গল্প ।। ছদ্মবেশী ।। উত্তম চক্রবর্তী
ছদ্মবেশী
উত্তম চক্রবর্তী
অভিজ্ঞ আই বি অফিসার মিস্টার প্রদীপ বিশ্বাসের কাছে পাকা খবর ছিল যে লোকটা নিশ্চয়ই কোন দু নম্বরি কাজে যুক্ত আছে, নাহলে কলকাতা শহরের বুকে এতো বড় দু' দুখানা বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ির এস্টেটের মালিক হবার জন্য এতো টাকা পেলেন কোথা থেকে ? দুখানা এস্টেটে না হলেও আশিখানা ফ্ল্যাট আছে এবং একেকখানা ফ্ল্যাট নাকি এক কোটি থেকে দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ বিশ্বাস বাবু লোক মারফৎ খবর নিয়ে জেনেছেন যে এই মাঝ বয়সী লোকটা, মানে দক্ষিণ কলকাতার দুটো এস্টেটের মালিক মিস্টার চঞ্চল সমাদ্দার নাকি ইনকাম ট্যাক্সের অফিসে একজন সম্মানিত ব্যক্তি, কারণ ওঁর ট্যাক্স দেবার রেকর্ড খুবই ভালো।
বিশ্বাস বাবু ডোভার লেনের চঞ্চল সমাদ্দারের বাড়ির গেটের কাছে রাস্তার অন্য দিকে এক সকালে তার মারুতি ডিজায়ার গাড়ির ভিতর বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আজ সমাদ্দারকে ফলো করে জানবেন উনি কোথায় যান আর কী কাজ করেন সেটা জানতেই হবে ওঁকে। বেলা ঠিক সাড়ে আটটার সময় ওঁর কালো রঙের হণ্ডা সিটি গাড়িতে সমাদ্দার বের হলেন বাড়ি থেকে। বিশ্বাস বাবুও ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওঁর পিছু নিতে। কিছুটা দূরত্ব রেখে ওরা সামনের গাড়িটাকে ফলো করতে থাকে। অনেকটা রাস্তা পার হয়ে সমাদ্দারের গাড়ি দাঁড়ালো বিবাদী বাগে লাল দিঘির পাশে জি পিওর পাশের এক গলির মুখে। বিশ্বাস বাবুর ড্রাইভারও গাড়ি থামিয়ে কিছুটা দুরেই অপেক্ষা করতে থাকে।
সমাদ্দার কিন্তু গাড়ি থেকে নামলেন না। বিশ্বাস বাবু অবাক হয়ে দেখলেন একটা ময়লা পুরানো প্যান্ট ও ততধিক নোংরা সার্ট পরা কাঁচা পাকা দাঁড়ি ওয়ালা একজন বৃদ্ধ মানুষ লাঠি হাতে গাড়ি থেকে নেমে ল্যাংরাতে ল্যাংরাতে গলিটার ভিতর ঢুকে গেলেন ও সাথে সাথে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। বিশ্বাস বাবু ড্রাইভারকে ইশারা করতেই ওঁর মারুতি গাড়ির ড্রাইভার আবার সমাদ্দারের গাড়ি লক্ষ করে এগিয়ে গেল ওকে ফলো করতে। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হল যখন সমাদ্দারের গাড়ি এবার ঘুরপথে আবার বালিগঞ্জের দিকেই রওনা দিল। ওঁর গাড়ির সবকটা কাঁচে কালো ফিল্ম লাগানো থাকায় ভিতরে কে কে বসে সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। বিশ্বাস বাবু গাড়ি ফলো করতে করতে আবার সেই ডোভার লেনে ফিরে এসে যখন দেখলেন গাড়িটা ফ্ল্যাট বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল তখন হতাশ হয়ে ফিরে চললেন ওঁর অফিসের দিকে। ওঁর মাথায় কিছুতেই ঢুকল না সমাদ্দারের গাড়িতে ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন কোথা থেকে ?
