উদ্যম
বদরুদ্দোজা শেখু
রজনী একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। তার আসল নাম রজনীগন্ধা দেউচি । তার অদৃষ্টটাই দুঃখ দিয়ে লেখা। সে যখন পাঁচ বছরের শিশু তখন তার মা হঠাৎ জ্বরের বিকারে মারা যায়। বাড়িতে বাবা আর বুড়ী দিদা । বাবা সতীনাথ দেউচি দরিদ্র মানুষ।শহরতলির গ্রামের কিনারে একটা মুলিবাঁশের বেড়া-দেওয়া ঘরে তাদের সংসার। রেশনে কিছু চাল আটা পায়। সে শহরে রিকশা চালায়। দিনভোর যা রোজগার হয় তা দিয়ে কোনোমতে তিন জন প্রাণীর গ্রাসাচ্ছাদন চ'লে যায়। বাড়িতে একবারই রান্না হয়।তার বাবাই ফিরে এসে সন্ধ্যার সময় করে। তার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল তাদের মেয়েটাকে স্কুলে পড়াবে।তাই সতীনাথ গ্রামের প্রাইমারীতে রজনীকে ভর্তি ক'রে দিয়েছিল। স্কুলে মিড ডে মিল পেতো আর ফ্রি-তে লেখাপড়া। এই ক'রে একদিন তার মেয়ে দশম শ্রেণী পাশ করলো। এবার তাকে শহরের দ্বাদশ শ্রেণীর স্কুলে দিতে হবে । তার টাকা জোগাড় করার জন্য সতীনাথ রাত ন'টা অবধি রিকশা চালাতে লাগলো।ভর্তির টাকা জোগাড় হলো বটে তবে স্কুলটা একটু দূরে হওয়ায় তার মেয়ের একটা সাইকেল দরকার । বেশ কিছুদিন যাবার পর সবুজসাথী প্রকল্পে রজনী সরকার থেকে একটা সাইকেল পেল। তবে সাইকেল ফিটিং করার সময় বেশ কিছু পার্টস্ বদল ক'রে লাগাতে হলো, এতো নিম্ন মানের সরকারী সাইকেল। অতিরিক্ত কাজের চাপে সতীনাথও একদিন হঠাৎ মুখে রক্ত উঠে রাতের মধ্যেই মারা গেল। বস্তির পড়শীরা চাঁদা তুলে তার শেষকৃত্য করতে সাহায্য করলো। রজনীর এবার শুধু দিদা থাকলো। সে পুরোপুরি রজনীর উপর নির্ভরশীল। বার্ধক্য তার সাথে হাঁপানির অসুখ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।প্রাইভেট ডাক্তার দেখাবার পয়সা নাই । রজনীকে সরকারী ক্লিনিক থেকে কিছু ট্যাবলেট দিয়েছে আর একটা ইনহেলার লিখে দিয়েছে যা এখনও কেনা সম্ভব হয় নি।অতিরিক্ত টিউশন পড়িয়ে সেটার ব্যবস্থার জন্য রজনী লেগে আছে। টিউশনি ঘরের রান্নাবান্না দিদার যত্ন- আত্তি এই সব ক'রে সকালে রজনীর আর পড়াশুনার সময় প্রায় থাকে না। পড়াশুনা রাতে যা পারে তা করে। সে দিদাকে খাবার ও ওষুধ খাইয়ে দিয়ে স্কুলে চ'লে যায়। পাশের বাড়িতে ব'লে যায় তার দিদার একটু খেয়াল রাখতে। দিদা সারা রাত কাশে আর হাঁপায়।রজনী কিছু করতে না পারায় তার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়।জ
সামনে তার একাদশ শ্রেণীর বাৎসরিক পরীক্ষা। তার এক ছেলে সহপাঠী নকুল সাহু আছে। সে মাঝেমধ্যে সাইকেলে ক'রে আসে আর রজনীর সাথে খাতাপত্র বিনিময় করে। সময় কাটায়।চ'লে যায় । পাশের পাকাবাড়ির লোকজন এটাকে ভালো চোখে দ্যাখে না।প্রতিবাদও করে না। শহরের প্রভাবে তারা একটু উদার হ'তে শিখেছে।
সেদিন সোমবার।ন'টার সময় নকুল তড়িঘড়ি ক'রে তাকে ডেকে স্কুলে চ'লে গেল, নইলে পরীক্ষায় দেরী হ'য়ে যাবে। পরীক্ষার টেনশনে রজনী ছিলই। নকুল ডাকতে আসায় তার দিদাকে ওষুধ দেওয়া ভুলে গিয়ে ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে সাইকেল নিয়ে সত্বর বেরিয়ে গেল।
