গল্প ।। প্রেম-আলাপন ।। সুচন্দ্রা বসু
ছবিঋন- ইন্টারনেট।
প্রেম-আলাপন
সুচন্দ্রা বসু
রাণা পড়া শোনা ছেড়ে ট্রেনে চড়ে বীরভূমের নানুর থেকে কলকাতার শিয়ালদায় এসে নামে।সেখানে সব অপরিচিত। কোথায় যাবে কি করবে সে বুঝতে পারে না। স্টেশনে দেখে অনেক লোকজন বসে আছে।সেও একটা জায়গায় গিয়ে বসে।পরণে জামাকাপড় ছাড়া রাণার আর কিছুই নেই। এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে আসছে। সেই দুপুরে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে।খিদেও পাচ্ছে। এখন খাবে কি সে।ভাবতে ভাবতে সে স্টেশন থেকে পায়ে পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।একটা চা রুটির দোকানে গিয়ে খাবার ভিক্ষে চায়।দোকানদার তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়।কলকাতা শহর এতো নিষ্ঠুর তার জানা ছিল না।
দোকান থেকে আশাহত হয়ে বেরিয়ে এসে সে দেখে অদুরে দু একজন ভিখারি ভিক্ষে করছে।
ক্ষমা ঘেন্না করে দু'একজন লোক তাকে ভিক্ষাদিয়ে যাচ্ছে।রাণা ভাবে তাকেও কি এভাবে ভিক্ষা করতে হবে ? না হলে সে খাবে কি? এতো সব ভেবে তো সে বাড়ি থেকে বের হয়নি।এমন সময় দুজন লোককে আসতে দেখে কেঁদে তাদের পায়ের উপর পরে। বলে বাবু দুদিন খাইনি একটা রুটি কিনে দেবেন? তাদের মধ্যে একজন বলে তুই থাকিস কোথায় ?
রাণা বলে- আমি থাকি বীরভূমের নানুরে।
অপরজন বলে- তুই এখানে এলি কি করে।রাণা বলে আমার গ্রামের একজন কলকাতায় কাজ জুটিয়ে দেবে বলে এনে আমায় স্টেশনে ফেলে রেখে কোথায় চলে গেছে দুদিন হল।ওদের মধ্যে একজন বলল, তুই কাজ করবি? তবে চল আমার সঙ্গে। সে তাকে রুটি ঘুগনি খাইয়ে তাকে নিয়ে চলে গেল।পরদিন তাকে তার গাড়ির হেল্পারের কাজে লাগিয়ে দিল।
কিছুদিন পরে সে ওই বাস মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রীরামপুর চলে আসে আর ৩১ নং রুটের বাস কন্ডাক্টরের কাজ নেয়।ওই বাসে চেপে যাতায়াত করত প্রবীর বসু নামে এক কবি। তার কাছেই সে কবিতা লেখার অণুপ্রেরণা পায়।সে কবিতা লেখা শুরু করে। একদিন ফেসবুকে তার এই কবিতাটা সে পোষ্ট করে।
"অনামিকা"
মেলে না গভীর প্রেমের প্রমাণ
বোঝে না হৃদয় হৃদয়ের টান ৷
হাজার বছরের প্রেমের কথা
লেখনী আঁকে কবিতা গাথা ৷
পারিজাত ফুল হাতে প্রেম দিতে দ্বারে
সে এসে কড়া নাড়ে প্রেমহীন সংসারে ৷
খোলে না দরজা মরসুমী ঝড়ের আবেদনে ৷
নারী হয়েছে মা দরজা খুলবে কেমনে ৷
আজও শরমে মরমে মরে
প্রেম দাগে কলঙ্কিনী করে ৷
কণ্যারা যন্ত্রনা নিয়ে বুকে
বেঁচে থাকে লুকিয়ে কান্নাকে ৷
সবার উপরে আছেন যিনি
সর্বগুণে ধন্য গুণমনি৷
পড়ে না ধরা ভুল তার চোখে
নির্ভুল বলে থাকে সে হাস্যমুখে ৷
এই কবিতাটি পড়ে রুণা নামে একটি মেয়ে কমেন্টে লেখে,কবিতাটা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। রাণা তার কমেন্ট পড়ে উৎসাহিত হয়।
রাণা তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।রুণা গ্রহণ করে এবং তার প্রোফাইলে ঢুকে তার কিছু কবিতা পড়ে। তাকে মেসেঞ্জারে লেখে আপনার মতো আমি বড় কবি নই। তবে সামান্য লিখি।তার একটি নমুনা পঠালাম আপনার কেমন লাগলো জানাবেন।
মেঘের ভেলায়
.........................
