ধারাবাহিক উপন্যাস।। সামান্য মেয়ে (৫) ।। রণেশ রায়
পর্ব -৫
বুড়ির বিয়ে
নিধিরামবাবু আর মাস্টারমশাই মানে আমাদের মানিবাবু দুজনেই গ্রামে যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী। দুজনেই আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট বিত্তশালী। তবে নিধিবাবুর আর্থিক প্রতিপত্তি বেশি। তার জোরে তিনি গ্রামে প্রভাবশালী। মাস্টারি করার দৌলতে মানিবাবুর সম্ভ্রম বেশি। নিধিবাবাবু প্রধানত মহাজনী কারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে তিনি আর্থিক দিক থেকে বলশালী হলেও মানিবাবুর মত মান্যতা পান না গ্রামে। আর শিক্ষার সম্ভ্রম মানিবাবুকে এমন একটা মর্যাদার জায়গায় দাঁড়াতে সাহায্য করেছে যা তাকে কিছুটা বাড়তি সুবিধা দেয় গ্রামে উভয়ের মধ্যে বিবাদে প্রতিযোগিতায়। নিধিবাবু এ দিক থেকে পিছিয়ে থাকাটাকে পূরণ করতে চান তাঁর অর্থবলে। আর তিনি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। পঞ্চায়েত পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লোকবল অর্থের দৌলতে রাজনৈতিক কারণে। তবে যেহেতু মানিবাবু অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব তাই তাঁর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিধিবাবু সবসময় পেরে ওঠেন না। মানিবাবু নিধিবাবুর মহাজনী কারবার পছন্দ করেন না। সেটা নানা ভাবে তিনি বুঝিয়ে দেন। গরিব মানুষের ঋণ ফেরতের ব্যাপারে নিধিবাবু যে চাতুরির পথ গ্রহণ করেন বা প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করেন সেটা মানিবাবু শুধু যে অপছন্দ করেন তাই নয়, বুঝিয়ে দেন। মানিবাবুও একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বহুদিন ধরে যুক্ত যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। আজ তারা ক্ষমতায় নেই। নিধিবাবুর দল ক্ষমতায় তাই মানিবাবুকে একটু গুটিয়ে থাকতে হয়। নিধিবাবুর প্রতাপ সহ্য করতে হয়। তবে দুজনের মধ্যে বিরোধটা গ্রামীণ জীবনে ফলগুধারার মত প্রবাহিত। কখনও কখনও তা তীব্রতা ধারণ করে বিশেষ করে নির্বাচনের সময়, সে গ্রামে সমবায়ের নির্বাচন হোক পঞ্চায়েত নির্বাচন হোক বা বিধানসভার নির্বাচন হোক। শুধু আর্থিক কারণ বা রাজনৈতিক কারণে নয় গ্রামীন সমাজের চলন বলন আচার আচরণ নিয়েও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আর এই পার্থক্য বিরোধের কারণ। মানিবাবু গ্রামের বাইরের জগৎটাকে বেশি দেখেছেন। তাঁর ছেলেমেয়ে গ্রামের বাইরে স্কুল কলেজে পড়েছে। শহরের জীবনের ছোঁয়া বেশি। সে সূত্রে গ্রামের আঁচার আচরণের সঙ্গে তাদের কোন কোন ক্ষেত্রে অমিল। মানিবাবু চান গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ ঘটুক। মেয়েদের মধ্যে অধিকার বোধ জাগুক। নিধিবাবুর জীবন যাপনে আবার এগুলো খাপ খায় না। এসব বিষয়গুলো গ্রামীণ সরল মানুষকে জটিল করে তোলে বলে নিধিবাবুরা মনে করেন। তাদের প্রশ্রয় দিলে নিধিবাবুর গ্রামে মাতব্বরির সুযোগ কমে যাবে বলে আশঙ্কা। এর মধ্যে মানিবাবু গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াবার ব্যবস্থা করেছেন নিজের বাড়িতে। সেই সূত্রে মানিবাবুর খাতির বাচ্চাবুড়োদের মধ্যে। