ছবিঋন- ইন্টারনেট।
সুন্দরবনে শিকার অভিযান
মিঠুন মুখার্জী
পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। গোবরডাঙ্গার জমিদার বংশের বংশধর বলে পরিচিত স্বপন প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শৌণকপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ছোটবেলা থেকেই খুব শখ বন্যপ্রাণী স্বীকার করা। এখন তার বয়স ত্রিশ বছর। পূর্বপুরুষেরা প্রচুর বাঘ হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী স্বীকার করেছেন। এই বয়সে কিছু পাখি মারা ছাড়া আর কিছুই স্বীকার করেননি তিনি। গভীর জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়ার জন্য বাবাকে অনেক বার বলেছেন। বাবা তাকে কথা দিয়েছেন ছয়মাস পর কলকাতা থেকে তার তুতো ভাইয়েরা আসলে একসঙ্গে সকলকে শিকারে যেতে দেবেন। দাদুর তিনখানি বন্ধুক ও চারটি চাবুক এখনো শৌণকের বাবা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছেন।
শৌণকের দাদুরা বেশ অত্যাচারী জমিদার ছিলেন। চাবুক দিয়ে কত প্রজার শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছিল তা ঠিক নেই। এতটাই নিষ্ঠুর ছিল তারা যা বলে ঠিক বোঝানো যাবে না । দাদুর থেকে বাবা ও বাবার থেকে শৌণক সেই ধারায় বজায় রেখেছেন। দয়া মায়া সহানুভূতি কিছুই নেই তার মধ্যে। নিষ্ঠুর বললেও ঠিক বলা হয় না, বাঘের থাবায় এক দাদুর জীবনে চলে গিয়েছিল তবুও শিকারের নেশা এদের যায় না। যাকে বলে রক্তে শিকারের ধারা বইছে। শৌণক মুখোপাধ্যায়ের বাবা স্বপন মুখোপাধ্যায়ও একসময় খুব বড় শিকারি ছিলেন। বয়স বাড়ায় আজ আর শিকারে যান না।
ছয় মাস পরে কলকাতা থেকে স্বপন প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের দুই ভাইয়ের চার ছেলে গোবরডাঙ্গায় আসেন। মেজভাই উদয়প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের দুই সন্তান- যারা বন্দুকের নিশানায় অব্যর্থ। মনি প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ও তারা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ছোট ভাইয়ের দুই সন্তান ঊষা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ও শিবপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। তাদেরকে পূর্বেই বলা হয়েছিল সেকালে যাওয়ার কথা তারা গোবরডাঙ্গায় আসার পর শৌণকপ্রসন্ন তার বাবাকে পূর্ব প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বললেন। সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার অনুমতি দেন স্বপন প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।
প্রতিবছরই শৌণকপ্রসন্ন কালীপুজোর সময় বাড়িতেই থাকেন। এবার ঠিক হলো এক সপ্তাহ পর কালীপুজোর দিনে শিকারে যাত্রা শুরু করবেন, সঙ্গে থাকবেন চারজন খুড়তুত ভাই। দুটি গাড়ির ড্রাইভার প্রত্যেকের কাছে বন্দুক ও গুলি থাকবে। কোন জঙ্গলে তারা শিকারে যাবেন তা শৌণক পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলেন । সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। সরকারি নিয়ম কানুন তখন এখনকার মত অত টাইপ ছিল না। তাছাড়া জমিদারদের উপর সরকারও তেমন কিছু বলতেন না।
