অণুগল্প ।। পাকুড়তলার মায়া ।। চন্দন মিত্র
পাকুড়তলার মায়া
চন্দন মিত্র
বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাসে মিলনঘাট যেন ভারতবর্ষের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ। বন্দর এলাকার বৈশিষ্ট্যই এমন। ছুটির দিন আর শরীরখারাপের দিনগুলি বাদ দিলে প্রায় প্রতিদিনই আমাকে ভ্যাসেল পেরিয়ে মিলনঘাটে পা রাখতে হয়। তারপর বাসে আরও একঘণ্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাই অফিসে। বাসজার্নিটা বেশ মজায় কাটে। নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের কথাবার্তা ও পোশাকপরিচ্ছদের বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে হুশ করে গন্তব্য চলে আসে। এই ঘণ্টা খানেকের জার্নিতে বাসের জানালা থেকে চোখে পড়ে একটি কালিমন্দির, একটি প্রাচীন মসজিদ, একটি গুরুদুয়ারা ও একটি গির্জা। ড্রাইভারদের মধ্যে হিন্দু ছাড়াও আছেন মুসলমান, শিখ ও খ্রিস্টান ধর্মের লোক। যেদিন হিন্দু ড্রাইভারের গাড়িতে চাপি, সেদিন দেখি গাড়ি কালিমন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রাইভার মন্দিরের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে একটি কয়েন ছুড়ে দেন প্রণামীর থালার উদ্দেশ্যে। মুসলমান ড্রাইভার থাকলে ইংরেজ আমলের যে পাথুরে মসজিদটি আছে সেখানে বাস থামিয়ে মসজিদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বলেন। শিখ ড্রাইভার থাকলে তিনি থেমে যান গুরুদুয়ারার সামনে। গুরুদুয়ারার দিকে তাকিয়ে তিনি 'ওয়াহে গুরু ...' বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। আর যেদিন খ্রিস্টান ড্রাইভার থাকেন সেদিন গাড়ি থামে গির্জার সামনে। গির্জার দিকে তাকিয়ে তিনি বুকে ক্রস এঁকে নেন।
আমার মতো নিত্যযাত্রীরা বিষয়টা ভালোমতো জানেন। ড্রাইভাররা নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মন্দির, মসজিদ, গুরুদুয়ারা বা গির্জার কাছে বাস থামিয়ে প্রার্থনা করলেও অন্যান্য ধর্মের পবিত্রস্থানগুলিকে অবলীলায় এড়িয়ে চলেন, তাতে তাঁদের স্টিয়ারিং হেলে যায় না। সেগুলির মূল্য তাঁদের কাছে কানাকড়ি। স্বধর্মপ্রাণ এইসব ড্রাইভারদের জন্য ধর্মতৃষাতুর যাত্রীদেরও ধর্মতৃষ্ণা মুফতে মিটে যায়। হ্যাঁ তারাও ড্রাইভারদের মতোই স্বধর্মপ্রাণ। নিজেদের ধর্মস্থানে বাস থামলে তাঁরা ভক্তি গদগদ হয়ে ওঠেন। অন্যান্য ধর্মস্থানগুলি যেন হেলাফেলার জায়গা। চোখে পড়লে মুখ ঘুরিয়ে নেন অন্যদিকে। আমার মতো ধর্মকে বালখিল্য মনে করার যাত্রী যে দু-চারজন থাকে না, তা নয়। তাঁরাও আমার মতো বিশ্বাসের বৈচিত্র্য দেখেন আর মজা নেন।
ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ড্রাইভার স্টপেজ ছাড়াও একটা বিশেষ জায়গায় অন্তত মিনিট পাঁচেক দাঁড়ান। আমার চোখে এখনও পর্যন্ত এমন ড্রাইভার পড়েননি যিনি না-থেমে অবলীলায় সেই স্থানমাহাত্ম্য পেরিয়ে যেতে পেরেছেন। যদিও সেখানে দাঁড়ালে পুণ্য অর্জনের ঝোলাটা ভরে ওঠে না বা পরকালে সমৃদ্ধির লোভনীয় আশ্বাস মেলে না। রাস্তার ধারে এক প্রাচীন পাকুড় গাছের তলায় সুন্দরীর প্রশস্ত চা-পান-বিড়ি দোকান। ড্রাইভারদের কেউ খান চা, কেউ খান পান; আবার কেউ খান সিগারেট। গাড়ি থেকে নামতে হয় না। সুন্দরী তার সুন্দর মুখখানাকে প্রসন্ন হাসিতে ভরিয়ে আরও সুন্দর করে ড্রাইভারদের হাতে তুলে দেয় তাঁদের চাহিদার জিনিস। ড্রাইভাররাও হাসিমুখে সুন্দরীর হাতে প্রণামীর মূল্য তুলে দিয়ে কৃতার্থ হন। বিভিন্ন ধর্মের নিত্যযাত্রীরা বা সাধারণ যাত্রীরাও বিরক্ত হন না, তাঁরাও পাকুড়তলার মায়ায় পড়ে যান।
==================
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা)
ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা