বহুকাল আগের কথা।ঘটনাস্থল গাঁয়ের এক গৃহস্থ বাড়ি।গৃহস্থের রান্না ঘরের পিছনে মাটির দেয়ালের গায়ে বাতিল একটা হাঁস মুরগির খোঁয়াড়।আধভাঙা স্যাঁতস্যেঁতে।তার মধ্যে বাস করত একটা বেড়াল।খোঁয়াড়ের অদূরে মাটির পাঁচিল।পাঁচিল লাগোয়া একটা বড়সড় পেয়ারা গাছ।বেশ পুরোনো।তার গোড়ায় পাঁচিল ঘেঁষে গর্ত খুঁড়ে বাস করত একটা ধুমসো ইঁদুর।প্রতি সকালে বেড়াল আর ইঁদুর বের হত খাবারের সন্ধানে।একটু দূর থেকে তাদের দেখা হত।প্রথম প্রথম ইঁদুর বেড়ালকে দেখে বেশ ভয় পেত।গর্তমুখে শরীরের অর্ধেকটা ঢুকিয়ে তাকিয়ে থাকত বেড়ালটার দিকে।ভাবটা এমন---যদি আক্রমণ করতে আসে সুড়ুৎ করে গর্তে সেঁধিয়ে যাবে।বেড়াল ইঁদুরকে এ ভাবে দেখে গেল বেশ কিছু দিন।ভাবল-- গৃহস্থ বাড়ির সবাই তাকে দেখলেই তাড়া করে।বাগে পেলে মারেও।তখন জীবন বাঁচাতে যে দিকে চোখ যায় পালাতে হয়।রাতে চুপিচুপি বাসায় ফেরা।একেবারেই নিঃসঙ্গ সে।পাশে ইঁদুরটা আছে।থাকুকনা।সে তো আর তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কোনো দিন।গায়ের জোরে সে পারবে না।সে সাহসও তার নেই।উল্টে ভয় পায় তাকে।এমন একাকি জীবনে যদি তাকে প্রতিবেশি মেনে নিই ক্ষতি তো নেই।আর যদি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারি কোনো বিপদে তার সাহায্য হয়তো পেতেও পারি।নিদেন পক্ষে দুটো মনের কথা বলার এক জনকে তো পাওয়া যায়।ইঁদুরের ভয় ভাঙিয়ে তার সঙ্গে প্রতিবেশির সম্পর্ক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় বেড়াল।
ইঁদুর বেশ কিছু দিন বেড়ালকে দূর থেকে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে।বুঝে যায় বেড়াল তাকে আক্রমণ করবে না হয়তো।দূর থেকে তার তাকানোতে তেমন আক্রমনাত্মক কিছু দেখা যায় না।ধীরে ধীরে তার বেড়াল- ভীতি কমতে থাকে।এক সভয় তা প্রায় দূর হয়ে যায়।এখন সে আর বেড়ালকে দেখে গর্তমুখে দৌড়োয় না।যাওয়ার পথেই দাঁড়িয়ে থাকে।বেড়াল কুতকুতে চোখে তাকে দেখে চলে যায় নিজের গন্তব্যে।সময় কেটে যেতে থাকে।এক সময় ইঁদুরের বেড়াল-ভীতি পুরোপুরি কেটে যায়।সে এখন বেড়ালের পাশ দিয়েই সহজে চলে যেতে পারে তার গন্তব্যে।
এক সকালে ইঁদুর বেড়ালের মুখোমুখি হতেই বেড়াল তাকে বলে--ভয় পেয়ো না ভাই।গৃহস্থের এই ভিটেয় তুমিও যেমন একা আমিও তেমনই।গৃহস্থ আমাদের দুজনের ই শত্রু।বাগে পেলে মেরেই ফেলবে হয়তো।এ ভাবে একা একা না থেকে আমরা দুজন বন্ধু হতেই পারি।তাতে আমাদের জোর তো কিছুটা বাড়বেই।বাড়তি সুবিধে--পরস্পরের বিপদে আমরা একে অন্যকে সাহায্য করতে পারব।তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।চাইলে বন্ধু হতে পার।