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মানিবাবুর পরিচয়। নিধিবাবুর কাছে এই কারণে মানিবাবু চক্ষুশীল। তবে উভয়ের এই তিক্ততা বাইরের থেকে কেউ বুঝতে দিতে চান না। গ্রামের কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে উভয়ের সহাস্য উপস্থিতি। নিধিবাবু মাস্টারমশাইকে মান্যতা দিতে, দেখাতে কার্পণ্য করেন না। মাস্টারমশাইও নিধিবাবুকে গুরুত্ব দেন। উভয়ের বিরোধটা সবসময় প্রকাশ্যে আসে না। একটা চলনসই আবহে উভয়ের সমাজজীবন।
বুড়ির বাবা মানিবাবুর খুব অনুগত। উনার ছেলেমেয়ে মানিবাবুর কাছে পড়াশুনা করেছে। স্কুলের শিক্ষক হিসেবে উনি বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। তাছাড়া আপদে বিপদে উনি পাশে থাকেন। বুড়ির বাবাদের কাছে নিধিবাবুদের মহাজনী প্রতিপত্তির মুখে মানিবাবু কিছুটা রক্ষাকবচ। ধার মেটাতে কখনও দরকার হলে মানিবাবুর কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায়। ধার হিসেবে ঠিকই কিন্তু বিনা সুদে নেহাৎ খুব দরকারে। মানিবাবুর ছোট একটা বই এর ব্যবসা থাকলেও মহাজনী কারবার উনি করেন না। মানিবাবুর ছেলে মেয়েরাও গ্রামের গরিব মানুষের কাছে প্রিয়। ওড়া এখানে থাকলে খেলাধুলা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের সাথী। এর মধ্যে নিধিবাবু বুড়ির বাবা রুনুবাবুর কাছে তার ছেলের সঙ্গে বুড়ির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। সেটা বুড়ির যেমন পছন্দ নয় তেমনি বুড়ির বাবারও পছন্দ নয়। বুড়ির বাবা নিধিবাবুর প্রস্তাবটা মানিবাবুকে জানান। এও জানান তাঁর বা বুড়ির এতে মত নেই। কি করে এই প্রস্তাবকে তিনি অস্বীকার করেন। বিশেষ করে সে যে মহাজন। আর গ্রামীন জীবনে মহাজনের প্রস্তাবটাই যেখানে আদেশ। উনি মানিবাবুর সাহায্য চান। এ নিয়ে মানিবাবু পড়েন বিড়ম্বনায় দ্বিধায়। বিড়ম্বনা এই কারণে যে মানিবাবু নিধিবাবুর ছেলেকে হারে হারে চিনলেও এ ধরণের চাপিয়ে দেওয়া জুলুমকে না মানলেও এ নিয়ে নিধিবাবুর বিরুদ্ধে গেলে দুজনের মধ্যে বিরোধটাও প্রকাশ্যে চলে আসবে। নিধিবাবু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খাটাতে চাইবে। আর ইতিমধ্যেই তাঁর নাতি নীলুর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে নিধিবাবু যেখানে জল ঘোলা করা শুরু করতে শুরু করেছেন। মানিবাবু এ নিয়ে নিধেবাবুর সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে নামতে চান না। আর যাই হোক গ্রামে আর্থিক