ভাষা ও স্বরধ্বনি : আঙ্গিকে মাতৃভাষা
রীতা রায়
ধ্বনি বা স্বর - যার থেকে সৃষ্ট ভাষা। ভাষার নিজস্বতা বিশ্বের প্রতিটা মানুষকে যেমন আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে তেমনি পরস্পরের ভাব আদান-প্রদান করতেও সাহায্য করে। স্বরধ্বনির উচ্চারণ থেকে সৃষ্ট স্থান-কাল ভেদে নানান ভাষা যা মত প্রকাশের ও মত বিনিময়ের মাধ্যম।
এই স্বরধ্বনি কখনো ঐচ্ছিক তো কখনো অনৈচ্ছিক ভাবে নিজস্বতা প্রদান করে এক একটি ভাষা তৈরী করেছে যা সময়ের সাথে বিবর্তন ঘটিয়ে আধুনিক রূপ নিয়েছে। ভাষা সর্বদাই পরিবর্তনশীল, কারণ সময়োপযোগী চলার লক্ষ্যে মুখের ভাষা পরিবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রনে নতুন ভাষার উদ্ভব হয়।
আমার পাশের বাড়িতে একটি পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে আছে। এটা ওর বাড়ি কিন্তু সে তার বাবামায়ের সাথে বাংলার বাইরে থাকে। মাঝে মাঝে আসে। করোনাকালে লকডাউন কাটাচ্ছিলো এখানে। সারাক্ষণ তার পিসির সাথে হিন্দিতে বকর বকর করতো, ঠাকুরমা ঠাকুরদার সাথেও। বাড়ির সবাই যখন ব্যস্ত তখন দোতলার ব্যালকনিতে একলা দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতো। একদিন বারান্দায় আমাকে দেখে বলে উঠলো -- 'ক্যায়া কর রহী হো?'
আচম্বিতে মিষ্টি স্বর শুনে ভালো লাগলো। হিন্দিতেই জবাব দিলাম। বাক্য বিনিময়ের মাঝে বলে উঠলাম -- 'তুমি বাংলায় কথা বলতে পারো না?' বাংলায় কয়েকটি কথা শেখানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু, ওর মুখের অভিব্যক্তি কেমন যেন বদলে গেল। শুধু শুধু ওকে কষ্ট দিচ্ছি ভেবে পুনরায় হিন্দিতে বার্তালাপে সাবলীল হয়ে উঠলো পরিবেশ। ভাবলাম, মাতৃভাষা যখন মায়ের ভাষা আর ওর মা যখন অবাঙালি তখন ওকে হিন্দি বলতে বাধা দেব কেন?
দুদিন বাদে আমরা আবার মুখোমুখি। ফিরে তাকালাম ওর মিষ্টি গলায় পরিস্কার বাংলা সম্ভাষণ শুনে -- 'তুমি কেমন আছো?'
এতো পরিস্কার উচ্চারণ অনেক বাঙালিও বলতে পারেনা, বিশেষত যারা গ্রাম থেকে বা বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে অথবা যারা আদিবাসী শ্রেণীভুক্ত কারণ তাদের ভাষাগত উচ্চারণে নিজস্বতার টান থেকেই যায় সাধারণত।
মেয়েটি বাংলা বলতে পারেনা.. এ কথাটা সেদিন ওকে কষ্ট দিয়েছিল আর তাই সে ভয়কে জয় করে দেখালো। এরপর যখনি দেখা হয় ও বাংলাভাষাতে জিজ্ঞেস করে -- 'তুমি কেমন আছো?'
স্বর বা ধ্বনি মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সহজ মাধ্যম যা একটি শিশু অবলীলাক্রমে নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত করে থাকে এবং পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে নিজস্বতা প্রদান করে এক একটি গোষ্ঠীর ভাষায় পরিবর্তিত হয়। এই ভাষার পৃথকীকরণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশ। আর ভারতের মতো বহু ভাষাভিত্তিক দেশে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের। মানুষ ইচ্ছা ও চেষ্টা করলেই সব ভাষায় কথা বলতে পারে কিন্তু চেষ্টা সবাই করে না। কিছুটা অনীহা বা জিহবার আরষ্ঠতার কারণে সঠিক উচ্চারণে বাধাপ্রাপ্ত হলেও সে বাধা জয় করা খুব কঠিন নয়। ভাষাটা 'জেনেটিক', সুতরাং বংশগত ও জাতিগত কারণে উচ্চারণ প্রক্রিয়ায় পরিবেশের প্রভাব থাকাটা স্বাভাবিক। সেই কারণে নিজের মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করলে কিছুটা অসুবিধা হয়। তবে নিয়মিত অভ্যাস এই বাধা দূর করতে সক্ষম।
আমার মনে আছে, অনেকদিন আগে আমার দাদা 'ত্রিশ দিনে তামিল শিখুন' -- বইটি কিনে আনে আর আমরা বইটি পড়ে বেশ কিছু তামিল শব্দ শিখেছিলাম কিন্তু বলার ধরণটা রপ্ত করতে পারিনি। সবই অনুশীলনের বিষয়। আমরা অন্য ভাষীদের মুখোমুখি হলে ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় কাজ চালিয়ে নিই কিন্তু কখনো নিজের দেশের 'প্রাদেশিক ভাষা' শেখার আগ্রহ দেখায় না। বরং অনেকে বিদেশী ভাষা শেখে.. ল্যাটিন, স্প্যানিশ, চাইনিজ ইত্যাদি ভাষা শেখার ক্লাস জয়েন করে। এভাবেই আরবি, ফারসি, ইংরেজি বা অন্যান্য অনেক বিদেশী শব্দ আজ বাংলা ভাষার সাথে মিশে গেছে। কিন্তু দেশীয় ভাষা তামিল, তেলেগু, কানাডা, মলয়ালাম, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবী, কাশ্মীরি, গোর্খা, আসামি ইত্যাদি এমনকী 'সংস্কৃত ভাষা' শেখার জন্য উৎসাহ খুব একটা দেখা যায় না। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল দার্জিলিং এর এক ভুটিয়া মেয়ে । আমরা ঠিক করেছিলাম একে অন্যকে নিজেদের ভাষায় পারদর্শী করে তুলবো কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেলো ও পুরোপুরি বাংলা শিখে ফেললেও আমি নেপালি বা ভুটিয়া ভাষার কিছুই রপ্ত করতে পারিনি কারণ আমরা যখন কথা বলতাম বাংলাতেই বলতাম.. নেপালি ভাষা বলা হয়ে ওঠেনি। বলার চেষ্টা করলেও তা সঠিক উচ্চারণে করতে পারিনি।
এই হল ভাষা ও স্বরধ্বনির মধ্যে পার্থক্য। ভাষা শেখা সহজ কিন্তু যদি তা সঠিক স্বর বা ধ্বনি উচ্চারণে প্রয়োগ না হয় তাহলে তা কানে কটু লাগে আর এই কাজটি প্রতিনিয়ত অভ্যাস ছাড়া সম্ভব নয়। মাতৃভাষার উচ্চারণ যত সহজে মুখে আসে, অন্য ভাষার ধ্বনি বা উচ্চারণ রপ্ত করতে অনুশীলন প্রয়োজন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাঙালিরা যেখানে যায় সেখানেই বাংলাভাষার প্রভাব ফেলে থাকে। ভাষা আন্দোলন করে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায় করে নেয় অথচ অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা যখন বাংলায় কর্মসূত্রে এসে বসবাস শুরু করে তখন তারা চেষ্টা করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। এমনকী, তাদের ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগ বাংলা মাধ্যমেই পড়াশুনা করে থাকে.. নিজেদের ভাষার দাবি তুলে আলাদা স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে তেমন দেখা যায় না কিন্তু, ভারতের অন্যান্য অনেক প্রদেশে বা বিদেশে বাঙালি স্কুল দেখা যায়। যদিও আজকাল বাঙালিরা বাংলার থেকে ইংরেজি ও হিন্দিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে কিন্তু অন্যান্য প্রাদেশিক, আঞ্চলিক, গ্রাম্য ও আদিবাসী ভাষাসমূহকে অচছুতের দলে ফেলে দিচ্ছে ফলে এই বাংলার বহু গ্রাম্যভাষা আজ অবলুপ্তির পথে। বাংলাভাষার প্রসার ঘটেছে বটে কিন্তু এই ভাষাতে মিশে যাচ্ছে প্রচুর বিদেশী শব্দ অথচ এই বাংলাভাষা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলার আঞ্চলিক ভাষাকে নষ্ট করেছে শিক্ষার অগ্রগতির কারণে ও কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে। এর জন্য বাংলাভাষীর অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা অনেকখানি দায়ী।
প্রতিটি ভাষার গুরুত্ব সমান সে লিখিত হোক বা মৌখিক। প্রত্যেকটি ভাষার ইতিহাস রয়েছে যা স্বগুণে সমৃদ্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে গুগুল 'কানাড়ি' ভাষাকে সব থেকে নগন্য ভাষা বলে উল্লেখ করে। স্বাভাবিক ভাবেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে কানাড়িগণ.. কেসও করা হয় এবং শেষপর্যন্ত্য গুগুল ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। সুতরাং ভারতীয় ভাষাগুলির ভিত এতটাই শক্ত যে তা উপড়ে ফেলা অত সহজ নয়। কিন্তু, দুঃখ হয় বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের জেলাভিত্তিক আঞ্চলিক ভাষাগুলির জন্য যা আজ তলিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। ভাষা মানুষের অন্তরস্থল থেকে উচ্চারিত স্বরধ্বনি.. যাকে ইংরেজিতে বলে 'voice' আর প্রতিটি মানুষের ভয়েস বা স্বর প্রমান করে তার নিজস্ব শেকড়কে যার থেকে আমরা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছি। সমাজ বিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে একদিকে যেমন মূল শব্দ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি তেমনি বিদেশী শব্দকে আপন করে নিচ্ছি প্রতিনিয়ত। বাঙালি হিসেবে আমাদের উচিত নিজেদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের সাথে সাথে অন্যান্য ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া কারণ সেগুলোও কারো না কারো মাতৃভাষা।
*****************************************
রীতা রায়
মহেশমাটি রোড, মালদা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত