বাকবিভূতি
সৌমেন দেবনাথ
পল্লব যেমন শান্ত-শিষ্ট আর দেবোপম সমাজের চোখে, তার বন্ধু গগনপতি আবার তেমন বাকপটু, স্পষ্টভাষী, বাগাড়ম্বরপ্রিয়, কণ্ঠঝড়সর্বস্ব। অন্যের কথায় ত্রুটি পেলে গগনপতির বাকবহুলতা বেড়ে যায়। কথার ঝড়ে কুপোকাত করে দেয় তাকে। কেউ ভুল বললে যথোচিত জবাব দেয়, কেউ অযাচিত কিছু বললে সমুচিত জবাব দেয়। আর কেউ বাকচাতুর্য, বাকছল দেখালে বাকবিতণ্ডায় মেতে উঠে। বাকশক্তি প্রবল তার, তবে বাককলহ তার কাজ নয়। অন্যায্য দেখলে, অবিচার দেখলে, অন্যায় দেখলে বাকপ্রয়োগে প্রতিবাদ করে। অপপ্রচার করে কেউ কেউ তাকে তাই বাকসর্বস্বও বলে।
পল্লবের মতো মৌনালাপ করা তার দ্বারা হয় না। তার বাগবাগিশের উলঙ্গ শিখার সামনে বয়সে সম্মাননীয়, মেধায় সম্মাননীয় ভস্ম ভূতনাথ হয়ে যান। শ্রুতিমধুর বিবৃতি-ভাষণ তার থেকে আশা করা ভীষণ দুরাশা।
অনুচ্চস্বরের পল্লবের সাথে উচ্চস্বরস্বের গগনপতির বন্ধুত্ব কীভাবে হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে পল্লবের সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে তার অনুচ্চারিত যন্ত্রণা গগনপতির মুখগহ্বর থেকে বের হয়। তার অস্ফুট চিৎকারধ্বনি গগনপতির কথামালার মধ্য দিয়ে ঝরে।
বাকসর্বস্ব সে নয় পল্লব জানে, জানে না আশপাশ। বাকসংযম আর লাবণ্যমাখা কথাকারুকার্যে পল্লবের জনপ্রিয়তা বাড়ে, কিন্তু উচিত কথা বলার স্বভাব স্বাভাবিকতায় মুখে মুখে মুখ বাহাদুর হয়ে গেলো গগনপতি। বাগবিদগ্ধে যে কেউ গগনপতির শত্রু হবে, বাকমাধুর্যে যে কেউ পল্লবের মহোত্তম সাথি হবে। একদিন অনুচিতকে অনুচিত না বললেও নিরুত্তাপ থাকার কারণে পল্লবের সাথে গগনপতির মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাঁধে।
সত্যপথের সন্ন্যাসী সরলপথে স্বাভাবিক থাকলেও বন্ধুর পথে মুখ লুকায়। বন্ধু সুখলতা জীবন ক্যানভাসে এসে বন্ধুত্ব না ছড়িয়ে হলো প্রতিপক্ষ। যার উচ্চারণ স্বরে গগনপতির ভরাট স্বরের চিৎকারও ম্রিয়মান হয়ে যায়। সুখলতার বাকোচ্ছ্বাসে গগনপতির বাকজলোচ্ছ্বাসও ম্লান হয়ে যায়। বজ্রনিনাদ কণ্ঠস্বরের সামনে জলের ফোঁটা পড়ার শব্দ নিতান্ত শব্দহীন। দিগ্বিদিক জয়ের উচ্চার্য কণ্ঠ প্রগলভ উচ্চার্য কণ্ঠের কাছে নতজানু। দুঃসাহসিক উচ্চারণও গৃহকোণের সৌন্দর্য উদ্যত ফণার কারণক্রিয়ায় থেমে যায়। বৈরী কণ্ঠলীলায় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তূপাকার হয়ে ভাগাড়ে পচতে থাকে। সুখলতার শেষ কথা- নির্মলে ঋদ্ধ হও, অমলিনে অমলিন রও, সৌন্দর্যে মুগ্ধ হও, অনিন্দ্যে অনিন্দ্য রও।
গগনপতি পল্লবের সান্নিধ্য নিলো পুনর্বার। চুপ শ্রেয় বিবেক বর্গা অপেক্ষা। সদিচ্ছার ফাঁসি হোক, তবুও ইচ্ছায় বিপদ ক্রয় থাক। স্বপ্নজাল পুড়ুক, বিবেকের সীমানা খরায় খাক হোক, অন্তর স্বত্বা পচুক, তবুও বহির্দ্বার বাঁচুক। হৃদয় অন্যায়, অবিচার সহ্যে ক্ষত হোক, তবুও শরীর বাঁচুক। সুখলতার সীমানা ভ্রমণে বেঁচে থাকা যায়, বাঁচা হয়ে উঠে না। সুখলতা সহযাত্রিনী হলে বাঁচা দুর্বিষহ হলেও মগজ সেদ্ধ হতো না।