ইঁদুর ভাবল--বেড়াল কথাগুলো মন্দ বলেনি।ভয় নিয়ে কত দিন আর বাস করা যায়!যদি বেড়াল তার বন্ধু হয়ে যায় তাহলে সে কিছুটা তো নিরাপদ হবেই।বিপদে পড়লে তার সাহায্য ও পাওয়া যেতে পারে।এমন ভাবনা থেকে ইঁদুর বলে--ভালোই বলেছ ভাই বেড়াল।আমারও খুব ইচ্ছে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার।প্রস্তাবটা যখন দিলেই ফেরানোর কোনো প্রশ্নই নেই।আমারও একা একা আর ভালো লাগছে না।
এভাবে বেড়ালের সঙ্গে ইঁদুরের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।ক্রমে তা গভীর হতে থাকল।দুজনেই বিভিন্ন ভাবে একে অন্যকে সাহায্য করতে থাকল।কেউ যেদিন খাবার সন্ধান করতে না পারে অন্যজন তার খাবারের ভাগ দেয়।অবসরে মন খুলে সুখ দুঃখের কথা বলাবলি করে।এখন তাদের দিন বেশ ভালোই কাটতে লাগল।
দিন গড়িয়ে মাস।মাস গড়িয়ে বছর।বেড়াল ইঁদুরের বন্ধুত্বে কোনো দাগ লাগে না।দুজনেই একে অন্যের আরও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে।সকাল সন্ধ্যে পরস্পরের খোঁজ খবর নেয়।শরীরের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে।দিন বেশ ভালোই কাটতে থাকে তাদের।এক সকালে ইঁদুর খাবারের খোঁজে বের হওয়ার মুখে বেড়ালের প্রায়-অন্ধকার খোঁয়াড়ের কাছে যায়।বাইরে থেকে জোর গলায় বলে--কি হে বেড়াল-বন্ধু,তুমি কি আজ আর বের হবে না? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
খোঁয়াড়ের এক কোণ থেকে দুর্বল স্বরে বেড়াল বলে--না বন্ধু,আজ আর বের হতে পারব না।কাল রাতে আমার একটা ছানা হয়েছে।চোখ ফোটেনি এখনো।তা ছাড়া শরীরেও তেমন জুত পাচ্ছি না।যদি পার------।
---আর বলতে হবে না বন্ধু।তুমি থাকো বাসায়।আমি বের হচ্ছি।দেখি তোমার জন্যে কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কি না।অবশ্য আমার ক্ষমতা তো খুবই কম।তবু যদি সামান্য কিছু এনে দিতে পারি।উপোষ থাকার চেয়ে-------!
---তুমি যে বলেছ এটাই ঢের।যদি নাও পার কিছু জোটাতে তাতেও কোনো অসুবিধে নেই।একটা দিন কেটে যাবে কোনো মতে।
ইঁদুর বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে।এদিক সেদিক ঘুরে খুঁজে পায় একটা বার্লি খেত।বার্লিগাছ গুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে।ইঁদুর বোঝে গাছগুলোর গোড়ায় বার্লি-মূলের গোছা পুষ্ট হয়ে উঠেছে।বিলম্ব না করে ঢুকে পড়ে খেতে।খিদেটাও আজ বড় বেশিই লেগেছে।গতকাল যে দিকটায় গেছিল সে দিকে তেমন খাবারের সন্ধান করে উঠতে পারেনি সে।একটা বার্লি-ঝাড়ের গোড়ায় গর্ত করে ইঁদুর দেখা পায় এক গোছা বার্লি-মূলের।মনের আনন্দে বার্লি-মূল খেতে থাকে সে।মনে ভাবে--যে ক'দিন চাষি বার্লি তুলে না নিচ্ছে তার খাবারের আর কোনো অভাব নেই।যাওয়ার সময় একটা বার্লি-মূল গালে করে গর্তে নিয়ে রাখবে সে।এ ভাবে যে ক'দিন সুযোগ পায় পেট তো ভরাবে।ভবিষ্যতের জন্যে কিছু জমিয়েও রাখবে।হঠাৎ তার মনে পড়ে বেড়ালের কথা।তার নিজের পেট তো ভরল।বন্ধুর কোনো ব্যবস্থা তো হল না এখনো! বেলা বাড়ছে।লোক চলাচল বাড়বে এবার।বেশিক্ষণ বাইরে থাকা নিরাপদ হবে না আর।বির্লি-মূলের কথা কাল ভাবা যাবে।আজ বরং বন্ধুর জন্যে কিছু যোগাড়ের চেষ্টা করা উচিৎ।
খেত থেকে বেরিয়ে আসে ইঁদুর।এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি করে কিছুক্ষণ।কিন্তু বন্ধুর খাওয়ার মতো কিছুই যোগাড় করতে পারে না সে।এদিকে বেলা বেশ বেড়ে গেছে।আর বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।নিরাশ মনে বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে থাকে ইঁদুর গর্তের দিকে।গৃহস্থের রান্নাঘরের জানালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার নাকে আসে ভাজা মাছের গন্ধ।থমকে দাঁড়ায় সে।চারিদিক ভালো করে দেখে নেয়।কোথাও কেউ নেই।অনেক কসরতে জানালার ধাপে ওঠে ইঁদুর।দেখতে পায় উনুনের পাশে একটা পাত্রে ভাজা মাছ বেশ কিছুটা।সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ে সে জানালা গলে।একটা বেশ জুতসই টুকরো মুখে তোলে নেয়।দেরি না করে জানালা গলে বেরিয়ে আসে।আশঙ্কা থাকলেও কোনো বিপদ ঘটে না।মনটা খুশিতে ভরে ওঠে তার।বন্ধুকে দেওয়া কথা সে রাখতে পারছে।এর থেকে ভালো আর কিছুই নেই।খোঁয়াড়ের কাছে পৌঁছে বেড়ালকে ডেকে বলে--একটু বাইরে এসো বন্ধু।খাবার এনেছি তোমার জন্যে।হয়তো পেট ভরবে না তোমার।তবু কিছুটা তো------।
বেড়াল টলতে টলতে বাইরে এসে ইঁদুরের আনা ভাজা মাছের টুকরো দেখে।খিদেয় তার পেট জ্বলছে।বলে--যা এনেছ তাতেই আমার জীবন বাঁচবে বন্ধু।ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোটো করতে চাই না।তুমি না থাকলে-------!
---ওসব কথা পরে হবে বন্ধু।বেলা বেশ বেড়ে গেছে।আর বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।আমি চললাম গর্তে।তুমি ভেতরে যাও।সুস্থ হও।
দু'এক দিনেই বেড়াল সুস্থ হয়ে ওঠে।তার ছানাটার চোখও ফুটে গেছে এখন।কিন্তু তার বাইরে যাওয়া মানা।বেড়াল তাকে দুধ খাইয়ে খোঁয়াড়ে রেখে বেরিয়ে পড়ে খাবারের খোঁজে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফিরে আসে খোঁয়াড়ে।যাওয়া আসার পথে মাঝে মধ্যে দেখা হয় ইঁদুরের সঙ্গে।কুশল বিনিময় হয়।কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন।বেড়ালের ছানাটা এখন বেশ চটপটে হয়েছে।বাইরে বের হয় একটু আধটু।ছোটাছুটি করে।বিপদ দেখলে সেঁধিয়ে যায় খোঁয়াড়ের অন্ধকারে।এক দিন বেড়াল আবিষ্কার করে গত দু'দিন ইঁদুরের সাথে তার দেখা হচ্ছে না।কেমন যেন একটা বিপদের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বেড়ালের বুক।তবে কি ইঁদুর------!
