গল্প ।। বিরহে মিলন ।। রণেশ রায়
বিরহে মিলন
রণেশ রায়
মেয়েটি ডানাকাটা পরী নয়। অংক মেপে সুন্দরী নয়। তবে অসুন্দর নয়। বরং আকর্ষণীয়। ছিম ছাম উজ্জ্বল সপ্রতিভ । কথা বার্তায় নম্র অথচ কঠিন। স্মিত ভাষী। ধীরে সুস্থে সংযত থেকে কথা বলে। প্রতিটি কথায় আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে। এম এ পড়ে। প্রথম বেঞ্চের ছাত্রী নয়। তবে পড়াশুনায় আগ্রহী। বই ছাড়াও চিন্তার জগৎটা প্রসারিত। ঘটে যাওয়া ঘটনা সব মেনে নেওয়ার পাত্রী নয়। সংস্কার বা চাপিয়ে দেওয়া রীতি দিয়ে কোন কিছু মেনে নিতে রাজি নয়। যুক্তি দিয়ে বুঝতে আর বোঝাতে চেষ্টা করে। মায়ের সঙ্গে শহরের এক প্রান্তে একটা পল্লীতে তার বাস। মা একটা স্কুলে পড়ান। অবসরের প্রায় সময় হয়ে এলো । বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। বাবা বাড়িতে থাকেন না। মেয়েটি অল্প বয়েস থেকেই বাবা ছাড়া। বাবা থেকেও নেই। মা একই সঙ্গে দুজনের ভূমিকায়। বাবা মায়ের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল বিচ্ছেদ কেন তা সবটা মেয়েটি না জানলেও জানার চেষ্টা যে না করে তা নয়। ছোটবেলায় এ নিয়ে সে বিভ্রান্ত থাকলেও এখন আর সেটা তাকে বেঁধে না। বিষয়টা ওকে আগে পীড়া দিত। তবে এখন ও এটা নিয়ে তেমন ভাবে না। যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। এক কালের বিড়ম্বনা বোধটা আজ অনেকটাই দূর হয়েছে। বাবার অভাব যে ও অনুভব করে না তা নয়। তবে যতটা জেনেছে তাতে মনে হয় এটা হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। এর জন্য ও কাউকে দোষ দিতে রাজি নয়। আর মা তো বাবাকে কখনো দোষ দেন নি । বরং বাবার প্রশংসাই করেন। এখন বড় হয়ে অনেক দেখে শুনে সে সংসারের এই সত্যটা বুঝেছে। দুজন মহিলা পুরুষের মধ্যে নানা কারনে মানিয়ে চলায় অসুবিধে থাকতে পারে। দুজন দুটো পৃথক সত্তা পৃথক ব্যক্তিত্ব পৃথক ভাবনা চিন্তা। যতক্ষন না সংসারের টান পোরেনে বিরোধ বা পৃথকতার প্রাচীরটা সংসার নদীর খেয়া ডিঙোতে বাধা হয় ততক্ষন চলে। এখানে কে কত oiটা ছাড়বে সমাজের বাধানিষেধ তাদের মননকে একসঙ্গে থাকতে বাধ্য করবে তার ওপর নির্ভর করে সংসারের আঙিনায় দুজনে বাঁধা থাকবে কি না। যার যার আত্মসত্তাবোধ, তার জীবনবোধ আর সমাজের বাধা নিষেধের ওপর সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। অনেক সময় দেখা যায় হাজার তিক্ততার মধ্যে না চাইলেও সম্পর্কটা আনুষ্ঠানিকভাবে টিকে থাকে, নানা কারনে ভারসাম্য বজায় থাকে। আবার অনেক সময় তিক্ততা সে পর্যায়ে না থাকলেও সম্পর্কটা ভেঙে যায়। সংসারটা টিকে থাকার শর্ত হিসাবে ভারসাম্যটা সবসময় নাও থাকতে পারে। সম্পর্কটা স্থিতিশীল নাও হতে পারে। যে বন্ধুত্বের বাঁধন তাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে তা নানা কারণে আলগা হতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের আজকের যুগে এটা স্বাভাবিক। তাই আবেগ দিয়ে সমাজের গেরো দিয়ে একে বুঝলে চলে না। চপলা সেটা ভাবে। মেয়েটির নাম চপলা। আজকের মত শান্ত নয়, শৈশবে ও চঞ্চল ছিল বলে ওর বাবা ওকে ওই নামটা দিয়েছিলেন বলে সে মায়ের কাছ থেকে জেনেছে।
