অশোক দাশ
অভয় ঘোষাল। বয়স পঁয়ষট্টি। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি । কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ।চোখে চশমা । তাঁকে সকলে মাস্টার বলে ডাকে। এই এলাকার সকলের আপদে-বিপদে পাশে থাকে। সব মানুষই তাকে মান্য করে চলে।
সেদিন পড়ন্ত বিকেল, সূর্য অস্তরাগে ,দিগন্ত রাঙা। পাখিদের নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা । ঠিক এই গোধূলি মুহূর্তে, অভয় মাস্টার গাঁয়ের কালিতলার সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। হঠাৎই তার কানে আসে কান্নার কলরব। কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল অনেক মানুষের জটলা ।কৌতূহলী অভয় মাস্টার আগিয়ে যায় জটলার মাঝে। মাস্টারকে দেখতে পেয়েই কাঙালি আছড়ে পড়ে তার পায়ে, দাদা ঠাকুর আমার সব শেষ হয়ে গেল। অভয় মাস্টার কাঙালিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে কি হয়েছে পরিষ্কার করে খুলে বল?
আমার ছোট ছেলে তরুণ বেশ কিছুদিন ধরে অসুখে ভুগছিল, আমি মায়ের চরণামৃত খাইয়ে ছিলাম ।কিন্তু মা আমার সন্তানকে বুক থেকে কেড়ে নিল কেন বলতে পারো দাদা ঠাকুর? পাশ থেকে সনাতন বলে, মা তো আমাদের জাগ্রত দেবী, মা কি কোন সন্তানের মৃত্যু চান বলো মাস্টার! -কাঙালি খুড়ো, সনাতন ভাই এই নিষ্পান পাথরের মূর্তির কাছে মাথা ঠুকে কোন লাভ হবে না, ওঠো মুছে ফেলো তোমার চোখের জল। এক সন্তান গেছে আর কোন মায়ের সন্তান যাতে চরনামৃত খেয়ে, অকালে ঝরে না যায়, তার ব্যবস্থা করো।
কাঙালি বলে ওঠে, কি বলছ দাদা ঠাকুর? সনাতন বলে সে কি কথা মাস্টারবাবু? - কাঙালি খুড়োর ঝোঁক ছেলের হয়েছিল জটিল ব্যাধি, যে ব্যাধি ডাক্তারের চিকিৎসা ছাড়া বাঁচানো অসম্ভব ছিল।
কাঙালী ডাক্তারি না করে এই মন্দিরের মেজে ধোওয়া নোংরা জল অমৃত ভেবে, ওর ছেলেকে গরল পান করিয়ে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। কাঙালি বলে না না দাদা ঠাকুর অমন কথা বলো না, মা আমাদের জাগ্রত দেবী ।ওর কৃপায় তো কত লোকই রোগ যন্ত্রণা থেকে সেরে উঠেছে।
-- খোঁজ নিয়ে দেখো কাঙালি খুড়ো, তারা কোন ডাক্তারি চিকিৎসা করেছিল কিনা! তারা কি শুধুই মায়ের চরণামৃত খাইয়ে ছিল তোমার মতো! তোমার মতো তারা অন্ধবিশ্বাসে মায়ের পায়ে নিজেদের সঁপে দেয় না। হঠাৎ করিম বলে ওঠে কাঙালীর ছেলের জন্য আমিও দরগা তলায় সিন্নি মানত করেছিলাম। কাঙালী বলে আমিও তো মায়ের কাছে জোড়া পাঁঠা মানত করলাম করিম ভাই।
-- মাস্টার বলতে থাকে কথা কি যেন করিম ভাই ,আমরা আমাদের কিছু হলে একসঙ্গে দুটো কাজই করে যাই ।ডাক্তার দেখাই, ওষুধ খাওয়াই আবার মায়ের চরণামৃত ও খাওয়াই। ভালো হয়ে গেলে ডাক্তারের চিকিৎসার কথা ভুলে গিয়ে, দেবতার জয় গান গাই, জোড়া পাঁঠা দিয়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে পূজো দিই। কাঙালি, সনাতন, করিম একসাথে বলে ওঠে মাস্টারবাবু!
-- হ্যাঁ করিম ভাই, সনাতন ভাই, কাঙালি খুড়ো এভাবেই অন্ধবিশ্বাসে চলছে আমাদের এই সমাজ। আচ্ছা বলতো তোমরা, ঠাকুর- দেবতা ওঝা-বদ্যি, যদি সব রোগ নিরাময় করে দিতে পারতো ,তাহলে এত বড়- বড় হাসপাতাল, এত- এত ওষুধের দোকান ,এতসব ডাক্তার তৈরি করার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ, জটিল রোগের ওষুধ আবিষ্কার করার জন্য বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার কোন দরকার ছিল কি? কাঙালি বলে ওঠে কিন্তু---
-- কোন কিন্তু নয় কাঙ্গালি খুড়ো, রোগ হলে ডাক্তার দেখাতে হবে। চিকিৎসা করাতে হবে। ওষুধ খাওয়াতে হবে ।তবেই রোগী সুস্থ হবে। আজ বিজ্ঞানের জয়যাত্রায়, বিজ্ঞান অজানা অন্বেষণে চাঁদে- মঙ্গলে যন্ত্রযান পাঠাচ্ছে। বিজ্ঞান আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিচ্ছে। সবাই মন্ত্র মুগ্ধের মতো মাস্টারের কথা শুনতে থাকে, তারই মধ্যে গুঞ্জন ওঠে এসবই আল্লাহ ভগবানের দোয়া।
-- না করিম ভাই, আল্লাহ ভগবান নয়, এসব মানুষের নিরলস সাধনার ফল ।আচ্ছা তোমরা বলতো ? এই যে মাঠ ভরা সোনালী ধান, বাগানে হরেক বাহার ফুল ফল কারা ফলিয়েছে?
সমস্বরে বলে ওঠে আমরা---
মাস্টার বলতে থাকে, এই রাস্তাঘাট কলকারখানা স্কুল হসপিটাল বড় বড় মন্দির- মসজিদ- গির্জা বড় বড় দালানকোঠা ইমারত কারা বানিয়েছে?
সকলে বলে ওঠে আমরা, আমরাই বানিয়েছি।
-- তাহলে তোমরা আমার সাথে একমত যে মানুষই সব পারে ।মানুষের রক্ত ঘামে তৈরি সোনালী ফসল, মানুষের ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্র , আকাশচুম্বী অট্টালিকা, রাস্তাঘাট, প্রকৃতির বুকে অফুরন্ত সাজানো বাগান, সব মানুষের শ্রমে- ঘামে- রক্তে তৈরি।
কাঙালি বলে ,তাহলে কি ভগবান নেই?
করিম কহে, আল্লাহকে কি করে অস্বীকার করি মাস্টার বাবু?
মাস্টার বলতে থাকে, আল্লাহ ভগবানকে আমি অস্বীকার করতে বলছি না, আল্লাহ ভগবান থাক যে যার মনের মধ্যে। ধর্ম- বিশ্বাস থাক যে যার অন্তরে। তা নিয়ে বাড়াবাড়ি যেন না হয়। বিশ্বাস থাকা ভালো, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস নয়।
তোরা সকলে মিলে কাঙালীর সন্তানের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার ব্যবস্থা কর।
কিছু সময় পর জ্বলে উঠলো চিতার আগুন। মাস্টার মনে মনে ভাবতে থাকে এই লেলিহান অগ্নিশিখায় পুড়ে যাক্ অন্ধ কুসংস্কারের মায়াজাল। মোহগ্রস্ত মানুষ খুঁজে পাক্ সঠিক পথের দিশা। মাস্টার মনে মনে গেয়ে ওঠে- 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে / এ জীবন পূর্ণ করো দহন দানে'/
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে--------- ।
==================
অশোক দাশ
ভোজান, রসপুর ,হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ ,ভারত
মোবাইল নম্বর-৮৩৪৮৭২৫৩৩৩