সারাদিন পরীক্ষার টেনশনে তার আর দিদার কথা মনে নাই।এদিকে তার দিদা হাঁপানি উঠে একা ঘরে বিনা সাহায্যে মারা গেল। সে যখন ফিরছিল, হঠাৎ তার মনে পড়লো , সে তো দিদাকে ওষুধ খাইয়ে যায় নি। সে খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাসায় এসে দ্যাখে ঘরে কোনো সাড়াশব্দ নাই। আর তার দিদা মেঝেতে প'ড়ে আছে। দ্রুত সে দিদাকে চৌকিতে টেনে তুললো। তার নাড়ী দেখলো, বুকে হাত দিয়ে তার হার্ট চলছে কিনা দেখলো । আর তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা তীব্র ভয়াল ঠান্ডা স্রোত ব'য়ে গেল। সে চীৎকার ক'রে কেঁদে উঠলো।পাশাপাশি বাড়ির লোকজন এসে দেখলো তার দিদা মারা গেছে। স্কুল ফেরার সময় নকুলও তার সাথে এসেছিল।সে কিছুক্ষণ থেকে বললো, তোর হয়তো কাল আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। আমি যাই, আমার অনেক পড়া বাকি। পরে কথা হবে। ব'লে সে চ'লে গেল। রজনীদের অবস্থা তো সবার জানা। পাড়ার লোকজন চাঁদা তুলে কোনো রকমে রজনীর দিদার শেষকৃত্য সম্পন্ন করলো। রজনী এখন অসহায় একা। এই বেড়ার ঘরে সেই কিশোরী মেয়ে কী ক'রে থাকবে ? আর যাবেই-বা কোথায় ? পাশের মুদীর দোকানের রামদা অভয় দিলো, দরজা বন্ধ ক'রে ঘুমাবি !, কোনো ভয় নাই আমরা তো আছি।তুই কাল অবশ্যই পরীক্ষা দিতে যাবি। রামদার বৌ রজনীকে কিছু খাবার দিয়ে গেল রাতে খাওয়ার জন্য। রজনী তেমন কিছু খেতে পারলো না।সকালের জন্য রেখে দিলো। রজনী আলো জ্বেলে রাতে লেখাপড়া রিভাইজ করলো আর সিদ্ধান্ত নিলো , তাকে আগামীকাল পরীক্ষা দিতেই হবে। নইলে সে এক বছর পিছিয়ে যাবে। সেদিন সকালে আর তার সহপাঠী নকুল এলো না। সে একাই সাইকেল নিয়ে স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এলো। একবার নকুলের সামনে পড়ায় সে বললো, তাহলে পরীক্ষা দিচ্ছিস ! এভাবে খেয়ে না খেয়ে পরীক্ষা শেষ করলো। এর মধ্যে নকুল আর কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাকতে এলো না। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল,রজনী প্রথমবার প্রথম ডিভিশন পেয়েছে। তার আনন্দ আর ধরে না।তার বাপ-মা থাকলে খুব আনন্দ পেত। খবর শুনে রামদা খুশীতে ওকে ক'টা লজেন্স দিল।
পরদিন নকুল রজনীকে শুভেচ্ছা জানাতে এলো।রজনী তাকে আর বাসায় ঢুকতে দিল না। বললো, যে বন্ধু বিপদের দিনে বন্ধুকে ফেলে পালিয়ে যায় সে কাপুরুষ, সে কখনোই প্রকৃত বন্ধু হ'তে পারে না। জীবন-সাথী হওয়া তো দূরের কথা । সে স্বার্থপর। তোমার সাথে আর আমার কোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক নাই, তুমি এখান থেকে এক্ষুণি চ'লে যাও। নইলে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবো।নকুল জোর থাপ্পড় খেলো। সে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু রজনী তাকে ধাক্কা দিয়ে বের ক'রে দিয়ে ঘরে খিল দিল। পরদিন সে আরো দু'টো টিউশন ধরলো, তাকে দ্বাদশ শ্রেণী ভালো ভাবে পাশ করতেই হবে।