রুমেলা চপলার বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে একইসঙ্গে পড়ে। চপলার মত বুদ্ধি-দীপ্ত না হলেও দেখতে সুন্দরী সন্দেহ নেই। বন্ধুত্বটা বেশিদিনের নয়। অল্পদিনের হলেও বন্ধুত্বের বন্ধনটা ইতিমধ্যেই জমি পেয়েছে, বেশ শক্তপোক্ত হয়ে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছে। একে অপরের অভাববোধটা আরো বেশি বেশি করে অনুভব করে চলেছে। রুমেলাও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পুরোনো কলকাতায় সে নিজেদের বাড়ির পাশেই মামাদের যৌথপরিবারে বড় হয়েছে। মামা মামীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সবাই মিলেমিশে থাকে। রুমেলার এক নিজের ভাইও আছে। ও বাড়িতে চপলা প্রায়ই যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি দূরে নয়। তাই চপলারই রুমেলার বাড়িতে বেশি যাতায়াত। রুমেলার মামার বাড়ির সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা গড়ে উঠেছে। এখনো রুমেলার বাবা নেই। কাকা ওদের সঙ্গে থাকে। তবে উনার সঙ্গে চপলার আলাপ হয় নি। উনি নাকি বেশিরভাগ সময় কাজে কম্মে বাইরে থাকেন। চপলা যখন যায় তখন উনি থাকেন না। তাই আলাপের সুযোগ হয় নি। তবে চপলা লক্ষ্য করেছে যে কাকার কথা উঠলে রুমেলা সব বলতে চায় না। বিশেষ করে কোথায় কি কাজ করেন সেটা সম্পর্কে রুমেলার মুখে কুলুপ। তবে সে কাকাকে বাবার মতোই খুব শ্রদ্ধা করে সেটা বোঝা যায়। আবার একটা চাপা ক্ষোভও রুমেলার মধ্যে ও লক্ষ্য করেছে। ক্ষোভটা কেন তা চপলা আন্দাজ করতে পারে না। হয়তো কাকার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক নিয়ে বাজারে যে গুজব তা নিয়ে ক্ষোভ। আবার হতে পারে কাকা যা করেন সেটা ও পছন্দ করে না। তবে শ্রদ্ধা কেন ? চপলা দ্বন্দ্বে পড়ে । এটা তাকে ভাবায় । তবে ও রুমেলার সঙ্গে একটা ব্যাপারে একাত্ম বোধ করে। ওর বাবা মারা গেছেন। আর ওরও বাবা থেকেও নেই। দুজনের অভাবের জায়গাটা একই। দুজনের অভাবের জায়গাটায় মিল থাকলেই বন্ধুত্বের বন্ধনের ভিত্তিটা দৃঢ় হয়। বন্ধুত্বের জমি উর্বর হয়।
রুমেলার মা চপলার মায়ের মত নন। কম কথা বলেন। বাবাকে নিয়ে কথা উঠলে বেশি কথা বাড়াতে চান না। কোথায় যেন একটা ক্ষোভ। উনি সংসারের প্রতি কিছুটা উদাসীন বলেই বোধহয়। যতদিন ছিলেন সংসার দেখেন নি। বরং কাকাই সেটা করেছেন। কাকার প্রতি মায়ের একটা দুর্বলতা। আর দুজনে সমবয়সী। রুমেলার মায়ের স্নেহের পাত্রী হয়ে উঠেছে। মামা মামী সবার মন কেড়েছে। মামার বাড়িতে বাচ্চাদের ও পেয়ারের দিদি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোটমামার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা। ঘনিষ্ঠতা ঘনতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর যেন এ বাড়ির সঙ্গে একটা আত্মীয়তা বোধ নিজের অজান্তেই দানা বাঁধছে। ছোটমামা বছর চারেকের বড়, প্রাণচঞ্চল মানুষ। চাকুরী করে। নাটক থিয়েটার পাগল। প্রথম প্রথম চপলা রুমেলাকে সংগ করে ছোটমামার সঙ্গে নাটক থিয়েটার দেখতে যেত। যেন