেন্ট দিয়ে পশ্চিম আর দক্ষিণের কোণ ঘেষে বেঞ্চের মত তৈরি করেছে, নান্দনিক টাইলস দিয়ে তাতে শোভা বর্ধন করা হয়েছে,
পা তুলে বসে তাকিয়ে আছে সামনের পুকুরটার দিকে, পুকুরটার আকৃতি অনেক বড়, অনেকে এটাকে দীঘি বলে ফেলে, সুশান্ত সংশোধন করে দেয় এটা দীঘি নয় পুকুরই,
দীঘি হলো নাগরপুরের উপেন্দ্র সরোবর । এগারটি বাঁধানো ঘাট আছে তাতে,। সমবয়সী বাবুরা মুখ টিপে হাসে আর বাড়িতে হলে ছোটছেলে সৌমিত একটু কড়াগলায় বলবে, শুরু হলো তোমার অতীতচারণ, এবার থামো তো, শুনতে শুনতে ঠোঁটের গোড়ায় বসত বেঁধেছে, গাল-গল্প।
মনটা খারাপ হয়ে যায় সুশান্তর। গালগল্প নয় এগুলো একেবারে হাতের তালুর মতো সত্য।
মা চলে যাবার পর থেকেই সুশান্ত ভেতরটা মরে গেছে, মায়ের চলে যাবার বয়স হয়েছিল একটু বেশিই হয়েছি, নব্বই পার করে তবেই বিদায় নিলো।
খুব অসুস্থ অবস্থায় গাঙ্গনাপুর গ্রাম থেকে ছোটছেলে উত্তম কল্যাণীর ফ্ল্যাট নিয়ে গিয়েছিল, কাছেই হাসপাতালের সুবিধা উপরতলায় প্রদ্বীপ আছে, পরিবার নিয়ে।
লোকজন কেউ না থাকেই পালা করে, আর গাঙ্গনাপুরের বিশাল বাড়িটায় তেমন কেউ থাকে না বলতে গেলে, কলেজের ছাত্রদের কাছে পুরো দোতলাটা ভাড়া দেয়া, গ্রাম সম্পর্কে এক মাসি রাতে এসে ঘুমায়, এই হলো মায়ের কাছে থাকার লোকজন, সুশান্ত সপ্তাহের তিনদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল অবধি থেকে রঞ্জুনপল্লীতে চলে আসে।
সারাজীবন মায়ের শরীর খুব শক্তপোক্ত ছিল, হঠাৎ করেই বয়সের উপসর্গ দেখা দেয় প্রকৃতির নিয়মেই। আজ কাশি কাল জ্বর, পরশু পেটের ব্যাথা বাত ব্যাথা তো ছিলই,।
হঠাৎ ধরা পড়লো লিভার ক্যানসার, একেবারে লাষ্ট স্টেজ।
বাড়াবাড়ি হতেই কল্যাণীতে নিয়ে যায় উত্তম।
শেষবার যখন মাকে দেখতে গিয়েছিল সেটা যে শেষবার হবে তখন মনে হয়নি, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছিল তবুও মনে হতো আজ দেখা হলো কালও দেখা হবে, পরদিন একটু সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হতো। আগের রাতে ঘুমাবার আগে উত্তমের কাছ থেকে সর্বশেষ মায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে তবেই সুশান্ত ঘুমাতে যেত।
সেদিন ছিল উত্তমের বড়মেয়ে সঞ্চারীর জন্মদিন। গত তিনমাস ওদের পাঁচভাই আর দুবোনের বাড়িতে এধরনের আয়োজনগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবাই মন খাবাপ করে চূড়ান্ত মূহুর্তের জন্য অপেক্ষা করছে।
সুশান্তই এই গুমোট আবহাওয়া থেকে বের হবার জন্য এবং মায়ের নিশ্চিত যাত্রা যেন সুস্থির হয় আনন্দময় হয়, ভেবেই প্রস্তাবটা দেয়, মনে মনে ভয় ছিল কেক কাটার আনন্দময় মূহুর্তেও ঘটে যেতে পারে মায়ের চলে যাবার চরম মূহুর্ত।
ওরা আনন্দ করছে, মাকে নিয়ে ছবিও তুললো, রোগাক্লিষ্ট মুখে একটু হাসির আভাস দেখা গেল। উত্তমের স্ত্রী মায়ের তোলা একটা নতুন শাড়ি পেছিয়ে দিয়েছিল শরীরে। সবাই পাশের ঘরে কেক কাটছে হাসছে ছবি তুলছে হুল্লোড় করছে, ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে বিরিয়ানি পৌছে দিয়ে গেছে।
সবাই পালা করে মায়ের কাছে আসছে বাইরে যাচ্ছে, ঠায় বসে আছে সুশান্ত। খাটের পাশে চেয়ার টেনে মায়ের হাত ধরে, যেন হাত ছেড়ে দিলেই মায়ের প্রাণপাখিটা উড়ে চলে যাবে ওদের ফাঁকি দিয়ে।
বাইরে সবাই ডিনারে বসে গেছে।
মা ওর হাতটা আরেকটা শীর্ণ হাত দিয়ে চেপে ধরে,গাঙ্গনাপুর আমার শোবার ঘরে সিন্দুকে একতাল মাটি শুকিয়ে রেখেছি, আমাদের ঠাকুর দালানের সামনের মাটি।
বলে থেমে যায়, এই কয়টি কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে, অপেক্ষা করে সুশান্ত আবার কখন বাকি কথাগুলো বলবে।
অনেক্ক্ষণ পর চোখের জলটুকু মুছে নেয়ে দুর্বল হাতে, সচকিত সুশান্ত গামছা দিয়ে মুছে দেয় পুরো মুখটা।
আমি এবার সেরে ওঠলে আমাকে নিয়ে যাবি তো, নিয়ে যাবি সিংজোরায়।
আবার থেমে যায়।
আমি আমাদের মাটি মিশিয়ে দেব আমাদের ভিটায়।
আবার থেমে যায়।
জন্মভূমির মাটির সাথে আমার দেশের মাটি, একদেশে জন্ম নিলাম আরেক দেশ আমাকে আশ্রয় দিলো ঠিকানা দিল, আমার দেশ হলো।
তবুও জন্মভূমির মায়ার বড় টানরে খোকা। নিয়ে যাবি তো আমাকে।
সুস্থ হলে নিয়ে যাব মা, আমি নিয়ে যাব তোমাকে।
শুধু একবার যেতে চাই, জন্মভূমি মাটির ঋণ শোধ করবরে খোকা, দুইদেশের মাটি মিশিয়ে দেব।
নিয়ে যাব মা। মায়ের নিস্প্রভ চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। সুশান্তর হাতটা আরো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে।
শেষ ট্রেন ধরে চাকদাহ যখন পৌঁছে তখন মধ্যরাতের সীমানা ছুঁই ছুঁই করছে ঘড়ির কাঁটা।
রাত তখনও পোহায়নি, সুশান্তর ফোন বেজে ওঠে, সারাদিন পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীরে ঘুমও জেঁকে বসেছে। প্রথমবার ফোনটা বেজে বেজে থেমে যায়, দ্বিতীয়বারেই জেগে হ্যালো বলতেই উত্তম জানায় মায়ের প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
এখ্খুনি চলে আসুক বাকিরা পরে এলেও চলবে।
যা বোঝার বুঝে যায় সুশান্ত।
মা চলে যায় সুশান্তকে ফাঁকি দিয়েই। অশৌচ, শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলেও গুরুদশার জন্য একটা বছর কোথায়ও যায়নি সুশান্ত।
মায়ের সিন্দুক থেকে মাটির তালটা এনে পূজোর ঘরে রেখেছে। আরেকতাল মাটিও আছে, ঠাম্মাব আসার সময় জন্মভিটার মাটি নিয়ে এসে ঠাকুরঘরে রেখেদিয়ে ছিল ।
দুতাল মাটি পাশাপাশি রেখে দেয় সুশান্ত ওর রঞ্জনপল্লীর শোবার ঘরে।