কিন্তু ঘাগু অফিসার প্রদীপ বিশ্বাসের মনের সন্দেহ থেকেই গেল। পর পর তিন দিন সেই একই ভাবে উনি সমাদ্দারের গাড়ি ফলো করলেন এবং দেখলেন রোজই ঠিক ওই গলিটার মুখে এসে সমাদ্দারের গাড়ি থেমে যায় আর ছেঁড়া ফাটা জামাকাপড় পরা ওই বৃদ্ধ লোকটা সেই গাড়ি থেকে নেমে গলিটাতে ঢুকে যান। সাথে সাথে গাড়িটা আবার বালিগঞ্জে ফিরে যায়। এ যেন রাক্ষস রাজ রাবণ সেজে গুঁজে রোজ আসেন সীতা মায়ের চোখে ধুলো দিতে।
প্রদীপ বিশ্বাস এবার আর ডোভার লেনে না গিয়ে সোমবার সকালে লাল দিঘির পাড়ে জি পিওর পাশের গলিটার মুখে এক পাগড়ি মাথায় সর্দারজির ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠিক বেলা সাড়ে নটায় সমাদ্দারের গাড়ি এলো সেখানে আর গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিকে তাকিয়ে সেই বৃদ্ধ মানুষটা আস্তে আস্তে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে ঢুকে গেল গলির ভিতর। বিশ্বাস বাবু সমাদ্দারকে আগেও কয়েকবার দেখেছেন, ওঁর সন্দেহ হয় যে এই লোকটাই সমাদ্দার এবং কোন একটা অজ্ঞাত কারণে উনি গরীব বৃদ্ধ সেজে এখানে আসেন রোজ। গলিটা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটা আবার ফিরতি পথ ধরে সোজা চলে এলো বড় রাস্তায়। তারপর লোকটা রাইটার্সের পিছনের লায়ন্স রেঞ্জ হয়ে এসে বসল সেন্ট এন্দ্রুজ চার্চের গেটের সামনে ফুটপাথের এক পাশে। বিশ্বাস বাবু দেখে আরও অবাক হলেন যে সেই বৃদ্ধ মানুষটা ওঁর কাঁধের ঝোলা থেকে একটা চট বের করে পেতে তার উপর একটা এলুমিনিয়ামের ছোট বাটি রাখলেন ও ভিক্ষা করতে শুরু করলেন। বোঝাই গেল যে লোকটা রোজ এখানে এসে সারাদিন বসে থেকে শুধু ভিক্ষাই করেন। মনে হল এটা যেন ওঁর অনেকদিনের পেশা।
বিশ্বাস বাবুর তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। এটা উনি কী দেখছেন ? কোটি পতি মানুষ চঞ্চল সমাদ্দার ডালহৌসি পাড়ায় এসে বসে ছদ্মবেশে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন ! কিন্তু কেন, কেন উনি রোজ এসে এখানে বসে ভিক্ষা করেন, ওনার এতো টাকা এতো সম্পত্তি তাহলে এলো কোত্থেকে ? আচ্ছা ওঁর এই ভূমিকার পিছনে অন্য কন উদ্দেশ্য নেই তো ? বিশ্বাস বাবু দেখলেন এই জায়গাটায় আর কোন ভিখারি নেই আশেপাশে। অথচ পথ দিয়ে যেতে যেতে প্রায় সবাই একবার চার্চের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকাচ্ছে আর ভিখারি বেশি সমাদ্দারের বাটিতে কেউ খুচরো টাকা বা কেউ ছোট বড় নোট দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস বাবুর অফিস কাছেই। অনেকক্ষণ দুর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করে উনি চলে গেলেন অফিসে। মনে মনে জমে উঠল অনেক প্রশ্ন অনেক চিন্তার পাহাড়।