গর্তমুখে গিয়ে বেড়াল ডাক দেয় ইঁদুরকে উদ্দেশ্য করে।ভেতর থেকে সাড়া দেয় ইঁদুর।বেড়ালের আতঙ্ক দূর হয়।জিজ্ঞেস করে--গত দু'দিন তুমি কি বাইরে বের হওনি বন্ধু? তোমার কি শরীর খারাপ? খাচ্ছ কি?
ইঁদুর বলে--শরীর ঠিক আছে বন্ধু।আমারও গত পরশু চারটে ছানা হয়েছে।তাই শরীর দুর্বল।খাওয়ার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।কয়েকটা বার্লি-মূল গর্তে জমিয়ে রেখেছিলাম।এখনো কয়েক দিন চলবে।আসলে জানতাম এমন দিন খুব তাড়াতাড়ি আসতে চলেছে।তাই----!
---ভালো করেছ বন্ধু।ছানা হয়েছে এ তো বেশ আনন্দের কথা।সবাই মিলে সুস্থ থাকো তোমরা।আমার সমস্যা কেটে গেছে।ছানাটা বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে।বাইরে বেরোতে পারছি।রোজ বেরুবার মুখে তোমার খোঁজ নিয়ে যাব।যদি কোনো সাহায্য লাগে দ্বিধা না করে বোলো আমাকে।আজ চলি।
ভালোয় মন্দয় কেটে যায় আরও বেশ কিছু দিন।বেড়ালের ছানাটা বেশ ছটফটে আর চালাক চতুর হয়ে উঠেছে এর মধ্যে।বাইরে তো বের হচ্ছেই সে।নিজেই কাছেপিঠে খাবার খুঁজে নেয় মাঝেমধ্যে।বেড়াল তার ছানার সক্ষমতায় বেশ খুশি হয়ে ওঠে মনে মনে।এদিকে ইঁদুরের ছানাগুলোরও চোখ ফুটে গেছে।সকালে মানুষজনের চলাচল শুরুর আগে তারা গর্তের বাইরে আসতে শুরু করেছে।গর্তের চারপাশে একটু দৌড়োদৌড়ি।তার পর আবার সেঁধিয়ে যায় গর্তে।ইঁদুরের বার্লি-মূল শেষ না হলেও এখন খাবারের সন্ধানে যাওয়া আসা শুরু করেছে সে।সামনেই বর্ষাকাল।কিছু খাবার সঞ্চয় করতেই হবে গর্তের মধ্যে।ছানাগুলো বড় হচ্ছে।খাবারের চাহিদা বাড়ছে তাদের।অতিবর্ষায় খাবারের খোঁজে বের হতে না পারলেও পেট তো ভরাতেই হবে।ইঁদুর বেড়ালের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়েছে আগেই।আসা যাওয়ার পথে দুজনই খেয়াল রাখবে তাদের পরস্পরের ছানাদের।ফলে দুজনের মনেই কিছুটা স্বস্তি।
বর্ষা নেমে গেছে চারিদিকে।মাঠেঘাটে জল জমতে শুরু করেছে।ইঁদুর তাই খাবারের খোঁজে বেরোচ্ছে কম।আকাশ পরিষ্কার থাকলে তবেই সে বের হয়।বর্ষার সঞ্চয় তার করাই আছে।অসুবিধে নেই।কিন্তু বেড়ালের সে সুযোগ নেই।তাকে প্রতিদিন বের হতে হয়।বহুদূর পর্যন্ত যেতে হয় কোনো কোনো দিন।তাতেও একদিন সে কোনো খাবার যোগাড় করতে পারে না।পেট ভরবে কি করে সে ভাবনায় অস্থির বেড়াল ফিরে আসতে থাকে বাসায় বাধ্য হয়েই।তার ছানাটা তখন খিদের তাড়নায় বাইরে ঘুরছিল খাবারের খোঁজে।মাকে দেখে খাবার পাওয়ার আশায় এগিয়ে আসতে থাকে বাসার দিকে।বেড়াল তখন রান্না ঘরের জানালার পাশ দিয়ে বাসামুখো।হঠাৎ-ই তার নাকে আসে ভাজা মাছের গন্ধ।দাঁড়িয়ে পড়ে সে।নিশানা করে বোঝে গন্ধটা রান্না ঘরের ভেতর থেকেই আসছে।মনস্থির করে সে।লাফিয়ে উঠে পড়ে জানালার ধাপে।রান্না ঘরের ভেতরে কোনো মানুষ নেই।ফোকর গলে ঢুকে পড়ে ভেতরে।উনুনের পাশে ছোটো ঝুড়ি ঢাকা ভাজা মাছের পাত্র।মাথা দিয়ে গোঁত্তা মেরে ঝুড়ি সরিয়ে দেয় বেড়াল।বড় একটা ভাজা মাছ মুখে তুলে নেয়।ঝুড়ি সরানোর খুট শব্দে গৃহকর্ত্রী রান্না ঘরে ঢোকে।বেড়াল লাফিয়ে জানালার ফোকর গলে বাইরে যাওয়ার আগে তার লেজে পড়ে ঝাঁটার বাড়ি।সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর চিৎকার।আঘাত তেমন গুরুতর নয়।বেড়াল মাছ নিয়ে সোজা খোঁয়াড় মুখো।তার ছানাটা তখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।পুরো ঘটনাটাই সে দেখেছে খুঁটিয়ে।আর দেরি না করে সে ও খোঁয়াড়ে ফিরে যায় কোনো বিপদ ঘটার আগেই।
গৃহকর্ত্রীর কাছে হব শুনে গৃহকর্তা রান্না ঘরের জানালায় পাতে একটা ফাঁদ।মাছ চুরি করতে এলে বেড়াল যাতে ফাঁদে পড়ে।পরদিন বেড়াল সকাল সকাল বেরিয়ে যায় খাবারের সন্ধানে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল।বেড়াল ছানা খিদেয় অস্থির।তার মায়ের ফেরার কোনো লক্ষণ নেই।খিদে সহ্য করতে না পেরে সে রান্না ঘরের জানালার কাছে আসে।অনেক চেষ্টায় জানালার বাইরের ধাপে ওঠে সে।ফোকর গলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেতেই আটকে পড়ে ফাঁদে।নিজেকে মুক্ত করার জন্যে ছটফট করতে থাকে বেড়াল ছানা।ফলে ফাঁদ আরও চেপে বসে তার শরীরে।গৃহবাসীরা তখন দিবানিদ্রায় মগ্ন।শরীরের মাঝ বরাবর চেপে বসা ফাঁদে বেড়াল ছানার দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়।সন্ধ্যে হতে তখন আর বেশি দেরি নেই।বেড়াল বাসায় ফেরার মুখে তার ছানার দশা দেখে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।ছানা তখন প্রায় অর্ধমৃত।গৃহবাসীদের জেগে উঠবার সময় ঘনিয়ে আসছে।বেড়াল ছোটে ইঁদুরের গর্তের কাছে।অস্থির গলায় ডাক দেয় বন্ধুকে।ইঁদুর বাইরে এসে সব শোনে।বেড়াল তাকে বলে--বন্ধু----বাঁচাও আমার ছানাকে।দেরি করলে সে মারাই পড়বে।ফাঁদ কেটে তাকে মুক্ত করতে একমাত্র তুমিই পার।এ বিপদ থেকে আমাকে------।
ইঁদুর বেড়ালের সঙ্গে হাজির হয় জানালার ধারে।জায়গাটা তার তো চেনা।কিছুদিন আগে সে ও তো জানালা গলে----।রান্না ঘরের ভেতর থেকে হঠাৎ চিৎকার---পড়েছে---মাছ চোর ফাঁদে পড়েছে।মাছ চুরি করার মজা টের পাওয়াচ্ছি।আজ তোকে যমের বাড়িতেই পাঠাব।
