মুদ্রার উত্তর-দক্ষিণ
সৌমেন দেবনাথ
দূর থেকে যা কিছুই যত সুন্দর হোক না কেন কাছে গেলে তত সুন্দর মনে হয় না। দূরের জিনিসের প্রতি আকর্ষণ সকলের স্বাভাবিক গুণ। আবার কোন সৌন্দর্যটা কার কাছে কত সুন্দর তা বলা দুষ্কর। সর্বাঙ্গ সুন্দরী হলেও সুন্দর হয় না। সুন্দর হতে হলে মনে সুন্দর হতে হয়। দূরে না থাকলে সোহাকে আমিরের এতো মনে পড়ার কারণ ছিলো না। কাছে যখন ছিলো ছুঁয়েও দেখতো না। আর এখন দূরে তাই স্পর্শ পাওয়ার এতো আকুলতা। কণ্ঠ শোনার এতো ব্যাকুলতা। কিন্তু কল দিলে সোহা বিরক্তি প্রকাশ করে। এমন বিরক্তি প্রকাশ যে কারোর উন্নত চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে বিষ ঢেলে দিতে সক্ষম। আমির বলে, তোমাকে আমার মোটেও ভালো লাগে না, আবার আমার প্রতি বিরক্ত হলে হবে?
মুখের কথা তো আর মনের কথা নয়। মুখে হুটহাট কথা বলা আর মনের মধ্যের জমা বিশুদ্ধ কথা তো এক না।
যখন কাজ থাকে না বা সময় পেলেই কাউকে মনে পড়ার আগেই সোহাকে মনে পড়ে। মনের মানুষের সাথে কথা বলার লোভ সবচেয়ে বড় লোভ। স্বভাবতই তার দিকেই ফোনকল চলে যায়। সোহা তির্যক বাণে জর্জরিত করে বলে, যখন তখন কল করবে না। ব্যস্ততা থাকে। এতো বেশি কল করাকে ছেলেমি লাগে।
আমির বললো, মন যখন উতালা হয়ে উঠে তখন সময়-অসময় বিচার করার জ্ঞান থাকে না।
সোহা গরল মিশিয়ে বললো, তোমার সমস্যাটি কি?
এই কথাটি আমির অনেকের কাছ থেকে শুনেছে, কিন্তু কাউকে মনোপুত উত্তর দিতে পারেনি। আমির ভাবলো, আড়ালে গেলেই ভুলে যায়। চোখের আড়ালে গেলেই মনের কথা মনে থাকে না। উন্নত মানুষদের সাথে মিশলেই মন অধিকতর উন্নতে কাতর হয়ে উঠে। এমন একটা ঘৃণ্য মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হওয়া অনুচিত। মন থেকে ভালোবাসলে নির্দিষ্ট মানুষকে ছাড়া আর কারো কথা ভালো লাগার কথা নয়।
মামুন আমিরের বাল্যবন্ধু। সবার এলাকায় একটাই কাজ, আর তা হলো বখাটেপনা করে বেড়ানো। আমির বললো, এলাকায় আমাদের বদনাম রটে যাচ্ছে। বড় হচ্ছি আর বখাটেপনা করে ব্যক্তিত্ব খোয়াচ্ছি।
মামুন বললো, যারা ঘরকুনো তাদের এমন সন্দেহ অস্বাভাবিক নয়। যারা স্বাধীন চলাফেরাকে বখাটেপনা বলে তাদের মনে হিংসা আছে। এলাকার ছেলে এলাকায় ঘুরবো, বখাটে হবো কেন্?
এমন সময় আমির সোহার থেকে মিসডকল পেলো। কল দিয়েই আমির বললো, তোমার থেকে মিসডকল প্রাপ্তি কল পাওয়া অপেক্ষা অনেক বেশি আনন্দের। শুধু সুন্দরী না, মেধাবীও। সুন্দরীদের মিসডকল কতজনই পায়?
