গল্প ।। আমার সাধনদা ।। দীনেশ সরকার
আমার সাধনদা
দীনেশ সরকার
সাধনদা আমার মামাতো দাদা । আমার মায়ের মুখে শুনেছি মামির পর পর দুটো মেয়ে হওয়ায় মামি খুব মুষড়ে পড়েছিলো । তখনকার মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিলো মেয়ে হ'ল দায়, তাকে খাইয়ে-পরিয়ে বড় করে পণ দিয়ে, খরচাপাতি করে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া । আর ছেলে হ'লো সম্পদ, সে রোজগার করবে, সংসারের হাল ধরবে । গ্রামের মানুষের মধ্যে এটা মজ্জাগত সংস্কার ছিল । তাই তৃতীয়বার যখন মামি সন্তানসম্ভবা হ'লো তখন সে বিভিন্ন ঠাকুরের থানে গিয়ে হত্যে দিতে লাগলো, সাধ্যি-সাধনা করতে লাগলো, 'হে, ঠাকুর এবার যেন ছেলে হয়, আর যেন মেয়ে না হয়' ---ইত্যাদি ---- ইত্যাদি । আশপাশের পীরের দরগাও বাদ যায় নি । তারপর যখন মামির ছেলে হ'লো, তখন অনেক সাধ্যি-সাধনা করে পাওয়া বলে ছেলের নাম রাখলো সাধন ।
সাধনদা আমার থেকে বছর চারেকের বড় ছিল । খুব ভালো ছেলে । পড়াশোনায় ভালো, কাজে-কর্মেও ভালো । অবসর সময়ে, ছুটি-ছাটার দিনে মামার সাথে মাঠে কাজ করতো । চাষি পরিবার, মাঠে-ঘাটে কাজ না করলে চলে । আবার পাড়ার সব কাজেই সাধানদা থাকতো । সে কাউকে ভ্যান-রিক্সায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক বা পাড়ার দুর্গাপুজো সরস্বতী পুজো হোক, সবেতেই সাধনদা । পাড়ার সবাই তাই সাধনদাকে খুব ভালোবাসতো ।
আমি তখন খুব ছোট, মায়ের সাথে মামার বাড়ি যেতাম । দুই মামাতো দিদি আর সাধনদার সাথে আমার সময়টা খুব ভালো কাটতো । মামাবাডি খুব ভালো লাগতো । আমিও বড় হ'তে লাগলাম, দুই মামাতো দিদিরও একে একে বিয়ে হ'য়ে গেল । তখন মামাবাড়ি গেলে সাধনদার সাথেই সময় কাটাতাম । মা মামির সাথে গল্প-গুজব করতো । আমার কি আর মামা-মামির সঙ্গ ভালো লাগতো ? আমি সারাক্ষণ সাধনদার সাথে সাথেই ঘুরতাম ।
সাধনদা উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করলো । স্কুলের এ যাবৎ সেরা রেজাল্ট । তখন নাইন, টেন আর ইলেভেন, এই তিন বছরের সিলেবাস নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হ'তো । আমিও ওই সিলেবাসে পাশ করেছি । তখন ঘরে ঘরে মোবাইল বা ল্যান্ড ফোনের জমানা শুরু হয় নি । তখন ল্যান্ড ফোন ( ভারতের ডাক ও তার বিভাগের ) থাকতো অফিস-কাছারিতে আর খুব বড়লোকদের বাড়িতে । তখন চিঠিই ছিল খবর আদান প্রদানের একমাত্র মাধ্যম । সাধনদা তার ভালো রেজাল্টের খবর চিঠি লিখে আমার মাকে ( তার পিসিকে) জানালো । মা-বাবা খুব খুশি হ'লো । মা আমাকে বললো, 'তোকেও তোর সাধনদার মতো রেজাল্ট করতে হবে ।'
যাই হোক, মা-বাবা আর আমি মামাবাড়ি গেলাম সাধনদাকে শুভেচ্ছা জানাতে । সাধনদার রেজাল্টে মামা-মামি খুব খুশি, পাড়া প্রতিবেশীরাও খুব খুশি । মামাবাডি থেকে মিনিট চল্লিশেক সাইকেলে গেলে একটা কলেজ, তবে সে কলেজের রেজাল্ট ভালো হয় না । সাধনদা ভর্তি হ'লো দূরের একটা ভালো কলেজে । বাডি থেকে সাইকেলে আধ ঘন্টা গেলে স্টেশন, তারপর ট্রেনে পয়তাল্লিশ মিনিট । ট্রেন থেকে নেমে মিনিট দশেক হাঁটা । উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট হয়েছে ভালো কলেজে তো পড়বেই ।