ছোটমামার ফ্যান। এখন রুমেলাকে বাদ দিয়ে কিছুটা লুকিয়ে মামার সঙ্গে নির্ঘন্ট ঠিক করে। রুমেলার এটা চোখ এড়ায় না। ও মজা পায়। কিছুটা প্রশ্রয় দেয় এমন কি সুযোগ করে দেয়। মামা ওকে সঙ্গে যাবার কথা বললে ও কোন অজুহাত দেখিয়ে গররাজি হয়। চপলাকে একা পাবার সুযোগ মামা ছাড়ে না। এখন নাটকের চৌহদ্যির বাইরেও দুজনের গমনাগমন। আজকাল ক্লাশ শেষ না হতেই বাড়ি ফেরার তারা। রুমেলা বোঝে ও হাতির বাড়ি যায়। মামাকে কোথাও সময় দেওয়া আছে।
এমনি করে চপলার চলে। ক্লাস কেটে বন্ধুদের ফাঁকি দিয়ে রেষ্টুরেন্টে ময়দানে বা গঙ্গার পারে । মধ্যে মধ্যে নাটক সিনেমা দেখতে। মামার কল্যানে দেশের রাজনীতির খবর কিছু রাখে। আগুনের তাপ লাগে। মন রেঙে ওঠে পুরুষ স্পর্শে। ভয় পেলেও নিজেকে সসঙ্কোচে সমর্পণ করে, এক সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়। অচেনা বাবাকে মনে পড়ে। মায়ের কাছে জেনেছে মায়ের সাথে বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাপ। তারপর প্রলাপ। ওরাও ছাত্রজীবনটা এইভাবে কাটিয়েছে। বাবা নাকি আদর্শবান পুরুষ ছিলেন। নিজের জীবনে আজ এই মানুষটাকেও আদর্শবান মনে হয়। চপলা পুলকিত হয়। কিন্তু তারপরই একটা চাপা কান্না, একটা অজানা ভয়। মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বাবা মাও তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। বাড়িতে আপত্তি থাকা সত্তেও মাকে এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে হয়। তখনকার দিনে এটা ছিল একটা মেয়ের পক্ষে কঠিন যুদ্ধ। আজ সময় বদলেছে। তাকে হয়তো তেমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। কিন্তু তাও তার ভয়। বাবা মায়ের মধ্যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলো, বিয়ে হলো, মেয়ে হলো, তারপরও সম্পর্কটা টিকলো না। সেই তুলনায় তো তারা সহজে পরস্পরকে পাচ্ছে। টিকবে তো ! সহজে পাওয়া কিছু সহজেই হারায় বলে প্রবাদ আছে। সে শঙ্কিত হয়ে ওঠে।যেন একটা অনিশ্চয়তার ধোঁয়া কুন্ডুলি পাকিয়ে উঠতে থাকে ! সঙ্গে অবিশ্বাসের আতঙ্কটাও ! কেমন যেন আত্মবিশ্বাসের অভাবটা উঁকি মারে। চপলা নিজের ওপর বিশ্বাসটা ফিরে পেতে সচেষ্ট হয় l এক্ষুনি বিশ্বজিৎ মানে ছোটমামা আসবে। ও নিজেকে ফিরে পায়। বিশ্বজিৎ সময় ধরে আসে। ওরা দুজনে মুখোমুখি। ওদিকে রুমেলা ঠিক করেছে আজ একটু মজা করবে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ আর কি । ওদের স্বরনালি সন্ধ্যাটা তেতো করে দেবে। সন্ধ্যার পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় অমাবস্যার অন্ধকার নামিয়ে আনবে। ও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দুই বন্ধু অরূপ আর সমীরকে নিয়ে চপলাকে অনুসরণ করে। চপলা যেখানে দাঁড়িয়ে তার একটু দূরে অপেক্ষা করে। মামা আসতে ওরা গুটি গুটি ওদের কাছে গিয়ে উপস্থিত। চপলা অবাক হয়। জানতে চায় ওরা কোথায় যাচ্ছে। মুখে চোখে অস্বস্তি। মামা অরূপ বা সমীরকে চেনে না। সমীর একটু চ্যাংড়া। সে চপলাকে উদ্দেশ্য করে বলে :
কি রে ! ছুপে মাস্তানি ? বাড়ি গেলি না?
