মিতুল
অঙ্কিতা পাল
মমতা দেবী একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। খুব অল্প বয়সে স্বামী মৃন্ময় বাবু দুর্ঘটনায় মারা যান । দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ছোট্ট সংসার তার। বড় মেয়ে মিতুল দ্বাদশ শ্রেণীতে, ছোট মেয়ে পুতুল দশম শ্রেণীতে ও ছেলে মৈনাক সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে । এভাবে মোটের ওপরে তাদের জীবনযাত্রা ভালই চলছিল।
একদিন সন্ধ্যে থেকে মমতা দেবীর খুব বুকের যন্ত্রণা শুরু হয়, তিনি যন্ত্রণায় খুব কাতরাতে থাকেন। এমতাবস্থায় কাতর কণ্ঠে বড় মেয়ে মিতুল কে বলেন - একটু জল দিবি রে মা । তার বড় মেয়ে মিতুল এত সহজ সরল যে মায়ের এই অবস্থা দেখে খুব ভয় পেয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবে মায়ের কিছু হলে আমি কি করবো। তাই সে দ্রুত পায়ে গিয়ে পাশে ডাক্তার কাকুকে ডেকে আনে। ডাক্তার বাবু মমতা দেবীকে দেখে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলেন। পরদিন সকালেই মিতুল পুতুলকে নিয়ে তাদের মায়ের পরীক্ষা করতে যায়, রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারবাবুর হাতে দিতেই জানতে পারে , তাদের মায়ের কঠিন অসুখ করেছে। তারা মমতা দেবীকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করায়। কিছুদিন পর মমতা দেবী মারা যান।
তারা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে, এত কাল তারা দারিদ্রতা কি জিনিস জানত না। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তাদের চোখের সামনেই দারিদ্রতা নেমে আসে, আর পুরো সংসার নিজের কাঁধে নিয়ে নিতে হয় বড় মেয়ে মিতুলকেই। ছোট ছোট ভাই বোন গুলোকে নিয়ে সে যেন অসহায় হয়ে পড়ে।
অনেক কষ্ট করে বাচ্চা-কাচ্চা পরিয়ে নিজের পড়াশুনা ও ভাই বোনদের পড়াশোনা চালিয়ে যায় সে, যেহেতু সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিল সেজন্য খুব অল্প দিনের মধ্যেই একটি ছোটখাটো চাকরি পেয়ে যায়। এভাবেই চেয়ে ছোট ভাই বোনদের বড় করে ও লেখাপড়া শিখিয়ে তোলে সে।
একদিন হঠাৎই তার ভাই তাকে ডেকে বলে - বড় দি আমার একটা আবদার আছে । সে হঠাৎই মূর্তিমানের মতন তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে - বল তোর কি আবদার । ভাই তখন নিঃসংকজে বলে ওঠে- এখন আমার একটা বাইক খুব প্রয়োজন, কারন আমার বন্ধুদের সবার বাইক। মিতুল তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে বলে - সবার আছে তা তোর কি দরকার। কিছুক্ষণ পর তার বোন পুতুল এসে বলে - দিদি দিদি আমার কিন্তু একটা দাবি আছে। মিতুল রাগের সঙ্গে চোখ বড় বড় করে উচ্চকণ্ঠে বলে - যাও সব নিজের কাজ কর । এই বলে সে গটগট করে নিজের ঘরে চলে যায়।
এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল, ভাই একটি বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এলো। ভাইয়ের বউকে দেখে মিতুলের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠলগেল। সে ভাই কে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল- এটা কে ভাই? ভাই নির্ভয় উত্তর দিল- আমার বউ সোমা। দিদি বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো - তোর তো এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি , নিজের পায়ে দাঁড়াসনি, এখন বিয়ে করার খুব দরকার ছিল ?
মৈনাক ঝাজি বেড়ে উত্তর দিল - আমি সোমাকে ভালোবাসি। মানতে হয় মানবি, না বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। কথাটা শুনে মিতুলের চোখে জল এসে গেল , সে মনে মনে ভাবল মা মারা যাওয়ার পরে যে ভাইকে কষ্ট করে আগলে রেখেছি পড়াশোনা শিখিয়েছি বড় করেছি আজ তার এই প্রতিদান। আর কোন কিছু না বলে ঘরে চলে গেল।
এরপর কিছুদিন কেটে গেল, মিতুলের খুব জ্বর এলো । মিতুল কয়েকদিন অফিস যেতে পারল না তাই ভাই ভাই বউ ও বোন সবাই মিলে তাকে গঞ্জনা দিতে শুরু করল।
মিতুল গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে সেই রাত্রে আত্মঘাতী হলো।
====================
ভাঙ্গড়, দক্ষিণ 24 পরগনা।