দিন গড়িয়ে চললো । আমিও ক্লাস এইটে উঠেছি । হঠাৎ আমার মাকে লেখা মামার একটা চিঠি পেলাম । তাতে মামা লিখেছে, 'সাধন নিখোঁজ । আজ তিন দিন তার কোনো খোঁজ নেই ।' সে দিন আর বেরোনোর সুযোগ ছিল না । পরের দিন মা আর আমি দুপুর নাগাদ মামাবাড়ি পৌঁছে গেলাম । মাকে জড়িয়ে ধরে মামি হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগলো । মামির কান্না দেখে মা-ও কাঁদতে লাগলো । আমারও মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । একটু সামলে মামিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'সাধনদা কি করে নিখোঁজ হ'লো ?' মামি কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তার সারমর্ম এই রকম ----- দিন সাতেক আগে সাধনদা রোজকার মতো সকালে খেয়ে দেয়ে কলেজে গেছে । অন্যদিন সন্ধ্যা নাগাদ ঘরে ফেরে । সেদিন রাত হয়ে গেল কিন্তু সাধনদা ফিরলো না । রাত্রি দশটা নাগাদ মামা পাড়ারই সাধানদার স্কুলের সহপাঠীদের বাডিতে গিয়ে জানতে চাইলো তারা আজ সাধনদাকে কেউ দেখেছে কিনা । সবাই জানাল আজ সাধনদার সাথে কারও দেখা হয় নি । সারা রাত মামা-মামি কেউ ঘুমোতে পারলো না, সাধনদার ফেরার অপেক্ষায় বসে ছিলো । পরের দিন সকালে সাধনদার দু-তিনটে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মামা খুঁজতে বের হ'লো । স্টেশনের কাছে যে সাইকেলের দোকানে সাইকেল রাখতো, সে জানালো ---- সকালে সাইকেল রেখে গেছে কিন্তু পরে আর নিতে আসেনি, সাইকেলটা এখনোও পড়ে আছে । স্টেশনের জি আর পিতে খোঁজখবর করা হ'লো গতকাল কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা । তারাও কোনো খবর দিতে পারলো না । শেষে থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করা হলো । মামাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সাধনদার বন্ধুরা ছুটলো সাধনদার কলেজে । সেখানে সাধনদার ক্লাসে গিয়ে খোঁজ করতে সবাই বললো সাধনদা কাল পুরো ক্লাস করেছে । তারপর তারা সবাই একসঙ্গে বের হয়েছে । ক্লাসের দুজন বললো তারা ট্রেনে একই কামরায় উঠেছিলো । পাশাপাশি বসে গল্প-গুজবও করেছে । তাদের স্টেশন আসতে তারা নেমে গেছে, সাধানদা সিটে বসে ছিলো । ট্রেনে লোকজন ভালোই ছিলো । সাধনদার বন্ধুরা হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে এলো ।
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল পুলিশ সাধনদার কোনো খবর দিতে পারে নি । আমিও ভেবে পেলাম না কলেজ থেকে ফেরার পথে সাধনদা কোথায় যেতে পারে । আমি মামিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'মামা কোথায় ? মামাকে দেখছি না তো ?' মামি বললো, 'এ ক'দিন তো আমাদের খাওয়া-ঘুম ছিল না । কাজ কর্ম সব শিকেয় উঠেছিল । চাষি পরিবার । চাষ-আবাদ না করলে খাব কি ? তাই তোর মামা এ ক'দিন বাদে আজই মাঠে গেল । একটু পরেই এসে পড়বে ।'
একটু পরেই মামা হালের বলদদুটো আর লাঙল নিয়ে ঘরে ফিরলো । লাঙলটা নামিয়ে রেখে বলদদুটোকে গোয়ালে বেঁধে ঘরে এল । আমি মামাকে প্রণাম করতেই মনে হ'লো মামার চোখদুটো ছল-ছল করে উঠলো । এই ক'দিনে মামার একি চেহারা হয়েছে !
