আলোর প্রতীক্ষায়
অশোক দাশ
সেদিন সম্ভবত জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ হবে। ব্যাংকে টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে দু'জন ভদ্র মহিলা নাগাড়ে কথা বলে চলেছে । তাদের কথোপকথন শোনা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। কারণ ক্যাশিয়ার বাবু এখনো তার কাজ শুরু করেননি।
-আরে কাবেরী না! তোর সঙ্গে কতদিন পর দেখা, বল কেমন আছিস?
-আর বলিস না, পায়ের ব্যথাটা আবার বেড়েছে, এই অবস্থায় কাশ্মীর যেতে হবে । প্লেনে যাবো, টিকিট কাটা হয়ে গেছে।
-তোর বর এখন কোথায়?
-কলকাতার বউবাজারে আমাদের পৈত্রিক ব্যবসা, সোনার দোকান। এই ব্যবসার জন্যই তো হুট করে কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনা। বল শ্যামলী তোর খবর কী?
-আমার কর্তা তো গত মাসে রিটায়ার্ড করেছে। ওতো হায়দ্রাবাদে থাকতো, এখন বাড়িতে। ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। ব্যাঙ্গালোরে পোস্টিং ওর ওখানে যাব বলেই ব্যাংকে এলাম। গত কয়েক মাস লক্ষী ভান্ডারের টাকা তোলা হয়নি। ভাবলাম কবে ফিরবো, টাকাটা তুলে নিয়ে যাই।
-আমিও তো একই পথের পথিক। বার্ধক্য ভাতার টাকাটা তুলতে এলাম।
ঠিক সেই সময়ে ছিন্ন বসন পরিহিতা, শীর্ণ মলিন মুখে একজন প্রায় সত্তরোর্ধ্ব বিধবা রমণী কাউন্টারে পাস বই দিয়ে বলতে থাকে, বাবু এই বইটা একটু দেখে দাও না, কোনো টাকা পয়সা এসেছে কিনা? বড় অভাব গো বাবুরা া কত বড় লোকের বাড়ির বউরা মাসে মাসে লক্ষী ভান্ডারে টাকা পাচ্ছে ,পেনশন পাচ্ছে ,আর আমার মত সহায় সম্বলহীনা মহিলাকে এদোর ওদোর করে ঘুরে ঘুরে মরতে হচ্ছে। পায়ের জুতো ছিঁড়ে গেল, তবু টাকা পেলাম না।
- আপনার একাউন্টে কোন টাকা ঢোকেনি বললেন ক্যাশিয়ার বাবু।
একরাশ হতাশায় সেই বৃদ্ধ কপাল চাপড়াতে লাগলো ।আর বলতে থাকে,সবই আমার অদৃষ্ট। তেলা মাথায় সবাই তেল দেয়, রুখু মাথার দিকে কেহ ফিরে তাকায় না।
মহিলার গমন পথের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে ভাবতে থাকি, কবে সমাধান হবে এই বৈষম্যের? কবে সমাজ দেবে এদের কান্না ঘামের দাম? কতদিন থাকবে এরা বঞ্চনার আঁধারে? কত ঝরবে বেদনার অশ্রু?
এইসব প্রশ্ন মাথার ভেতর কিলবিল করতে থাকে, জানি সূর্য অস্তাচলে গেলেও রাঙিয়ে দিয়ে যায় গোধূলি অস্তরাগ। কান্না হাসির ক্ষণস্থায়ী জীবনে আঁধার আছে, আছে আলো। সেই আলোর প্রতীক্ষায় দু নয়ন মেলেছি।
-------------------------
অশোক দাশ
ভোজান, রসপুর ,হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।