সোহার রাগ উঠে গেলো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শোনামাত্রই। বললো, বাগ্মী হও, বাচাল হয়ো না। এতো উপহাস করো কেন? মনে রেখো অত অত উপহাস আমি সহ্য করবো না। মনকে বিকশিত করো।
আমির বললো, শহরে পড়াশোনা করো, জানছো বেশি, বিকশিত হচ্ছো বেশি। আমাদের তো মনে হবেই নাজানেওলা।
সোহা রেগে বললো, খুব বেশি বলো সুযোগ পেলে। কথা সবাই জানে। পরিস্থিতি ভেবে অনেক কথা বলতে হয় না। পরিপক্ব হতে হয়, পক্ব না। পাকলে পঁচবে। যেদিন পাঁকে পড়ে পাঁক খাবে সেদিন বুঝবে। মনে যা আসে বলো। নিজের মনকে গুরুত্ব দাও, অন্যের মনকে পাত্তা দাও না। তুমি অসাড়, হালকা হাওয়ায় উড়ো। তুমি অনুভূতি কি বোঝ না, তুমি অনুভূতির মূল্য বোঝো না, তুমি অনুভূতির মূল্য দিতে পারো না! শিখেছো কথা, কথা দিয়ে রক্তাক্ত করা।
সোহা কল কেটে দিলো। মামুন বললো, পাত্তা দিবি কম। ব্যক্তিত্ব বুঝতে দিবি না। পাত্তা দিলে, ব্যক্তিত্ব ধরে ফেললেই নেহাত হয়ে পড়বি। বেশি মূল্য দিবি না অমূল্যকে, মূল্যহীন হয়ে যাবি। আদর দিলেই অনাদর পাবি, অনাদর দিলেই আদর জোটে।
আমির বললো, আমি শুধুই আমার। আমার একটা নীল আকাশ আছে। সেখানে আমি স্বপ্নঘুড়ি উড়াই। নীলাকাশ সবার, অন্যের আকাশে উড়ি না। কাউকে আমার নীল আকাশের ভাগ দিই না। সবার আকাশ যেমন বড়, আমার আকাশও তেমন নেহাত নয়।
এসব মুখে বলে, আবার মনে মনে বলে, সোহাকে ততটাই ভালোবাসি, যতটা ভালোবাসলে স্পর্শ ব্যতীত হৃদয় ছোঁয়া যায়।
এরপর বেশ কদিন গেলো। কেউ কাউকেই ফোন দেয় না। কি এক মায়া জন্মেছে মনে, কথা বলার জন্য মন ছটফট করে, কিন্তু কথা বলতে গেলেই কখনো দ্বিধা জাগে, কখনো ইগো জাগে। আর কথা বললেই ঝগড়া লাগে, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। না পেরে আমির সোহাকে ফোন দিলো, স্মরণ করো না কেন? বোঝো না, স্মরণে না নিলে স্মরণে থাকো না!
সোহা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, দায় পড়েছে তোমাকে স্মরণ করার। আমার যেন স্মরণ করার কেউ নেই। আমাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। কারো জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, আমার জন্য অপেক্ষা করার অনেকেই আছে।
আমির বললো, যাদের ধারণা অনেকেই তাকে চায়, মূলত তাদের কেউ নেই। সুন্দরীদের লোভ বেশি, কেউ তাদের কাছে যোগ্য হয় না। তাই অন্তঃপুর খালিই থেকে যায়।
সোহা রেগে বললো, তোমার মুখে এখন কিছু বাধে না। অমূল্য বাণী আমাকে বলতে হবে না, তোমার দৌড় আমি কম জানি না। ঠোঁটের ধার কমিয়ে মস্তিষ্কের ধার বাড়াও। মস্তিষ্কের ধার শাণিত থাকলে গ্রামে পড়ে থাকতে হতো না।
সোহা আর কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিলো। বাসাতে পড়ে থাকার কথাটা আমিরকে ব্যতীত করলো। উপযুক্ত আসনে বসতে না পারলে গুণের কোন দাম নেই।
বাসাতে ফিরছিলো আমির। পথে রুস্তমের সাথে দেখা। আমিরকে বললো, যে থাকে মনে কেমন আছে সে দূর বাসে?