আমরা চান-দান করে খেতে বসতে যাব, এমন সময় ডাকপিয়ন এসে মামাকে একটা চিঠি দিয়ে গেল । প্রেরকের নাম দেখেই মামা চেঁচিয়ে উঠলো, 'সাধনের চিঠি ।' আমি মামার কাছেই ছিলাম । মা আর মামি রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো । সবার মুখেই স্বস্তির চিহ্ন, যেন লাখ টাকার লাটারি জিতেছে । মামা চিঠি পড়তে লাগলো । চিঠির সারমর্ম, 'তোমরা আমার জন্য চিন্তা কোরো না । আমি ভালো আছি । সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ট্রেনে আমি এক দিব্যপুরুষের দেখা পাই । তার কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় । আমি তার সঙ্গে তার আশ্রমে চলে এসেছি । আমি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছি । কবে বাড়ি ফিরবো জানি না, আদৌ ফিরবো কিনা তাও জানি না । তোমরা ভালো থেকো ।'
মামি ডুকরে কেঁদে উঠলো, 'আমার ছেলেটা শেষে সংসারত্যাগী হ'লো । হে ঠাকুর, তুমি ব'লে দাও, আমি কি পাপ করেছিলাম তাই আমাকে এতবড় শাস্তি দিচ্ছো ।' মা মামির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকলো । মামা চিঠিটা উল্টে-পাল্টে দেখেও প্রেরকের ঠিকানা খুঁজে পেল না । শুধু নামটাই আছে । মামা সন্দেহ প্রকাশ করলো, 'সাধন কোনো অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে নি তো ? তাই ইচ্ছে করেই ঠিকানা লেখেনি ।' আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, 'চিঠিটা উড়ো চিঠি নয় তো ?' মামা বললো, 'না রে, এটা সাধনেরই হাতেলেখা ।'
যাই হোক, সাধনদা কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই বোঝা গেল না । আমরা পরের দিন বাড়ি ফিরে এলাম । সময় গাড়িয়ে চললো । মাস তিনেক পরে আমার মাকে লেখা মামির একটা চিঠি পেলাম, 'সাধন, বাড়ি ফিরে এসেছে । ও এখন পুরোপুরি ব্রহ্মচারী ।'
ব্রহ্মচারী ভাইপোকে দেখতে আমার মা ছুটলো তার দাদার বাড়ি, সঙ্গে আমিও গেলাম । এ কোন্ সাধানদাকে দেখছি । যে সাধনদার সাথে আমি ঘুরতাম, সাথে সাথে থাকতাম, এ তো সেই সাধনদা নয় । সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত পদ্মাসনে বসে ধ্যানরত এ কোন্ সাধনদা । কথা খুব কম বলছে । তার গুরুদেবই পাঠিয়েছে একবার মা-বাবার সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্য । গুরুদেব তাকে গুরু দায়িত্ব দিয়ে অন্য কোথাও পাঠাবে । সাধনদা এখন মামা-মামির সাথে এক হাঁড়িতে খায় না । নিরানিষ খায় । তার জন্য আলাদা হাঁডি-কড়াই থালা-বাটির ব্যবস্থা করতে হয়েছে । তাতেও মামির কোনো আপত্তি ছিল না । সাধনদার জন্য মামি সব করতে প্রস্তুত । শুধু সাধনদা যেন মামির চোখের সামনে থাকে । সাধন ভজন বাড়িতে বসেই যেন করে ।
মা তার ভাইপোকে যতটা সম্ভব বোঝানোর বুঝিয়ে বাড়ি ফিরলো । আমিও ফিরলাম । কয়েকদিন পরে মামির চিঠি ---- সাধনদা চলে গেছে । অনেক বলার পরে আশ্রমের ঠিকানাটা দিয়ে গেছে, তবে বলে গেছে তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে ।