আমায় নিয়ে চাঁদের পাহাড়ে তুমি বসবে পাশে ঘেঁষে
থাকবে তুমি হৃদয় মাঝে খুব গোপনে আমায় ভালোবেসে।
স্বপ্ন এঁকে হাতটি ধরে যাব দুজনে পরীর বেশে
প্রেমের টানে পালটি তুলে ভাসব মেঘের ভেলায় হেসে।
তোমার আমার আনন্দ জ্যোৎস্না লুটিয়ে নদীর জলের ধারায়
তারাদের মাঝে নীল আকাশ চাঁদকে হারায় রজনী নীরবতায়
জোয়ারের স্রোতে জীবন রূপালী চাঁদের কল্পনায় রূপকথার দেশে,
চরকা কাটে বুড়ি মুগ্ধ জোছনায় চাঁদের পাহাড়ে শেষে।
রাণা কবিতাটি পড়ে বলে বেশ লিখেছেন।
থাকেন কোথায়?
সে বলে শ্রীরামপুর মণিকমল হাসপাতালের ধারে।
আমি থাকি শ্রীরামপুর বাস টার্মিনাসের পাশেই ঘরভাড়া করে।
এরপর থেকে ফোনেই রুণার সঙ্গে ফেসবুকে রাণার কথা হয়। কারোর সাথে কখনও দেখা হয়নি । দু'জনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল ফোনেই। রাণার লেখা কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠে রুণা।
রাণার জীবন সম্পর্কে রুণা কোনদিন জানতে চায়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাণা কথায় কথায় জানতে পাড়ে রুণা বি.এ পড়ে শ্রীরামপুর কলেজে। রুণা বলে আপনি কতদিন লিখছেন। তা এই একজন কবির অনুপ্রেরণায় শুরু করেছি।তার লেখা কবিতা পড়ে তাকে অনুকরণ করে একটি কবিতা তাকে লিখে দেখাই।তিনি লেখাটি দেখে খুব খুশি হন।আর আমাকে বলেন নিজের ভাবনায় সহজ ভাষায় যেন লিখি। রুণা বলে তবে তো আপনাকে অনেক পড়তে হয়। হ্যাঁ হয় বৈকি। বাস্তবে যা দেখি যা অনুভব করি সেটাই কবিতায় প্রকাশ করি। কোন কবির লেখা বেশি ভালো লাগে? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা।
হ্যাঁ আমিও পছন্দ করি।
রুণা তার কথায় কেমন আবেগী হয়ে যায়।তার কথাবার্তা রুণার ভাল লাগে । রুণা তাকে জানায় কলেজে কবিতা উৎসব হবে সে যেন সেখানে যোগ দেয়।
রাণা তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। সে বলে গরীবের আবার কলেজের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নেই।এতে আপনার মাথা নীচু হয়ে যেতে পারে। রাণা অনুভব করে তার প্রতি প্রেম। সে বলে ঠিক আছে যাব। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব না। কবিতা উৎসবের দিনে সে আসে মঞ্চে উঠে সে বলতে শুরু করে -
আমি যদি বলি করছো তুমি এখন কি?
তুমি বল শুধু একজনের কথাই ভাবছি।
তার প্রেমেই যে সারাদিন হাবুডুবু খাচ্ছি।
লজ্জা শরম একেবারে হারিয়েছো নাকি?
তবে কি প্রেম খোলামকুচি মনে হয়
তাই হেসে হেসে খুশি হও প্রেমের কথায়?
তোমার অন্তর্যামী কি বলে দেখ তো দেখি
তোমায় সে ভালবাসে,অনুভবে টের পাও কি?
গল্প গাথায় এঁকে দুঃখ সুখের আলপনা
জানাও কি তাকে এইভাবেই তোমার যন্ত্রণা?
মনের কথা যদি আবেগী ভাষায় হয় সংলাপ
তবে কি এ' ভাবেই হয় দুজনের প্রেমালাপ?
তুমি কি তার প্রতি কখনোও হও এতটুকু বিরক্ত?
বোঝে কি সে তার প্রতি কতখানি তুমি অনুরক্ত?
না বুঝেই বলে কি সে ভুলভাল কথা যত
তাই কি বাড়ায় অজান্তে নিজের মনের ক্ষত।
যদি চাও জানতে কি হয় মানে এই বি--রক্ত?
বলে সে সহজেই বি(Bee)-মৌ- মিষ্ট অর্থাৎ মিষ্টি রক্ত। এই জন্যই বুঝি তুমি তার এত হও ভক্ত
গল্পের সাথী একমাত্র তুমিই তার উপযুক্ত। ধীরে ধীরে দৃঢ় হোক দু'জনার বন্ধুত্ব। দুজনের সখ্যতায় প্রগাঢ় হয়ে উঠুক মিষ্টত্ব। তবুও জানবে যখন আমার পরিচয় থাকবে কি পাশে! মনে জাগে ভয়।
কবিতা শুনছে রুণা
প্রেমের আলপনা
এক মনে বলছে রাণা
নিজের মনের ভাবনা।
----------------------