আমির বললো, যেভাবে পারি সেভাবে অপমান করি। শোনালে এক শোনাই একশত। যত দূরে ঠেলি তত সরে কাছে আসে। কত কত নতুন দেখছে, কিন্তু আমাতেই তার সন্তুষ্টি। পুরাতন মনে পুরাতনই, নতুন পায় না ঠাঁই সেখানে।
রুস্তম বললো, যে খরাকাল পড়েছে হাত ধরতে সোহাকে ধরে রাখ্। এটার থেকে ভালো পেলে দিলি না হয় ছুঁড়ে।
আমির বললো, চেতনায় যদি দীনতা থাকে হিতার্থে হৃদয় বিলাবি কিভাবে? অপুষ্ট চিন্তা তোর দুর্গতির কারণ হবেরে!
আমিরের এই দ্বিচারণে রুস্তম অবাক হলো। বুঝতে পারে না সোহার ব্যাপারে আমিরের অবস্থান।
এরপর বেশ কদিন চলে গেলো। বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই আমিরকে একাকিত্ব পেয়ে বসে। সোহাকে ফোন দিলো, বৃষ্টি হলে কি খুশি হতে তুমি! ছটফট করতে!
সোহা আশ্চর্য হয়ে বললো, কই মনে পড়ে না তো!
আমির বললো, মনে পড়বে কেনো! রঙিন শহরে আছো, রঙিন চশমা চোখে। চোখে ঠুলি, মনে তালা।
আমিরের এই কথা সোহার তেঁতো লাগলো, তাই তাকে তেঁতিয়ে দেওয়ার জন্য বললো, ভালো একটা ছেলে খুঁজছি না যে তা নয়। পারফেক্ট কাউকেই মনে হয় না।
আমির রেগে উত্তর দিলো, বরপক্ষ যখন এসে এসে দেখে চলে যাবে তখন বুঝবে পারফেক্ট কে!
এরা সবাই একসাথে কলেজে পড়তো। সোহা আমির একসাথেই থাকতো, ঘুরতো। সোহা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে দুইজনের মধ্যে ব্যবধানটা বেড়ে গেছে। বন্ধুরা তাই দেখলেই সোহার খোঁজ নেয়। আমির বলে, ওর খোঁজ রাখায় কি আমার কাজ?
মোশাররফ বললো, অন্তরে মিল থাকলে যত দূরেই যাক বাঁধন ছিঁড়বে না। অযথা কষ্ট পাসনে।
আমির বললো, অন্তর কি আর অন্তরে মিল কি বুঝলাম না! সুযোগ-সুবিধার জন্য ও আমার সাথে মিশতো, চলতো, ঘুরতো, থাকতো। ওর প্রয়োজন শেষ, জীর্ণ বস্ত্রের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর তাছাড়া ওর তুলনায় আমি উচ্ছিষ্ট। মাছি, মশা ছাড়া আমার দিকে কেউ তাকাবে না।
মোশাররফ বললো, অভিমানের কথা রাখ্। সম্পর্কের যত্ন না নিলে মরিচা পড়বে। সম্পর্কের শিকড়ে জল দিতে হয়। গাম্ভীর্যতা নিয়ে থাকলে সম্পর্কের রং নষ্ট হয়।
মোশাররফ চলে গেলে আমির বেশক্ষণ ভাবলো। মনের কোন এক কোণে একটা খোঁচা লাগলো। বুকের মাঝে শূন্যতা হাহাকার করে উঠলো। শূন্যতা অনুভব করা যদি ভালোবাসা হয় তবে সেকি সোহাকে ভালোবাসে! আর কোন ভাবনা রেখে সোহাকে কল দিয়ে বললো, ফোন পেলে অখুশি হও?
সোহা বললো, তোমার মতো গোমড়া আর ঘরমুখো নাকি? প্রাণোচ্ছ্বল থাকি সব সময়। কত মানুষই ফোন করে, অখুশি হওয়ার কিছু নেই।
আমির বললো, আমার সাথে এমন আচরণ করো কেন? তুমি কি এমন ছিলে?