প্রভাব প্রতিপত্তিতে নিধিরামের জোর আছে। তার সঙ্গে কিছু লোক জুটে যাবে। নির্বিবাদী মানিবাবু এই নিয়ে অশান্তি চান না। একই সঙ্গে মানিবাবু বুড়ির বাবাকে সাহায্য করতে দ্বিধাগ্রস্ত। উনিও চান বুড়ির বিয়েটা হয়ে যাক। তবে নাতি মানে নীলুকে বুড়ির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে। সমাজে মুখ থাকবে। মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে ভুলবোঝাবুঝিটা দূর হবে। এই বিয়েতে বুড়ির যে সর্বনাশ হবে সেটা তিনি জানেন। কিন্তু এতে উনার তো কিছু করার নেই। গরিবের পরিবারে এটাই যে নিয়তি। বরং এতে তিনি বিড়ম্বনা মুক্ত হবেন। সামাজিক বিড়ম্বনা পারিবারিক বিড়ম্বনা। মানিবাবু এক দ্বন্দ্বে এক স্ববিরোধীতায় পড়েন। ওনার বিশ্বাস এক স্ববিরোধীতার সম্মুখীন হয়। তিনি বিশ্বাস করেন এক আর সে বিশ্বাসকে মান্যতা দিলে ফল হয় অন্য। নিজের আত্মস্বার্থতে আঘাত লাগে।
বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত মানি মাষ্টার। তিনি কিভাবে তাঁর ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাধান করবেন ভেবে পান না। গরীব মানুষের প্রতি তাঁর একটা দায়বদ্ধতা আছে বলে তিনি গাঁয়ে মানুষের বিশেষ প্রিয়। সেদিক থেকে তিনি বুড়ির বাবার পাশে দাঁড়াবার দায় অস্বীকার করতে পারেন না। সেটা মানলে তাঁকে নিধিরামের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়, যেটা একটা অশান্তি ডেকে আনতে পারে। তাও উনি সেটা করতে পারেন কিন্তু নিজের মধ্যেই যে আরেকটা সংশয়। উনি নীলুর সঙ্গে বুড়ির সম্পর্কটা মন থেকে মেনে নিতে পারেন না। একটা অসম সম্পর্ক যেটা তাঁর সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত। এই সমাজের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এটা কতটা নীলু বা বুড়ির পক্ষে কাম্য সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আর আছে পরিবারের মধ্যে একটা অশান্তির সম্ভাবনা বিশেষ করে উনি যদি বুড়ির বাবার অনুরোধ রাখার চেষ্টা করেন বা নীলুকে নিরস্ত করতে না পারেন। উনি সাতপাঁচ ভেবে গ্রামে উনার পরিচিত কয়েকজন প্রতিপত্তিশালী মানুষকে বাড়িতে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠান। সন্ধ্যেবেলায় সবাই আসেন। তার মধ্যে উনার স্কুলের দু তিন জন শিক্ষক আছেন যারা এই গ্রামে বা আসেপাশে থাকেন। সবাইকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ইতিমধ্যে নিধিবাবুর দৌলতে বুড়ি আর নীলুর ব্যাপারটা গ্রামে প্রচার হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে আড়ালে আবডালে মাস্টারের বিরুদ্ধে কথা হয় সেটা মানি মাষ্টার বুঝতে পারছেন। তিনি কিছু গোপন না করে সবটাই বলেন। আরও বলেন যে নিধিরাম কিভাবে তাঁর ছেলের সঙ্গে বুড়ির বিয়ে দেওয়ার জন্য বুড়ির বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।সবাই একমত যে নিধিরামের অপদার্থ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা অন্যায় বিশেষ করে বুড়ি আর বুড়ির বাবার যেখানে আপত্তি। আর এটা মেনে নেওয়া মানে একটা মেয়ের সর্বনাশ করা। কিন্তু ওদের কি করার আছে? বড় জোর বুড়ির বাবাকে রুখে দাঁড়াতে বলা আর নিধিরামকে বুঝিয়ে বলা যে ওর মত ধনী পরিবারে এ বিয়ে মানানসই নয়। সেটা যেন উনি জোর খাটিয়ে করতে না যান।আর উনার পয়সার জোর আছে। মেয়েরতো আর অভাব হবে না। বুঝিয়ে সুঝিয়ে যতটা পারা যায়। তবে সবাই জানে নিধিরামের মত এক অর্থপিপাস কেন কোন যৌতুক ছাড়া ছেলের বিয়ে ওরকম একটা গরীব ঘরে দিতে চাইছে। কিন্তু অন্য প্রসঙ্গটা উঠতে সবাই দ্বিধাগ্রস্ত । নাতির সঙ্গে বুড়ির সম্পর্কটা সামাজিক দিক দিয়ে বেমানান। মানি মাষ্টারের মর্যাদার পক্ষে হানিকর।এ ব্যাপারে মানি মাষ্টারও রক্ষণশীল যতই প্রগতিশীল ভাবনার কথা বলুন না কেন। সেটা মানি মাষ্টারও জানেন। মানি মাষ্টার আর নিধিরাম দুজনেই সম্পন্ন আর গ্রামে বিশিষ্টজন হলেও এ ব্যাপারে দুজনের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। মানি মাষ্টার একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব হলেও গরিব পরিবারের মেয়ে বুড়িকে বর্জন করতে চান আর চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল সাবেকপন্থী হয়েও নিধিরাম বুড়িকে গ্রহণ করতে চান। আর সেটা করলে অনেকে তাকে ধন্য ধন্য করবে কারণ একটা গরিব ঘরের মেয়েকে কোন যৌতুক না নিয়ে নিজের ঘরের বউ করে আনতে রাজি হয়েছেন। দুজনের এই দুই অবস্থানের কারণটাও ভিন্ন। মানি মাস্টারের কাছে চলতি মূল্যবোধে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়েছে। আর নিধিরামের সংকীর্ণ স্বার্থ। বিনা মূল্যের একজন সর্বক্ষণের বান্দি পাবেন যে একই সঙ্গে ছেলের কামনা চরিতার্থ করবে।
দিন কতক পর মানি মাষ্টার তিনজনকে নিয়ে নিধিবাবুর বাড়ি যান। ওদের আসায় নিধিবাবু গদ গদ। নিধিবাবুর বাড়িতে মানি মাষ্টারের পদধূলি বিরল ঘটনা। নিধিবাবু প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মানিবাবুর বাড়িতে মাঝে মধ্যে যান। দুজনের আচরণের এই ভিন্নতার কারণ দুজনের সামাজিক অবস্থান। মর্যাদার দিক দিয়ে মানিমাষ্টার উঁচু পদের অধিকারী মাষ্টার হওয়ার দৌলতে। এটা সমাজ সংস্কৃতি বলা চলে। যদিও অন্য নানান দিক থেকে অর্থের বিত্ত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। নিধিবাবু এটা জানেন। তাঁর অভ্যর্থনার ত্রুটি হয় না। নানা কথার মধ্যে আসল কথাটা ওঠে। উত্থাপন করেন মানি মাষ্টার স্বয়ং। তিনি বলেন:
----- নিধে তুমি নাকি বড় ছেলের বিয়ের কথা ভাবছ ? খুব ভালো কথা। তোমার বাড়িতে একটা বউ দরকার। স্ত্রী অসুস্থ। ছেলে মেয়েরা ছোট। বৌমা অসুস্থ। তোমার তো বাইরে ঘুরে বেড়ানো । তা মেয়ে ঠিক হল?