চঞ্চল সমাদ্দারের বয়স এখন পঞ্চান্ন চলছে। ওঁর আসল বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার বার শুল গ্রামে। বাবা সুবল সমাদ্দার ছিলেন প্রচুর জমিজমার মালিক। শক্তিগড়ে ওদের চারখানা ধান কল ছিল একসময়ে। কিন্তু সুবল সমাদ্দার ঘরে সুন্দরী স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র চঞ্চল থাকতেও সুরা ও স্ত্রীলোকের পিছনে জলের মত পয়সা উড়িয়ে সেই ধান কলগুলি খুইয়ে বসেন। বাকি থাকে শুধু প্রায় একশ একর ধানি জমি ও বিশাল বড় প্রাসাদোপম বাড়িখানা। চঞ্চল যখন স্কুল ফাইনাল পাশ করে হাইস্কুলে ওঠে তখনই চূড়ান্ত মদ্য পানের পরিণামে লিভার খারাপ হয়ে যাওয়ায় চঞ্চলের বাবা সুবল সমাদ্দার গত হন।
বাবা মারা যাবার পর চঞ্চলের মা গীতা দেবী ওদের সমস্ত জমি জায়গা বেঁচে দেবার পরিকল্পনা করেন। গীতা দেবীর ভাই গোবিন্দ বসাক এই ব্যাপারে ওঁকে সাহায্য করেন। গোবিন্দ বসাক থাকেন কলকাতার সোনারপুরে, পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। বিধবা বোনের সম্পত্তি বিক্রি করার কাজে নিজেও বেশ মুনাফা করে নেন ও বোনকে ডোভার লেনে একটা বড় ফ্ল্যাট কিনে দিয়ে নিজে সোনারপুরে একটা পুরানো বাড়ি কিনে ফেলেন। বাকি টাকার সবটাই বোনের নামেই ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিলেন ভদ্রলোক। আর তাতেই ওদের খরচাপাতি চলতে থাকে ও চঞ্চল কলকাতায় এসে পড়াশুনা চালাতে থাকে। বিধবা মা কোনমতেই ওর লেখা পড়াটা বন্ধ হতে দেন নি।
চঞ্চল সমাদ্দার পড়াশুনায় অত্যন্ত ভাল। যাদব পুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। কিন্তু পড়া শুনা ছাড়াও ওঁর সবচেয়ে বেশি নেশা ছিল ইংরাজি নভেল পড়া আর দেশ বিদেশের সিনেমা দেখা। কলেজ জীবনে ওঁর বন্ধুদের সাথে লাইট হাউসে চঞ্চল একটা বিখ্যাত বিদেশি সিনেমায় দেখতে পান যে নায়ক ছদ্মবেশে লন্ডনের রাস্তায় ভিক্ষা করে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে বিশাল বড় হোটেলের মালিক ও দুখানা শপিং মলের মালিক বনে গেছে। সেই থেকেই চঞ্চল স্বপ্ন দেখত একদিন সেই বিদেশি সিনেমার নায়কের মত ও নিজেও শুধু ভিক্ষাবৃত্তি করে অনেক অনেক টাকা কামাবে। আর ভারতের মত দেশে যেখানে ভিক্ষা করা আইনত অপরাধ নয়, সেখানে কে ওকে আটকাবে।
ব্যাস, এখান থেকেই ওঁর এই ছদ্মবেশ ধরা ও সেন্ট এন্দ্রুজ চার্চের সামনে বসে ভিক্ষা করা শুরু। একটা দল বানিয়ে সেই ছোট ছোট ছেলেদেরও চিরিদিকে ছড়িয়ে দেয় রোজকার কমিশনের বিনিময়ে। চঞ্চল দেখল ইতিমধ্যে কলকাতায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা জাঁকিয়ে বসেছে। বুদ্ধিমান ছেলে, বাঙ্কের টাকা তুলে খোঁজ খবর নিয়ে ঢাকুরিয়া অঞ্চলে দুখানা বেশ বড় পুরানো বাড়ি জমি জায়গা সহ কিনে ফেলল চঞ্চল।