সোহার সহজ উত্তর, সময়, পরিবেশ মানুষকে বদলে দেয়। পরিবেশ মানুষকে শেখায় কার সাথে কেমন আচরণ করতে হয়। পরিবেশ মানুষকে শেখায় কার সাথে কতটুকু মেশা উচিত। সময়ের সাথে সাথে সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়, হোক সে বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা।
আমির কথা বাড়ালো না সোহার কথার ধরণ বুঝে। ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস কাটলো। আর সোহা ভাবলো, দিয়েছি আজ আচ্ছামত, দেখি বিক্রিয়া শেষে কি তৈরি হয়!
আমিরদের ক্লাস হয় না ঠিকমত। ক্যাম্পাসে যায় আর আড্ডা দিয়ে চলে আসে। আশা বললো, কিরে আমির, সোহার খবর কি?
আমির রেগে উত্তর দিলো, তোদের বান্ধবীর খবর আমার কাছে থাকবে?
আশা বললো, ওতো আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে না।
আমির বললো, অহংকার আর সাফল্যের ঈর্ষায় আকাশে উঠেছে তো! যে যত উপরে উঠবে, পড়ে গেলে তার তত বেশি লাগবে।
আর কোন কথা না বলে আমির অন্য দিকে চলে গেলো।
অন্য আর এক দিনের ঘটনা। মঞ্জুরুল বললো, কেমন যেন উদাসীন থাকিস। মনে অস্থিরতা নিয়ে মুখে কি হাসি থাকে?
আমির অবাক হয়ে বলে, আমার মনে অস্থিরতা মানে? কি নির্দেশ করছিস? কাকে নির্দেশ করে কথা বলছিস?
মঞ্জুরুল বললো, তুই তো শ্যামলা, এতে তো কোনদিন সোহা আপত্তি করেনি। ও একটু শর্ট এতে তোর যেন ঘোর আপত্তি!
আমির সত্যতা স্বীকার করে বললো, দাম দেয় না বলেই দাম দিই না৷ দূরে থাকতে চায় বলে দূরেই ঠেলে দিয়েছি। সহ্য করে না বলেই সহ্য করি না। ভুলে যাচ্ছে বলেই ভুলে যাচ্ছি। চোখে নতুন অঞ্জণ মাখছে, অধর রাঙিয়ে নতুন হৃদয় হরণের চেষ্টা করছে। চাচ্ছে দূরে যেতে, বাধা দেওয়ার আমি কে?
মঞ্জুরুল বললো, তাই-ই। ওরা সুখের পায়রা। যে বাড়ি খেতে পাবে, সেই বাড়ি চলে যাবে। যখন যার সান্নিধ্যে, তখন তারই হবে। দূরত্বটাই তোদের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সব দূরত্ব সব হৃদয়কে আটে না, ঠেলেও দেয়। আবার সম্পর্ক যদি মন থেকে হয়, ভাঙতে চাইলেও ভাঙবে না। আর সম্পর্ক যদি স্বার্থ দিয়ে হয়, জোড়া লাগাতে চাইলেও জোড়া লাগবে না।
দিন যায় দিন আসে। সোহাও খোঁজ নেয় না। আমিরও কথার তেজে ঝলসে যাওয়ার ভয়ে খোঁজ নিতে ভুলে গেছে। আবেগকাতর যতটা সে, সোহা হয়ত ততটায় বাস্তববাদিনী। আমির বুঝলো, আবেগ দিয়ে কখনো জীবন চলবে না, জীবন বাস্তবতা অনেক কঠিন। তবে সব পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায়, যদি ভালোবাসার মানুষটা সঠিক ও সত্য হয়।
হঠাৎ একদিন সোহা মামুনকে কল দিলো, বললো, তোরা কেউ আর খোঁজ নিস না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, এটাই আমার দোষ?
মামুন বললো, দোষ হবে কেন্? তুই তো আমাদের গর্ব!
সোহা বললো, আমির এতো বদলে গেছে কেন্? আমায় নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। আর যা ভাষা ব্যবহার করে! সেজন্য আমিও দুর্ব্যবহার করি। ইট মারে পাটকেল খাওয়ায়ে দিই। আগে সহ্য করতাম, এখন সহ্য হয় না।
মামুন বললো, সবাই তো ভালোবাসা এক ভাবে প্রকাশ করে না। ওর ভিতর ভিন্নতা আছে, বিচিত্রতা আছে, বিশিষ্টতা আছে, স্বাতন্ত্র্যতা আছে।
সোহা এবার রুস্তমকে ফোন দিলো, বললো, জানি তোরা দল বেঁধে ভালো আছিস। নতুবা আমায় ভুলে যাবি কেন্?