কালীপুজোর দিন সকাল ছটার সময় প্রসন্নময়ী কালী মন্দিরের পূজো দিয়ে শৌণক প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ভাইদের নিয়ে দুটো জিপ গাড়ি করে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন । বসিরহাট টাকি হাসনাবাদ সন্দেশখালি হয়ে সুন্দরবন পৌঁছেছিলেন তারা। রাস্তায় দুই জায়গায় একটু বিশ্রাম নিয়েছিলেন খাবার দাবার সঙ্গেই ছিল ফলে খাওয়ার কোন সমস্যায় করতে হয়নি তাদের। শৌণক প্রসন্নের ফুটতুতো ভাইদের প্রত্যেকের বয়সে ২৫ এর মধ্যে।
সুন্দরবন নিয়ে প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা কৌতুহল থাকে। এই দীর্ঘ অরণ্য খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এমন এমন জায়গা আছে এখানে যেখানে দিনের বেলায় আলো প্রবেশ করে না । আশেপাশের মানুষরা মাছ ধরা কাঠ ভাঙ্গা মধুর চাক ভাঙ্গা কাজে কাজ করে সংসার চালায় । এই কাজ করতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে জীবন হারায় তারা তবুও শিক্ষা হয় না কারণ এটাই তাদের জীবিকা মূলত এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বেশি দেখা যায় ছোট ছোট জলাশয় কুমিরেরও উৎপাত লক্ষ্য করা যায়। শৌণকপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় মূলত তার ভাইদের নিয়ে বাঘ শিকারের জন্যই সুন্দরবনে এসেছিলেন।
সুন্দরবন পৌঁছে তাদের সঙ্গে থাকা সুন্দরবনের জঙ্গলের ম্যাপ বের করে শৌণকপ্রসন্ন তার চার ভাইকে সামনে রেখে ম্যাপের বিশ্লেষণ করলেন । এই গভীর বনের যে দিকটায় বেশি বাঘ থাকে সেই দিকটা তারা চিহ্নিত করলেন। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন আমাদের গাড়ি দুটি পরপর চলবে । প্রথম গাড়িতে আমি মনি ও ঊষা থাকব, আর পরের গাড়িতে থাকবে ঠিক ও তারা। প্রত্যেকেই বন্ধুকে গুলি লোড করে রাখবে। সঙ্গেও গুলি রাখতে হবে । যেদিন তারা সুন্দরবন পৌঁছেছিলেন সেদিন রাগটা গাড়ির মধ্যেই তারা কাটিয়ে দেন। তাদের সঙ্গে জল থেকে শুরু করে শুকনো খাবার এক সপ্তাহের মত ছিল।
পরদিন ভোরবেলা গাড়ির লাইট জেলে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন তারা। আধাঘন্টা গাড়ি চালানোর পর প্রায় ১২ কিলোমিটার জঙ্গলের ভিতরে তারা প্রবেশ করলেন । সকলের মনের মধ্যে সাহস যেমন ছিল তেমনি কারো কারো ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল । একদম নির্জন জঙ্গল মাঝে মাঝে কয়েকটা পাখির ডাক কানে আসছে। তাদের কারো কারো শরীরের শিহরণ জাগছে । পোষা প্রশ্ন মুখোপাধ্যায় এদের সকলের মধ্যে ছোট তার চোখমুখে ভয়ের ছাপ সকলেই খুব সজাগ এরকম অভিযানে আসলে সজাগ না থাকলে চলে না কখন কোন দিক থেকে বাঘেরা আক্রমণ করবে তা বোঝার উপায় নেই। দুটো গাড়িতে মশাল জ্বালিয়ে নেওয়া হয়েছিল আগুন দেখলে বাঘ ভয় পায় তবে সব সময় কাজে আসে না । হঠাৎ মনে প্রসন্ন দেখলেন একটা হরিণ তাদের সামনে দিয়ে হুশ করে চলে গেল শৌণকপ্রসন্ন দেখলেন একটি হনুমান গাছের ডালে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে গাড়ি আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে তারা প্রসন্ন দেখলেন দুটি বন বিড়াল হঠাৎ করে তাদের রাস্তা কেটে চলে গেল । এরপর শৌণক প্রসন্ন আবারো ম্যাপ খুলে বললেন আরো ডান দিকে কিছুটা না গেলে বাঘের পদিস পাওয়া সম্ভব নয় । তার কথামতো ডান দিকে ড্রাইভার দয় আরো ৫ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে গেলেন এবার তারা যে স্থানে এসে উঠেছে । এই জায়গাটা বাঘেদের এলাকা খুব সচেতা না থাকলে প্রাণও যেতে পারে ড্রাইভার দল বন্দুক চালাতে জানতেন কারণ এই সমস্ত অভিযানে আত্মরক্ষার জন্য সবাইকেই বন্দুক ধরতে হয় নতুবা যেকোনো সময়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ যেতে পারে।