ব্যাঙ্কের টাকা ভেঙ্গে গড়ে তুলল ওঁর স্বপ্নের দুখানা এস্টেট 'ইমন' ও 'কল্যাণ'। আসলে ইমন হল চঞ্চলের মেয়ের নাম ও কল্যাণ হল ওঁর ছেলে। ইমন এখন পড়ছে এম এস সি ফাইনাল ইয়ার , কল্যাণ পড়ছে যাদবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে 'ইমন' ও 'কল্যাণ' এস্টেট হয়ে ওঠে দক্ষিণ কলকাতায় সবচেয়ে অভিজাত লোকদের ঠিকানা। সমাজে চঞ্চল সমাদ্দার হয়ে উঠলেন একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। যদিও সপ্তাহের সাতদিন সকাল আটটায় বেরিয়ে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফেরা চঞ্চল সমাদ্দার আসলে নিজে কী করেন, কোথায় যান সেটা কেউই জানতে পারল না।
প্রদীপ বিশ্বাস এরপর একদিন সন্ধ্যা বেলা এসে দুর থেকে লক্ষ করতে থাকেন এই ভিখারি বেশি চঞ্চল সমাদ্দার কী করেন দেখবার জন্য। ঠিক যেরকম ভেবেছিলেন তাই হল। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ পায়ে হেঁটে উল্টো পথের এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল বৃদ্ধ লোকটা এবং চঞ্চল সমাদ্দারের গাড়ি আসতেই উঠে পড়ল গাড়িতে। গাড়ি ছুটে চলল বালিগঞ্জের দিকে। বিশ্বাস বাবু বুঝলেন ওঁর সন্দেহই ঠিক।
রবিবার অফিসের একটা জরুরি কাজে বিশ্বাস বাবুকে আসতে হল ডালহাউসি পাড়ায়। সেন্ট এন্দ্রুজ চার্চের গেটের সামনে বৃদ্ধ বেশি চঞ্চল সমাদ্দার বসে। রবিবার বলেই হয়ত একটু দুরেই আরও একজন বয়স্কা মহিলা বসে ভিক্ষা করছেন দেখা গেল। বিশ্বাস বাবুর কৌতূহল হওয়ায় অফিস ফেরত গাড়িটা ড্রাইভারকে বলে এক নির্দিষ্ট জায়গায় পারকিং করতে বলে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন সেই বয়স্কা মহিলার সামনে। বেলা তখন দুটো বাজে। চার্চে লোকজন যাতায়াত করছে। অনেকেই এগিয়ে এসে সেই মহিলাকে টাকাপয়সা দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চঞ্চল সমাদ্দারের বাটিতেও পড়ছে টাকা ও কয়েন।
ভিখারিনী মহিলা মুখ তুলে প্রদীপ বিশ্বাসকে একবার দেখে আবার অন্য লোকের দিকে তাকিয়ে হাত পেতে থাকে। প্রদীপ বিশ্বাস ওঁর বাটিতে একটা একশ টাকার নোট দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মহিলা অবাক হয়ে মুখ তুলে প্রদীপ বাবুর দিকে তাকান ও হাত তুলে ওকে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু তাও লোকটা যাচ্ছেনা দেখে এবার জিজ্ঞাসা করেন 'তুমি কি কিছু বলবে বাবা ?' প্রদীপ বিশ্বাস একবার আড় চোখে সমাদ্দারকে দেখে নিয়ে ঝুঁকে বসে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, 'আচ্ছা, ওই ল্যাংরা দাঁড়িওয়ালা লোকাটা এখানে কতদিন যাবত ভিক্ষা করছে জানেন আপনি ? ওঁর নাম কী, কোথায় বাড়ি ওঁর ?'
ভিখারিনী মহিলা একবার সমাদ্দারকে দেখে নিয়ে নিচু গলায় জবাব দিল,'ওঁর নাম বলাই। আজ প্রায় দশ বছর হল লোকটা এখানে এসে বসে ভিক্ষা করছে। আগে আমি একাই ছিলাম। আর ও আসবার পর আমার ভিক্ষা কমে যাওয়ায় আমি এখন শুধু রবিবারই এসে বসি। বাকি দিনগুলি শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে বসে ভিক্ষা করি বাবা। কেন কিছু হয়েছে নাকি ? লোকটা কী কিছু করেছে ?'