মানি মাষ্টার নিধিরামকে তুমি বলেই সম্বোধন করেন। উনি বয়সে বড়। আর মাষ্টারমশাইদের গাঁয়ের লোকদের তুমি বলার রীতি চালু আছে। তাই এই নিয়ে কেউ কিছু ভাবে না। বরং মাষ্টারের এই ডাকের মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। মাস্টারমশায়ের প্রশ্নের উত্তরে বিনয়ের সঙ্গে নিধিবাবু বলেন:
------ ঠিকই শুনেছেন। তবে মেয়ে এখনও ঠিক হয় নি। ভাবছিলাম আমাদের রুনুর মেয়ে বুড়িকে বউ করে যদি ঘরে আনা যায়। মেয়েটা ভালো আর কাজের।
নিধিরাম জানেন যে মাস্টারমশাই এর নাতির সঙ্গে বুড়ির একটা সম্পর্ক আছে। তবে উনি কেন হঠাৎ এ ব্যাপারে আসছেন। আর উনিতো গরিব দরদী আবার বামপন্থী। গরিব বড়লোকের তফাৎ মানেন না। তাই নিশ্চয় নাতির সঙ্গে বুড়ির সম্পর্কটা মেনে নেন। ওটাকে প্রশ্রয় দেন। তবে কি উনি বাজিয়ে দেখতে চান বুড়িকে বউ হিসেবে আমি পেতে চাই কি না। সেটা হলে উনি তো তাঁর প্রস্তাব মেনে নেবেন না। বাঁধা দেবেন। নিধিরামের এ ব্যাপারে মানি মাস্টারকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হয়। এটা ভেবে উনি খুশি হন। বুড়িকে বউ হিসেবে পাবার বাসনাটা তীব্র হয়। সেটা যদি হয় তবে মানি মাষ্টারকে গোল দেওয়া হবে। আর মানি মাষ্টারকে হারানো উনার জীবনে বড় জয়। এইসব ভাবনার মধ্যে নিধিবাবুর কানে আসে ওদের মধ্যে একজন বলছেন:
---- নিধিবাবু আপনার মত প্রতিপত্তিবান পরিবারে বুড়ি কি মানান সই হবে? আর ওদের অর্থের কি জোর আছে যে আপনার ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবে।
এরই মধ্যে মানি মাষ্টার বলেন:
------ তোমার এ ধরণের অদ্ভুত চিন্তার কারণ কি জানতে পারি?
নিধিরাম একে একে দুই করার চেষ্টা করেন। ভাবেন এ ব্যাপারে ওঁদের এত মাথা ব্যথা কেন? বাড়ি বয়ে এসে প্রসঙ্গটা তুলছে। নিশ্চয় নাতির পথটা যাতে বন্ধ না হয় তার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। নিধিরাম বুড়ি নীলুর বিষয়টা যে জানেন সেটা বুঝতে দিতে চান না। তবে খেলাটা খেলতে রাজি। মাষ্টারের নাতির অধিকারটা ছেলের হয়ে উনি কেড়ে নিতে চান। নিধিরাম বলেন:
----- দেখুন ছেলের বিয়েতে আমার কোন দাবি নেই। গরিব বাবা দেবে কোথা থেকে ! জীবনে রোজগার তো অনেক করেছি তাই এইটুকু না হয় একজন গরিব মানুষের জন্য ছাড়লাম। মাস্টারমশাই আপনার মত মানুষ আমার এই কাজটাকে সমর্থন করবেন নিশ্চয়। আপনার আশীর্বাদ নিশ্চয় ছেলে ছেলের বউ পাবে।
মাষ্টার মশাই বলেন:
----- হ্যাঁ সেটা আপনার তরফ থেকে সত্যি একটা মহান কাজ। আমি সেটা চাই। তাও একটা সমাজ তো আছে। একটা সংস্কারও আমাদের মধ্যে কাজ করে। সে সব অস্বীকার করে এটা করতে পারলে তো ভালোই। কিন্তু মেয়ে এখানে মানিয়ে নিতে পারবে কি না বা আপনারা মানাতে পারবেন কি না সেটা একটা প্রশ্ন। তবে যদি পারেন ভালো। জানেন না হয়তো আমার নাতির সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক আছে। তবে আমি বামপন্থী লোক হয়েও বলছি যে ওদের সম্পর্কটা আমি মেনে নিতে পারছি না আমার সামাজিক অবস্থানের জন্য।
মাষ্টারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিধিরাম বলেন:
----- দেখুন এ ব্যাপারে আমি বামপন্থী। আমার কোন সংস্কার নেই। আর ছেলে মেয়ের বিয়ে বাজারে বেঁচা কেনার বিষয় নয়। ওকে যদি আমি বউ হিসেবে পাই আপনি বেঁচে যান। কোন বিড়ম্বনা থাকে না। আর সমাজে আপনার মর্যাদা আমার থেকে বড়। সেদিক থেকে আপনার অসুবিধে থাকলেও আমার নেই।
মাস্টারমশাই বোঝেন আজ সত্যি নিধিরাম ফাঁকা গোলে গোল দিয়ে গেল। তিনি নিধির কাছে জোর থাপ্পড়টা খেলেন। আর কথা না বাড়িয়ে মাস্টারমশাই সংগীদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন। মনে একটা সন্তুষ্টিও বোধ হয় কাজ করছে। নিধি যদি জেতে তবে সেটা তারও জিত। উনি যেটা চান সেটা ঘটে। অন্তত এই একটা ব্যাপারে নিধিবাবু আর উনি একই অবস্থানে যদিও দুজনের চাওয়া দুরকম। একজন চায় বর্জন একজন গ্রহণ।
ওঁরা চলে গেলে নিধিরাম ভাবতে থাকেন মাষ্টার কি চান। উনি নিশ্চিত যে মানিমাষ্টার চান তিনি যেন বুড়িকে বউ হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছেটা ত্যাগ করেন । তবে নাতির পথটা খুলে যাবে। আর উনি তো উনার ভাবনা অনুযায়ী নাতিকে এই অসম সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রশ্রয় দেন। গরিবদের মাথায় তোলাই যে ওঁদের কাজ। উনি যে বামপন্থী। বামপন্থী মানুষের জীবনের বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে যে আদর্শের সংঘাত ঘটে এটা নিধিবাবুদের মাথায় আসে না। আবার নিধিবাবুর মত দক্ষিণ পন্থীদেরও প্রয়োজনে বামপন্থী হতে হয়। আজ যেমন উনি হলেন। উনার উদ্দেশ্যটা যে বিনে পয়সায় একজন দাসী কেনা সেটা উনি লুকোলেন। এটা ভেবে নিধিবাবু আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। তিনি বুড়িকে বউ হিসেবে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। যখন ব্যাপারটা জানা জানি হয়ে গেছে আর মানিবাবু এ নিয়ে সঙ্গীসাথী সহ মাঠে নেমে পড়েছেন তখন নিধিবাবুই বা ছাড়বেন কেন। এ তো তার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই।মানিবাবুকে বুঝিয়ে দিতে হবে কত ধানে কত চাল।
নিধিবাবু দলবল নিয়ে প্রচারে নেমে পড়েন। একটা গরিব ঘরের মেয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে এক ভদ্রঘরের ছেলের সঙ্গে নির্লজ্জভাবে ঘুরে বেড়ায় । আর মানিবাবুর বামপন্থার নামে সামাজিক কুআচারকে প্রশ্রয় দেওয়া। উনি কত গরিব দরদী তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। উনি বিনা দাবিতে ছেলের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। রুনুর মত গরিব মানুষের জন্য এটা করা তার সামাজিক দায়িত্ব। সেটা মানিবাবুর গাত্র দাহ। তিনি সেটাকে আটকাতে নাতির এই প্রেমের মত অসামাজিক কাজকে প্রশ্রয় দেন। নিধিবাবুর কিছু পেটোয়া লোক আছে। তারা নেমে পড়ে মানিমাষ্টারের বিরুদ্ধে। নরম গরমে তাঁর কাছে বার্তা পৌঁছে দেয় যেন উনি নাতিকে সরিয়ে নেন। খুব দ্রুত মানিবাবুর বিরুদ্ধে প্রচার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। মানিবাবু এমনিতে বিড়ম্বনায় ছিলেন। কার্যত নিধিবাবু যা বলছেন তিনি তার বিপরীতটাই চাইছিলেন মনে মনে যদিও তা প্রকাশ্যে বলতে পাচ্ছিলেন না। তিনি চাইছিলেন নাতি যেন সরে আসে। এই অসম সম্পর্ককে মানতে পাচ্ছিলেন না। কার্যত উনি উনার আদর্শ বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন যার জন্য নাতির সঙ্গে তার ভুলবোঝাবুঝি। তবে এটা ঠিক নিধিবাবুর ছেলের সঙ্গে বুড়ির বিয়েতে তাঁর আপত্তি ছিল কারণ তিনি বুড়ির ভালো চান। নিধিরামের বুড়ির বাবার ওপর চাপ সৃষ্টিতে তাঁর আপত্তি ছিল। এই ব্যাপারটা গ্রামের সবাই জানে। কিন্তু নিধির প্রচার বাহিনীর দৌলতে এই বিষয়টা চাপা পড়ে নাতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টা প্রধান হয়ে উঠেছে। এটা তাঁর কাছে সম্মানের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। উনি নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন।
এরই মধ্যে ভারত জুড়ে কভিড ১৯ এর যন্ত্রনা। এ নিয়ে একটা আতংক সৃষ্টি হলেও সুন্দরবনে এই রোগের প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে এর ফলে মানুষের জীবন জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে আমফুর আক্রমণ। তুফান গ্রামে গঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নোনা জল গ্রামে ঠুকে চাষের ক্ষতি করেছে। বাড়ি ঘর ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। বুড়িদের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। নিধিবাবু আর তার দলের বদান্যে আশ্রয় জুটেছে একবেলা খাবার জুটেছে। এই সুযোগে নিধিরামের চাপ বাড়ছে। তার আর তার ছেলেরা সরাসরি বুড়ির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিতে বলছে। পরোক্ষে বুঝিয়ে দিচ্ছে তা নইলে সব অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে। নিধিবাবু তাদের বাড়ি মেরামত করার খরচা দেবেন জানিয়েছেন। যদিও এটা ঋণ হিসেবে চেয়েছেন বুড়ির বাবা। অনুদান বন্ধ হলে ঋণ না পেলে ওদের মরতে হবে। বুড়ি ভয়ানক সংকটে পড়ে। পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে তার বিয়ে মেনে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় । আর নীলুদের বাড়িতেও ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। নীলু এখনও আত্মনির্ভর হয় নি। বুড়ির রাতের ঘুম চলে যায়। বাবা মুখ খুলে কিছু বলছে না। দাদার খবরও ও পাচ্ছে না। কাকার অবস্থা খুব খারাপ।বিলু এখন টাকাও পাঠায় না ওর খবরও নেই।সে ভাবতে থাকে কি করবে।
ইদানিং এ গ্রামে বুড়ি আর নীলুকে আগের মত দেখা যায় না। আগে প্রতি শনি রবিবার ছুটিতে নিলু যেমন নিয়মিত আসত এখন তেমন আর আসতে পারে না। হয়ত ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার চাপ বেড়েছে অথবা মানিবাবু নাতির বেশি আসাটা পছন্দ করেন না তাই। বুড়িকে নিলু জানিয়েছে এ নিয়ে দাদু বিরূপ। আর নীলুর বাবা মা ব্যাপারটা জানায় জটিলতা বেড়েছে। তবে কি নীলু আসতে আসতে সরে যাচ্ছে। বাড়ির চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে চলেছে ! প্রশ্ন ওঠে বুড়ির মনে। এ ব্যাপারটা আগে বুড়ি নীলুর কাছে তুলেছিল। এরকম একটা অমিলের মেলবন্ধন কি সম্ভব। এতটা অসম সম্পর্ক বাস্তবে কার্যকরী হওয়া ততটা সম্ভব নয় বলে সে সংশয় প্রকাশ করেছিল। কিন্তু নীলু সেটা গ্রাহ্য করে নি। তাকে যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী মনে হয়েছিল। আর নীলুর একার কেন বুড়িরও তো একটা সমস্যা