দিন গড়িয়ে চললো । প্রায় বছর পার হ'লো । একদিন আমার মাকে লেখা মামির আবার একটা চিঠি এলো । চিঠির বিষয়বস্তু ---- 'সাধন কয়েকটা দিনের জন্য সবার সাথে দেখা করতে এসেছে । সাধন এখন পুরোপুরি সন্ন্যাসী, গেরুয়াধারী । সারাক্ষণ পূজা-আর্চা, জব-স্তব, আহ্নিক নিয়ে ব্যস্ত । ওর গুরুদেব ওকে উত্তরবঙ্গের আশ্রমের দায়িত্ব দিয়ে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে দেবে ।'
চিঠি পড়ে মায়ের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল । সাধনটা শেষ-মেষ সন্ন্যাসী হয়ে গেল ! এত ভালো ছেলে এই তার পরিণতি ! এবার তার সন্ন্যাসী ভাইপোকে একবার দেখতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো মা । পরের দিন থেকে একনাগাড়ে কয়েকদিন ঝড়-বৃষ্টি চললো । তাই সন্ন্যাসী সাধনদাকে আর দেখতে যাওয়া হ'লো না ।
একনাগাড়ে ঝড়-বৃষ্টিতে চারিদিক জল থৈ-থৈ । পথ-ঘাট-মাঠ সব জলে একাকার । আমাদের দরমার স্কুল ঘরের ভিতরে জল ঢুকে গেছে । স্কুল মাঠে এক হাঁটু জল । স্কুল বন্ধ । তিন-চার দিন রোদ হতেই জল নেমে গেল । স্কুল খুলে গেল । আমিও স্কুলে গেলাম । বিকালে স্কুল থেকে ফিরতেই ডাকপিয়ন এসে আবার একটা চিঠি দিয়ে গেল । আমার মাকে লেখা মামির চিঠি । চিঠির বিষয়বস্তু ছিল, " ঠাকুরঝি, আমরা বড় বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি । কয়েকদিন আগে বিকালে আমাদের এখানে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হ'লো । জানি না, তোমাদের ওখানে হয়েছে কিনা । ঝড়ে আমাদের মাটির গোয়ালঘরের চাল উড়ে গেল । গোয়ালে তখন হালের গরু দুটো বাঁধা ছিল । একনাগাড়ে বৃষ্টিতে গোয়ালঘরের দেওয়ালের মাটি গলে গলে পড়তে লাগলো । যে কোনো সময়ে দেওয়াল ধসে গরুদুটো চাপা পড়তে পারে । এমনিতেই গরুদুটো বৃষ্টিতে ভিজছিল । তাই তোমার দাদা গরুদুটোকে গোয়াল থেকে বার করে আম গাছে বেঁধে রাখবে বলে গোয়ালঘরে ঢুকেছিল । গরুদুটো খুলে বার করে আনার সময়, গরুদুটো বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু তোমার দাদা আর বেরোতে পারে নি । তোমার দাদার পিঠে হুড়মুড়িয়ে দেওয়াল ধসে পড়ে । তোমার দাদা দেওয়াল চাপা পড়ে । ভাগ্যিস, সাধন সেদিন বাড়ি ছিল । ঝড়-বৃষ্টির জন্য ওর আশ্রমে ফেরা হয় নি । সমানে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে । আমি আর সাধন খানিকটা দেওয়ালের মাটি সরিয়ে টেনে তোমার দাদাকে বার করে নিয়ে আসি । তোমার দাদা তো যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করছে । সেই বৃষ্টির মধ্যে সাধন ওর বন্ধুদের ডেকে ভ্যানরিক্সা যোগাড় করে তোমার দাদাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় । সাধন যদি সেদিন না থাকতো তবে আমি একা যে সেদিন কি করতাম ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দেয় । তোমার দাদাকে চার দিন পরে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে । ডাক্তারবাবু বলেছেন মাস খানেক বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে । কোমরের হাড়ে ভীষণ চোট লেগেছে । তারপর তোমার দাদা হয়তো বসতে পারবে, লাঠি নিয়ে দু-এক পা চলাফেরাও করতে পারবে । কিন্তু কাজকর্ম আর কোনোদিন করতে পারবে না । ঠাকুরঝি, আমার কপালে একি বিপদ ঘনিয়ে এলো ! পারলে একবার এসো ।'
