জয় জগন্নাথ
সুচন্দ্রা বসু
কথাতেই আছে বাঙালির বারোমাসে তের পার্বণ। লক্ষ্মী পুজো, ইতুপুজো,শুক্রবার শুক্রবার সন্তোসী মায়ের পুজো বিপত্তারিণী,মনসা পুজো,শীতলা পুজো।কত রকমের ষষ্ঠীর পুজো,শিবরাত্রি নন্দ উৎসব নিয়ে মায়েরা ব্যস্ত থাকত ছেলেবেলা থেকেই মা ঠাকুমাদের এইসব ব্রত উদযাপন করতে দেখেছি। মাঝে মাঝে শুনতাম আজ উপোস। ব্রত পালন শেষে লুচি মিষ্টির ব্যবস্থা থাকত সেদিন।তাতেই ছিল আমার আকর্ষন।
পুজোর মধ্যে সন্তোসীমায়ের উপোসেই দেখেছি মিষ্টি, ফল, টক খাওয়া বারণ ছিল। তাই তাতে আমার কোন আক অর্থষণ ছিল না। উৎসবের দিনগুলোতে ইস্কুলে যেতে হত না। সেটা আনন্দের ছিল। সন্তোসীমায়ের পুজো ছাড়া অন্য পুজোগুলোতে আকর্ষণ ছিল ফল মিষ্টি খাওয়ার লোভে।
রথ যাত্রা এলে তো দারুণ মজা হত।
সে সময় পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়ত।কি সুন্দর করে সেইসব রথ সাজিয়ে বের করত।কেউ ফুল দিয়ে আবার কেউ রঙিন কাগজ দিয়ে সাজিয়ে বিকেলে কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে পাড়ায় ঘুরতে দেখতাম। এই রকম ছোট ছেলেমেয়েদের রথ টানতে দেখে আমারও সাধ জাগে রথ সাজিয়ে পাড়ায় ঘুরতে। কিন্তু মা বাবা দিত না বলে আমার মন খারাপ হতো। বাড়িতে ঠাকুমার কাছে যথারীতি বায়না জুড়ে দিলাম। জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা আলমারিতে বন্দি কেন থাকবে।তোমারা ওদের বের করে রথে বসিয়ে পুজো কর।বলতেই রথ তৈরি করার ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ঠাকুরদার। তিনি বলেন ছোটদের আনন্দ না হলে উৎসব সম্পূর্ণ হয়না। তার যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কিন্তু সেই রথ তৈরি করবে কে? ভাবতে
ভাবতে এগিয়ে গেলেন পাড়ার আব্বাস আলির কাছে। তাঁর হাতেই গড়ে উঠল প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার রথ।
প্রলয় বিশ্বাস ছিল ব্রাহ্মণ।প্রতি বছর এই বিশ্বাস বাড়িতে জন্মাষ্টমী উৎসব ধুমধাম করেই হত ।
রথটি দেখে প্রলয়বাবু বলেন কি নিখিল এবার কি রথযাত্রা করবে?
ঠাকুরদা শুনে হেসে বলেন কি আর করব প্রলয়
নাতনির আবদার। ও তুমি বুঝবে না। তোমার তো
আর নাতনি নেই।
প্রলয়বাবুর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না।
প্রলয়বাবু শুনে বললেন তা ভালো কর।
তোমার এই রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার সঙ্গে থাকবে আমার গোপাল।
ঠাকুরদা খুশি হয়ে বলেন তাহলে তো ভালোই হয়।
প্রলয়বাবুর বাড়িতে গোপাল অনেকদিন ধরেই রয়েছে। কিন্তু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা ছিল না। কাঠের তৈরি, এই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে ঠাম্মার খেলার আলমারিতে সাজিয়ে না রেখে এই মূর্তিগুলোকে রথে অধিষ্ঠান করতে চাইলাম আমি।আমার কথা শুনে ঠাম্মা প্রথমটায়
আপত্তি করলেও পরে ঠাকুরদার কথায় রাজি হয়ে গেলেন।ঠাকুরদা ঠাকুমাকে বললেন।বেছারারা কতদিন আর আলমারিতে বন্দী হয়ে থাকবে? ওগুলো বের করে দাও রথে চড়ে গায়ে একটু বাইরের হাওয়া লাগিয়ে আসুক।
ঠাকুরদা ঠাকুমাকে বলে প্রলয় বলেছে রথের দিনে তাদের গোপাল আসবে আমাদের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে যেতে ।
সোজা রথের দিনে গোপালকে এনে প্রলয়বাবু বসিয়ে দিল একদম উপর তলায়। মাঝের তলায় ওদের তিনমূর্তিকে বসিয়ে ঠাকুরদার ও তার বন্ধুর সাথে আমি ওই রথ নিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ ঘুরে বিশ্বাস বাড়ি এসে থামলাম।এই রথ যাত্রায় আমাদের সাথে কীর্তনের দলও ছিল।পাড়ার ছেলেরা চপ পাঁপড় ভাজার স্টল দিয়েছিল। রথের দিন আমাদের বাড়ি থেকে খিচুড়ি ভোগ বিতরণকরা হয়েছিল। প্রলয়বাবুর বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় ভক্তদের লুচি সুজি নাড়ু দেওয়া হয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশি অনেকেই সেদিন রথ যাত্রায় আমাদের সাথে পথে ঘুরেছিল। একসাথে খাওয়া দাওয়া করেছিলাম সকলেই। আব্বাস আলিও ছিল। খুশি হয়ে সে বলেছিল এই কর্মযজ্ঞে থাকতে পেরে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।
ঠাকুরদা শুনে বলল, ভাগ্যিস তুমি এই রথটি বানিয়ে দিয়েছিলে তাই আজ এই উৎসবে আমরা সকলে আনন্দ করতে পারলাম। জয় জগন্নাথের জয়।
=================
সুচন্দ্রা বসু
২৬৭/৫ জি.টি.রোড। পানপাড়া
হুগলি শ্রীরামপুর।