রুন্তম বললো, ঈর্ষণীয় ফল করলে সকলের ঈর্ষায় পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ কারণে কত বন্ধু ছুটে যাবে।
সোহা বললো, পুরাতন বন্ধুরা কখনো পুরাতন হয় না। জানি আমায় নিয়ে অনেক সমালোচনা করিস, সমালোচনা আমার অনুকূলে আসে না, তাও জানি। তোদের সঙ্গ প্রত্যাশা আমার জাগে না বুঝি?
এভাবে সব বন্ধুকে এক এক করে কল দিলো। দিলো না শুধু আমিরকে। আমরা এমনই সবাইকে সময় দিই, সবার কথা হজম করি; আপন মানুষটাকে সহ্য করি না, আপন মানুষের কথা হজম করি না। সবাই আমিরকে কল দিতে লাগলো আর বলতে লাগলো, সোহা আজ কথা বলেছে।
আমির বললো, সোহা তোদের সাথে কথা বলেছে তা আমাকে বলার অর্থ কী?
মোশাররফ বললো, সঙ্গীহীন শূন্যজীবন শ্মশান সমান। সোহার মতো তুলনাহীন হাজার গুণে রূপে ধন্যা মেয়েকে কষ্ট দেওয়া তোর ঠিক হচ্ছে না। তোর রোষানলে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে নিষ্পাপ প্রাণীটি।
অসহ্য এক জ্বালায় আমির সোহাকে কল দিলো। সোহা রিসিভ করতেই বললো, তোমার সাথে আমি কোন কালে প্রেম করেছি? তোমাকে ভালো লাগে কোনদিনও তোমাকে বলেছি? বন্ধুরা তোমাকে আমাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করে কেনো?
সোহা নিষ্প্রভ হঠাৎ এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ে। বললো, তোমার অযাচিত উক্তিতে আমার যাচিত জীবন যাপনে প্রভাব ফেলে। মৌমাছির পিছে হুল আর তোমার মুখে হুল। তোমার কণ্ঠবিষে আর আমায় নীলাভ করো না।
এরপর আর কেউ কারোর খোঁজ রাখে না। সেদিন মনভার করে বসে আছে আমির। মঞ্জুরুল পাশে এসে বসে বললো, কিছু স্বপ্ন প্রতিনিয়ত কষ্ট দেবে, কিছু স্বপ্ন বাঁচতে শেখাবে, কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আসলে এই স্বপ্নই জীবনের অনুষঙ্গ। তাই বলে স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেলে হবে?
আমির তেমনটি চুপটি মেরে বসে থাকলো। মঞ্জুরুল আবার বললো, ভালোবাসার মানুষকে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখাতে যাওয়া ঠিক না। এতে সে বিরক্তিবোধ করে এবং ধীরে ধীরে অবহেলা ও কষ্ট দিতে দ্বিধা করে না। আবার ভালোবাসার মানুষকে বেশি নজরে, বেশি শাসনে, বেশি অধিকারে রাখতে গেলেও বিরক্তিবোধ করবে, তাতে সম্পর্কের বুনট শক্ত না হয়ে আলগা হয়ে পড়বে।
আমির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মঞ্জুরুল থামলো না, বললো, ভালোবাসার কোন রং হয় না। কোন গন্ধ হয় না। এমনকি কোন স্বাদও হয় না। কিন্তু জীবনে ভালো লাগা এবং দুঃখ নামে দুটি অধ্যায় সূচিত ও রচিত হয়। আবার সবাইকে ভালোবাসা যায় না, কিন্তু যাকে ভালোবাসা যায় তার থেকে দূরে থাকা যায় না।
আমির হায়-নিঃশ্বাস তুলে বললো, কাউকে ভুলে যাওয়া কঠিন নয়, কিন্তু কাউকে সত্যি করে চিনতে পারা কঠিন।