আজ বাবাকে খুব মনে পড়ছে, বাবার বড়ছেলে সুশান্ত, বাবার সংগ্রাম বেদনা সাফল্য সব সুশান্ত খুব কাছ থেকে দেখা, সিংজোড়ার দক্ষিণ পাড়ায় ঘোষদের বসতি। এখানকার বাসিন্দা মনোতোষ ঘোষের পুত্র রমেশ ঘোষ, মনোতোষ বাবু ছিলেন গয়হাটা বাজারের নামকরা মিষ্টি ব্যবসায়ী, রমেশ ঘোষের সাথে বন্ধুত্ব হলো মধ্যপাড়ার নুরুর সাথে, গয়হাটা উদয়তারা স্কুল পেরিয়ে করটিয়া সাদত কলেজেও হরিহর আত্মা দুজন, একই রকমের পোশাক দুজনের গায়ে, কট্টর ধার্মিক দু পরিবারে অন্দরমহলেও তাদের বন্ধুত্ব সমাদৃত হয় ভালবাসায় । দুপরিবারে যোগাযোগ আগেও ছিল, নূর আর রমেশ শুধু বিষয়টা ঘনিভূত করে।
পূজো আর ঈদ মিলে যায় আদর আপ্যায়নে।
রমেশের বিয়েতে নূরুর ব্যাস্ততা আর আনন্দের যেন শেষ নেই।
রমেশের ঘরে তিনটে সন্তান হেঁটে বসে কোলে দাপিয়ে বেড়ায় নূরুর বিয়ের খবর না থাকলেও প্রেমের খবর সবটুকু রমেশের পাঞ্জাবির পকেটে।
হঠাৎ হারিয়ে যায় নূরুর পরান পাখি, বিরহকাতর নূরুর জন্য রমেশের বুকটা যেন ফেটে যায়, নতুন বৌদিও কম কাতর নয় নূরুর জন্য।
নূরুর বাবা নূরুর বিয়ে দিয়ে সংসারে ফেরায় বিবাগী নূরুকে, নূরুর স্ত্রী আর নতুন বৌদি যেন নূরু আর রমেশের প্রতিচ্ছবি, ওদের বন্ধুত্বে অসম্পূর্ণরুপে পূর্ণ করে।
নূরুর ব্যাবসা শিবালয়ে তবুও গয়হাটায় রমেশের মিষ্টির দোকানের আড্ডার টানে চলে আসে প্রায়ই, চুটিয়ে আড্ডায় কত দিনরাত মৌতত সৌরভে কেটে যায়। রমেশও শিবালয় যায় বন্ধুর সংসার ব্যবসা দেখতে, নূরুর বৌ কতরকমের রান্না করে খাওয়ায়,। পদ্মার জলেবাতাসে মিশে উড়তে থাকে, ভালবাসার গল্প।
হঠাৎ দাঙ্গা শুরু হয়, ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, নূরু গ্রামে চলে আসে, দুবন্ধু মিলে দাঙ্গা সামাল দেবার চেষ্টা করে, ওদের সাথে থাকে আরো তরুণ।
এরমাঝেই একরাতে খুন হয় মনোতাষ বাবু, লুট হয় বাড়ি দোকান, আরো কয়েকটি পরিবারও আক্রান্ত হয়।
রমেশ আর নূরু ওদের দল নিয়ে দুগ্রাম দূরে পাহারায় ছিল, অথচ নিজের গ্রামই অরক্ষিত হয়ে গেল।
রমেশের মায়ের মন ভেঙে গেল। বউ ছেলেমেয়ে ভয় কুঁকড় থাকে সারাদিন, রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গুমরে কাঁদতে থাকে ভয়ে। চারপাশের পরিস্থিতি কখনও কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, ওর নিজের জীবন সংশয় দেখা দেয়।
একরাতে মামার সাথে দেশ ছাড়ে রমেশ, বুকের ভূমি থেকে কার অদৃশ্য হাত উপড়ে নেয় দেশ।
ভূমিহীন দেশহীন পরিচয়হীন নিস্ব উদ্বাস্তু হয়ে আসে এদেশে, শুধু জীবনটুকু সম্বল করে।
এদশে আশ্রয় পেলেও সন্মান পেতে শরীরের রক্তের সাথে বুকের রক্ত ঝরাতে হয়েছে অনেক।