গাড়ি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে চলেছে হঠাৎ বাঘের গর্জনের শব্দ । বাঘের এই আওয়াজ শুনে সকলের হৃদয় ঠান্ডা হয়ে যায় । শৌণকপ্রসন্ন গর্জন শুনে উপলব্ধি করতে পারেন কাছে কোথাও বাঘ আছে তিনি সকলকে সাবধান করে বলেন যে, কোন মুহূর্তে আমাদের উপর বা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সকলেই বন্ধু খাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকবে। গাড়িতে মশাল ছাড়াও প্রত্যেকের মাথায় কয়লার খাদানের শ্রমিকদের মত হেলমেট । কপালের কাছে একটা পাওয়ারওয়ালা লাইট ছিল দূরের বিষয়কে দেখতে এগুলো খুবই সহযোগিতা করতো সকলে হেলমেটের লাইট জেলে দেয় । হঠাৎ সকলে দেখে রাস্তার উপর দুটি বাঘ দাঁড়িয়ে । একদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে গর্জন করছে তাদের চোখে আলো পড়ায় চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল শৌণক ও অন্যান্য ভাইয়েরা বাদ দুটিকে উদ্দেশ্য করে গুলি চালায় বাঘ দুটি লাফ দিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায় গাড়ি থেকে সোনা প্রসন্ন ও তাদের ভাইরা নেমে বাক দুটির কিছু নেয় ড্রাইভাররা তাদের উদ্দেশ্য করে গাড়ি নিয়ে আস্তে আস্তে পা পা এগোয়। যেখানে এসে তারা উপস্থিত হয়েছে এখানে সূর্যের আলোয় সবকিছুই কিছুটা দৃশ্যমান। দুজন ও তিনজন মিলে দুটি ভাগের পিছনে তাড়া করেন অনেকক্ষণ বাড়তিকে খুঁজেও তারা পাননি । শৌণকপ্রসন্ন মনেপ্রসন্নকে বলেন মুহূর্তের মধ্যে বাড়তি কোথায় বিলীন হয়ে গেল গর্জনও করছে না ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কোথায় ঘাপটি মেরে আছে ঊষা ও শিবপ্রসন্নের একই অবস্থা হয় তারা যে বাক্তির পেছনে তারা করছিলেন সেই ব্যক্তিও খুঁজে পান না। চোখে মুখে সকলেরই একটা আতঙ্ক কাজ করছিল অনেক খুঁজতে খুঁজতে তারা সকলে এক জায়গায় এসে হাজির হয় একে অপরের পিঠে পিঠে ধাক্কা লাগায় ভয় পেয়ে যান তারা। তারপর যখন দেখে বাঘ নয় তখন কানে জল আসে।
এরপর সন্ধ্যে ঘনিয়া আসে তারা সিদ্ধান্ত নেন এখান থেকে লোকালয়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। রাত হয়ে যাওয়ায় বিপদের সম্ভাবনা বেশি তাই তারা যেখানে পৌঁছেছিল সেই জায়গাতেই অতি সন্তর্পণে রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে সোনা প্রসন্ন সভার উদ্দেশ্যে বলেন সারারাত জেগে থাকা সম্ভব নয়। প্রত্যেককেই খুব সচেতন থাকতে হবে আমরা কিন্তু বাঘের দেড়ায় আছি বললেই চলে আমরা সাতজন আছি দুজন দুজন ও তিনজন করে তিন ঘন্টা পরে ঘুমাবো নতুবা কালকে চলতে পারব না। ঘুমালেও সজাগ থাকতে হবে ও বন্দুক সবার সঙ্গেই থাকবে শৌণকপ্রসন্নের কথামতো প্রথম উষা ও শিব ঘুমিয়ে পড়ে, বাকিরা চারদিকে নজর রাখে।
==============