ছিল। ও বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। জানত নিধিবাবুর চাপ দিন দিন বাড়ছে। বাবাকে রাজি হতে বাধ্য করানোর চেষ্টা চলছে। আর গ্রামের কেউ কেউ তাতে সায় দিচ্ছে। নিধিরামের প্রস্তাবটা বুড়ির বাবা যখন বুড়িকে জানায় তখন বুড়ি সেটাতে আপত্তি জানায়। কিন্তু ও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। জানত নিধিবাবুরা পয়সার প্রতিপত্তি খাটিয়ে বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এ কাজটা সম্পন্ন করতে চাইবে। আর বাবার পয়সা নেই, সেই গরিমা নেই যে ইচ্ছেমত মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করবে। ওদিকে এটাও সত্যি যে সে নীলুর ও তার পরিবারের কাছেও তেমন মানানসই নয়। আর বিয়েটা তো মানানসই দুজনের মধ্যে গাঁট বন্ধনের মাধ্যমে দুটি পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের সামাজিক স্বীকৃতি। প্রেম সেখানে পরের প্রশ্ন। প্রেম থাক বা না থাক মানিয়ে চলার বিষয়টি প্রধান। আর মেয়েদের কাছে মানিয়ে চলাটা বাধ্যবাধকতা। তার নিজের সত্তা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও। প্রেমে পড়ে নীলু নিজেকে প্রত্যয়ী বলে যতই মনে করুক না কেন বিয়ে আর প্রেম সব সময় একই খাতে বয় না। বিয়ের পর জটিলতা তৈরী হয়। সেও হয় তো ও বাড়িতে শেষ পর্যন্ত বান্দায় পরিণত হবে। যেভাবে নিধিরাম ওকে উনার বাড়িতে বউ হিসেবে পেতে চায় সেটাই নীলুর বাড়িতেও ওর পরিণতি। বিশেষ করে ও যেখানে পড়াশুনা জানে না। আচার আচরণে একটা বৈপরীত্য। এই সব সাথ পাঁচ ভেবে বুড়ি একেক সময় ভাবে এই সম্পর্কটা না তৈরী হলেই ভালো হত। ওদের মত গরীব ঘরের মেয়ের কাছে এটা দিবাস্বপ্ন। নিধিবাবুদের খোয়ারেই ওদের স্থান। আর বাবা এই নিয়ে যদি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তবে বাবাকে দোষ সে দিতে পারে না। দারিদ্রই এর জন্য দায়ী। গরীব বলেই ওর পড়াশুনা হয়নি সামাজিক মর্যাদা সে পেতে পারে না । তাই এটাই যেন বিধাতার বিধান। তাকেও হয়তো মেনে নিতে হবে।
নিধিরাম তার সূত্র থেকে জানতে পারে বুড়ির মনের অবস্থা। তিনি বুড়ির বাবাকে এখনও কায়দা করতে পারেন নি। তবে ঋণের টোপ দিয়েছেন। আমফুর কথা বিবেচনা করে বিনা বন্ধকীতে ঋণ দেবেন জানিয়েছেন। তিনি গরিবদরদী বলে নিজেকে তুলে ধরছেন। আর তাঁর পেছনে আছে ক্ষমতাসীন দল। এবার তিনি গ্রামের কিছু মহিলাকে বুড়িকে রাজি করাবার ভার দেন। সব দিক থেকে বুড়িদের পরিবার ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। এদিকে নীলুর কোন খবর নেই। ওর দাদুর সঙ্গে বিরোধ হয়েছে সেটা ও জানে। আর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেও চলে। এক অসহায় অবস্থা। বুড়ি জানে নিধিরামের ছেলের সাথে বিয়ে মানে ও বাড়ির দাসী বনে যাওয়া। তবে সেটা তো গরিব ঘরের যে কোন মেয়ের নিয়তি। সে ভাবে ভাগ্যকে মেনে নেওয়া ভালো। তাতে পরিবারটা তো বাঁচবে। দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে শেষ পর্যন্ত তাকে নিধিরামের প্রস্তাব মেনে নিতে হয় । আর যেখানে মানিবাবুরাও শক্ত ভাবে পাশে দাঁড়াতে পারলেন না সেখানে তাদের এ ছাড়া করার কি আছে !
ক্রমশ ---------