সুশান্ত ছোটবেলায় মাঠের পাড়ের তালগাছ থেকে তাল কুড়িয়ে আনতো, মা তাল চিপে রস বের করে কখনও গুড় কখনও নুন দিয়ে জ্বাল দিয়ে দিলে ওরা মুড়ি দিয়ে মেখে খেত, ক্ষুধার পেটে কি স্বাদ ছিল সে খাবারে। পাশের বাড়ির হরেণ কাকা একটু ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠেই বলে, তোদের জন্য এবার আমাদের শেয়ালগুলো তাল খেতে পারলো না,
ক্ষেতের আইল থেকে কঁচু তুলে আনতো শাক তুলে আনতো , ঠাম্মা কাঁচা মরিচ নুন আর কুড়িয়ে আনা লেবুপাতা দিয়ে সেদ্ধ করে দিলে থালায় নিয়ে পেটভরে খেত ওরা।
রমেশ ঘোষ সুশান্তকে বলে এদের সাথে সন্মানের টিকে থাকতে হলে মেধা দিয়ে দাঁড়াতে হবে, সুশান্ত বুঝে গিয়েছিল কি করতে হবে, প্রতিবছর ক্লাসে ফাস্ট হতে লাগলো, ওর ধারাবাহিকতা বজায় রাখলো পরের ভাইবোনগুলো।
দীর্ঘদিন পর এসে বুঝতে পারলো ফলটা ওরা ঘরে তুলতে পেরেছে।
মেধার জোরে সরকারি চাকুরির বড় বড় পদ অর্জন করলো ওরা।
পাকিস্তান গেল বাংলাদেশ হলো, ওদের আসা হলো না জন্মভূমিতে। সংগ্রাম করতে করতেই তো কেটে গেল অনেকটা সময়।
নূরুকাকা এসেছিলেন মাঝে দুবার।
এদেশে বাবাও চলে গেলেন ওদেশে নূরু কাকা কাকিমাও চলে গেলেন।
সুশান্ত সংসারে সমাজে থিতু হয়ে বসে খুজতে থাকে হারিয়ে যাওয়া শৈশব কৈশোর ওর জন্মভূমি।
মা কাঁদে জন্মভূমির জন্য।
একবার যেতে চায় পিতৃভূমিতে।
একদিন কাকতালীয়ভাবে পেয়ে যায় একটা মোবাইল নম্বর। সেটার সূত্র ধরেই সুশান্তের প্রিয় জন্মভূমি ওর মায়ের জন্মভূমি।
মায়ের চলে যাবার ঠিক দুবছরের দিন ও পেরিয়ে আসে গেদে স্টেশন, ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ট্রেনে টাংগাইল।
নূরুকাকার মেয়ে স্বপ্বা ওকে নিয়ে যায়
সিংজোড়া।
সুশান্তের বুক জুড়ে উত্তর দক্ষিণের হাওয়া বইছে।
বারবার থামিয়ে দিচ্ছে ওর পা, এই মাটি থেকে, কে ওদের উপড়ে নিল শেকড়, কে কেড়ে নিল পরিচয়?
কেন নিল?
হায়রে দেশ ভাগ, ভাগ করে নিল সব শুষে নিল সব, শুধু টানটা রইলো দুর্নিবার।
সেই মাটির জন্য এতো মায়া কেন? মায়ার ঋণ কেন বারবার ডাকে ওকে।
স্বপ্না চলে গেছে ভেতর বাড়িতে, ও দাঁড়িয়ে আছে সড়ক থেকে যেখানে বাড়ির রাস্তা নেমে গেছে
ওদের সাত পুরুষের ভিটায় , তিন প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাস করছে অন্য ধর্মের মানুষ।
মানুষ শব্দটা মনে হতেই বুকটা খামচে ধরে।
মানুষ! মানুষ!
ওর বুকে জেগে ওঠে নজরুল,
" তুমি ব্রাহ্মণ নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও,
মুসলমান নও,
তুমি মানুষ - তুমি ধ্রুব সত "।
গেটের সামনের মাটি খুঁড়ে মিশিয়ে দেয় সুশান্ত পাসপোর্ট ভিসা ট্রেনে বয়ে আনা মাটি।
জন্মভূমি আর দেশের মাটি মিলেমিশে যায়,
প্রণামের ভঙ্গিতে সুশান্ত বসে পড়ে মাটিতে।
-----------------------
রোকেয়া ইসলাম
বাংলাদেশ।