প্রদীপ বিশ্বাস বুঝতে পারে যে সমাদ্দার নাম ভাঁড়িয়ে এখানে ভিক্ষাবৃত্তি করছে। মুখে শুষ্ক হাসি ফুটিয়ে বলে,'না না। কিছু করেনি। এমনি খোঁজ নিচ্ছিলাম।' বলেই তাকিয়ে দেখে সমাদ্দার ওঁর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রদীপ বিশ্বাস মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে হাঁটা লাগায়। ভিখারিনী মহিলা কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রদীপের গমন পথের দিকে।
পরদিন বেলা নয়টায় আরেক জন অফিসারকে সাথে নিয়ে প্রদীপ বিশ্বাস এসে হাজির হলেন ডোভার লেনে চঞ্চল সমাদ্দারের বাড়ি সে বাড়ি থেকে বের হবার আগেই। সমাদ্দার হাসি মুখে স্বাগত জানিয়ে ওদের বসালেন ওঁর সুসজ্জিত বৈঠক খানায়। সমাদ্দারের মুখে কোন দাঁড়ি গোঁফ ছিলনা তখন। অতিথিদের জন্য দামী প্লেটে চা বিস্কুট চলে আসবার পর ভদ্রবেশী সমাদ্দার সমাগত অতিথিদের জিজ্ঞাসা করলেন,' বলুন মিস্টার বিশ্বাস, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি ?' যদিও কার্ডে এরা দুজনেই আই বি অফিসার জেনে চঞ্চল সমাদ্দার একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এটা যে কোন সৌজন্য মূলক সাক্ষাৎ নয়, সেটা বুঝতে ওঁর বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
প্রদীপ বিশ্বাস চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখে সমাদ্দারের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন,'আপনি ছদ্মবেশে ল্যাংরা সেজে বলাই নাম নিয়ে ওই চার্চের গেটে বসে রোজ ভিক্ষা করেন কেন মিস্টার সমাদ্দার ? আপনার এতো বড় দুখানা এস্টেট, এতো টাকার মালিক আপনি। তবুও এভাবে ভিক্ষা করে রোজগার করবার কোন কারো আছে কী চঞ্চল বাবু ?'
চঞ্চল সমাদ্দার জানত যে কোন না কোন একদিন কেউ ওকে এই প্রশ্ন করতেই পারে। তার উপর কালই এই প্রদীপ বিশ্বাস লোকটা ওঁর ব্যাপারে চার্চের গেটে গিয়ে খোঁজ খবর করছিল উনি দেখতে পেয়েছেন। কোনরকম উত্তেজনার মধ্যে না গিয়ে চঞ্চল সমাদ্দার জবাব দিলেন,'কেন মিস্টার বিশ্বাস ? আমাদের দেশে ভিক্ষা করা তো বে আইনি নয় ? আমি যদি ভিক্ষা করে রোজগার করি তাতে কারো কোন ক্ষতি হবার তো কথা নয়। যার যা ইচ্ছা তাই দেয়। আমি তো কাউকে জোরাজোরি করি না।'
প্রদীপ বিশ্বাস একটু থতমত খেয়ে গেলেন। চঞ্চল সমাদ্দার যে এই ব্যাপারটাতে কোন রকম ভাবে না ঘাবড়ে এতো সোজাসুজি জবাব দেবেন উনি ভাবতেও পারেন নি। সত্যি তো, ভিক্ষা বৃত্তি এখনো এদেশে বে আইনি হয় নি। তবে কেন চঞ্চল সমাদ্দার ভিক্ষা করতে পারবে না ? তবুও প্রদীপ বিশ্বাস পিছিয়ে পড়লেন না। আবার জিজ্ঞাসা করলেন,'কিন্তু আপনার তো বেশ ভালো একটা রোজগার আছে। তবুও আপনি ভিক্ষা করছেন কেন সেটাই আমার জানার ছিল। আর এই ভিক্ষা করে আপনি কত টাকাই বা রোজগার করেন মিস্টার সমাদ্দার ?'