মঞ্জুরুল বললো, খুব কষ্ট লাগে যখন প্রিয় মানুষটি ছোট খাটো ভুলগুলি ক্ষমা না করে উপরন্তু ভুল বোঝে। কিন্তু সব কিছুই সময়ের সাথে সাথে পুরাতন হয়, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনই পুরাতন হয় না। যতই দিন যায় ততই সেটা নতুন হয়।
আমির বললো, সোহা সত্যিই আর আমার নেই। ওর পরিবর্তনটা আমি মানতে পারছি না। বড় প্রতিষ্ঠানে পড়তে গিয়ে ওর মনটা বড় না হয়ে সংকোচিত হয়ে গেছে। আমার মাঝে ওর স্বপ্ন আর পড়ে নেই, ওর স্বপ্নকে ওর পরিবেশ বাড়িয়ে দিয়েছে জ্যামিতিক হারে।
কলেজ জীবনে সোনায়-সোহাগা সম্পর্ক ছিলো ওদের। সে সম্পর্কে মরিচা ধরেছে। নারীর সাফল্য পুরুষের জন্য লজ্জার তা যেন আমির হাড়ে হাড়ে বুঝছে৷ ভীষণ হীনম্মন্যতায় ভোগে ও। দাবিটাও কেন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। আমিরের নিষ্প্রভতা আশা লক্ষ্য করে। আশাও সব জানে বৈকি। সে বললো, ভালোবাসার মানুষটির চোখের দিকে তাকালে পুরো পৃথিবী দেখা যায়। তাই সেই ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে পৃথিবী আঁধারে ঢেকে যায়।
তৎক্ষণাৎ আশা সোহাকে কল দিলো। আমির বিষয়ে কিছু বলতে গেলেই সোহা হাজার কথা শুনিয়ে দিলো। আশা বললো, কেউ অশ্রু ঝরায় সকলের সামনে আর কেউ সকলের সামনে থেকেও গোপনে অশ্রু ঝরায়। চোখের জল সবচেয়ে তরল যেখানে এক ভাগ পানি আর নিরানব্বই ভাগই অনুভূতি। তুই অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিস। তোর আর ওর মাঝে যে শীতল যুদ্ধাবস্থা যাচ্ছে তার অবসান দরকার।
সোহা বললো, পশুর চেয়ে যে অধম সে অসুর। সে বন্ধু নয় সে জন্মশত্রু। আহত ব্যক্তির যন্ত্রণা সারে, কিন্তু অপমানিত ব্যক্তি অপমানিত হওয়ার কথা ভোলে না। আমি ওকে অভিশাপ দিচ্ছি, ও পুড়ে অঙ্গার হবে। আমি সেই পোড়া ছাই থেকে কাবাবের গন্ধ নেবো।
সোহা কল আর ধরে রাখলো না। আশা বুঝতে পারলো, জটিল অবস্থা।
বেশ কদিন এভাবে গেলো। এর মধ্যে সোহা সবাইকে বললো, আগামী পনেরো তারিখ আমি তোদের মাঝে আসবো।
এ কথা শুনে বন্ধু মহলে সাড়া পড়ে গেলো। সবাই একজোট হলো আর শফথ নিলো, আমির সোহার মধ্যে মিল করিয়ে দেবে।
সোহা চলে এলো। এসে ববি, বুশরা আর আশাদের সাথে উঠলো। রাতে ঘুমানোর সময় ববি বললো, একজন প্রকৃত প্রেমিক শত শত মেয়েকে ভালোবাসে না, বরং সে একটি মেয়েকেই শত উপায়ে ভালোবাসে।
সোহা রেগে গেলো, আমির তোদের কাকে কত টাকা দিয়েছে উকালতির জন্য বল্? আমি ওকে কোন কালে ভালোবেসেছি সেটাও বল্?
ববি বললো, শূন্যতায় ডুবে আছিস, আরও শূন্যতায় ডুবতে চাচ্ছিস, শূন্যতার সম্পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করছিস।
সোহা বললো, ইচ্ছে হলেই নিজের স্বপ্নগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনার রং দিয়ে সাজাই। ইচ্ছে হলেই ঘুরে বেড়াই প্রজাপতির ডানায় চড়ে দশ দিগন্তে। শূন্যতা দেখলি কোথায়?