চপলা আর কি করে ! আমতা আমতা করে বলে :
চল সবাই মিলে চা খাই। সবাই মিলে চায়ের দোকানে ঢোকে। চপলার মুখে নৈরাশ্যের ছায়া। মামার অবস্থাটাও তথৈ বচঃ । ভাবে বিকেলটা মাঠে মারা গেল।
চপলার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। মা সুনীতা দেবী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। আজকাল চপলার দেরি করাটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আজকে মেয়েদের রাস্তাঘাটে নিশ্চয়তার অভাবের কথা ভেবে মায়ের শঙ্কা হয়। উনি মেয়ের চলাফেরায় যে পরিবর্তনটা এসেছে লক্ষ্য করেন। দেরির কারন জানতে চাইলে মেয়ে অপ্রয়োজনে আজকাল উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই বয়সে এই প্রতিক্রিয়ার কারণটা উনি আন্দাজ করেন। তাঁর দুশ্চিন্তা তাকে নিজের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। স্মৃতি এসে তার সঙ্গে আলাপে বসে। সেই কলেজ জীবনে অনির সঙ্গে লুকিয়ে আড়ালে আবডালে পায়ে পায়ে চলা। তখন আজের মত চলার পথ তেমন মসৃন ছিল না। কন্টকিত সে পথ। কাঁটা বিঁধে পা রক্তাক্ত হত। অজানা আশংকায় মন কাঁপত। কে কখন দেখে ফেলে ! জানাজানি হয়ে যায় ! আজ চপলাদের সে সমস্যা তেমন নেই। মায়ের মনে হয় হয়তো চপলাও আজ নিজেকে সেভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে মেয়েকে কিছু বলে না। এসব হিজি বিজি ভাবতে ভাবতে চপলা এসে উপস্থিত। ভাবনার জগতে ছন্দ পতন ঘটে l মেয়ে আজ যেন বিষন্ন। শরীর খারাপ নাকি? মা জিজ্ঞেস করে। মেয়ের চোখ বলে দেয়, কেন এসব অযাচিত প্রশ্ন ? যেন মা-ই কোন দোষ করেছেন। মেয়ের এই ঠান্ডা ব্যবহারে সুনীতা দেবী বিরক্ত হলেও কিছু বলেন না। তিনি অশান্তি যতটা পারেন এড়িয়ে চলতে চান। মেয়ে তার ঘরে চলে যায়। আবার মায়ের স্মৃতির জগতে বিচরণ। চপলার চার বছর বয়েসেই বাবার এ সংসার থেকে বিদায়। তার পর থেকে মেয়ে তাঁর ছাঁয়া সঙ্গী। মানুষ হিসেবে অনির তুলনা হয় না। উনি এখনো মনে করেন। তবে তার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর তাগিদে সংসার উপেক্ষিত হত বলে সুনিতা দেবীর বিশ্বাস। সেই নিয়ে দুজনের মতপার্থক্যের সূত্রপাত। অনিন্দ তাঁর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কাজের জন্য একেকদিন বাড়িতেও ফিরতে পারতেন না। এই অবস্থায় দুজনেই আলোচনা করে বিচ্ছেদের পথে যান যাতে দুজনের ব্যক্তিগত পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কটা খারাপের দিকে না যায়। সুনীপার মনে পড়ে অনিশ বাবু অরফে অনি তাঁকে আবার বিয়ে করার অনুরোধও করেন। তাঁর এক বন্ধুকে যাকে সুনিতা খুব পছন্দ করত তাঁকে পাত্র হিসেবে প্রস্তাবও দেন তিনি। সুনিতার সব মনে পড়ে। বিচ্ছেদের পর তিনি আবার বিয়ে করেন বলে সুনিতা শুনেছেন।