চঞ্চল সমাদ্দারের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চায়ের ক্যাপটা নামিয়ে রেখে বলেন,'আরে মশাই, আমি শুধু ভিক্ষা করেই বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা রোজগার করি। আমি হলাম গিয়ে কলকাতার ফাইভ স্টার ভিখারি। আপনি একটু ভালো করে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। নিন নিন, চা টা শেষ করুন। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।' বলেই সমাদ্দার আবার হাসতে থাকে। যেন ব্যাপারটাতে ওঁর বেশ মজা লাগছে।
প্রদীপ বিশ্বাস এই ছদ্মবেশী ভিখারির রোজগার শুনে অবাক হয়ে ওঁর সহকর্মীর দিকে তাকালেন। এটা যে ওদের দুজনের মোট রোজগারের চেয়েও বেশি সেটা ভেবেই এরা অবাক হয়ে যান। প্রদীপ বিশ্বাস ঢোঁক গিলে মিন মিনে গলায় জিজ্ঞাসা করেন,'আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু আপনি কী তার জন্য যথারীতি ট্যাক্স পেমেন্ট করেন মিস্টার সমাদ্দার ? এটা তো আপনার আদার ইনকামে দেখাতে হবে তাই না ?'
'দেখাই নি কে বলল আপনাকে ?' চঞ্চল সমাদ্দারের গলার স্বর কঠিন হয়ে ওঠে। একটু থেমে আবার বলে,'আপনি আরও একটু হোম ওয়ার্ক করে এলে ভালো করতেন মিস্টার বিশ্বাস। আমার আই টির রিটার্ন ভালো করে চেক করুন গিয়ে।' কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ান চঞ্চল। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠেন, 'নিন চলুন। এবার কিন্তু আমাকে বের হতে হবে। আশা করি চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে ?'
লজ্জায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিলেন প্রদীপ বিশ্বাস। চঞ্চল সমাদ্দার যে কাউকে কোন কথা বলবার সুযোগ রাখেননি সেটা দেখে অবাক হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, 'আপনি কিছু মনে করবেন না মিস্টার সমাদ্দার। আমার জীবনে এরকম একজন সৎ মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। কিন্তু আপনার কথা শুনে আর আপনার এই সখের রোজগারের উপায় দেখে সত্যি আমি অবাক হয়ে গেছি। আমি ভুল সন্দেহ করেছিলাম। কিছু মনে করবেন না।'
সমাদ্দার একটু নরম হয়ে বলেন,'আসলে এটা আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল। বহু বছর আগে একটা ইংরাজী সিনেমা দেখে এই সখটা তৈরি হয়। তারপর থেকে এটাই একটা নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউই এটার খবর রাখে না। আপনাদের অনুরোধ করব ব্যাপারটা আমার পরিবারের সন্মানের স্বার্থে দয়া করে পাবলিক করে দেবেন না। চলুন, আপনারা এগোন। আমাকে আবার ডালহৌসি যেতে হবে ভিক্ষা করতে।'
প্রদীপ বিশ্বাস এবং ওঁর সঙ্গী অফিসার চঞ্চল সমাদ্দারের সাথে হাত মিলিয়ে পথে নেমে এলেন। প্রদীপ বিশ্বাসের চোখের সামনে ভেসে এলো সেই দৃশ্যটা যে এখন এই ধনী ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ভিখারির ছদ্মবেশে এয়ার কন্ডিশন গাড়ি চড়ে গিয়ে ডালহৌসিতে এন্দ্রুজ চার্চের গেটে চট পেতে বসবে সামনে বাটি সাজিয়ে আর হাত পেতে ভিক্ষা করবেন সারাদিন। সত্যি, পৃথিবীতে কতরকম আশ্চর্য মানুষ আছে, আমরা তার কতটুকু খবর রাখি। ভাবলেন অন্য কারো কোন ক্ষতি না করে যদি নেশায় পড়ে ভদ্রলোক ভিক্ষা বৃত্তি করে টাকা রোজগার করেন, যথারীতি সরকারকে ট্যাক্সও দেন তাহলে সরকারেরই বা কী আর ওনারই বা কী ? এটা তো কোন মারাত্মক বা বেআইনি নেশা নয় আর চুরি চামারিও নয়। চঞ্চল সমাদ্দারের প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ওঁর ভরে উঠল। ভগবান ওর মঙ্গল করুন।
--------শেষ--------
ব্যাঙ্গালোর।