বিপদ বুঝে ইঁদুর এক দৌড়ে গর্তে।বেড়াল সে দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।অসহায়ের মতো ছানার মৃত্যু দেখা ছাড়া তার আর করার কিছুই নেই।পুরো রাগটা তার গিয়ে পড়ে ইঁদুরের উপর।সে চেষ্টা করলে ছানাটা হয়তো-----!ফাঁদ কাটতে কত সময়ই বা-----।একে কি বলে বন্ধুত্ব?বন্ধুর বিপদে পালিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের প্রতিদান!ছাড়বে না সে ইঁদুরকে।তার ছানার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে সে।
ছানার মৃত্যুতে বেড়াল হিংস্র হয়ে ওঠে মনে মনে।বাইরে প্রকাশ পেতে দেয় না কিছুই।এক দিকে ছানার শোক।অন্য দিকে প্রতিশোধের প্রবল তাড়না তাকে অস্থির করে তোলে ভেতর থেকে।কিন্তু তবু তাকে স্থির ভাবে অপেক্ষা করতে হয় সুযোগের।
এক মধ্যদুপুরে বেড়াল খোঁয়াড়ের আস্তানায় ফেরার পথে ইঁদুরের ছানাদের দেখতে পায়।গর্তমুখ থেকেএকটু দূরে তারা দৌড়োদৌড়ি করছে।খাবার খুঁজছে হয়তো।ইঁদুরকে কাছেপিঠে দেখতে পায় না বেড়াল।বেড়ালের ভেতরের প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে প্রবল বেগে।নিঃশব্দে গর্তমুখে এসে দাঁড়ায় সে।অপেক্ষা করতে থাকে।ইঁদুর ছানাগুলোর কোনোটা ছোটাছুটির ঝোঁকে গর্তমুখের কাছে এলেই বেড়াল সামনের একটা থাবায় মাটিতে চেপে ধরে তাকে।অন্য থাবার নখ দিয়ে চিরে ফেলে তার শরীর।ছটফটানি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চেপে রাখে মাটিতে।এ ভাবে একে একে চারটি ইঁদুর ছানাকেই সে সাবাড় করে।কিন্তু না খেয়ে পাশাপাশি শুইয়ে রাখে গর্তমুখের কাছে।অপেক্ষায় থাকে ইঁদুর ফেরার।দুপুর গড়িয়ে ইঁদুর গর্তে ফিরে আসতে গিয়ে একটু দূর থেকে বেড়ালকে দেখে।গর্তমুখের কাছেই বসে সে।বেড়ালও দেখে ইঁদুরকে।পাশে ফেলে রাখা ইঁদুরের একটা মৃত ছানা এক থাবায় টেনে নেয় সামনে।মুখে তুলে চিবোতে থাকে।এ দৃশ্য দেখে ইঁদুর চিঁহি--চিঁহি স্বরে বলতে চেষ্টা করে---এ কি করছ বন্ধু? আমার ছানাটা-----!
---সবগুলোকেই সাবাড় করেছি।তোকে দেখিয়ে খাব।তার পর তোকেও খাব।তবেই আমার জ্বালা জুড়োবে।তোর জন্যেই অকালে আমার ছানাকে হারিয়েছি।তার প্রতিশোধ সুদে আসলে-----!
ইঁদুরের দ্বিতীয় ছানাটাও উঠে আসে বেড়ালের মুখে।বেড়ালের হিংস্র লাল চোখের দিকে তাকিয়ে ইঁদুরের বোঝা হয়ে যায় সবটুকু।প্রাণ বাঁচাতে সে দৌড় দেয় উলটো দিকে।বেড়ালও তাকে ধাওয়া করে।রাস্তায় পৌঁছে একটা বড় মাপের ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দেয় ইঁদুর।বেড়াল বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে তাকে।শেষে এক সময় ফিরে যায় তার খোঁয়াড় মুখো।
সেই শুরু।আজও চলছে তার রেশ।ইঁদুর দেখলেই বেড়াল ধাওয়া করে তাকে ধরতে।সফল হলে মেরে খেয়ে ফেলে তাকে।
-------------------------------
নিরঞ্জন মণ্ডল
গ্রাম--জগদীশপুর পালপাড়া
ডাক+থানা--রাজারহাট
কোলকাতা--700135
ফোন--9775564662