বুশরা বললো, অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন কখনো সুখ দিতে পারে না। আকাশের চাঁদ দেখে বিহ্বলিত হোস, আকাশের চাঁদ রাতের আঁধার দূর করতে পারে, মনের আঁধার দূর করতে পারে না।
সোহা বললো, নিঃসঙ্গতায় কেউ হারায় না, ভীড়ের মাঝেই সবাই হারায়। আমি কখনোই আর ওর সান্নিধ্য চায় না। ও মানুষ হওয়ার যোগ্যতায় রাখে না।
আশা বললো, তোদের দুইজনের মধ্যেই অনেক ইগো, কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচিস না, আবার কেউ কাউকে পাত্তা দিস না। কেউ কাউকে শ্রদ্ধা করিস না। যে-ই খোঁজ নেয় অন্যজন পেয়ে বসে বীরত্ব ফলাস। দুইজনই সুখে থাকার অভিনয় করিস, অথচ দুইজনই মরিস মনে মনে। তুই ইউনিভার্সিটিতে পড়িস, ও পড়ে গ্রামের কলেজে। ও ভাবতেই পারে, তুই দেমাগ দেখাস। তোকেই সব বিষয়ে এক পা বেশি এগুতে হবে।
তিন বান্ধবী মিলে ওকে সারারাত জ্ঞান দিতে লাগলো। ওদিকে আমির তার বন্ধু মামুন, রুস্তম, মোশাররফ ও মঞ্জুরুলকে ফোন দিয়ে জানালো, সোহা এসেছে। তোরা সবাই ওকে সঙ্গ দিবি, সময় দিবি। দেখে দেখে রাখবি।
রুস্তম বললো, মানে? তুই থাকবি না? কই যাবি?
আমির বললো, আমার কাজ আছে। ফোনও বন্ধ থাকবে।
রুস্তম বললো, তোর গলা ধরে আসছে কেন কথা বলতে বলতে? আচ্ছা তুই কি বলতো! কেন সোহাকে একা করে দিয়ে একা থাকিস? কেন তাকে কাদিয়ে নিজেও কাদিস? কেন মন দিয়ে ভালো না বেসে মন নিয়ে খেলা করিস? কেন ভালোবাসার মানুষকে অপমান করিস, কেন নিজেদের সুন্দর স্বপ্নগুলোকে ভেঙে চুরমার করছিস? ভেতর থেকে যত ক্ষোভ বের করে দে, দুটি নিষ্প্রাণ প্রাণে আবার প্রাণ ফিরুক।
আমির কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। সকাল না হতেই সবাই কলেজ ক্যাম্পাসে গেলো। বন্ধুরা এলো, আমির নেই। সবাই ফোন দিলো। আমিরের ফোন বন্ধ। সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। সোহা বললো, চল্, ভালো একটা রেস্টুরেন্টে যাই।
সোহার ঠোঁটে হাসি। কিন্তু তার অভিব্যক্তিতে কেমন একটা কষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সোহা ভাবলো, বিশুদ্ধ ভালোবাসা আর সন্দেহ কখনো একসাথে থাকতে পারে না। আমি জানি, কিভাবে শব্দ ছাড়া কান্না করা যায়। কি করে লাল চোখ আড়াল করা যায়, তা জানি। অশ্রুতে ভেজা বালিশ আমিও উল্টে নিতে জানি। আমি এখন সুখে থাকার অভিনয় শিখে গেছি।
তারপর বন্ধু, বান্ধবীদের সাথে হৈ-হট্টগোলে যুক্ত হলো। তবুও মন মানে না, চারিদিকে তাকায় সে। কেন যেন চারিদিকে এক প্রিয় মানুষের অস্তিত্বের ঘ্রাণ পাচ্ছে ও। সবাই আছে, শুধু প্রার্থনা জুড়ে থাকে যে, সে নেই। মনে মনে অভিধান বহির্ভূত সব গালি শত চেষ্টা করেও দিতে গিয়ে ও দিতে পারলো না।
=================