রাত দশটা নাগাদ মা মেয়ে দুজনে খাবার টেবিলে। রোজ এই বেলায় দুজনের যত মনের কথা। মা মেয়ে তখন পরস্পরের বন্ধু। মনের গোপনে থাকা কথা আর গোপন থাকে না। ভাষা পায়। স্নান করে ঘরওয়া পোশাকে চপলার শরীর মন দুটোই চাঙা। জড়তা কেটে গেছে। হয়তো বুঝেছে ঘরে ঢুকে তার ওরকম আচরণ টা ঠিক ছিল না। সেটা পুষিয়ে দিয়ে মাকে খুশি রাখতে ও আজ একটু বেশি তৎপর। এমনও হতে পারে যে তার কোন প্রস্তাবে মা'কে রাজি করাবার এটা কৌশল। এই কৌশলটা চপলা প্রায়ই নিয়ে থাকে। দুজনের মধ্যে কথা শুরু হয়। রুমেলা রুমেলার বাবা কাকা মা সবার কথা। রুমেলার সএ ছোট থাকতেই বাবা মারা গেছেন। কাকা যেন বাবার জায়গা নিয়েছে। তবে বর্তমানে তাকে বেশি দেখা যায় না। রুমেলার কাকার খবরে রহস্যের ছোঁয়া। কি করেন সংসারে তাঁর ভূমিকা কি কোনটাই স্পষ্ট নয়। সে ব্যাপারে মা মেয়ে দুজনের নীরবতা তাদের ঔৎসুক্য বাড়িয়ে দেয়। একটা খবর বাতাসে উড়ে বেড়ায়। বাবা মারা যাওয়ার পর মা কাকাকে নিয়ে থাকেন। চপলা কিন্তু তাকে কাকা বলেই জানে। দুজনের বিয়ের রটনা সে বিশ্বাস করতে চায় না। বিষয়টা তাকে যন্ত্রণা দেয়। তবে কাকা তাকে মেয়ের মতই ভালোবাসেন। চপলা রুমেলার মায়ের ব্যাপারে উচ্ছসিত। তাঁর কথা উঠলে থামতে চায় না। যেমন ভালো রান্না করেন তেমন ছবি আঁকেন। জীবনে স্বামীকে বেশিদিন পান নি। কাকার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কানা ঘুষতেও তাঁর কিছু আসে যায় না যেন। রুমেলার বাবা তাঁর প্রথম স্বামী । তিনি মারা যাওয়ার পর কাকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে যে ধোঁয়াশা তা নিয়ে মায়ের ঔদাসীন্য রুমেলাকে অস্বস্তিতে ফেলে সন্দেহ নেই। মা যেন এই কলঙ্ক নিয়েই বাঁচতে চায়। তবে কাকা তো এখন বাড়িতে থাকেন না বললেই হয়। এতেও মায়ের কিছু আসে যায় না। নানা কথার মধ্যে চপলা মামার কথা তোলে। আগে সুনিপা দেবী মামা বিশ্বজিতের কথা বহুবার শুনেছেন। না চাইতেই কথার ছলে ওর কথা বার বার শোনায় মায়ের মনে সন্দেহের মেঘ জমেনি তা নয়। তবে সে মেঘে বজ্রের গর্জন যেমন নেই তেমনি তাতে বর্ষার বার্তাও থাকে না। সুনিপা দেবীর তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। তিনি বোধহয় অপেক্ষা করে যাচ্ছেন মেয়ে নিজের থেকে কবে কি বলে। মনে হচ্ছে আজ সেই বলার বেলা। তিনি মেয়েকে বলার সুযোগ করে দেন সুকৌশলে নানা প্রশ্ন তুলে। চপলা প্রশ্নের ফাঁদে পরে গড়গড় করে যা বলে তার সংক্ষিপ্ত সার হলো :
সে মানে চপলা রুমেলার মামা বিশ্বজিৎকে বিয়ে করতে চায়। ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ওদের বাড়িতে রুমেলার দিদা ছাড়া সবার মত আছে। অন্য বর্ণের পরিবার হওয়ায় দিদার অমত। তবে সেটা টিকবে না। মামারা কেউ জাতপাতের মধ্যে নেই। রুমেলার মায়ের বিয়ের সময়ও এরকম সমস্যা দেখা দিয়েছিল। রুমেলার মা তো এ বিয়েতে বিশেষ উৎসাহী। সেই আসবে সব কথা বলতে। ওদের ইচ্ছে দুবাড়ির যৌথ উদ্যোগে একদিনের অনুষ্ঠান হবে। রীতিনীতি যৎসামান্য যেটা না হলে নয় সেটা হবে। চপলা মায়ের মত জানতে চায়। মা আপত্তি করেন না। শুধু তিনি শুধু জানতে চান রুমেলার কাকার মত মত কি। উনিই তো এখন অভিবাবক। উনি নাকি মত দিয়েছেন। তবে থাকতে পারবেন কি না ঠিক নেই। বিয়েতে রুমেলার কাকা নাও থাকতে পারেন জেনে সুনীতাাদেবী আহত হন। ভাবেন এমন কি রাজকর্ম আছে যে উনি আসতে পারবেন না শালার বিয়েতে। না অন্য কিছু যেটা ওরা গোপন করছে। সুনীতা দেবীর ব্যাপারটা ভালো লাগে না। তবে তাতে কিছু আসে যায় না। আর উনার মামা ব্যক্তিটিকে তো ভালো লেগেছে। যদিও মাত্র দিন দুই দেখেছেন। রুমেলার সঙ্গে এসেছিল।
বিয়ের দিন এসে গেল। সন্ধ্যে বেলায় উভয় তরফের আত্মীয় পরিজন। পাত্র পাত্রী প্রস্তুত। অতি সাধারন ব্যবস্থা। জাঁক জমক তেমন নেই । মোট শ তিনেক মানুষ। পাত্র বিয়েতে বসার আগে এক ভদ্রলোককে দেখা গেল অল্পবয়স্ক কয়েকজনের মধ্যে। তিনি যেন একটু আড়ালে থাকতে চান। রুমেলার মা একান্তে তাঁকে চপলার কাছে নিয়ে যান। আলাপ করিয়ে দেন। চপলা জানতে পারে তিনি রুমেলার কাকা । তার এতদিনকার ঔৎসুক্য মেটে। ভদ্রলোককে আর বেশিক্ষন বিয়ে বাড়িতে দেখা যায় না l দূর থেকে চপলার মা সব দেখেন। ভদ্রলোককে দেখে একটু চমকেই ওঠেন। বিশেষ পরিচিত মনে হয়। লক্ষ্য করেন উনাকে ঘিরে একটা চাপা উত্তেজনা, একটা গুঞ্জন। রহস্যটা যেন অন্য মোড় নেয় চপলার মায়ের কাছে। এ নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। তবে কাউকে বুঝতে দেন না। ভালোয় ভালোয় বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয় l
আজ একাকীত্ব তাকে যেন গ্রাস করেছে। যাকে সে ইদানিং প্রায় ভুলতে বসেছিল আজ মেয়ের বিয়েতে সে হানা দেয়। মনের বন্ধ দরজাটা আজ খোলা হাট। স্মৃতিতে অতীতের যাতায়াত অবাধ। তবে সকলের এই যখন তখন আবির্ভাব তাঁকে বিব্রত করে। খালি বিছানাটা তাকে অতীতে নিয়ে যায়। সে যেন একজনের জন্যই অপেক্ষা করে বসে থাকে। স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় কখনো তাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে কখনো কফি হাউসে। তার মনে পড়ে অনিন্দর সঙ্গে প্রথম আলাপ। অল্প সময়ে তা প্রলাপে পরিণত হয়। ক্লাস কেটে নাটক সিনেমা বা ফাঁকা পার্কে ময়দানে। সেই সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তখন স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে। ছাত্র আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। দুটো বিপরীত ভাবনা ছাত্রসমাজকে আন্দোলিত করে। অনিন্দ সশস্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্রকৃত স্বাধীনতা আসা সম্ভব বলে মনে করে। সুমিতার তাতে সংশয় । যদি অহিংসার মাধ্যমে সেটা সম্ভব হয় ক্ষতি কি? বরং সেটাই কাম্য । আবার অনিন্দদের যুক্তি সে একেবারে নস্যাৎ করতে পারে না। ইংরেজরা কি আপনাআপনি দখল ছাড়বে? এ নিয়ে দুজনের মধ্যে মতপার্থক্য । অনিন্দ যেন একটু বেশি উগ্র হয়ে ওঠে । দোটানার মধ্যে দুজনের চলে। এরপর দেশভাগ স্বাধীনতা। অনিন্দরা এ স্বাধীনতা মানে না।
কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে তারা সংসার জীবনে ঢোকে। সুনিপা একটা স্কুলে চাকুরী করে। অনিন্দ চাকরি করলেও তার রাজনীতিতে ঝোঁক । সে ভারতে বাম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পরে। তখন রাষ্ট্রের চোখে বাম আন্দোলন অপরাধ । রাষ্ট্রের ভ্রুকুটি সত্বেও বাম আন্দোলন শিকড় গাড়ে। তাদের মেয়ে হয়। তবে সংসারের দিকে অনিন্দের তেমন মন নেই। সুনীতা কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলেও অনিন্দের তেমন বিরোধিতা করে না । বরং পরোক্ষে সমর্থন করে। একটা নৈতিক সমর্থন। তবে দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যায়। মেয়ের তখন চার বছর, অনিন্দ সুনীতার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয় । অনিন্দ কোথায় চলে যায়। সুনীতা বোঝে ও বৃহত্তর রাজনীতির স্বার্থে ঘরছাড়া। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ। মেয়ের পুরো দায়িত্ব তখন থেকেই সুনীতার। চপলা সেই থেকে একরকম পিতৃহীন । আজ বাবার চেহারাও তার তেমন মনে নেই।