চিঠি পড়া শেষ করে দেখি মায়ের চোখ দিয়ে জলের ধারা বইছে । আমারও মনটা খুব বিষণ্ণ হলো । নিজেকে সামলে মাকে বললাম, 'কেঁদে তুমি কি করবে বলো, দুর্ঘটনা তো যখন তখন ঘটতে পারে । তখন তার আর কিছুই করার থাকে না । চলো, কালই আমরা মামাকে দেখতে যাই ।'
পরেরদিন দুপুর নাগাদ মামার বাড়ি পৌঁছে গেলাম । মামা বিছানায় শুয়ে । মা তার পাশে বসে মামার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো আর সান্ত্বনা দিতে লাগলো,'তুমি কিচ্ছু ভেবো না দাদা, তুমি ঠিক হয়ে যাবে । ডাক্তারবাবু যে ভাবে যা করতে বলে কোরো, দেখো তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে - - - - ।' আমি মামা-মামিকে প্রণাম করে বাইরের বারান্দায় এসে বসে আছি । মামাকে দেখার পর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, তাই সাধনদার কথা আর মাথাতেই নেই । তাই মামিকে আর জিজ্ঞেস করা হ'লো না সাধনদা এখানে আছে না আশ্রমে ফিরে গেছে ।
মন খারাপ করে বসে আছি । ভাবছি মামা সুস্থ হয়ে উঠবে তো ! এমন সময় দেখি সাধনদা । সামনে দুটো হালের গরু, হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, মাথায় গামছা বাঁধা, জল-কাদা মাখা, লাঙল আর জোয়াল কাঁধে সাধনদা । এ কোন্ সাধনদা ! এ তো সন্ন্যাসী-মহারাজ সাধনদা নয় !
গরুদুটো ভাঙা গোয়ালঘরে ঢুকে গেল । সাধনদা লাঙল আর জোয়াল নামিয়ে রাখতেই আমি সাধনদার কাছে ছুটে গিয়ে বললাম, 'সাধনদা, তুমি ?'
সাধনদা হাসতে হাসতে বললো, 'কেনো রে চিনতে পারছিস্ না ।'
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ' না মানে তুমি আশ্রমে ফিরে যাও নি ?'
সাধনদা বললো, 'বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে আমি কি করে আশ্রমে যাই বল্ । শোন্, প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য হ'লো পিতা-মাতার সেবা-শুশ্রুষা করা, তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেওয়া । আমাদের চাষি পরিবার । বাবা আর কাজকর্ম করতে পারবে কিনা কেউ তা জানে না । আমি যদি চাষের কাজে না লেগে আশ্রমে ফিরে যাই, তবে তো আমাদের পরিবারটা ভেসে যাবে ।'
আমি বললাম, 'তা তোমার গুরুদেব ? তিনি কিছু বলবেন না ?'
সাধনদা বললো, 'শোন্, আমি সব কিছু বিস্তারিত জানিয়ে গুরুদেবকে চিঠি দিয়েছিলাম । তার উত্তরে উনি কি লিখেছেন জানিস, উনি লিখেছেন,' তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো । পিতা-মাতার সেবা করা সন্তানের পরম ধর্ম । পিতা-মাতার সেবা করলে ঈশ্বরের সেবা করা হয় । সংসারে থেকেও ঈশ্বর সাধনা করা যায় । সব সময় সৎ থাকবে, সৎ চিন্তা করবে, সকলের মঙ্গলের কথা ভাববে, তাহলেই দেখবে পরমেশ্বর তোমাকে পরম শান্তি দেবেন । গুরুদেব আরও অনেক কিছু লিখেছেন, তোকে আমি চিঠিটা পড়াবো ।'
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সাধনদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
**********************************************************************
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ---- ৭২১৩০৬