তার কাছে নকুল অপমানিত হ'য়ে তার মনে হিংসার উদয় হলো এবং সে প্রতিজ্ঞা করলো সে এর বদলা নিবেই। সে চুপিচুপি কোনো মুদির দোকান থেকে এক বোতল অ্যাসিড কিনলো আর সুযোগ বুঝে একদিন বেড়ার ঘরের সামনে অপেক্ষা করতে থাকলো। যেই রজনী সন্ধ্যার সময় টিউশন সেরে বাড়ি ফিরেছে, সে তাকে হ্যালো ব'লে , যেই রজনী তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে অমনি সে অ্যাসিডের বোতল তার দিকে ছুঁড়ে মারলো। প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরে রজনী লাফ দিয়ে বাম দিকে স'রে গেল। মুখটা বাঁচলেও ছিঁটে ফোঁটা তার গায়ে লাগলো।সে চীৎকার ক'রে উঠলো, পাশের মুদির দোকানের রামদার নাম ধ'রে চেঁচাতে লাগলো, সেই ফাঁকে নকুল চম্পট। রামদা ছুটে আসতেই তাকে হাঁপাতে হাঁপাতে সব ঘটনা বললো। রামদা দোকানে তার ছেলেকে ব'সিয়ে রজনীকে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে গেল ।ওখানে ওষুধ নিয়ে তারপর গেল থানায়। সেখানে নকুলের নামে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগে কেস দায়ের করলো। পুলিশ রজনীর বাসায় এসে অ্যাসিড ও বোতলের নমুনা সংগ্রহ ক'রে নিয়ে গেল। পুলিশ পরদিন বিকেলের মধ্যেই নকুল সাহুকে গ্রেফতার করলো । তার হাতের ছাপ নিল আর সেটা অ্যাসিডের বোতলের হাতের ছাপের সাথে ম্যাচ করা হবে। তার হাতের ছাপ আর বোতলের হাতের ছাপ হুবহু মিলে গেল।এবার তাকে লক-আপে ভরা হলো, জেরা করা হবে।
জেরায় জেরায় সে নিজের অপরাধ কবুল করলো।
পাড়ার সকলে রজনীকে মুলিবাঁশের জীর্ণ বাসায় থাকতে মানা করলো। কিন্তু সে নিরুপায় । তার এক কাকা আছে দূরের এক গ্রামে। তার বাবা ভবানীর সাথে বিয়ের পর শহরতলিতে থেকে যায় উপার্জনের স্বার্থে ।দূরের গ্রামে কাকার কাছে গেলে আশ্রয় পাবে হয়তো ,তবে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হ'য়ে যাবে। তাই সে ওপথ ধরলো না। কোর্টে নকুলকে চালান করার পর সে জামিন পায় নি। এখনও সে জেলে বাস করছে। পুলিশ দ্রুত কাজ করায় অনেক কিছুই প্রমানিত হলো। তাই এই দুর্দিনেও রজনী দ'মে গেল না। কারণ তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। দ্বাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দিল, খুব ভালো রেজাল্ট না হলেও সে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করলো। আজ তার বাপ-মা-য়ের জন্য গর্ব হচ্ছে। সবার পরামর্শে সে ডি-এল-এড এ ভর্তি হলো। দু' বছর পর ডিগ্রী বের হলো।এখন সে প্রাইমারীতে চাকরির আবেদন করতে পারবে। পাশাপাশি সে টিউশনও চালিয়ে গেল।
এবার রামদা কয়েকজন মুরুব্বির পরামর্শে তার সমকক্ষ একটা পাত্র ঠিক করলো যে তাকে সুরক্ষা দিতে পারবে। রজনীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করানো হলো। পাত্র উচ্চতর মাধ্যমিক পাশ। পাত্রপক্ষের রজনীকে পছন্দ হলো। মেয়েটি দেখতে শুনতে ভালো আর অসহায়। যা বলবে তাই শুনবে তার উপর ঘরকন্নার কাজকর্ম জানে। ওতেই হবে।আসলে তার হবু শাশুড়ী তার সংসারের জন্য একটা উপযুক্ত কাজের মেয়ে ও বৌমা পেয়ে যাবে ব'লে ছেলেকে রাজি করালো। পাত্রপক্ষের কোনো দাবি-দাওয়া নাই। শুভ দিন ঠিক ক'রে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তাদের চার হাত এক ক'রে দিয়ে পাত্র জগদীশের হাতে রামদা রজনীকে সমর্পণ করলো।পরে রজনী জানতে পারলো, জগদীশ তার স্কুলেই পড়তো। সে যখন একাদশে , জগদীশ তখন দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়তো। জগদীশের ছোটখাটো একটা পোষাকের ব্যবসা আছে। সে রজনীকে চাকরির জন্য উৎসাহিত করলো না। বরং যা ভালো লাগে ভালো পারে তাই হৃদয় দিয়ে ক'রে যাওয়ার পরামর্শ দিল। ক'দিন রজনী ভাবলো ।তারপর জানালো, সে তার মুলিবাঁশের ভিটেয় একটি শিশুশিক্ষালয় খুলে' পাড়ার ছোট বাচ্চাদের নিয়ে লেখাপড়া করানোর কাজ করতে চায়।এটাতে জগদীশ মায়ের অনুমতি পাওয়া যাবে না ব'লে প্রথমে আপত্তি জানালো, তবে তার জেদাজেদিতে অনিচ্ছা সত্বেও পরে অনুমতি দিল। রজনীর আনন্দ আর ধরে না। সে গরীব শিশুদের শিক্ষাদানের সেবা করতে পারবে , কতো পূণ্যের কাজ হবে। সেদিন রাতে তারা অন্তরঙ্গ হলো।
জানালা দিয়ে সূর্যের আলো পড়লো ঘরে।জগদীশ রজনীকে তোলাতে তোলাতে বললো ,এতো বেলা হ'য়ে গেল, দেখো মা হয়তো বিরূপ হ'য়ে যাবে।ওঠো ওঠো, যাও আগে বাড়ির কাজ সারো। রজনী আর তার অনুভূতির কথা জগদীশকে বলতে পারলো না ।ভাবলো, পরে বলবে। দু'জনে শক্ত ক'রে দুজনের হাত ধরলো আর রজনী উঠে সংসারের কাজে গেল। সেদিন দুপুরে রজনী রামদার কাছে গেল।রামদার তত্ত্বাবধানে তার মুলিবাঁশের ঘরটি সংস্কার ক'রিয়ে ছোট বাচ্চাদের একটা শিক্ষালয়ের উপযোগী ক'রে সাজিয়ে তুললো। দরজার সামনে কিছু নয়নতারা ফুলগাছ লাগিয়ে দিল। চালু হলো রজনীর মায়ের নামের ব্যক্তিগত শিশুকেন্দ্র "ভবানী শিশু শিক্ষালয়"। পাড়ার সবার কাছে ঘুরে ঘুরে রজনী ছোট ছোট বাচ্চাদের তার স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার স্কুল বেশ কিছু ফুলের মতো বাচ্চাদের কলরবে মুখরিত হ'য়ে উঠলো। রজনীর কিছু সমবয়সী বান্ধবীও ওই কাজে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। প্রাইমারীতে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত বাচ্চাদের ওখানে লেখাপড়া শেখানো হয় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১।০০ পর্যন্ত। পরিবারের লোকজন নিজেদের বাচ্চা নিয়ে আসে, নিয়ে যায়। রজনী এটাকে সার্থক কাজ মনে করে। তার শাশুড়ী এটা পছন্দ করে না। বলে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কাজ । বাচ্চাদের শিক্ষার কিছু সরঞ্জাম ও মনোরঞ্জনেরও দরকার।তাই জগদীশের কাছে হাত পাততে হয়। সঙ্কোচ হয়। আর তখন একটা চাকরির প্রয়োজনীয়তা রজনী অনুভব করে।জগদীশ রজনীকে চাকরি করতে উৎসাহিত না করলেও রামদা ও আরো শুভাকাঙ্খীরা প্রাইমারীতে লোক নেওয়ার সময় তাকে দরখাস্ত জমা করতে উৎসাহিত করলো।কারণ স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর ক'রে না থেকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক জরুরী। আর অবৈতনিক শিশু শিক্ষালয় চালাতেও বেশ কিছু নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয়। নিজে চাকরি করলে সেটাও আর তার স্বামীর কাছে চাইতে হবে না। আর ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না ; তার স্বামীর আরো ভাইবোন আছে। সম্পত্তির অধিকার নিয়ে যে-কোনো দিন বিবাদ খাড়া হ'তে পারে। আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে তার নিজের উপর আস্থা বাড়বে। এই সব পরামর্শ তার মনে ধরলো।তার বাপ-মাও হয়তো এইটাই চেয়েছিল। তাই সে জগদীশকে না জানিয়ে চাকরির দরখাস্ত জমা করলো। বছর খানেক পরে সে চাকরির নিয়োগপত্র পেল। পাশের গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলে পোষ্টিং। সে আগে চাকরিতে যোগদান করলো ও পরে তার স্বামীকে জানালো। জগদীশ তার প্রাথমিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও রজনী তাকে বুঝিয়ে রাজী করালো যে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় । ভবিষ্যতে বেঁচে থাকলে পেনশন পাবে। ভবিষ্যতে হয়তো সুবিধা হবে।তাই উপলদ্ধি করতে পারায় সে রাজী হলো।রজনী বললো, সে তার শিশু শিক্ষালয় সকাল ন'টা পর্যন্ত চালাবে আর তার পরে স্কুলে যাবে। তাছাড়া শিক্ষকদের অনেক ছুটিছাটা আছে।কাজেই সুবিধামতো সে শিশু শিক্ষালয় চালানোর ব্যবস্থা করবে। ওটা ও বন্ধ করবে না। তাছাড়া শিশু শিক্ষালয়ে আরো কয়েকজন স্বেচ্ছা-সহযোগী আছে তাদেরকেও কিছু হাতখরচ দিতে পারবে আর শিশুদের জন্যও কিছু বাড়তি খরচ করতে পারবে। কিন্তু তার চাকরি করা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অশান্তি শুরু হলো। রজনী সকালে শ্বশুরবাড়িতে রান্নাবান্না কাপড় ধোওয়া ইত্যাদি অনেক কাজ করতো।তার শাশুড়ি আর ননদরা প্রায় কিছুই করতো না।এখন তাদের গাত্রজ্বালা শুরু হলো।
কিন্তু রজনী অনড়। দরকার হ'লে স্বামীকে নিয়ে সে
আলাদা ঘরসংসার করবে, কিন্তু চাকরি ছাড়বে না।
স্বামী তার মেনি- মুখো।সে তার মায়ের কথার অবাধ্য হ'তে পারলো না।এখন তাকে স্বামীর ঘর ছাড়তে হবে অথবা চাকরি ছাড়তে হবে।যখন তার স্বামী তার কথা শুনলো না, সে নিজের পথ বেছে নিল। যখন তার উপর নানা রকম অত্যাচার হতে লাগলো, তাকে নানারকম মিথ্যা অপবাদ দিতে লাগলো তার শাশুড়ি আর ননদরা, তার অসহ্য হ'য়ে উঠলো ও বাড়ি। সে তার অপদার্থ স্বামীকে প্রকাশ্যে তালাক দিলো আর তালাকপত্র সই ক'রে তা স্বামীর মুখে ছুঁড়ে মারলো আর ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
সে জগদীশের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে তার ঘর ছাড়লো আর তার নিজের শিশু শিক্ষালয়ে এসে উঠলো।দু'চার দিনের মধ্যেই তার নিজের পাড়ায় সে একটা ছোটখাটো ঘর ভাড়া নিলো আর তার চাকরি ও তার শিশু শিক্ষালয়ের কাজকর্ম চালাতে লাগলো।
এখন সে স্বাধীন।এখন তাকে কারো মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না। ঘরের বাইরেও তার অনেক কাজ ও পরিচিতি বেড়েছে।সে তার ইচ্ছামতো খরচ করতে পারে।অসহায় বাচ্চাদের ও দুর্গতদের সাহায্য করতে পারে।এতে তার আনন্দ হয়।আর তার মনে হয় তার বাবা মা তাকে পরোক্ষ থেকে আশীর্বাদ ক'রে যাচ্ছে।ধনী বাড়ির বৌ হ'য়ে তাকে ঝিয়ের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে না। এটাই তার বড়ো পুরস্কার।
জগদীশের মা বাবা অন্য এক ধনী পরিবারের মেয়ের সাথে তার ছেলের যখন আবার বিয়ে ঠিক করলো , তখন জগদীশ তার ভুল বুঝতে পারলো। সে রামদার কাছে এসে তাকে ধরলো, রজনীর কাছে ফিরে আসার জন্য।কিন্তু রামদা অসহায়। সে কথা দিতে পারলো না। রজনী তার সেই প্রস্তাব ক্রোধে তুচ্ছভাবে প্রত্যাখান করলো। রামদা রজনীকে জানে।সে জেদী ও আত্মবিশ্বাসী মেয়ে।জগদীশ বাড়ির চাপেই অন্য মেয়ের সাথে আবার গাঁটছড়া বাঁধলো।
কিন্তু নারী পুরুষের সম্পর্ক প্রকৃতির এক আদিম টান। রজনী তার বয়সী পাড়ার এক যুবককে পছন্দ করলো।তার সম্পর্কে রামদার কাছে ভালো ক'রে খোঁজখবর নিলো। সে গ্র্যাজুয়েট ,সচ্চরিত্র।এখনও চাকরি পায় নি । সে আর তার মা এক সঙ্গে থাকে।আর বাড়িতেই কিছু টিউশন পড়ায়। সে রামদার এক দূর সম্পর্কিত ভাই। সেই অবিবাহিত পুরুষকে পছন্দ ক'রে তার মায়ের কাছে রামদার মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠালো আর তার ছেলেকেও বলতে বললো।তারা মা ব্যাটায় আলোচনা ক'রে এই প্রস্তাবে রাজী হলো। একদিন রামদার উপস্থিতিতে তাদের সাক্ষাৎ ঘটানো হলো রজনীর বাড়িতে।রজনী পাত্রকে বললো, আমাকে কি তুমি পছন্দ করো আর বিয়ে করতে ইচ্ছুক ? পাত্র তার সম্মতি জানালো।রজনী আবার জানালো, আগে আমার একবার বিয়ে হয়েছিল আর তার সাথে আমার তালাক হয়েছে।তবুও কি তুমি ইচ্ছুক। পাত্র সম্মতি জানালো। রজনী আবার বললো, তবে তার শর্ত হলো, তুমি আমার চাকরি করা বা শিশু শিক্ষালয় চালানোর জন্য আপত্তি করতে পারবে না। এই একটি কারণেই আমার আগের স্বামীর সাথে তালাক হয়। বাদল মানে পাত্র বললো , মাথা খারাপ ! এ যুগে চাকরির জন্য সবাই ঘুলিকানা হচ্ছে, আর আমি চাকরি ছাড়তে বলবো ? এ সবে আমার কোনো আপত্তি নাই , বরং জোরালো সমর্থন আছে। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো জরুরী। ছেলের মাও হাজির ছিল।তাঁর মত জানতে চাইলে তিনিও আপত্তি করবেন না জানালেন।এবার রজনী আবার বললো, বেশ। তোমার কোনো প্রেমিকা নাই তো? বাদল একটু অপ্রতিভ হ'য়ে বললো, না ,আমার ওসব কিছু নাই। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ব্যস, কথা চূড়ান্ত হলো। অতিথিদের মিষ্টিমুখ করানো হলো।আবার রামদার উদ্যোগেই শুভ পরিণয় সম্পন্ন হলো।
এখন রজনীর স্বামী বাদল দাস ঘরসংসার সামলায় আর টিউশন করে । রজনী তার প্রাইমারীর চাকরি ও শিশু শিক্ষালয়ের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে এতো দিনে সুখের মুখ দেখলো। এখন সে আরো তার মা -বাবার জন্য গর্ব অনুভব করে। শাশুড়ীর যত্ন করে।স্বামীর সাথে অন্তরঙ্গ হয়। একজন মেয়ের সেরা আনন্দ তার মা হওয়া। এবার সে নিজেদের সন্তানের প্রয়োজন উপলদ্ধি করলো।
----------------------
বদরুদ্দোজা শেখু
18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।