রাতের অন্ধকারে তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে সোহেলী আজ ভাবছিল তার অতীতের কথাগুলো। পাশের ঘর থেকে সুনয়নার এপাশ-ওপাশ শব্দ ,সঙ্গে স্বামী অখিলেশের নাক ডাকা শব্দ ।
আজ এই মধ্য রাত্রের আকাশের দিকে একা বারান্দায় তাকিয়ে থাকার ঘটনার কথা বেশ কিছুদিন আগেও ভাবতে পারতো না! কেননা সোহেলীর জীবন একটা সময় অনেক বারনের, মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বারান্দায় দাঁড়াতে পারবে না ,কোন সুপুরুষের সাথে কথা বলা চলবে না। বাপের বাড়িতে বাবা-মার কঠিন নির্দেশ ছিল। ভাবি স্বামী অখিলেশ ছাড়া অন্য কোন ছেলেদের সাথে কথা বলা একেবারেই চলবে না। স্কুল কলেজ সর্বত্র নিয়ম মেনে চলতে হয়েছে যাতে সতীত্ব বজায় থাকে। বামপন্থী পিতা ও এ বিষয়ে মাকে সমর্থন করত। ব্যতিক্রম ছিল তার ছোটবোন রুনা । এই নিয়ে সংসারে প্রচন্ড অশান্তি হতো বাবা-মায়ের সাথে রুনার । রুনা কলেজের বন্ধুকে বিয়ে করে চলে যায় তাদের ছোট্ট সাজানো সংসার ।
একাধিক সামাজিক কাজে সে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। আর্থিক অবস্থা তেমন নয় তবে ওদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধনটা ভীষণ ।
বাবা মার বাধ্য সহেলী ভাবতেও পারেনা নিজের ভালোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে যাবে।
মায়ের মামাতো বোনের ননদ শিক্ষয়িত্রী গায়ত্রী দেবী ছোটবেলায় সহেলীকে পছন্দ করেছিল তার একমাত্র ছেলে অখিলেশের জন্য। অকিলেশ পড়াশোনা খুব ভাল ছিল। খুব ভালো চাকরিও পেয়ে গিয়েছিল । এমএ পাস করার সাথে সাথেই সোহেলীর সাথে বিয়ে হয়ে যায়।
শিক্ষিত রুচিশীল পরিবার ছিল অখিলেশদের। সহেলী ভেবেছিল হাতে চাঁদ পেয়েছে। কেননা অনেক বন্ধুদের জীবন কাহিনি শুনেছিল, অনেকেই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীর ওপারে চলে গেছে! সহেলি ভয়তেই থাকতো।
কোনদিন প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি ।
নতুন বউ সংসারের সব দায়বদ্ধতা নিয়ে এসেছে সে ই সংসার কে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ যেন প্রত্যেক বাড়ির এক চিত্র!
বিয়ের পরপরই সংসারের হেঁসেলের দায়িত্ব সহেলীর হাতে পড়ে ।শ্বশুরমশাই সোহেলীর হাতে রান্না ছাড়া খেতে পারে না !
শাশুড়িকে সেবা করতে হবে যেহেতু একমাত্র পুত্রের মা সে !
সহেলী একসময় ভুলেই গেছিল সে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে! অখিলেশ চাকরির উপর তলায় উঠতে শুরু করল ।
এক সময় যেন সহেলি তার কাছে বস্তুতে পরিণত হলো!
তার একটাই কথা। তোমাকে সন্তান দিয়েছি স্ত্রীর পরিচয় দিয়েছি। আর কিছু পাওয়ার চেষ্টা করো না।
আমার চলার পথে বাধা হয়ো না।
দিনরাত পার্টি অফিস বন্ধু বান্ধব নিয়ে দিন কাটাতে লাগলো অখিলেশ । প্রায় সময় অফিসের ট্যুরে চলে যেত বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে কখনো বা এসে তাদের গল্প বলতো।
সহেলীর যে এসব ভালো লাগে না সে একান্ত ভাবে অখিলেশকে পেতে চায়। এ কথা কোনদিনই অখিলেশ বোঝেনি!
সহেলি বুঝে গেছিল এর থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র দরকার একটা ভালো চাকরি। বারবার কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিতে লাগলো সকলের চক্ষুর অন্তরালে।
একসময় চাকরিটা পেয়েও গেল। অখিলেশ আপত্তি করেনি ।
তা র স্ত্রী অধ্যাপিকা এ পরিচয় দিতে ভালই লাগতো। ইদানিং পার্টিতে নিয়ে যেতে চাইলে সহেলী রাজি হতো না।
সহেলি ততক্ষণে নিজের পরিচয় তৈরি করে ফেলেছে নিজের উপার্জিত টাকায় ফ্ল্যাট কিনেও ফেলেছে। অখিলেশ তার কাছে স্বামী হিসেবে থাকে মেয়ের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু বাইরের মাদকতা সে কোনদিনই ছাড়বে না।
এই মধ্য বয়সে সহেলীর জীবনে ডিভোর্সসি রাজীব এসেছিল একান্ত গোপনে ।কিন্তু সহেলি পারেনি তার ডাকে সাড়া দিতে । আজ বাবা মা সব জেনেও সহেলীকে অখিলেশের এর সাথে মানিয়ে নিতে বলে সামাজিক মর্যাদার কথা বলে। সহেলির জীবন যেন সামাজিক মর্যাদার ই সীমাবদ্ধ। তার নিজস্ব কোন পাওনা থাকতে পারে না! সে যে মেয়ে!
জীবনের মধ্য গগনে সহেলি আজ বড় একা! ক্লান্ত শ্রান্ত !প্রতিমুহূর্তের লড়াই যেন নিজের সাথে। রাজীব বারবার আসলেও তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবার ভয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রী সুনয়না কয়েকদিন আগে যখন বললো গরিব শুভকে বিয়ে করতে চায় !
প্রথমে অবাক হয়ে গেছিল তার সাহস দেখে। মনে মনে সুনয়নাকে সাপোর্ট করলেও অখিলেশ আর নিজের পদের পরিচয় অনুযায়ী সুনার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি!
অখিলেশের অফিসের কলিগের ছেলেকেই বিয়ে করে বিদেশে যেতে হবে সেই সিদ্ধান্তই জানিয়ে দেয় । সুনয়না ও বাধ্য মেয়ের মত মেনে নেয় । একটি মেয়েরও যে ব্যক্তিগত জীবন থাকা উচিত তা আজও এ সমাজ মেনে নেয় না প্রত্যেকেই যেন জীবনের সাধারণ সুরক্ষা খোঁজে জীবনের মধ্য গগনে জীবনের প্রকৃত মানে উপলব্ধি হলেও কোন কিছু করার থাকে না যেমন আজ সহেলীরও নেই !
-------------------------------
কলমেঃঃ মম মজুমদার