বিয়ের বেশ কয়েকদিনন পর। চপলাদের বাড়িতে অল্পকয়েকজন আত্মীয় পরিজনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থ্যা হচ্ছে । রুমেলা চপলাদের বাড়িতে কাল থেকে । সবাই মেয়ে জামাইকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কিতে ব্যস্ত। সুনীতাদেবী তার ঘরে। কেমন যেন বিমর্ষ । সাধারণত এটা দেখা যায় না। উনি অনেক ঝড় ঝাপটার মধ্যেও স্থির থাকেন। কিন্তু আজ তাঁকে বিধ্বংস লাগছে। দেখলেই বোঝা যায় রাতে ঘুম হয় নি। অন্যমনস্ক ক্লান্ত। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একটা দুশ্চিন্তার ভাব। সকাল থেকে মেয়ের সঙ্গেও বেশি কথা হয়নি। চপলা সেটা লক্ষ্য করে। জানতে চায় মায়ের কি হয়েছে। সুনীতাদেবীর মুখ ফেকাশে হয়ে ওঠে। নিজেকে আড়াল করার জন্য 'না কিছু নয়' বলে মুখ ঢেকে সরে যান। চপলা আর কিছু বলে না। ভাবে সে চলে গেছে। মা একা হয়ে পড়েছে। বাবাও নেই। সেই কবে সম্পর্ক ছেদ করে চলে গেছেন। স্বভাবিকভাবে তিনি ভারাক্রান্ত। আর বেশি প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত না করাই ভালো। ভাবে চপলা। কিন্তু সুনীতা দেবীর মায়ের মনে যে পাথরচাপা একটা কান্না চেপে বসেছে তার খবর তিনি ছাড়া কেউ জানেনা না। বাড়িতে একটা বৈপরীত্যের পরিবেশের মধ্যে সকালটা কাটে। যত বেলা বাড়ে বাড়িতে বিষন্নতার ছায়াটা তত প্রসারিত হতে থাকে। মেয়ে সন্ধ্যেবেলায় চলে যাবে। এর মধ্যে সুনীতাদেবী নিজেকে গুছিয়ে নেন।
খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলের আগে চপলার মা কল্পনা সুনীতা দেবীর কাছে আসেন। সুনীতাদেবীর ঘরে আলাদা করে কিছুক্ষন কথা বলেন। তারপর দেখা যায় রুমেলা চপলাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। সঙ্গে সুনীতাদেবীও। একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা বেশ কিছুটা দূরে একটা বাড়িতে আসেন। তিনতলার দুকামরা একটা ফ্ল্যাট। চৌকিতে এক ভদ্রলোক বসে। সঙ্গে দুটি ছেলে। সকলে ঘরে ঢোকে। ভদ্রলোক সুনীতাকে দেখেন। দুজনে যেন পূরণ পরিচিত। সুনিতা বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না।
বেশ রাত হয়েছিল সুনীতা বাড়ি ফেরে। সঙ্গে চপলা। ও আজ মায়ের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু দুজনে বাড়ি ফিরে জানতে পারে বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। ওরা করো খোঁজ পেতে চায়। শমণ রেখে গেছে । সুনীতা যেন কাল দেখা করে। সুনিতা বোঝে ওরা কি চায়। সে নিশ্চিত হয়। পাখি উড়ে গেছে।
চপলার চোখে জল। বোঝে মা কেন বাবাকে কেন এত শ্রদ্ধা করেন l রুমেলার কাকার রহস্যটা কি। তিনি কেন বাড়ি ফেরেন না। সে বোঝে রুমেলার সঙ্গে তার সম্পর্কের বৃত্ত পূর্ণ হলোl এখন ওরা একটা বৃহত্তর পরিবারের সদস্য যে পরিবার চলতি সংসারের চৌহদ্দি পার হয়েছে বৃহত্তর লক্ষ্যে।
================